আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
এ যেন বারো হাতের জাদু! যা গায়ে জড়ালে চেনা মুখটিও লাগে অচেনা। কখনও তাঁত, কখনও সিল্ক, কখনও নিদেন সুতি— নানা রূপে মুগ্ধ করে শাড়ি। শাড়িবিলাসী নারী তাঁর সংগ্রহ নিয়ে কিন্তু রীতিমতো খুঁতখুঁতে। পছন্দের প্রবণতা অনুযায়ী তাতে যোগ হয় ঢাকাই, বোমকাই, বালুচরি, বেনারসি বা শিফন-জর্জেট। মোদ্দা কথা শাড়ি-ভর্তি আলমারির সামনে দাঁড়ালেও যেন মনে হয় কত ভালো শাড়ি এখনও কেনা হয়নি বা পরা হয়নি! তাই না? আর তার সঙ্গেই মনে হয়, কোন শাড়ি এবার কাচতে হবে, কোনটার পালিশ লাগবে বা ড্রাই ওয়াশ। কারণ আলমারিতে ঠিক করে গুছিয়ে বা সাফসুতরো না রাখলে দামি, ভালো শাড়িও খারাপ হয়ে যেতে পারে তাড়াতাড়ি। তখন মনখারাপ না করে যত্ন নিন আগে থেকেই।
এ ব্যাপারে কথা হচ্ছিল শাড়ি সংগ্রাহক জয়িতা সেনগুপ্তর সঙ্গে। বিভিন্ন প্রদেশের শাড়ি নিয়ে তিনি কাজ করেন। শাড়ি-সমঝদার জয়িতা বললেন, ‘বেনারসি বা কাঞ্জিভরমের মতো একটু ভারী ধরনের শাড়ি আলমারিতে হ্যাঙারে না ঝুলিয়ে রাখাই ভালো। এমনি ভালো করে ভাঁজ করে কোনও তাকের ওপর তুলে যত্নে রাখুন ওদের। এর সঙ্গে সঙ্গে বছরে দু’-তিনবার আলমারি থেকে বের করে ওইসব শাড়ির ভাঁজ একটু উল্টেপাল্টে দিলে বা অল্প রোদে ফেলে রাখলে তা এ ধরনের শাড়ির জন্য স্বাস্থ্যকর।’ ভাদ্র মাসের দুপুরে রোদ্দুরে মাদুর পেতে অতীতে মা-কাকিমাদের শাড়ি বিছিয়ে দিতে দেখেছি আমরা। আজকাল ফ্ল্যাটবাড়িতে পরিসর কমেছে, ব্যস্ততাও বেড়েছে। তাই আগেকার মতো এলাহিভাবে দেওয়া না গেলেও একটু সময় হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যালকনিতে আসা অল্প রোদেই মেলে দিতে পারেন শাড়ি। রোদ লাগার পরে সেগুলো তুলে সঙ্গে সঙ্গে ভাঁজ করে আলমারিতে রাখতে যাবেন না। জয়িতা জানালেন, ঘরে সেগুলোকে এমনি ফেলে রাখুন। পুরোপুরি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় চলে এলে তারপর গুছিয়ে আলমারিতে তুলুন।
সিল্ক, কটন বা মসলিন জামদানির মতো দামি শাড়িতেও বছরে দু’তিনবার রোদ লাগাতে হবে। এগুলো হাল্কা শাড়ি, এদের হ্যাঙারে ঝোলাতে কোনও অসুবিধা নেই। তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে বলছেন জয়িতা— জামদানির সঙ্গে যেন অন্য কোনও শাড়ির ঘষা না লাগে। হ্যাঙারে রাখলেও একটু ফাঁক ফাঁক করে রাখার চেষ্টা করুন। এখন খুব ভালো ক্লথ-ব্যাগও পাওয়া যায়। কাঞ্জিভরম বা বেনারসির মতো ভারী শাড়ি এই ব্যাগে ভরে রাখতে পারেন। এতেও একটি শাড়ির জরির সঙ্গে অন্য শাড়ির জরির ঘষা লাগবে না। তাতে শাড়ি টিকবে বেশি দিন।
ধোয়াধুয়ির ক্ষেত্রে আজকাল ভালো শাড়ির জন্য একটু নির্ভরযোগ্য জায়গা থেকে ড্রাই ক্লিন বা পালিশ করিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আগেকার দিনে অনেকে একদম ঠান্ডা জলে হাল্কা বেবি শ্যাম্পু বা মাইল্ড ডিটারজেন্ট দিয়ে কাঞ্জিভরম বা ভালো সিল্ক, তসরও বাড়িতে কেচে নিতেন। তবে সেটা অবশ্যই অরিজিনাল শাড়ি হতে হবে। শাড়ির জরি বা মেটিরিয়াল যদি অরিজিনাল না হয় তাহলে জলে ধুলে শাড়ি কিন্তু নষ্ট হয়ে যাবে! কাচার পরে শাড়ির জল ঝরিয়ে শেডে শুকোতে দেওয়া হতো। কোনও ভালো শাড়িই ছাপা শাড়ির মতো নিংড়ে নেওয়ার প্রশ্ন নেই। জয়িতার বক্তব্য, তিনি নিজেও ভালো শাড়ি বাড়িতে এভাবে কেচেছেন। শাড়ি তাপ পাবে কিন্তু সরাসরি রোদ যেন না লাগে। এরপর ৭৫-৮০ শতাংশ শুকিয়ে গেলে শাড়ি তুলে ফেলতে হবে। এরপর খুব সাবধানে আয়রন করে নিতে হবে। পুরো শুকিয়ে শাড়িতে জল ছিটিয়ে ইস্ত্রি করলে জলছোপ থেকে যেতে পারে। তাই পুরো শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আয়রন করতে হবে। তবে এইভাবে যত্ন করার কাজ এত সূক্ষ্ম ও সময়সাপেক্ষ যে এখন ড্রাই ক্লিন করানোই ভালো অপশন। ড্রাই ক্লিন বেশি করালে শাড়ি খারাপ
হয়ে যায়, এটা কিন্তু ভুল ধারণা, জানালেন তিনি।
বাঁধনি বা ন্যাচারাল ডাইয়ে তৈরি শাড়ি থেকে প্রথম দু’তিনটে ওয়াশের পর রং উঠবে। কারণ এতে কোনও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। সেই ধরনের শাড়ি বরং প্রথম দিকে ১৫-২০ মিনিট একটু নুন-জলে ভিজিয়ে রাখুন। ওই শাড়িতে অতিরিক্ত যে
রং আছে, তা বেরিয়ে যাবে।
দু’তিনটে ওয়াশের পরে কিন্তু আর রং ওঠে না।
এমনিতে ভালো শাড়ি কাচার ক্ষেত্রে সবাই যেটা করে থাকেন, প্রথমবার পরলেন, রোদে মেলে রেখে দিয়ে আরও বারকয়েক পরার পরে সেটা দোকানে কাচতে দিলেন। কোভিড পরিস্থিতির পর সেই ধারণাও একটু পাল্টেছে। শাড়ি কত দ্রুত কাচা উচিত সেই প্রশ্ন উঠছে আমাদের মনে। কারণ এখন হাইজিনের কথা মাথায় রেখে আমরা সঙ্গে সঙ্গে বাইরের পোশাক কেচে ফেলছি। তাই এখন কেউ শাড়ি একবার পরে তারপরেই ড্রাই ক্লিন করিয়ে নিতে পারেন। কেউ যদি মনে করেন সেটা বারবার করা খরচসাপেক্ষ, তাহলে পরা শাড়ি রোদে দিয়ে আলাদা প্যাকেটে করে কিছু দিন বাইরে রেখে তবেই আলমারিতে তোলা উচিত।
ঘন কাঁথাকাজের শাড়ি বা জরি-ভর্তি শাড়ি কখনও যদি বাড়িতে আয়রন করেন, তাহলে শাড়িটা উল্টো করে বিছিয়ে তারপর করুন, পরামর্শ জয়িতার। তাতে শাড়ির কাজ নষ্ট হওয়ার কোনও ঝুঁকি থাকে না। অথবা সাদা পাতলা কাপড় শাড়ির উপরে পেতেও আয়রন করতে পারেন। শাড়ি কোনওভাবে ফেঁসে গেলে বা সুতো ছিঁড়ে গেলে নিজে সেলাই না করে রিফু করিয়ে নেওয়া উচিত।
সুতির শাড়িতে মাড় দেওয়া ক্ষতিকর কিনা, অনেকে বুঝতে পারেন না। জয়িতা জানালেন, বেগমপুরি বা ভালো ঢাকাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁতিরা মাড়ে ভিজিয়ে সেই সুতো বোনেন। তাই সুতোয় মাড় থাকেই। তবে শাড়িতে খুব গরম মাড় দেবেন না। ঠান্ডা করে দিন, তা না হলে শাড়ির রং জ্বলে যেতে পারে।
কয়েকটা রং যেমন ফিরোজা পিঙ্ক, ফিরোজা ব্লু, ব্ল্যাক, রেড— সুতির শাড়ি থেকে উঠে যেতে পারে। এই রংগুলোই এমন। তবে সাউথ কটনে রং ওঠে না। আরও কিছু পরামর্শ মাথায় রাখার জন্য দিলেন জয়িতা। শাড়ি-ব্লাউজে সরাসরি পারফিউম কখনওই দেবেন না। পারফিউম দেওয়া মানে ফ্যাব্রিক নষ্ট করা। হাতে সুগন্ধি লাগান। যাঁরা বেশি ঘামেন, তাঁরা পরার পরে শাড়ি অবশ্যই রোদে মেলে দেবেন। আলমারিতে ওডোনিলের মতো কিছু সুগন্ধি প্যাকেট খুলে ঝুলিয়ে দিন। তবে শাড়ির সঙ্গে সেটা যেন ঠেকে না থাকে। তাহলে রোদে দেওয়ার পরে শাড়ি আলমারিতে তুললে কোনও বাজে গন্ধ হবে না। রাখতে পারেন ভালো মানের কর্পূরও। কাপড়ের ছোট থলের মধ্যে ওই কর্পূর রেখে দিতে পারেন। শাড়িতে গন্ধ তো হবেই না, পোকাও হবে না। ন্যাপথালিন দিলেও তা কোনও কাপড়ে জড়িয়ে রাখুন। দিতে পারেন জর্দাপাতা। জর্দাপাতার উগ্র গন্ধে আলমারিতে কোনও বাজে গন্ধ হবেই না।
এসব মনে রেখে শাড়িদের আপন করে নিন, ওরা সঙ্গ দেবে বহুদিন।