ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি। এই প্রবচন বিলকুল খেটে যায় বিয়ের ব্যাপারে। খানিক খোলসা করে বলা যাক। বংশবিস্তার বা রাজ্যবিস্তারের মোক্ষম রাজনৈতিক চাল হিসেবে বিয়ের কথা প্রচলিত। কিন্তু ধর্ম! ধর্মবিস্তারের জন্য বিয়ে, এমন কথাটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! বিয়ের ‘মোডাস অপার‌্যান্ডি’ যদি ধর্মবিস্তার হতো, তাহলে ভিন্নধর্মের মধ্যে বিয়ের রেওয়াজ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু সমাজ তো তা সুনজরে দেখে না। অথচ এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের বিয়ে হয়ও বটে। আসলে বিয়ে তো দুই প্রকার, ‘সামাজিক বিয়ে’, যেখানে অভিভাবকরা পাত্রপাত্রীর বিয়ে দেয়। আর ‘প্রেমের বিয়ে’, যেখানে পাত্রপাত্রী বিয়ে করে, মিয়া-বিবি রাজি তো কেয়া করেগা কাজি। এমন কখনও শোনা যায় না যে, সমাজপতিরা বুক ফুলিয়ে এক ধর্মের সঙ্গে ভিনধর্মের বিয়ে ঘটিয়েছেন।
এই সব মিলিয়ে এটা কিন্তু মানতেই হবে যে, বিয়ের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বড় নিবিড়। এর মূল কারণ হল, আবিশ্বের মানবসমাজে বিয়ে এবং ধর্ম, এই দু’টোই যাবতীয় সম্পর্কের ‘অন্যতম স্তম্ভ’। একটু তলিয়ে দেখা যাক। আসলে বিয়েটা তো কোনও ‘ধর্ম’ নয়, এমনকী কোনও ‘ধর্মাচরণ’ও নয়। বিয়েটা একটা ‘প্রথা’, যেটা যত না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক। এভাবেই বিয়ে আর ধর্মের একটা যোগসাজশ পাওয়া যেতে পারে। ধর্ম যেমন একটা সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি, তেমনি বিয়েটাও একটা সামাজিক সংস্কৃতি।
তাই, এরকম একটা চালু ধারণা আছে যে, একই ধর্ম বা সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হলে সেটা বেশি মজবুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু তাই বলে কোনও ধর্মের তথাকথিত আচরণবিধিতে এমন কোনও হুকুম নেই যে, নিজের ধর্মের মধ্যেই শুধু বিয়ে করতে হবে। আবার এটাও বলা নেই যে, অন্য ধর্মে বিয়ে করাটা চলবেই না। এটা প্রায় হলপ করেই বলা যেতে পারে যে, সামাজিক বিয়ের ক্ষেত্রে যে যে কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, প্রেমের বিয়ে ভাঙার প্রসঙ্গেও সে সব হেতুই কাজ করে। তবে ওই সব কারণের মধ্যে ‘ধর্ম’-ও আছে, এমনটা প্রায় শোনাই যায় না।
এবার উল্টোটা দেখা যাক। এটাও খুব কম দেখা যায় যে, দু’টি পৃথক ধর্মের প্রেমের বিয়ের আগে বাধ্যতামূলক ভাবে পাত্র বা পাত্রীকে ধর্মান্তরিত হতে হল। এমনকী এটাও খুব বিরল ব্যাতিক্রম যে, দুই ধর্মের পাত্রপাত্রীর বিয়ে হল যে কোনও একটি ধর্মীয় আচার মেনে। বরং পাত্রপাত্রীর বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় যার যার পরিবারের ধর্মীয় প্রথা মেনে। সমাজে এই উদাহরণও আছে যে, পাত্রপাত্রী যদি তথাকথিত ধার্মিক হয়, তাহলে তারা যে শুধু নিজের ধর্মের অনুষ্ঠানে অংশ নেয় তাই-ই নয়, তারা সমান শ্রদ্ধায় অন্যের ধর্মের ভক্তিমূলক অনুষ্ঠানেও শামিল হয়। কাজেই বিয়ের সাফল্য কোনও ধর্মমূলক সংস্কৃতির ওপর পুরোটা নির্ভর করে না, বরং অনেক বেশি করে ব্যক্তিবিশেষের ওপর।
কিন্তু এত কিছুর পরেও বিয়ের গা থেকে ধর্মের দাগটা মুছে দেওয়া যায় না! কেন? এর পিছনে আছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা কিছু ‘ট্যাবু’! এই ‘রিচুয়াল’-এর কারণেই বিয়ের অনুষ্ঠানে সরকারি নিয়মকানুন বা বিধিনিষেধের চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য পায় ঈশ্বর বা আল্লাহ বা গড! বিয়ে পরিচালিত হয় পুরোহিত বা পাদ্রী বা কাজির বিচার মাফিক। আর কে না জানে যে, এই সব ধর্মকর্তারা যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিজেদের সুবিধামতো আইনকানুন জুড়ে দেয়। এই সূত্র ধরেই আসল কথাটা চলে আসবে। আপাতভাবে একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও, সেটাই অপ্রিয় বাস্তব। বিয়ে, ধর্ম, সংস্কৃতি— এই সব কিছুর পিছনে বড় কারণটা হল আর্থসামাজিক। যেখানে দারিদ্র্য বহাল, যেখানে অশিক্ষার অন্ধকার, তথাকথিত ধর্মগুরুরা সেখানেই নিজের ‘রাজ’ কায়েম করার সুযোগ পায় বেশি। গরিব-প্রধান, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা ভূখণ্ডগুলিতে তাই ভিনধর্মের বিয়ে দেখাই যায় না। বিধর্মে বিয়ে মানে নরকে গমন। অন্য ধর্মে বিয়ে মানেই সামাজিক বয়কট! একঘরে করে দেওয়ার শাস্তি!
কাজেই বিয়ে আর ধর্মকে আলাদা করা অসম্ভব। বিয়ে হল একটা বিশেষ সম্পর্ক, আর ধর্ম হল একটা বিশেষ বিশ্বাস। ধর্মের ব্যাপারে মানুষ যতটা স্পর্শকাতর, বিয়ের ব্যাপারেও লোকজন ততটাই স্পর্শকাতর। সবচেয়ে ভালো হতো, বিয়ের মাথা থেকে ধর্মের ঘোমটাটা সরিয়ে দিতে পারলে! বিয়েটা তাহলে সর্বার্থেই ‘মিলন’ হয়ে উঠত।
শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়