শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
সমাজতত্ত্বের দিক থেকে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, বৈদিক যুগের আদিপর্বে মেয়েরা ছিল জ্ঞানী। তাদের বাক্স্বাধীনতা ছিল। যে কোনও বিষয় মতামত দান থেকে শুরু করে বিদ্যাদান সব কিছুই করেছে সে যুগের বিদুষী নারী। তারপর থেকে সমাজে ক্রমেই নারীর অবমূল্যায়ন শুরু হয়। নারী হয়ে ওঠে পুরুষের আজ্ঞাবাহী হাতের পুতুল। তাই ‘শ্রীশ্রীচণ্ডীর’ দেবীস্তুতিতেও রূপ, যশ, অর্থ প্রভৃতির সঙ্গে ‘পুত্রং দেহী’ অর্থাৎ পুত্র কামনা করা হয়েছে কন্যা নয়। বংশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পুত্রের প্রয়োজন, তাই ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’। অর্থাৎ পুত্রের জন্ম দিতেই স্ত্রীর প্রয়োজন। অথচ পুত্রকে যে জন্ম দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখাবে সেই নারীরই সমাজে মূল্য নেই! আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কয়েক প্রজন্ম আগেও বলা হত ‘পড়াশোনা শিখলে নারী বিধবা হবে’। অর্থাৎ তাদের ভয় দেখিয়ে, নানাভাবে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করে সমাজপতিরা নারীদের করে তুলেছিল পরাধীন, অসহায়।
ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত কিছু মানুষ ও কয়েকজন বিদেশি নারী-পুরুষের প্রচেষ্টায় নারী শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে সতীদাহপ্রথা বন্ধ হয়। বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিধবা বিবাহের প্রচলন, নারী শিক্ষার নব সূচনা শুরু হয়। নারীর ম্লান মুখে ভাষা ফোটে। ধীরে ধীরে শিক্ষিতা নারী কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখে। নিজেকে কর্মের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আজ নারী বহুলাংশেই সার্থক একথা স্বীকার করতেই হবে।
সমাজের এই বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানের সবলা, প্রতিষ্ঠিতা নারীদের আচার-আচরণে, স্বভাবে-ব্যবহারে নাকি অনেক পরিবর্তন এসেছে বলে অনেকেই সমালোচনা করেন। অর্থ উপার্জনের জন্য ঘরে বাইরে অক্লান্ত কাজ করতে করতে নারী অনেকাংশে অধৈর্য, আত্মকেন্দ্রিক, রূঢ়ভাষী হয়ে পড়ছে। এর ফলে নাকি ডিভোর্সের সংখ্যাও বাড়ছে। অর্থাৎ বর্তমান সমাজ প্রগতিশীল হলেও আঙুলটা উঠছে নারীদের দিকেই।
বর্তমানে শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় অনেক কিছুই পাল্টে গিয়েছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে অণুপরিবারে পরিণত হয়েছে। মা-বাবার কাজের চাপে একাকিত্ব আবার বাবা-মায়ের থেকে অনেক দামি দামি জিনিস চাইলেই পেয়ে যাওয়া, বাবা মায়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে গিয়ে শৈশবেই ইঁদুর দৌড়ে শামিল হয়ে লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে যাওয়া পুত্র ও কন্যারা অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে।
কিন্তু মেয়েদের আর্থিক সচ্ছলতা তাকে অনেকটাই সাহস জোগায় নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করতে। আগের মতো নারী এখন আর পড়ে পড়ে মার খায় না। নিজের সম্মান রক্ষার্থে তারা লড়াইও করে। সমাজ ও সংসারে কাজেরও সমবণ্টন হয়েছে। সংসারে স্বামী ও স্ত্রী ভাগ করে নিেচ্ছ সব কাজ। তাই আমাদের সমাজের নারীরা এখন ঘরে বাইরে দশভূজা। এমন অবস্থায় নারীমনের কোমল দিকগুলি একটু হলেও পাল্টাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।
মনোবিদ তনিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে তাল রেখে নারী পুরুষ উভয়েই একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। আগের মানসিকতা নিয়ে চলতে গেলে পরিবর্তিত সমাজের সঙ্গে তাল রাখা দুষ্কর। তাই নারীর বৈশিষ্ট্যগুলোরও বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে একথা মানতেই হবে। সুন্দরী নারীকে দেখতে, কথা বলতে, তার সঙ্গে সময় কাটাতে সকলেই ভালোবাসে। একজন সুন্দরী মহিলার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে অনেকেই খুব সহজে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু সম্পর্ক স্থায়ী হয় সেই নারীর ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি এবং সুন্দর স্বভাবের ভিত্তিতে। সমাজ তথা পুরুষের চোখে বিদুষি নারী হয়ে উঠেছে মহীয়সী।
একজন নারীর সুন্দর হয়ে ওঠার মূল রহস্য লুকিয়ে আছে তার শিক্ষায়-বিচক্ষণতায়, আত্মনির্ভরতায় ও আত্মপ্রত্যয়ে। আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নারী যখন সবলা হয়ে ওঠে তখন সে অনেক বেশি সাবলীল হয়। আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নারী তার পেশা বা কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে করতে দক্ষ হয়। অনেক বেশি বিচক্ষণ হয় যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। আবেগতাড়িত হয়ে লক্ষ্যহীন গন্তব্যের দিকে ধাবিত হয় না। অনেক বেশি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিজেকে তথা সমাজকে সুন্দর করে তোলে। শিক্ষিত-স্বনির্ভর নারী জানে কোথায় কতটা তাকে কঠোর বা নরম হতে হবে। কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ কীভাবে করতে হবে। তাই আধুনিক নারীর স্বভাব-চরিত্র, বিচক্ষণতা, শিক্ষা, রুচি, স্বাধীনতাবোধ ও কর্মক্ষমতা বিকশিত হয় পরিবেশ-পরিস্থিতি ও তার আর্থিক সামর্থের ওপর নির্ভর করে।
অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল এস হ্যামারমেশ তাঁর ‘বিউটি পেজ’ (Beauty Pays) গ্রন্থে বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রমাণ করেছেন একজন নারীর সৌন্দর্য সাফল্যের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত তার অর্থনৈতিক সাফল্য।
সবশেষে বলব, নারীর সৌন্দর্য তার সুন্দর স্বভাবকে বাদ দিয়ে নয়। সব কিছু গুণ (কিছু কম বেশি থাকতেই পারে) ও আর্থিক সাফল্যই একজন নারীকে করে তোলে মহীয়সী। তবে এইসব গুণমান নারী ও পুরুষ উভয়ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে এবং সমাজ নারীদের কাজকর্মকে আরও উদার চোখে দেখলে সমাজ পাবে এক একটি রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী নারী।
দূর্বা বাগচী