সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
১৯৪৬ থেকে যাত্রা শুরু হয় আজকের সঙ্ঘশ্রীর। প্রথমে রাধা স্টুডিও থেকে সিনেমার সেট ভাড়া করে, আর পটের ঠাকুর এনে। পরে প্রতিমার পিছনে বিভিন্ন দৃশ্য এঁকে মণ্ডপ সাজাতেন কিংবদন্তি শিল্পী কালিদাস দাস। প্রতিমায় রূপদান করতেন মৃত্শিল্পী জিতেন পাল। পাঁচের দশক থিমপুজোর ইতিহাসে প্রথম মাইলস্টোন। ১৯৫৬ সালে কালীঘাট মুক্তদলে লোহার ফ্রেম দিয়ে মণ্ডপ ও আলোর খেলা দেখান শিবপুর বি ই কলেজের ছাত্র হীরেন চৌধুরী। ১৯৫৯ সালে উত্তর কলকাতার জগত্ মুখার্জি পার্কে সেই প্রথম ‘আর্টের ঠাকুর’ গড়লেন অবিনাশ কবিরাজ বাড়ির ছেলে অশোক গুপ্ত। দেবী দুর্গার ফর্ম ভেঙে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন। কিন্তু থামেননি। অস্ত্রবিহীন দুর্গা, নানা রঙের ব্যবহার—একবার তো থার্মোকলের প্রতিমাও বানিয়েছিলেন রাজবল্লভ পাড়ায়। ১৯৭৫ সালে বিখ্যাত চিত্রকর নীরদ মজুমদারের হাতের ছোঁয়ায় ভবানীপুর বকুলবাগানে প্রাণ পেল আর্টের ঠাকুর। থিমের প্রতিমার সঙ্গে সেই থেকে জড়িয়ে গেল শিল্পীদের নাম।
আমার কিন্তু আর্টের প্রথাগত কোনও শিক্ষাই নেই। এত কিছু জানতাম না। কিন্তু ওই প্রাণের আনন্দ কোথাও লুকিয়ে ছিলই। ছয়ের দশক থেকে কলকাতায় প্রতিমা শিল্পীদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন শিল্পী রমেশচন্দ্র পাল। ঘটনাচক্রে আমার দেখা প্রথম প্রতিমা তাঁরই হাতে গড়া। তখন পুজো মানে সাবেকি ব্যাপার। আমার জন্ম পার্ক সার্কাসে। বাবা পার্ক সার্কাস ময়দানের বিখ্যাত দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানে প্রতিমা গড়তেন রমেশ পাল। ছোটবেলায় এত বুঝতাম না। কিন্তু এটুকু দেখেছি, রমেশ পালের তৈরি মা দুগ্গার মুখ আর পাঁচটা প্রতিমার মতো নয়। মোহনবাঁশি রুদ্র পাল এর বেশ খানিকটা পরে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু দু’জনের প্রতিমায় রঙের বিষয়টি মুগ্ধ করত। তবে সাবেকি ধরনের। আমাকে বেশি টানত অলোক সেনের প্রতিমা। ওঁর ঠাকুরটা যেন একটু অন্য ধরনের। ভাবনার ছাপ থাকতো। মহম্মদ আলি পার্কের প্রতিমা গড়তেন তিনি। কলেজ স্ট্রিটে আমার মেজদির বাড়ি। ওই টানেই চলে যেতাম। মেজদির বাড়িতেও দুর্গাপুজো হয়। কিন্তু আমার ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল, দুপুরে ফাঁকায় ফাঁকায় গিয়ে মহম্মদ আলি পার্কের ঠাকুরটা দেখব। মোহনবাঁশির কাজও সুন্দর। সাবেকি। কী সুন্দর প্যাঁচা। কিন্তু আমার দেখার বেশি আগ্রহ কিন্তু অলোক সেনের ঠাকুর।
১৯৮০ সালে আমরা পিকনিক গার্ডেনে চলে আসি। সুনীলনগর তখন কলোনি। তখন পুজো হতো দুর্গামণ্ডপে। পাশেই রাধাগোবিন্দর মন্দির। বাজার বসত। ছোটবেলায় বড়দাকে দেখে দেখে আঁকা, মণ্ডপ বানানো, ঠাকুর গড়ায় ঝোঁক ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই তাগিদও বাড়ে। আমি সুনীলনগর সর্বজনীনের কাজ শুরু করি ১৯৮৮ সালে। টানা ন’বছর। তখন একটা অ্যাড এজেন্সিতে ট্রেনি হিসেবে কাজ করতাম। ততদিনে এশিয়ান পেন্টস শারদ সম্মান দেওয়া শুরু হয়েছে। আদি বালিগঞ্জ তখন কলকাতার অন্যতম সেরা পুজো। শিল্পী রণবীর ধর করতেন। ম্যাডক্স স্কোয়ার, কলেজ স্কোয়ার তো বিখ্যাতই। ১৯৯২ সালে এশিয়ান পেন্টস পেয়েছিলাম পাটের বিনুনি দিয়ে জলসাঘরের মতো মণ্ডপ করে। ১৯৯৫ সালে শারদসম্মান পেলাম গ্রামবাংলার পটচিত্র বানিয়ে। আড়াই মাস ধরে পটুয়াদের রেখে পুরো মণ্ডপজুড়ে কাজ। তখন পুরো মণ্ডপে পটের ব্যবহার খুবই কম। থিমপুজোর বাজার ক্রমশ তৈরি হচ্ছে। ১৯৯৬ পর্যন্ত আমি সুনীলনগরে কাজ করেছি। পরে ২০০৫ সালেও করি। একই সময়ে কাজ করছে মণ্ডপশিল্পী সুতনু মাইতি। আহিরীটোলা, কুমারটুলি পার্কের পুজো ওই করত। ১৯৯৭’তে সুতনুর চালতাবাগান, আহিরীটোলা পুরস্কার পায়। তারও পরে শিল্পী অমর সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আসে ভবতোষ সুতার।
১৯৯৮ সালে বোসপুকুর শীতলামন্দিরে আমার থিম ছিল ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’। তারপর ২০০০ সালে ওখানেই করলাম তাসের ঘর। তার আগে থিম যাই হোক, চট, প্লাই বা কাপড়ের প্যান্ডেল হতো। তার উপরে কিছু জায়গায় কারুকাজ থাকত। তাসের ঘরের আগে শুধু একটি মেটেরিয়াল দিয়ে শুরু থেকে শেষ পুরোটা কেউই করেনি। মণ্ডপের পুরোটাই শুধু তাস। একই প্রয়োগ ছিল পরের বছরেও। ভাঁড়ের মণ্ডপ!
আজও মানুষ যা ভোলেনি। মাটি দিয়ে পুরোটা করতে চেয়েছিলাম। থিম পরে এল। চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে দেখছিলাম, ঝুড়িতে মালার মতো সাজিয়ে ভাঁড় আসছিল। দেখে খুব ভালো লাগল। বুঝলাম, এই ভাঁড়টাকে যত ছোট করব, মালাটাও তত ছোট হতে থাকবে। সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় কাজ। প্রথমে থিম ব্যাপারটা ছিল না। পরবর্তীতে থিম করেছিলাম, চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দির। উমা শান্তির দূত। পুরোটা মাটি বলে মণ্ডপজুড়ে গৈরিক রং। ভাঁড়ে রং ছিল না। সেবার ঠাকুর করেছিল সনাতন রুদ্র পাল। চালচিত্রেও ভাঁড়ের ব্যবহার ছিল। সাজেও একই এফেক্ট এনেছিলাম। বাকিটা ইতিহাস!
তখন অমরদা অজেয় সংহতিতে মাটির কাজ করেছিল। প্রচার ছিল না। তা সত্ত্বেও মানুষের ভিড় উপচে পড়েছিল। প্রত্যেকের কাজই ভালো লাগত। কাজ তো শেখার। পূর্ণেন্দু দে শিবমন্দিরে করেছিল, আশ্রমের মতো। প্রতিযোগিতা সব আমলেই ছিল। আমাদের সময় আমরা প্রতিমা শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করতাম। আমার সবথেকে বেশি থিমের ঠাকুর গড়েছে শিল্পী পরিমল পাল। এখন তো মেটেরিয়াল থিমের কাজ কমেছে। কিন্তু গৌরাঙ্গ কুইল্যা এই ব্যাপারে এখনও সচেতন। ভবতোষ লেকটাউন প্রদীপ সঙ্ঘে শব্দের উপরে কাজ করেছিল। ঢুকে বেরতে ইচ্ছা করছিল না। সনাতন দিন্দাও তো আমাদের সময়েই কাজ শুরু করেছিল।
তখন এত উন্মাদনা, কভারেজ ছিল না। কত কাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের তো প্রথমে প্যান্ডেলওয়ালা বলত। সেখান থেকে থিমপুজো। ২০১৭ সালে বড়িশা সর্বজনীনে ‘শূন্যতে শুরু, শূন্যতে শেষ’ করেছিলাম। মন থেকে ভালো লেগেছিল। পরের তিন বছর কাজ নেই। তাই আক্ষেপ তো আছেই। ফিরে আসার মঞ্চ পেলে প্রমাণ করব, বন্দন রাহা এখনও ফুরোয়নি।