মাতৃরূপেণ...
শান্তনু দত্তগুপ্ত
বিধাননগর স্টেশন থেকে লাইন ধরে দমদমের দিকে নাক বরাবর খানিকটা হাঁটাপথ। পথ আর কই! এ তো রেললাইন! এখানে হাঁটতে মানা। তাও হাঁটে লোকে। এটাই শর্টকাট। তারপর ডানদিকের ঢাল ধরে নেমে যায়। খুচখাচ কয়েকটা কারখানার পথ মেলে এখানেই। দু’টো বস্তি পেরিয়ে বাঁয়ে ঘুরলে দেখা যায় ওই গেটটা। বন্ধ... কোনওরকমে একটা মানুষ গলে যেতে পারে, এমন একটা ফুটো শুধু রয়েছে। তার সামনেই প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে আছেন বিধুবাবু। বিধুশেখর বিশ্বাস। চেয়ারটার রং কোনও এক কালে লাল ছিল। এখন তার ছোঁয়া বেঁচেবর্তে আছে। এটাই বিধুবাবুর সিংহাসন। গত ২৩ বছর ধরে প্রকাণ্ড এই ফটকের ধারে বসে থাকেন তিনি। এতগুলো বছরে অনেক কিছু বদলেছে। মালিক বদলেছে। কোম্পানির সিকিউরিটি এসেছে। কত লেবার এসেছে... চলেও গিয়েছে। বদলায়নি বিধুবাবুর চেয়ারটা... বসার জায়গাটা... আর, বিধুবাবু নিজে।
পাশে একটা তাপ্পি মারা জংলা রঙের ব্যাগ পড়ে আছে বিধুবাবুর। ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটে ছুঁইছুঁই। আজ কারখানার দরজাটা খোলেনি। খুলবে না। কিন্তু এই দিনটা তো কারখানার ফটকটা হাঁ করে খোলা থাকে! অন্যদিন কালিঝুলি মাখা জামা গলানো ছেলেগুলো ফিটবাবুটি সেজে এই দিনটায় কারখানায় আসে... কব্জি ডুবিয়ে মাংস খায়... পকেট থেকে ফস করে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নবীন বা জীবন। এগিয়ে দিয়ে বলে... ‘বিধুদা, নাও নাও, সারা বছর তো বিড়িই খাও। আজ না হয় একটা...’। মুখ বেঁকান বিধুবাবু, ‘তোরা যেন বছরভর কিং সিগারেট খাস!’ খৈনি খাওয়া দাঁত বের করে হাসে নবীন। বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটাই এমন! এখানকার হাওয়া-বাতাসটা বদলে বদলে যায়। ভোরবেলা যখন চেয়ারটা বাইরে এনে বিধুবাবু বসেন, পাশের ঘাসগুলোতে তখনও ভেসে থাকে শিশির। বড্ড ভালো লাগে বিধুবাবুর। অন্যবার... অন্য বছর। এবার হাওয়াটা ভারী ভারী লাগছে তাঁর। অভ্যেস মতো সকাল সকাল চেয়ারটা টেনে বসেছেন ঠিকই, কিন্তু চারদিকটা খাঁ খাঁ করছে। আজ বিশ্বকর্মা পুজো হয়নি। কারখানা বন্ধ। সেই লকডাউনের শুরু থেকে। ভেবেছিলেন, আবার সব আগের মতো হবে... ক’টা দিন তো! মাসের পর মাস চলে গেল। মালিক বলেছে, কারখানা আর চালাবে না। ওরা কেউ কেউ এল... যারা কাছেপিঠে থাকে। চেঁচামেচি করল, অত বড় দরজাটা সবাই মিলে ঝাঁকাল, তারপর বসে পড়ল মাটিতে... চোখ বেয়ে জল নামছিল ওদের। বিধুবাবু একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। নবীন বলছিল, ‘বিধুদা... তিন তিনটে ছেলেমেয়ে... খাওয়াব কী করে?’ উত্তর দিতে পারেননি বিধুবাবু।
ছেলে দু’টো বড় হয়ে গিয়েছে। বড়টা তাও বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। ছোটটা কোনওরকমে আট ক্লাস। তারপর আর পড়েনি। বখে গিয়েছে। ক্যানিংয়ের বাড়িতে গেলেই গিন্নি মুখ করে... ‘সংসারের দিকে নজর নেই, মাসে দু’মাসে একবার আসো। ছোট ছেলেটা যে রাতবিরেতেও রাস্তায় পড়ে থাকে! নজর কে দেবে? পড়শি?’ কিছু বলতে পারেন না বিধুবাবু। বড়টা তাও খেতে খামারে যা কাজ পায় করে। ১০০ দিনের কাজটাজও করে টুকটাক। আগেরবার বাড়ি গিয়ে শুনছিলেন, কোন এক সর্দার ধরেছে। পুজোয় শহরে আসবে... কুমোরটুলিতে। ঠাকুর বয়ে নিয়ে গেলে নাকি ভালো টাকা পাওয়া যায়। বিশ বাইশ জনের দল হয়। ছোট ঠাকুর কুমোরটুলি থেকে তুলে প্যান্ডেল পর্যন্ত পৌঁছে দিলেই হাজার পাঁচেক। আর ঠাকুর বড় হলে বা কাঠামো বেশি হলে তো কথাই নেই। দর বাড়বে চড়চড় করে। গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়ার সময় রেট আরও বেশি। পাঁচ ফুটের ঠাকুর ১০-১২ হাজার। সাত পাক ঘোরাতে হয়, কায়দা করে জলে নামাতে হয়... এত ঝক্কির জন্য পয়সাটাও তো বেশি লাগবে নাকি!
মাঝে ফোন করেছিলেন বাড়িতে... ছেলে বলল, ওটা এবার বোধহয় হবে না। সর্দার লোক কাটছাঁট করেছে। ১২ জন নিয়ে যাবে এবার। ট্রেন তো চলছে না... তাহলে কীভাবে যাবে? ছেলে বলল, বাসে, ট্রাকে... যেভাবে হোক। কয়েকজন আগে চলে যাবে। সর্দার পরে। এবার নাকি সবাই নম নম করে সারবে। টাকা উঠবে না... আনকোরা লোক নিয়ে গিয়ে লাভ নেই।
ঠাকুর কেন এবারই এমন করল...? চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বিধুবাবুর। সকাল থেকেই এটা হচ্ছে... সামলাতে পারছেন না। আজ তো মহালয়াও। কত বছর পর এমনটা হল... বিশ্বকর্মা পুজো, আর মহালয়া একসাথে। চেয়ারে বসেই ঘাড়টা তুললেন আকাশের দিকে... নাঃ, ঘুড়িও তো দেখা যায় না। ওই একটা চাঁদিয়াল উড়ছে মনে হয়। বয়সের ভারে চোখ ধূসর হয়েছে। এখন আর ভালো ঠাহর করতে পারেন না। শুনছেন... দেখছেন... লোকের চাকরি নেই। টাকা নেই। ব্যবসা নেই। মহামারী শরীরে নয়... লেগেছে সংসারেও। ঘরে ঘরে এক রোগ... এক কান্না। না পাওয়ার যন্ত্রণা... সব হারানোর দুঃখ। গিন্নি সেদিন বলছিল, পাশের বাড়ির অজিত নাকি গলায় দড়ি দিয়েছে। একটা প্রাইভেট বাসে কন্ডাক্টরের কাজ করত ও। বাস চলছে না... টাকা যা ছিল, শেষ। কেউ ধার দেয় না... খেতে না পাওয়া ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকাতে পারত না। গলায় দড়ি দিয়ে প্রাণ জুড়োলো। তাঁর সংসার কীভাবে চলছে, জানেন না বিধুবাবু। মার্চ মাসের শুরুতে একবার বাড়ি গিয়েছিলেন। তারপর আর হয়ে ওঠেনি। সব বন্ধ হয়ে গেল... চাইলেও যেতে পারলেন না। গত মাসে শেষ মাইনে পেয়েছিলেন। ওই শেষ। তাও রংচটা চেয়ারটা ছেড়ে উঠতে পারেননি। বড্ড বড় দায়িত্ব যে তাঁর... ভেতরে কত লোহালক্কড় আছে, চুরি হয়ে গেলে? সেই মাইনের টাকাটাও শেষ হয়ে আসছে। ছেঁড়া, তাপ্পি মারা ব্যাগটা থেকে পুরনো একটা রেডিও বের করে কিছুক্ষণ সেটার উপর হাত বোলালেন বিধুবাবু। রেডিও না... টু ইন ওয়ান। আগের মালিক দিয়েছিল। এখনও যত্নে রেখে দিয়েছেন বিধুবাবু। মহালয়ার দিন অ্যালার্ম দিতে হয় না তাঁকে। কীভাবে যেন চারটের ঠিক একটু আগে ঘুম ভেঙে যায়। বড় ভালো লাগে তাঁর... আশ্বিনের শারদ প্রাতে... মনে হয় মা এসে গিয়েছেন। দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর ছোট্ট চৌকিটার পাশে। মাকে বুঝে উঠতে পারেননি বিধুবাবু। দশের কোঠায় পা দেওয়ার আগেই মা তাঁর পাড়ি দিয়েছেন তারার জগতে। এই দিনটায় মাকে খুব মনে পড়ে... আবছা হাসিমুখটা ধরা দেয় মনের আয়নায়। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা রক্তমাংসের একটা মানুষ আশীর্বাদ দেওয়ার মতো করে হাতটা তুলে রয়েছে... বলছে... ‘অ বিধু, আর কতক্ষণ খাবারটা আঢাকা ফেলে রাখবি বাবা... খেয়ে নে!’ চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়... তখনকার মতো। দু’টো ক্যাসেট আছে তাঁর। একটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। ডিউটি শেষ করে জামা কাপড় ছেড়ে লুঙ্গি পরে তক্তাপোশে বসেন বিধুবাবু। তারপর চালিয়ে দেন ক্যাসেটটা। রোজ। ভারি ভালো লাগে তাঁর... হেমন্তবাবু যখন ধরেন ‘ও নদী রে...’। কত কথা যে তাঁর নিজেরও শুধোতে ইচ্ছে করে... এই কারখানাকে, সামনের হাড় বের করা রাস্তাকে, ট্রেন লাইনের ওপারে যে জায়গাটা একটু জলা মতো হয়ে আছে... ওই জায়গাটাকে।
চোখটা বড় জ্বালাচ্ছে আজ... ঝাপসা হচ্ছে বারবার। সাড়ে চারটে বাজে। আর আধঘণ্টা পর উঠবেন তিনি। ওই জায়গাটা বড় ডাকছে আজকে। বর্ষায় জল ভরে যায় নিচু এলাকাটায়... সূর্যের তাপে শুষে নিতে সময় লাগে। তারই মধ্যে আকাশে এসে যায় তুলোর মতো মেঘ। ওখানে কাশফুল হয়। দেখেছেন বিধুবাবু। দেখেন বিধুবাবু... ফি বছর। একটু সময় ছুটি নেন কারখানার ফটকটা থেকে। বসে থাকেন ওখানে। টু ইন ওয়ানটা ব্যাটারিতেও চলে। সঙ্গে নিয়ে যান তিনি। আগমনির এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকে বিধুবাবুর দ্বিতীয় ক্যাসেটটা। ওখানে... রেললাইনের ধারে কাশের হাওয়ায় চালান ওই ক্যাসেটটা। শোনা যায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলা... ‘যা দেবী সর্বভূতেষু...’। মানে বোঝেন না বিধুবাবু। কিন্তু অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। মা আসছে, মা আসছে অনুভূতি...। আজও যাবেন। এই আধ ঘণ্টা পর।
পুজো নাকি এবার তেমন ভালো করে হবে না। শুনছেন বিধুবাবু। পাশের বস্তিতে থাকে বিলে। এলাকার দাদা গোছের। বলছিল, হোয়াটসঅ্যাপে নাকি কীসব মেসেজ এসেছে... এবার অঞ্জলি দেওয়া যাবে না, সিঁদুর খেলা হবে না। ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ নেই বিধুবাবুর। খায়, না মাথায় দেয় জানেন না। শুধু লোকজনের কাছে দেখেন, এতে লেখা আসে, ছবি আসে...। তবে বিলে খবর রাখে। সেটা জানেন তিনি। ও যখন বলছে, খুব কি ভুল বলবে? কিন্তু পুজো হবে, আর অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া যাবে না... এ আবার হয় নাকি? মানতে পারেন না বিধুবাবু। কুমোরটুলিতেও বিলের ভালো যাতায়াত আছে। ওখানে এক-দু’বার গিয়েছেন তিনি। মেন রোডের পাশে সরু গলিটা দিয়ে ঢুকেই যে এমন দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার থাকতে পারে, ভাবতে পারেননি তিনি। ওইটুকু গলি দিয়েই অত বড় বড় প্রতিমা বেরিয়ে আসছে, উঠে যাচ্ছে ম্যাটাডোরে... হাত জোড় করে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন বিধুবাবু। বিলে বলেছিল, ‘কাকা, সারাদিন হাত জুড়ে থাকতে হবে। এবার নড়াচড়া করো!’ গলির মুখে বেশ কয়েকটা খাবার দোকান আছে। সেখানেও বিলের খুব খাতির। টোটন, মদন... আরও কত নাম। বিলে বলছিল, এবার নাকি বাজার খুব খারাপ। বছরের এমন একটা সময়ে হাঁফ ফেলার সময় পায় না ওরা। সারাদিন বিক্রি হয় ডিম-টোস্ট, হাঁসের ডিম সেদ্ধ, ঘুগনি, আর চা...। এ বছর কী একটা রোগ এল, পথে বসিয়ে দিল কত লোককে। বিলে বলছিল, ‘বুঝলে কাকা, ফরেনাররা আসে ওখানে। ওরা এলেই আশপাশের সবাই চনমন করে ওঠে। ওরা খায়, গাইড ভাড়া করে... কত কী! এবার আর কিচ্ছুটি নেই। আগেরবার যে সাইজের ঠাকুর ৭০ হাজারে বিক্রি হয়েছিল, এবার সেটাই ৩০-৪০ হাজারে ছাড়তে হচ্ছে। বেশিরভাগ লোকই এ বছর ছোট ছোট ঠাকুর বায়না করছে। যে কি না ১২ ফুটের ঠাকুর নিত, সে বলছে, সাড়ে পাঁচ-ছ’ফুটের বেশি নিতে পারব না। আর কুমোরটুলির কারিগররাও তাতেই ছেড়ে দিচ্ছে। কী করবে বলো... কিছু টাকা তো ঘরে আসেবে! কিছু তো খাওয়া জুটবে! বড় শিল্পীদের না হয় রেস্ত কিছু আছে... ছোটখাট কারিগররা কী করবে বলো?’
এসব শুনে বিধুবাবুর বড় ব্যথা লাগে। সত্যি তো... খেতে না পেলে তো মরা ছাড়া গতি নেই! মনে পড়ে অজিতের কথা। গলায় দড়ি দিল ছেলেটা...! বড় ছেলেটার জন্য বিলেকেই ধরপাকড় করবেন ভেবেছিলেন... এসব শুনে বুঝতে পারেন, বলে লাভ নেই। ঠিক যেমন ছেলেকে সর্দার বলেছে। ওটাই সার কথা। এবার কিছু হওয়ার নেই। বিলে বলে চলে, ‘কমপ্রোমাইজ করতে হচ্ছে সব্বাইকে... বুঝলে কাকা। একচালার ঠাকুর এবার বেশি হচ্ছে। ক্যারিং কস্ট কম লাগবে। একটা গাড়িতেই হয়ে যাবে। গয়নাপত্র পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে লোকজন। আগের বছর যারা ঠাকুর তৈরি করে ২৮-৩০ লাখের ব্যবসা করেছিল, এবার ওরাই বলছে ১০-১২ লাখ হলে বেঁচে যাই। আর ছোট ছোট কারিগরদের মুখের দিকে তাকানো যায় না! কী দিন এল! বছরটা গেলে বাঁচি।’
বিধুবাবুরও মনে হয়, বছরটা সত্যি খুব খারাপ। একটাও ভালো খবর নেই। একটা মানুষও ভালো নেই। এটা দুঃস্বপ্ন নয় তো! হলেই বোধহয় ভালো হতো। মহালয়ার এক মাস পর পুজো... শেষ কবে হয়েছে, মনে নেই বিধুবাবুর। বছরটা খারাপ বলেই এসব হচ্ছে। একটা খারাপ মাস ঢুকে পড়েছে পুজোর মধ্যে। মা দুগ্গা এসে গেলে নিশ্চয়ই এর একটা বিহিত করবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে...।
আশায় বাঁচেন বিধুবাবু। সব শেষ হয়েও তাই শেষ হয়ে যায় না...। অতি যত্নে কিছুটা বাঁচিয়ে রেখে দেন। ঠিক যেভাবে বাঁচিয়ে রেখেছেন মাকে। শরতের শুরুতে ফিরিয়ে আনেন তাঁকে। দেবীর আগমনির সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায় মায়ের ছবিটা। পাঁচটা বাজল। এবার উঠবেন বিধুবাবু। ওরা বলেছে, চেয়ারটা আর ভেতরে ঢোকানোর দরকার নেই। বাইরেই পড়ে থাক। আর ভেতরে রাখবেনই বা কী করে... ফটকে মস্ত একটা তালা ঝুলছে। আজই বেলায় বেলায় এসে ওটা ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে ওরা। তখনই ওই ছেঁড়া ব্যাগটায় করে সর্বস্ব বেঁধে বাইরে এনে রেখেছেন বিধুবাবু। আর একটা বিগ শপারে রয়েছে মা দুর্গার একটা ছবি। দেওয়ালে ঝুলছিল। এবার রওনা দেবে বিধুবাবুর সঙ্গে। ওরা তখনই চলে যেতে বলেছিল। বিধুবাবু যাননি। যাবেন কী করে! ডিউটি যে পাঁচটা অবধি!
কীভাবে ক্যানিং ফিরবেন... জানেন না বিধুবাবু। তাও বেরিয়ে পড়েছেন। আগে যাবেন রেললাইনের ওপাশের জলাটার ধারে। বসবেন কিছুক্ষণ। ক্যাসেটটা বুকপকেটে রেখেছেন তিনি। হাত কাছে পেতে চান... মনে হলেই।
কাশফুল দুলছে হাওয়ায়... বেশ লাগছে। সন্ধ্যা নামবে এবার। টু ইন ওয়ানটায় ক্যাসেট ঢুকিয়ে অল্প ভল্যুমে চালালেন বিধুবাবু... ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা...’। চোখটা আবার ঝাপসা হয়ে এল। মায়ের মুখটা এখন আর মনে পড়ছে না। শিউলি ফুলের গন্ধের সঙ্গে জমাট বাঁধছে আর একটা মুখ... উমার। কতই বা বয়স ছিল ওর... পাঁচ? ছয়? সাতও হতে পারে। মনে নেই বিধুবাবুর। একরাতের পেটের যন্ত্রণায় শেষ হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। ডিউটিতে ছিলেন বিধুবাবু। ফিরতে পারেননি সেদিন। খবর যখন পেয়েছিলেন, শেষ ট্রেন ছেড়ে গিয়েছে। পরেরদিন ফার্স্ট ট্রেনে রওনা দিয়েছিলেন। যখন পৌঁছলেন... উমা নেই। যন্ত্রণায় বুকের একটা পাশে তখন থেকে পাথর বসে রয়েছে বিধুশেখর বিশ্বাসের। মানতে পারেননি... মানতে পারেন না... মা এমন অবিচার করতে পারে? মুখটা মনে আনতে চান না বিধুবাবু। কিন্তু ফিরে আসে... বিসর্জনের সময়। জলে ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়া... দেবী চললেন... ওই দৃশ্যটা দেখতে মন চায় না তাঁর। কখনও না। মেয়েটার কী এমন বয়স ছিল...। উমা যেদিন চলে গেল তাঁকে ছেড়ে...।
বুকটা ধক করে উঠল বিধুবাবুর... সেদিনটাও যে মহালয়াই ছিল...।
ছবি : সোমনাথ পাল ও মুকুল রহমান
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়
20th September, 2020