আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
‘এই তালবন দিয়ে পথ। তার পরে তিল খেত। তার পরে তিসি খেত। তার পরে দিঘি। জল খুব নীল।’
কিংবা ‘হাট বসেছে শুক্রবারে/ বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে।’
শৈশবে ডুব দিলে যেসব অমোঘ দৃশ্যকল্প মনের মধ্যে ঘাই মারে, তার অন্যতম সহজ পাঠের এমন সব মায়াবী বিবরণ। তালবনের পথ পেরিয়ে বিনিপিসি, বামি আর দিদি কোন পথে দিঘিতে ঘটি মাজতে যায়, বা বক্সিগঞ্জের হাটের স্বরূপ কী, তা জানার অদম্য কৌতূহল বোধহয় প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও শেষ হয় না। নন্দলাল বসুর তুলির টান এই দৃশ্যকল্পকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে। তাই সহজ পাঠ রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের কাছে আজন্মের ভালোবাসা। সারল্যের আশ্রয়ও।
এমন সহজ পাঠকে আজকাল ফ্যাশনেও জনপ্রিয় করে তুলছেন বাঙালি ডিজাইনাররা। শাড়ির পাড় বা আঁচলে তো বটেই, সারা শাড়ির জমিতেও তাঁরা বুনেছেন সহজ পাঠের কাহিনি। কোথাও প্রথম ভাগের বেশ কিছু আঁকা, কখনও আবার সহজ পাঠ দ্বিতীয় ভাগের নানা চিত্র। শাড়ির বুনন ও রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নন্দলাল বসুর জনপ্রিয় ছবিগুলিই ব্লক প্রিন্ট বা স্ক্রিন প্রিন্টের আকারে ঠাঁই পেয়েছে শাড়িতে। এমন শাড়ি নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করছেন ত্রিপুরার শ্রাবণী দত্ত। ওই রাজ্যের স্বাস্থ্যবিভাগে চাকরির পাশাপাশি শাড়িকে ভালোবেসে শাড়ির নকশায় নানা পরীক্ষানিরীক্ষার কাজও সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন শ্রাবণী। তবে তিনি এমন নকশাকে ব্লক বা স্ক্রিন প্রিন্টিং না করিয়ে একেবারে হাতে বোনা কাঁথা কাজে তুলে এনেছেন। কাঁথার কাজ মূলত সিল্কের ওপরেই ভালো হয় বলে বেগমপুরি ও মুর্শিদাবাদি সিল্ক বেছেছেন তিনি। এই ধরনের সিল্কের ওপর সুতোর কাজে সহজ পাঠের নকশা ফুটিয়ে তোলে ‘টিম শ্রাবণী’। বুটিকের নাম ‘মায়াবী বুটিক’। কিন্তু হঠাৎ সহজ পাঠের নকশা কেন? জানালেন, ‘মলমল ও সুতির থানে এমন নকশা প্রায়ই দেখা যায়। এই ধরনের শাড়িতে সহজ পাঠের ব্লক প্রিন্টিং খুব প্রচলিত। তাই এই নকশাকে কীভাবে অন্য শাড়িতে বসানো যায়, সে কথা ভাবছিলাম। এগুলো দেখেই মনে হয়, এই বুনন যদি কাঁথা কাজের হয়, তাহলে দেখতেও অনেক ভালো লাগবে আর বেশ নতুনত্ব থাকবে। তারপরেই নিজের দলের হস্তশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে এই নকশাকে শাড়ি জুড়ে ঢালাও ভাবে বোনানো শুরু করি। যেহেতু পুরো কাজটাই হাতে বোনা ও নন্দলাল বসুর হাতের আঁকা খুব সূক্ষ্ম, তাই কাঁথা সেলাইয়ের মারফত এসব ফুটিয়ে তুলতে সময় অনেকটা বেশি লাগে। তাই দামও একটু বেশির দিকেই হয়।’
সময় বেশি লাগার কারণে একসঙ্গে অনেক শাড়ির ফরমায়েশ নিতে পারেন না শ্রাবণী। তাঁর দলে চারজন হস্তশিল্পী রয়েছেন। শাড়ির নিজস্বতা বজায় রাখতে এক একটি শাড়ির নকশা বুনতে এক-দু’জনের বেশি কাজে লাগান না। তাঁর মতে, এক একজনের বুননের হাত আলাদা। তাই একই শাড়িতে বিভিন্ন হাত মিলে কাজ করলে শাড়ির বুননে তফাত এসে যায়। সূক্ষ্ম চোখে দেখলে তা ধরাও পড়ে।’ দু’-এক জনের দায়িত্বে এক একটি শাড়ি তৈরি হয় বলে একটি শাড়ি বুনতে প্রায় মাস ছয়েক সময় লেগে যায়। মূলত বেগমপুরি সিল্কে এই কাজ বেশি হয়, তবে নানা ধরনের সিল্কেই কাঁথার নকশায় এমন সহজ পাঠের কথা ফুটিয়ে তোলা যায় বলে মত শ্রাবণীর। কিন্তু সিল্কের ওপরে তো ব্লক প্রিন্টও ভালো হয়! তাহলে তা না বেছে কাঁথা কাজ বাছার কারণ কি শুধুই নান্দনিকতা?
শ্রাবণী বললেন, ‘নন্দনতত্ত্ব যদি একটি কারণ হয়, তাহলে অবশ্যই আর একটি কারণ এর অভিনবত্ব। এর আগে সুতির শাড়িতে এমন ব্লক চোখে পড়েছে। কেউ কেউ স্ক্রিন প্রিন্টও করান। কিন্তু কাঁথার নকশায় সহজ পাঠ ফুটিয়ে তুলতে এর আগে কাউকে দেখিনি।’ এমন কাঁথা কাজের সহজ পাঠ শাড়ি আপন করে নিতে চাইলে বা ‘মায়াবী বুটিক’-এর অন্য শাড়ি দেখতে চাইলে এদের ফেসবুক পেজ দেখতে পারেন। অর্ডারও দেওয়া যাবে এই পেজ মারফত।
শ্রাবণী যে কাজটা কাঁথার নকশায় ফুটিয়ে তোলেন, তাকেই দামী মলমলে ব্লক প্রিন্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন অনেকে। তবে সেখানে শাড়ি ও নকশার মানের হেরফের হয়। কম দামী মলমলে নকল নকশার ব্লক প্রিন্ট কিনে ঠকেছেন, এমন শাড়িপ্রেমীও কিন্তু কম নেই। তাই প্রিন্ট নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা অনেকের মধ্যেই থেকে যায়। সহজ পাঠের নকশা নিয়ে কাজ করা আর এক ডিজাইনার কলকাতা নাগেরবাজার-যশোর রোডের সুস্মিতা বোস। তাঁর বুটিকের নাম ‘মন’। সহজ পাঠ শাড়ির নকশা একটি মলমলে দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রথমে তা পছন্দ হয়নি। বরং মনে হয়েছিল নকশাটিতে ডিটেলিং কম, নন্দলাল বসুর ছবিগুলোকে কোথাও কোথাও বিকৃত করা হয়েছে বলে মনে হয়েছিল। প্রিন্টের মানও ভালো লাগেনি। তখন নিজের তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলেন সুস্মিতা। ব্লক প্রিন্টে কিছু কারুকাজ যোগ করেন। মলমলের মানের দিকেও নজর দেন। তার এভাবেই নিজের বুটিক থেকে সহজ পাঠ শাড়িটি তৈরি করেন তিনি। তবে সহজ পাঠ নকশার নকল প্রিন্ট, মলমল ও সুতির থানের মান নিয়ে তিনিও বেশ চিন্তিত। বললেন, ‘সহজ পাঠ নকশা এখন প্রায় সকলেই কমবেশি করেন। এই ব্লক প্রিন্ট খুব প্রচলিত হয়ে যাওয়ায় এর নকলেরও বাড়বাড়ন্ত রয়েছে। ছবিগুলোর দিকে ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, নন্দলাল বসুর আসল ছবির প্রিন্ট সেগুলো নয়। তাছাড়া খুব কম দামে এই শাড়ি অনেকে বিক্রি করলেও মলমলের মান খারাপ হওয়ায় তা বেশিদিন পরার উপায় থাকে না। তাই এমন শাড়ি অর্ডার করার আগে মলমলের মান ও ছবির নকশা খুঁটিয়ে দেখে তবেই অর্ডার করা উচিত।’ সাধারণত খুব কম দামে যাঁরা এইসব শাড়ি বিক্রি করেন, তাঁদের এড়িয়ে শাড়ির মান বুঝে তা কেনার পক্ষপাতী তিনি। তাঁর কথায়, ‘একটু দামি মলমলে এই নকশা হলে একেবারে জলের দরে হয় না। সেটাও মাথায় রাখা উচিত। আর স্ক্রিন প্রিন্টিং এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তাতে প্রিন্ট বেশি দিন টেকসই হয় না।’
কিন্তু আজকাল অনলাইনে কেনাকাটার যুগে শাড়ির নকশা বা কাপড়ের মান হাতে দেখে পরখ করার সুযোগই বা কোথায়? সে অসুবিধা স্বীকার করেন সুস্মিতা নিজেও। তাই তাঁর মতে, এই ধরনের ডেলিকেট শাড়িগুলো সবসময়ই চেনা ও নামী বুটিক থেকে কেনা ভালো। অচেনা কোথাও অর্ডার করলে তার আগের রেকর্ড একটু খতিয়ে জেনে শাড়ির অর্ডার করা উচিত। ‘দেখুন, এমনিতেও একটা নকশা প্রচলিত হয়ে গেলেই কলকাতার বাজারে তা খুব দ্রুত নকল হয়। তাই নকশার খুঁটিনাটি না দেখে কিনলে ঠকতে হবে। এছাড়া যে কাপড়ে নকশা হবে, তাকেও খুব ভালো মানের হতে হবে। নইলে একবার কাচার পর সেই শাড়ি আর পরার অবস্থায় থাকবে না। তেমনই কাপড়ের মান ভালো হলে তা বহু বছর টিকবে।’ সুস্মিতারও মন বুটিকের নামে ফেসবুক পেজ আছে। সেখান থেকেই সহজ পাঠ শাড়ি অর্ডার করা যায়।
নিজের বুটিক ‘রূপকথা’-য় এমন সহজ পাঠ শাড়ি রাখেন চন্দননগর কাঁটাপুকুর এলাকার পৃথুলা ভট্টাচার্য। তাঁর এই বুটিকে তাঁকে সঙ্গত করেন পুত্রবধূ মেঘবালিকা ভট্টাচার্য। গত চার বছর ধরেই এমন শাড়ি তৈরি করছেন মেঘবালিকা। সহজ পাঠ শাড়ির চাহিদা যে ২৫ বৈশাখের সময়টায় বাড়ে, তা স্বীকার করে নিলেন তিনিও। বাজারচলতি নকশার বাইরে বেরিয়ে সহজ পাঠের অন্য কিছু নকশা খুঁজলে ‘রূপকথা’ আপনাকে হতাশ করবে না। মেঘবালিকা মলমল ও সুতির থানে যেমন ব্লক প্রিন্ট করান, তেমন সিল্কের শাড়িতেও ব্লক প্রিন্টে সহজ পাঠ শাড়ি তৈরি করেন। তাঁর মতে, ‘সিল্কে ব্লক প্রিন্ট দেখতে খুবই ভালো লাগে, তাই এই শাড়ির চাহিদা আছে। তবে সিল্কে ব্লক প্রিন্ট করালে তার দাম অনেকটা বেড়ে যায়। সেই দামে অনেকেই কিনতে চান না। সে কারণে সকলের কথা মাথায় রেখে মলমলের ওপরেও নানা কালেকশন রাখতে হয়। সাধারণত ৬০০ টাকা থেকে এই সব শাড়ির দাম শুরু হয়।’
বৈশাখ এলে যেমন সহজ পাঠ শাড়ির কাটতি বাড়ে, তেমনই এই শাড়ির মধ্যে ‘এসো হে বৈশাখ’ লেখাও খোঁজ করেন অনেকে। তখন সহজ পাঠের ব্লক প্রিন্টের সঙ্গে ‘এসো হে বৈশাখ’ লেখা আলাদা ব্লক তৈরি করে তা প্রিন্ট করাতে হয়। অনেকে স্ক্রিন প্রিন্টেও এমন লেখা চান। ক্রেতার চাহিদা বুঝে সেভাবেই সেই শাড়ি প্রস্তুত করা হয় বলে জানালেন বুটিকের কর্ণধার পৃথুলা। ফেসবুকে ‘রূপকথা’ বুটিকেরও নিজস্ব পেজ রয়েছে। চাইলে সেখান থেকেই অর্ডার করতে পারেন এমন শাড়ি।
শাড়ির জমি ও পাড়ে সহজ পাঠের নানা অধ্যায়ের ছবি, কোথাও স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে সহজ পাঠের দু’লাইনের ছোট ছোট ছড়ার সমাহার— আখর ও ছবির ছোঁয়াচ মিলিয়ে এভাবেই সহজ পাঠ হয়ে উঠছে সজ্জার উপকরণ। শাড়িবিলাসীরা ভালোবেসে আপন করে নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের এই যুগলবন্দি।