শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা—এই দুটি ডানায় ভর করে এখন মেয়েরা অনেক বেশি বাইরে কাজ করেন। সেই কাজ অত্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে যোগ্যতার সঙ্গে তাঁরা পালন করেন। বহু বছর সেই কাজ দায়িত্ব নিয়ে পালন করার পর হঠাৎ সেই কর্মজগৎ থেকে সরে আসায় একটা মানসিক সমস্যায় অনেককেই ভুগতে দেখা যায়। মনের পাশাপাশি শরীরেও নানা ক্রাইসিসে ভোগেন মেয়েরা অবসরের পর। একে একে বাতের সমস্যা, হাড় দুর্বল হয়, হার্টের গোলযোগ, থাইরয়েড, ব্লাড সুগারের সমস্যা—এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম রোগ। এইসবের জন্য নানা চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত থাকে। কারণ জটিলরোগের চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। অথচ চাকরি থেকে অবসর নেওয়ামাত্রই বন্ধ হয়ে যায় নিয়মিত উপার্জন। পেনশন তো আর সবার থাকে না। এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে করতেই একটা বিষাদ আসে মনে। অর্থনৈতিক বিপন্নতা মনের ওপর অহেতুক চাপ সৃষ্টি করে। অবসরের পর মন ও শরীর ভালো রাখার পরামর্শ দিলেন মনোচিকিৎসক কামাল হোসেন।
একদিকে শারীরিক অসুখ-বিসুখ, অপরদিকে কাজের জগতের ব্যস্ততা কমে যাওয়া, কলিগদের সঙ্গে দেখাশোনা, কথাবার্তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়াও প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে মনের উপর। বিষণ্ণতা, একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে ক্রমশ। অবশ্য সবার ক্ষেত্রেই যে প্রভাব সমান পড়বে এমন নয়। দেখতে হবে কার জীবনের গতিপথ কেমন, তার উপর নির্ভর করবে সেই নারীর মানসিক অবস্থা—পারিবারিক জীবন, দাম্পত্য জীবন, নাকি নিঃসঙ্গ জীবনের তিনি অংশীদার—এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম পরিস্থিতি। পারিবারিক জীবন থাকলে তিনি যতটা না নিঃসঙ্গতা বোধ করবেন, একা হলে তা অনেক বেশি হবে। ক্রমশ আত্মবিশ্বাস কমতে থাকবে। স্বাভাবিক রুটিন এলোমেলো হয়ে গেলে একটা অবসাদ, বিষণ্ণতা এসে যায়। সব মিলিয়ে একটা দিশাহারা ব্যাপার কাজ করে। তাই অবসরের ৮-১০ বছর আগে থাকতেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা উচিত। কারণ অবসর তো হঠাৎ কোনও সিদ্ধান্ত নয়। নির্দিষ্ট সাল, তারিখ-সময়সীমা থাকে। তাই হাতে অনেকটাই সময় পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য চিন্তাভাবনার বিষয় হলেও এখন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। ব্যয়বহুল তো বটেই, তেমন নানা ধরনের ইনসিওরেন্স, মেডিক্লেম পলিসি আছে, রয়েছে নানা ছাড়ের সুযোগ সুবিধে। এগুলি নিয়েও ভালো করে আলোচনা করে জেনে রাখা উচিত।
কাজের জগতে অবসরের দিন এসে গেল মানেই জীবন শেষ, এমন ভাবনা মাথায় আনবেন না। বরং ভাবুন যা আপনি পারেন, অথচ সময় এবং সুযোগের অভাবে এতদিন যে শখ পূরণ করতে পারেননি সেগুলোতে সময় দিন। ক্রিয়েটিভ কাজে মনোনিবেশ করুন।
রিটায়ারমেন্টের পরেও অন্যান্য কাজের ইচ্ছা থাকলে নতুন যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। খুব বড়, প্রমিসিং কোনও জীবিকা বা উপার্জনের পন্থা না হলেও, দায়িত্ব নিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করুন। করতে পারেন সমাজকল্যাণের কাজ, কোনও ক্লাবেও সদস্য হতে পারেন।
আত্মবিশ্বাস রক্ষার জন্য কাজে যুক্ত থাকা খুব প্রয়োজন। কারণ ক্রমশ একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা বাড়ার ফলে বয়স্কদের মধ্যে অবসাদ, ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমার্সের মতো রোগের প্রকোপ বাড়ছে। তাই এর থেকে মুক্তি পেতে হলে হতে হবে সামাজিক। মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, নিজেকে সব সময় বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত রাখতে হবে। অস্তিত্বের প্রয়োজনেই এই আদানপ্রদান জরুরি। যা মস্তিষ্কের কাজগুলো ভালোভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করবে। এতদিন অনেক কাজ করেছেন বলেই অবসরের পর সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবেন—এই ভাবনাটাই ভ্রান্ত। জীবনে নতুন শুরুর কথা ভাবুন। পশ্চিমী দেশগুলিতে নতুন জীবন, নতুন সঙ্গী, নতুনভাবে জীবনকে চেনা, উপলব্ধি করার ছবিই দেখা যায়, অবসরের পর জীবনকে এই ভাবেই উপভোগ করুন। হাসিমুখে স্বামী-স্ত্রী এই বয়সে জীবনটা এনজয় করুন। মাঝে মাঝে হাত ধরাধরি করে বেড়াতে যান, সিনেমা নাটক দেখুন।
একাকিত্বে ভোগাটা মানুষের কাছে অভিশাপস্বরূপ। তাই যাঁরা অবিবাহিত বা স্বামী/স্ত্রী যে কোনও একজন মারা গিয়েছেন তাঁরাও সমমনস্ক বন্ধু খুঁজে নিন। সময়টা সঠিকভাবে কাজে লাগান। দেখবেন একাকিত্ব কেটে যাচ্ছে। খারাপ আছি, কষ্টে আছি এসব ভাবলেই অবসাদ গ্রাস করবে। এমনিতেই এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সদস্য কম। সন্তানরাও কেরিয়ারের জন্য ভিন রাজ্যে, ভিন দেশে থাকে। আবার এক শহরেও ভিন্ন সংসারের চিত্র দেখা যায়। সে সংসারে বাবা-মার অস্তিত্ব সংকটে। ফলে নিঃসঙ্গতা বাড়ে বই কমে না। কিন্তু হেরে যাওয়ার মানসিকতা রাখবেন না। নিজেই নিজের হাল ধরুন। আপনারও তো সমমনস্ক সঙ্গী আছে—বেঁচে থাকার সেই সব উপাদান খুঁজে নিন। মনে রাখবেন, প্রত্যেক বয়সেই জীবনকে দেখার, চেনার বোধ বদলে যায়। সেইমতো নিজেকেও বদলাতে হবে। তা না হলেই কষ্ট বাড়বে। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে তাই উপভোগ করুন। এক জীবন শেষের গল্প অন্যকে শোনাবেন কেন, বরং নতুন জীবনের আশা নিয়েই প্রাণভরে বাঁচুন। দেখবেন আপনার চারপাশের সেই চিরচেনা জগৎটাই আপনার কাছে ভালো লাগতে শুরু করবে।
শেরী ঘোষ