প্রস্থানত্রয় বলিতে বেদ, বেদান্ত ও গীতাকে বুঝায়। বস্তুতঃ বেদ, বেদান্ত ও গীতাই মুখ্যশাস্ত্র। অন্যান্য শাস্ত্র ইহাতে প্রকাশিত সত্যেরই বিভিন্নমুখী অভিব্যক্তি। বেদ, বেদান্ত ও গীতাতেও মূলতঃ একটি তত্ত্বেরই ত্রিমুখী বিকাশ। বেদকে বলে শ্রুতি-প্রস্থান—ইহা অনাদি-সত্য। কেহ নির্ম্মাণ করে নাই, গুরু-শিষ্য-পরম্পরায় অনাদিকাল ধরিয়া শ্রুত হইয়া আসিতেছে। ইহা অনন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার। গীতাকে বলে স্মৃতি-প্রস্থান। শ্রুতির সত্যই মানবীয় জীবন-স্মৃতির মধ্যে, লৌকিক ইতিহাসের মধ্যে, কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনের মধ্যে, শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন সংবাদের মাধ্যমে প্রকটিত হইয়াছে স্মৃতি-প্রস্থান গীতাগ্রন্থে। বেদান্তসূত্রকে বলে ন্যায়-প্রস্থান। শ্রুতি ও স্মৃতির সত্যই ইহাতে ন্যায়ানুমোদিত ভাবে বাদ, বিচার ও তর্কের মাধ্যমে সুসিদ্ধান্তরূপে সংস্থাপিত হইয়াছে। যাহা শ্রুত হইয়া আসিতেছে ঋষিগুরু পরম্পরায়, দৃষ্ট হইয়াছে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের মধ্যস্থলে, তাহাই পুনরায় যুক্তিমুখে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে বেদান্তদর্শনে। এই প্রস্থানত্রয়ের সঙ্গে দেবীমাহাত্ম্য শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থের সম্বন্ধ কি, তাহাই নিবন্ধে সংক্ষেপে আলোচ্য। প্রস্থানত্রয় জ্ঞানশাস্ত্র। চণ্ডী বিজ্ঞানশাস্ত্র। জ্ঞানে বিজ্ঞানে বিরোধিতা নাই। একই সত্যানুসন্ধিৎসা ও একবাক্যতা আছে। জ্ঞানশাস্ত্রে নির্ম্মল সত্য (pure truth), বিজ্ঞানশাস্ত্রে প্রযুক্ত সত্য (applied truth)। জ্ঞানের দ্বারা আনীত সত্য, বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা স্থাপন করে। বেদাদি শাস্ত্রের মহাসত্য, চণ্ডী আধ্যাত্মিক পরীক্ষা অর্থাৎ সাধন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। বেদ, গীতার মন্ত্র ও বেদান্তের সূত্র, চণ্ডীতে মুর্ত্তি ধারণ করিয়াছে।
বেদের একটি বিখ্যাত সূক্তের প্রকট প্রতিমা দেবী দুর্গা। অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাগ্দেবী যে মন্ত্রের দর্শন করিয়া ব্রহ্মাবাদিনী ঋষি হইয়াছেন সেই দেবীসূক্তের উজ্জ্বল বিগ্রহই শ্রীশ্রীমহাদেবী চণ্ডিকা। দেবীসূক্ত ও সপ্তশতী পাঠ করিলেই উহা হৃদয়ঙ্গম হয়। দেবীসূক্ত-মধ্যেই চণ্ডীর বীজ নিহিত আছে। এই জন্যই দেবী-মাহাত্ম্য পাঠের পূর্ব্বেই দেবীসূক্ত পাঠ করিতে হয়। কেহ কেহ বলেন, দেবীসূক্ত পরে পাঠ্য। সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য দেবীসূক্ত জপ করিয়াই মায়ের অর্চ্চনা করিয়াছিলেন। ইহাতে দেবী প্রত্যক্ষ হইয়াছিলেন। দেবীসূক্তে যিনি মন্ত্ররূপা, দেবীমাহাত্ম্যে তিনি বিগ্রহরূপা। ইহা দ্বারা বেদ ও চণ্ডীর একাত্মতা প্রতিপন্ন হয়। ছান্দোগ্য উপনিষদে উক্ত হইয়াছে—
“সদেব সৌম্যেদমগ্র আসী-/ দেকমেবাদ্বিতীয়িম্।”
ব্রহ্ম বস্তু আদিতে এক এবং অদ্বিতীয় ছিলেন। পরবর্ত্তী তৃতীয় মন্ত্রে বলা হইয়াছে—“তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি।”
আমি বহু হইয়া প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব, এইরূপ ইচ্ছা করিলেন ব্রহ্ম। এক বস্তু, বহু হইলেন। কিরূপে এই ইচ্ছা পূর্ণ হইল তাহা শ্বেতাশ্বতর-শ্রুতি স্পষ্টতর করিয়া কহিয়াছেন—“য একোঽবর্ণো বহুধা শক্তিযোগাৎ।”
তিনি এক, “শক্তিযোগে” বহুরূপে হইয়াছেন। শ্বেতাশ্বতর পরবর্তী মন্ত্রে করিয়াছেন—
“পরাস্য শক্তির্বিবিধৈব শ্রূয়তে/ স্বাভাবিকী-জ্ঞান-বল-ক্রিয়া।”
সুতরাং শক্তি দ্বারাই যে তিনি বহুরূপ হইয়াছেন ইহা শ্রুতিতে সুস্পষ্ট। এই পরাশক্তি পরব্রহ্মের স্বাভাবিকী শক্তি।
মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর ‘সপ্তশতী সমন্বিত চণ্ডীচিন্তা’ থেকে