আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
শান্তিনিকেতনে আমার কুটিরের দালানে বসে আছেন অসীমা দেবী। বয়স তা প্রায় আশির কাছাকাছি হবে। তাই বলে সেলাইয়ের নেশাটা ছাড়তে পারেননি। তবে এখন আর আগের মতো মাটিতে উবু হয়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেলাই করতে পারেন না। চেয়ারে বসেই ছাত্রীদের সেলাই শেখান আজকাল অসীমা। কোলে তার রংবেরঙের সুতোর ঝাঁপি। সূচে সুতো পরানো, হাতে একটুকরো কাপড়। আর সেই কাপড়েই বন্দি করেন কল্পনার জগৎখানা। কখনও পাখি ওড়ান সূচের টানে কখনও বা নদীর স্রোতে বইয়ে দেন রঙিন মাছ। সবই কাপড়ের এফোঁড় ওফোঁড় দিয়ে রান সেলাইয়ের কাজ। নিজের নেশার কথা জানতে চাইল অসীমা বলেন বাংলাদেশের এই শিল্পটার শুরু কিন্তু সেই বৈদিক যুগ থেকেই। তখন মুনি ঋষিরা কাঁথা কাজের নকশায় কাপড় সেলাই করতেন গায়ে দেওয়ার জন্য। তাতে কারুকাজের বিশেষ বহর ছিল না বটে তবু সেলাইয়ের মাধুর্য ছিল অপূর্ব। সোজা টানে ছোট রান দেওয়া যে কতটা শিল্প নৈপুণ্যের দাবি রাখে তা যে না করেছে, তাকে বোঝানোই দায়। তবে আজ যে এই শিল্প অন্য এক মাত্রা পেয়েছে তাতেই তিনি খুশি। বললেন, ক্রমশ কাঁথার নকশায় নানারকম প্রাচুর্য দেখা দিল। পশু, পাখি, মাছ, এমনকী সিনারি পর্যন্ত আঁকা হতে লাগল রানের টানে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছল কাঁথা কাজের কদর।
কাঁথার রূপ বদল
বারো হাতের জাদুতেই কাঁথার নকশা সবচেয়ে বেশি খোলে এই ধারণা বঙ্গসমাজে সর্বত্র। কিন্তু এমন শিল্পকে কি শুধুই একটা গণ্ডিতে আটকে রাখা যায়? নাকি রাখা উচিত? শুধুই শাড়ির কবলে থাকলে বিদেশ পর্যন্ত তার মহিমা ছড়াবে কী করে? তাই খানিকটা সময়ের তাগিদে আর খানিকটা প্রয়োজনেই কাঁথা কাজকে শাড়ি ছাপিয়ে অন্যত্র নিয়ে গেলেন কাঁথা কারিগররা। আজ তাই আমরা শাড়িতে নেই। বরং কুর্তি, পাঞ্জাবি বা স্টোলে আছি। এই প্রসঙ্গে দক্ষিণাপণের খাদি ইন্ডিয়ার তরফে অশোকবাবু জানান, নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ নাগাদই এই চলটা শুরু হয়েছিল। পাঞ্জাবিতে আরও পরে। প্রথম দিকে সালোয়ার কামিজের কাট পিসে ভরাট কাঁথার নকশা থাকত। ক্রমশ তা গলার কাছে, হাতে বা কামিজের নীচের অংশে ঠাঁই পেল। এই যে কামিজের নীচের অংশে কাঁথার নকশা, তা কিন্তু অনেকটাই অবাঙালি ধাঁচে তৈরি। অর্থাৎ অবাঙালি স্টাইলে কামিজের নীচে বা দামানে কারুকাজের রেওয়াজ রয়েছে। পরবর্তীতে বাঙালি মেয়েরাও সেই স্টাইলের অনুকরণে কামিজের নীচের দিকে ভরাট কাজ করাতে শুরু করলেন। কামিজের নীচের দিকে কাঁথা কাজের কদরও তখন থেকেই বাড়তে লাগল। এছাড়া আবার ভরাট কাজের নকশা ছাড়াও রোজকার ব্যবহারের জন্য হাল্কা কাজও মনে ধরল মহিলামহলে। তখন থেকেই গলার কাছে কাঁথার কাজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখনও সিল্ক বা তসর ছাড়িয়ে সুতি পর্যন্ত পৌঁছয়নি কাঁথার নকশা। কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশের জন্য সুতির কাপড়ই শ্রেষ্ঠ। অতএব সিল্ক ছেড়ে কাঁথা কাজের সুতিতে অবতরণ।
নকশার নানা রূপ
২০০০ সাল থেকে নিজস্ব বুটিক চালান অনন্যা সিংহ। বললেন পরনে ফিউশন ওয়্যার যবে থেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তবে থেকেই কাঁথা কাজের নকশায় বদল এসেছে। নেকলাইনে ভরাট কাজ আর সারা গায়ে অল্প ফুলেল নকশা পছন্দ করছেন নব্য যুগের তরুণীরা। জিন্স বা স্ট্রেট প্যান্ট সব কিছুর সঙ্গেই এই ধরনের নকশা মানানসই। আবার লেগিংস দিয়েও পরা যায়। এই ফিউশনই কাঁথা কাজকে দোপাট্টা বা স্টোলেও নিয়ে এসেছে। উজ্জ্বল রং, ওয়েস্টার্ন লুক এইসবই স্টোলের নকশার ক্ষেত্রে বেশি মাথায় রাখা হয়। তারই সঙ্গে আবার টুকরি এমব্রয়ডারি স্টাইলও এখন কাঁথার স্টোলে ইন ফ্যাশন। অনেক রঙের কাপড় কেটে জুড়ে তৈরি এই স্টাইল। জিন্স বা লেগিংস সবেতেই দারুণ মানানসই। কাঁথা কাজ করা একেবারে এথনিক লুকের দুপাট্টাও পাবেন এখন। তবে সেগুলো মূলত ভারতীয় পোশাকের সঙ্গেই বেশি চলে। সেক্ষেত্রে মোটিফে প্রকৃতি বা ফিগার যা কিছুই থাকতে পারে। অনেক সময় আবার স্টোলের ক্ষেত্রে হাল্কা তসর রঙের কাপড়ের ওপর কনট্রাস্ট একরঙা সুতোর কাজ চোখে পড়ে। এই ধরনের স্টোল সব পোশাকের সঙ্গেই মানিয়ে যায়।
ছেলেদের ট্রেন্ডি আউটফিট
ছেলেদের জন্য ট্রেন্ডি পোশাকের খোঁজেই প্রথম কাঁথার কাজের দিকে নজর দেন সেরিনিটি বুটিকের কর্ণধার সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজে নিজস্বতাই তাঁর ইউএসপি। ডিজাইনার শর্বরী দত্তর কাজ দেখেই অনুপ্রেরণা পান সৈকত। বরাবর আঁকতে পারতেন। ফলে সেটা একটা বাড়তি প্লাস পয়েন্ট তাঁর কাজে। অভিনব নকশা, কাজের নতুনত্ব সবই নিজের আঁকার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। সামান্য একটা ফুলের মোটিফেও অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ফর্ম ব্যবহার করেন। ছেলেদেরও স্টাইলের ওপর হক আছে তাই না? সেই কথা ভেবেই সৈকতের কাঁথা কাজের সূত্রপাত। তবে ছেলেদের পোশাকে ডিজাইন করা একটু কঠিন। ফুলেল নকশা বা ফিগার কোনওটাই এক্ষেত্রে খাটে না। তাই সৈকত ঝুঁকলেন জিওমেট্রিক ডিজাইনের দিকে। তার সঙ্গে পুরনো দিনের ক্লাসিক মডেল যুক্ত হল। তাজ মহলের জাফরির নকশা বা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট প্যাটার্ন পুরুষালি পোশাকে আনল বৈচিত্র্য। গাঢ় কাপড়ের ওপর হাল্কা সুতোর রানের টানে তৈরি করেন বিচিত্র সব ছবি। সাধারণত রঙিন সুতোর উজ্জ্বল নকশা করা হয় হাল্কা রঙের ফ্যাব্রিকের ওপর। কিন্তু বেস ফ্যাব্রিকটাই যদি একটু উজ্জ্বল হয়? তাতে কি খুলবে না হাল্কা সুতো কাজ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে এই নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করলেন ডিজাইনার। পুরুষ পোশাকে অন্য লুক এল সেই এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে। আর সেই সঙ্গে ছেলেরাও হয়ে উঠল স্টাইলিশ।
পাঞ্জাবি ছাড়াও জিন্সের সঙ্গে ছেলেরা এখন শর্ট কুর্তাও পড়ছেন। এমন কুর্তায় অবশ্যই নকশার নানা ধরন লক্ষ করা যায়। কথাও শুধুই গলার কাছে কাজ থাকে, কোথায় কাজের পরিধি হাতা পর্যন্ত পৌঁছয়। সেক্ষেত্রে অনেকে আবার নেকলাইনে অল্প কাজের পাশাপাশি হাতা জুড়ে ভরাট কাজ পছন্দ করেন। তবে পুরুষালি লুক বজায় রাখতে এই ধরনের পোশাকে কাঁথা কাজের একটা প্যাটার্ন থাকে। সাইড থেকে টানা কাজ হতে পারে, ভিন্ন স্টাইলের নেকলাইনে কাজ করা থাকতে পারে। কিন্তু সারা গায়ে ভরাট কাজ এক্ষেত্রে ততটা চোখে পড়ে না।
টুকরো কাপড়ে বোনা রান সেলাইয়ের নকশা এখন শিল্পে পরিণত। অনবরত ভাবনা চলছে ডিজাইন ঘিরে। সুঁচসুতোর টানে কাঁথার নকশা তাই দেশ ছাপিয়ে বিশ্বময়।