সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
প্রথম সম্ভাষণটিই প্রবাদে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ বাদুড়বাগানের ঈশ্বরকে বলছেন, ‘আজ যে আমি সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি আজ আমি সাগর দেখছি।’ তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তর, ‘তবে নোনাজল খানিকটা নিয়ে যান।’ যেন খশ্ করে বারুদ মাখানো একটি কাঠির জ্বলে ওঠা।
মধুর শ্রীরামকৃষ্ণের শান্ত উত্তর, ‘না গো! নোনাজল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর! তুমি ক্ষীর সমুদ্র।’
এই দৃশ্য, এই কথা ‘কালের’ ফিতেতে চিরকালের জন্যে ধরা থাকল। বাষট্টি বছরের বন্ধুর পথ পেরিয়ে বিদ্যাসাগর এই সঙ্গমে এসেছেন, আর শ্রীরামকৃষ্ণ অতিক্রম করেছেন ছেচল্লিশ বছরের জীবন পথ। দুই কল্পতরু মুখোমুখি। একজন দয়ার, আর একজন ধর্মের। শাস্ত্র বলছেন, দয়া, মানব প্রেম, শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ধর্ম আর কর্ম একটি কাঙ্ক্ষিত সমাহার। শ্রীরামকৃষ্ণ এক দর্পণ; বিদ্যাসাগরের সামনে তুলে ধরে যেন বলতে চাইছেন, এতকাল অপরকে দেখলে, এইবার নিজেকে দেখার সময় হয়েছে। তুমি পণ্ডিত, তুমি বিদ্যার সাগর। অনেক পড়েছ, কিন্তু অন্তরে কি আছে দেখনি। ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়ে আনন্দ পাও। অন্যের দুঃখে তোমার প্রাণ কাঁদে। আমি সব জানি। এই মাস্টার আমাকে সব বলেছে। প্রথম, তোমার বিদ্যানুরাগ। মাস্টারের (শ্রীম) কাছে চোখের জলে বলেছিলে, ‘আমার তো খুব ইচ্ছা ছিল, পড়াশোনা করি, কিন্তু কই তা হল। সংসারে পড়ে কিছুই সময় পেলাম না।’ দ্বিতীয়, তোমার সর্বজীবে দয়া। তুমি তো শুধু বিদ্যার সাগর নও, দয়ারও সাগর। বাছুরেরা মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয় বলে তুমি দুধ খাওয়া বন্ধ করেছিলে।
ঘোড়া নিজের কষ্ট বলতে পারে না, তাই তুমি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ো না! একদিন তুমি এক ঝাঁকা-মুটেঅলাকে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছিলে। একপাশে পড়ে আছে তাঁর ঝাঁকা। সেই মৃত্যুপথ যাত্রী অসহায় মানুষটিকে কোলে করে বাড়িতে তুলে এনে তুমি চিকিৎসা করেছিলে।
তৃতীয়, তোমার স্বাধীনতাপ্রিয়তা। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের অমিল হল বলে সংস্কৃত কলেজের প্রধান অধ্যক্ষের পদ সঙ্গে, সঙ্গে ছেড়ে দিলে। তোমার চতুর্থ গুণ, লোকের অপেক্ষায় না থাকা। তুমি এক শিক্ষককে ভীষণ ভালোবাসতে। তাঁর মেয়ের বিয়ের আইবুড়ো ভাতে কাপড় বগলে নিজেই চলে গেলে।
তোমার পঞ্চম গুণ, তোমার মাতৃভক্তি আর মনোবল। মা বলেছিলেন, ঈশ্বর! তুমি যদি তোমার ভাইয়ের বিয়েতে না আসো, তাহলে আমার মন ভীষণ খারাপ হবে। তুমি কলকাতা থেকে হাঁটা শুরু করলে। পথ আটকে পড়ে আছে দামোদর। পারাপারের নৌকো নেই। সাঁতরে নদী পার হলে। বিয়ের রাতেই ভিজে কাপড়ে মায়ের সামনে—এই দেখ মা, আমি ঠিক এসেছি।
এই সব অবিস্মরণীয় ঘটনা ঠাকুর যত ভাবছেন,ততই ভাবাবিষ্ট হচ্ছেন। বিদ্যাসাগর বসে আছেন চেয়ারে। সামনে টেবিল। বিপরীত দিকের বেঞ্চে বসেছেন ঠাকুর। একেবারে মুখোমুখি। বিদ্যাসাগরের পরিধানে থান কাপড়, হাতকাটা ফ্লানেলের জামা, পায়ে তাঁর সেই বিখ্যাত চটি জুতো (বিদ্যাসাগরী চটি)। মাথার চারপাশ উড়িষ্যাবাসীদের মতো কামানো। বাঁধানো দাঁত, যখন কথা বলেন, দেখা যায় ঝকঝকে উজ্জ্বল। মাথা দেহের তুলনায় বেশ বড়। প্রশস্ত উন্নত ললাট। সামান্য খর্বাকৃতি। পৈতাটি গলার কাছে দৃশ্যমান। টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে কাগজ, কলম, দোয়াত, ব্লটিং পেপার। রয়েছে অজস্র চিঠি, হিসাবপত্রের বাঁধানো খাতা। চিঠিগুলি কিছু দিতে চায় না, কেবল পেতে চায়। সুখের কথা কিছু নেই, শুধু দুঃখের কথা— লম্বা লম্বা ফিরিস্তি। অক্ষরের আর্তনাদ, ‘আমি এক অনাথ বিধবা, আমার অপোগণ্ড শিশুটিকে দেখার কেউ নেই, আপনিই ভরসা।’ ‘আপনি বায়ু পরিবর্তনে গিয়েছিলেন, যথাসময়ে আমরা আমাদের মাসোহারা পাইনি, বড় কষ্টে আছি।’ ‘আপনার স্কুলে ফ্রি ভর্তি হয়েছি, কিন্তু আমার বই কেনবার ক্ষমতা নেই।’ ‘পরিবারবর্গ অনাহারে। আমাকে একটা চাকরি।’ ‘আমি আপনার স্কুলের শিক্ষক, আমার ভগিনী বিধবা হয়েছে। তার সমস্ত ভার আমাকে নিতে হয়েছে। মাইনে না বাড়ালে চালাতে পারছি না।’ ইংরিজি পত্রও আছে, করুণ গাথায় ভরা, My dear Vid, you are the greatest Bengali that ever lived and people speak of you with glowing hearts and tearful eyes, and even my worst enemies dare not say that I am a bad fellow! Behold and help again one who loves you and has no friend who seems to care for him except yourself... I appeal to Issur Chandra Vidyasagar my friend and let him act as Issur Chandra Vidyasagar ought to act... Michael M.S. Dutt
[প্রিয় ভিদ (বিদ্যাসাগর), মহত্ত্বম বাঙালি আপনি, বিরলতম। উদ্দীপিত অন্তরে অশ্রুভরানয়নে মানুষ আপনার জয় গাহে। আমার ভয়ঙ্কর শত্রুরা আমাকে জঘন্য ব্যক্তি বলার সাহস হয়তো পাবে না। আমি আবার আপনার সাহায্যপ্রার্থী; আপনি ছাড়া আর কে আছে আমার! ঈশ্বরচন্দ্র, বন্ধু আমার! আমার সঙ্গে ঈশ্বরের মতোই ব্যবহার করবেন, এই আমার প্রার্থনা—মধুসূদন!] বিদ্যাসাগর যার রক্ষাকর্তা, সে দেনার দায়ে জেলে যাবে! সপরিবারে বিদেশে অনাহারে মরবে! কোনও চিঠিতে নিবেদন, ‘সালিশির দিন নির্ধারিত। আপনি সেদিন এসে আমাদের বিবাদ মিটিয়ে দেবেন।’
শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের অতল থেকে রত্নরাজি একে একে তুলে এনে তাঁর সামনে ধরছেন; কারণ এইটিই তাঁর এবারের দায়িত্ব। এই কারণেই তাঁর পৃথিবীতে আসা। দপ্তর খুলেছেন দক্ষিণেশ্বরে। নোটিস (তিনি মজা করে বলতেন লুটিস) ঝুলিয়েছেন, ‘হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ’। হাজার কাজে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন বিদ্যাসাগর। নিজের সাগরে নিজেরই ভরাডুবি। অদ্ভুত একরোখা চরিত্র। মোটা মোটা হিসেবের খাতা, কিন্তু আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এক ‘হিসাবী-বেহিসাবী’। অন্যের বিপদে সাহায্য করবেন, করবেনই করবেন। ধার করে করবেন। যাদের জন্যে করবেন, তারাই আবার আশ্রয় নেবে নিন্দুকদের দলে।
দুশো বছর পরেও মানুষ কেন মনে রাখবে তাঁকে! বিস্মৃতিপরায়ণ জটিল সৃষ্টি মণ্ডলে, যেখানে সূর্য অস্তাচলে গেলে ভোরের কথা মনে থাকে না। তামসিক নিদ্রা এসে চেতনাকে গ্রাস করে। শ্রীরামকৃষ্ণ নশ্বর বিদ্যাসাগরে অমরত্বের উপাদান খুঁজছেন। ‘বিদ্যাসাগর’ একটি উপাধি। বিদ্যার সাগর। মহা পণ্ডিত। সমসময়ে আরও কয়েকজন ‘বিদ্যাসাগর’ রয়েছেন। বিশেষ একটি সম্মান, কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে সম্মানকেই সম্মানিত করেছেন প্রাপক। খেতাব হয়েছে ধন্য।
ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে বিদ্যাসাগর চেনাচ্ছেন—‘এই দেখো, একে একে দেখো—তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম; সত্ত্বের রজঃ। সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়। দয়ার জন্যে যে কর্ম করা যায়, সে রাজসিক কর্ম বটে—কিন্তু এ রজোগুণ সত্ত্বের রজোগুণ, এতে দোষ নেই। শুকদেবাদি লোকশিক্ষার জন্যে দয়া রেখেছিলেন— ঈশ্বর-বিষয় শিক্ষা দেবার জন্যে। তুমি বিদ্যাদান, অন্নদান করছ, এও ভালো। নিষ্কাম করতে পারলেই এতেও ভগবান লাভ হয়। কেউ করে নামের জন্যে, পুণ্যের জন্যে, তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তো তুমি আছই।’
বিদ্যাসাগর—কেমন করে?
ঠাকুর [হাসতে, হাসতে]—আলু, পটল সেদ্ধ হলে তো নরম হয়, তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া!
বিদ্যাসাগর [হাসতে, হাসতে]—কলাইবাটা সেদ্ধ তো শক্তই হয়।
ঠাকুর [বড় স্নেহ মাখা গলায়]—তুমি তো তা নয় গো! শুধু পণ্ডিতগুলো দরকচা পড়া। দয়া, ভক্তি, বৈরাগ্য, বিদ্যার ঐশ্বর্য।’
শৈশব থেকেই বাস্তব জীবনের পরীক্ষা ক্রমশই কঠিন থেকে কঠিনতম হয়েছে। চলার পথের দু’ধারে ধনীদের জীবনের তামাশা আর সর্বহারাদের সংগ্রাম দেখেছেন। প্রকৃত ধর্মকে আড়ালে রেখে ধর্ম ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য দেখেছেন। তাঁকে বলা যেতে পারে—একটা উর্বর সময়ের সোনার ফসল। অতি উত্তম একটি বীজ থেকে উপ্ত ঋজু একটি বৃক্ষ। বৃদ্ধিই যার ধর্ম। শিকড় ভূমিকে বিস্মৃত হয়নি। বিকাশের অহঙ্কারে পত্রশূন্য হওয়ার আশঙ্কাও ছিল না। পাতার আকারে ঝরেছে করুণা। কথায় কথায় তাঁর চোখে জল আসত। সে নিজের দুঃখে নয়, অন্যের দুঃখে। তাঁর জীবন বহুরকমের কাণ্ডে গাঁথা একটি মূল্যবান মালা।
সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল তখন। না আছে চোগা চাপকান, দামি জুতো, পাগড়ি, বুক পকেটে চেন লাগানো ঘড়ি। হেঁটে কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়ি বীরসিংহে যাওয়া আসা করেন। এমন হাঁটা অন্য কোন মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। অনেক ঘটনার একটি—সেবার তিনি বীরসিংহ থেকে কলকাতায় ফিরছেন হাঁটা পথে। পথে দেখলেন, একটা মাঠের মধ্যে একজন বৃদ্ধ চাষি মাথায় একগাদা মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়েই আছে। ব্যাপারটা কী। জোয়ান ছেলে বৃদ্ধ পিতার মাথায় বোঝা চাপিয়ে বাড়ি মুখো করে দিয়েছে, যেন ‘হ্যাট গরু হ্যাট।’
ছেলের কাণ্ড আর পিতার দুর্গতি। ঈশ্বরচন্দ্রের দু’টি চোখ জলে ভরে গেল। বৃদ্ধের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নিলেন। বৃদ্ধের বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় দু-তিন ক্রোশ দূরে। মালপত্র সমেত অসহায়, অসমর্থ বৃদ্ধকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বিদ্যাসাগর আবার কলকাতার পথ ধরলেন। চোখের জল তখনো শুকোয়নি। এই হাঁটাপথের বৃত্তান্ত শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের লেখায় পাওয়া যায়, ‘তৎকালে আমরা (১৮৪১-৪৬) কলিকাতা হইতে পদব্রজে বাটী যাইতাম। হাটখোলার ঘাট পার হইয়া শালিখার বাঁধা রাস্তায় মোসাট নামক গ্রাম পর্যন্ত যাইয়া, ঐ বাঁধা রাস্তা ত্যাগ করিয়া মাঠের পথ বরাবর পশ্চিমমুখে রাজবলহাট নামক গ্রামে উপস্থিত হইতাম। তথা হইতে বীরসিংহা ছয় বা সাত ক্রোশ (বারো কি চোদ্দ মাইল)।’ বিদ্যাসগর মহাশয়ের এই অক্লান্ত হাঁটা প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না, জীবনের প্রায় শেষ অবস্থায় বদহজমে আক্রান্ত। চিকিৎসকের পরামর্শ, ‘খুব হাঁটুন।’ বিদ্যাসাগরের প্রশ্ন, ‘কতক্ষণ করে হাঁটব?’ চিকিৎসকের উত্তর, ‘যতক্ষণ না ক্লান্ত বোধ করেন।’ বিদ্যাসাগর হাঁটবেন, উত্তম পরামর্শ, যতক্ষণ না অবসন্ন হয়ে পড়ছেন ততক্ষণ; বিদ্যাসাগর হাসছেন আর বলছেন, ‘তাহলে তো দিনরাত হাঁটতে হয়, কারণ হেঁটে আমি কখনো ক্লান্তি বোধ করি না।’ এই অসম্ভব মানুষটি অন্যের কবিতার একটি লাইন ধার করে, একটু পরিবর্তন করে বলতে পারেন, সে অধিকার তাঁর আছে, ‘হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিব মানুষের হৃদয়ের পথে।’
একদলা আগুনের মতো ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। কারণ তিনি ছিলেন সত্যাশ্রয়ী। চাটুকারিতা, মোসায়েবি সহ্য করতে পারতেন না। অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি, প্রতিপত্তি তাঁকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। পরাধীনতা তাঁর চিত্তকে গ্রাস করেনি। তাঁর পক্ষেই বলা সাজত—সত্যের জন্যে সব কিছু ছাড়তে প্রস্তুত, কোনও কিছুর জন্যে আমি সত্যকে ছাড়তে প্রস্তুত নই। তৈলপ্রয়োগে জীবন আর জীবিকার পথকে মসৃণ করতে চাই না। আমি ঘৃণা করি ব্রাহ্মণের শরীরে ক্ষত্রিয়ের তেজ। কোনওভাবেই হার না মানা এক যোদ্ধা। তুমুল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁর পথচলা। অর্থাভাব! আমি গ্রাহ্য করি না। শত্রুতা আমার চিরসাথী। মৃত্যুভয়! আমি বহুবার মরতে মরতে না মরে জয় করে বসে আছি। কামানের গোলার সামনে বুক পেতে দিতে পারি। পারি না একটা ব্যাপার সহ্য করতে—নারীর চোখের জল, ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন। মুখবন্ধ খামের মতো এক একটি পরিবার। বেঁচে থাকার সঠিক বার্তাটা কারও পড়ার সুযোগ হল না। বিদ্যাসাগরের একটিই প্রশ্ন—বিপ্লবটা কোথায় হওয়া উচিত ছিল—সিপাহিদের ছাউনিতে? না, পরিবারের আটকাঠ বন্ধ বধ্যভূমিতে! রাজা রামমোহন চিতার আগুন থেকে সতীদের রক্ষা করলেন। বাল্যবিবাহ রোখা গেল না। বাল বিধবারা হয় দুষ্ট ব্যবসায়ীদের ফাঁদে উধাও হল, না হয় চলে গেল কাশী, বৃন্দাবনে পথের ভিখারি হতে। শক্তি সাধকরা গলা ফাটিয়ে কোন মাকে ডাকছেন? পাথরের মা। রক্তমাংসের মা নৈয়ায়িকদের শাস্ত্র-কলে পড়ে যে মাকে ডাকছে ত্রাহি ত্রাহি রবে, সে মা কি মণিকর্ণিকার’ অনির্বাণ চিতার আগুন দগ্ধ না হলে জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশা নেই।
সিদ্ধান্তবাগীশ! আমি বিদ্যাসাগর। ‘বিধবা বিবাহ আমার ‘আইভরি প্রোজেক্ট।’ নতুন জীবন, নতুন সংসারের স্বপ্ন আমি ফেরি করবো—সেই কারণে সর্বস্বান্ত হতেও প্রস্তুত। আমার চলার পথের অন্ধকারে আততায়ীরা ওঁত পেতে আছে, আমি জানি। তবু যে আমি নিরস্ত হব না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমার ভাল লাগলেও, কেশবচন্দ্রের ব্রাহ্ম সমাজ আমার ধাতে সইল না। পরমহংসদেব দক্ষিণেশ্বরে আমাকে আমন্ত্রণ করেছিলেন, আমি কথা দিয়েও কথা রাখিনি। আমি মনে করি পিতা আর মাতাই আমার দেবতা। আলো না জ্বাললে অন্ধকার যে ঘুচবে না! জ্ঞানের আলো, শিক্ষার আলো। পল্লীর ঘরে ঘরে শিশুকণ্ঠে ধ্বনিত হোক জীবনের জয়গান— অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, আ-এ আমটি খাবো পেড়ে। জীবনের মন্ত্র ও ধর্ম একটিই ‘সদা সত্য কথা বলিবে।’ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আপনার সংঘাতপূর্ণ, উত্তাল সাগর-সম জীবনটিকে যেন মুঠোয় ধরে রেখেছেন, সাগরে এ-কোন অগ্নি! উপনিষদের নচিকেতা মৃত্যুর দরবারে গিয়েছিলেন এই অগ্নির সন্ধানে। ‘নিঃস্ব হয়ে বিশ্বে এলে দয়ার অবতার/ কোথাও তবু নোয়াও নি শির জীবনে, একবার। নামলে একা মাথায় নিয়ে মায়ের আশীর্বাদ/ করলে পূরণ অনাথ আতুর অকিঞ্চনের সাধ। ওরা ‘বুট’ পায়ে মাঠে নেমেছিল ‘ ভারত- বল’ খেলতে।’ চটির কাছে কয়েক ডজন গোল খেয়ে সম্বিৎ ফিরল। সত্যেন্দ্রনাথের কলম:
সেই যে চটি-দেশী চটি- বুটের বাড়া ধন
খুঁজব তারে আনব তারে এই আমাদের পণ,
এই ‘ বাট খাড়া দাঁড়ি পাল্লা’ মার্কা বচন সর্বস্ব অঙ্গনে আর একবার যে আসতে হবে, কাঁদছে আমাদের প্রাণ।