আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
তোমার মৌনে তোমার প্রচ্ছন্ন শক্তির উন্মেষ হউক, যাহা অজ্ঞাতে রহিয়া তোমাকে নিরন্তর নিঃসহায় ও অনাথ করিয়া রাখিয়াছিল, মৌনের মধ্যবর্ত্তিতায় তাহা জাগ্রত হউক এবং তোমার আত্মার চরিতার্থতায় ও ক্ষুৎ-পিপাসা-পীড়িত বিশ্ববাসীর পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তিতে সমর্পিত হউক।
আত্মসুখের জন্য বা ভোগলিপ্সু দেহের জন্য যে অন্ন গ্রহণ করিতেছি, তাহা ত’ এই দেহখানাকে আর অমর করিয়া দিতে পারে না! মৌন ভাবসাধনার দ্বারা আজ ক্ষুধার সহিত সত্য-সুন্দরের সংযোগ সাধিত হইয়া দেহ রক্ষার সাথে সাথে বিশ্বাত্মাকে পরিতুষ্ট করুক। এই দেহ যে জগতের কল্যাণকল্পে উৎসর্গ করিতে হইবে, সুখলোভী মনোবৃত্তির প্রলোভন-মুখিনী প্রবণতা হইতে সযত্নে রক্ষা করিয়া ইহাকে যে জগন্মঙ্গল যজ্ঞের আহুতি-স্বরূপে সমর্পণ করিতে হইবে, প্রতিগ্রাস অন্ন আমাকে তাহাই স্মরণ করাইয়া দেউক।
যথার্থ সাধকের কাছে মৌন কর্ম্মহীনতা নহে, ভবিষ্যৎ কর্ম্মের আয়োজন মাত্র; কর্ম্মবিরতি নহে, আরম্ভ মাত্র। তপশ্চরীর সন্নিবিষ্ট মনঃশক্তি তখন প্রতি মরমীর মর্ম্মে আঘাত করে এবং অনুভূতির অজ্ঞাতসারে তাহাকে প্রকৃত কর্ম্মপথবর্ত্তী করে। যাহারা প্রেম থাকা সত্ত্বেও পথ চিনিতে ছিল না, তাহারা তখন মৌনীর অনাহত উপদেশে পথ বাছিয়া লয়। আর, যাহারা কল্যাণকে চাহিত না, অকল্যাণের নরককুণ্ডকেই স্বর্গসুখ ভাবিয়া অনির্দ্দেশ পতনের পথে ছুটিয়াছিল, তাহারা কুশলের অভাব অনুভব করে, হৃদয়ের গোপনতম প্রদেশে নিবিড়তম বেদনা উপলব্ধি করিয়া চমকিয়া উঠি। তোমার মৌন তেমন মৌন হউক, তাহা হইলেই উহা যাবচ্চন্দ্র-দিবাকর শ্রদ্ধায় অভিসিঞ্চিত হইবে।
স্নেহের—, ... সুখসেব্য সৌভাগ্য লইয়া জীবনের অমূল্য দিনগুলি কাটাইয়া দিতে পারে শুধু অলসেরা। ভগবানের কাজ গুরুভার হইয়া যাঁহাদের স্কন্ধের উপরে নিপতিত হইয়াছে, তাঁহারা দুঃসহ দুখকেই ভগবানের দয়ার দান জানিয়া অকম্পিত অন্তরে দাবানলের মাঝে ঝাঁপাইয়া পড়ে। জগতে মানুষ বলিয়া যাঁহারা পরিচয় দিতে চাহেন, বক্ষে-পৃষ্ঠে কীট-পতঙ্গের পরিচয় আঁকিতে যাঁহারা কুণ্ঠায় নতশির হন, চিরকাল তাঁহারা মরণকে পদদলিত করিয়াছেন। বিলাস-ব্যসনের মায়া-মরীচিকায় না ভুলিয়া গহন পথের অসহন দুঃখকে সোনার সোহাগা বলিয়া তাঁহারা মানিয়া লইয়াছেন। মান-সম্ভ্রম, লোক-লৌকিকতা, ইষ্টনিষ্ট, নিন্দাযশ প্রভৃতিকে সমজ্ঞান করিয়া বিজয়ী সেনাদলের ন্যায় সদর্পে শল্য-শূল-সমাকীর্ণ সমাজ-প্রান্তরের বক্ষের উপর দিয়া পদক্ষেপ করিয়া তাঁহারা চলিয়া গিয়াছেন। বিবেকের অনুশাসনকে মান্য করিতে যাইয়া প্রয়োজন স্থলে তাঁহারা মানুষের গড়া স্মৃতিশাস্ত্র আর মানুষের গড়া দণ্ডবিধি-আইন উভয়ই অবহেলে অগ্রাহ্য করিয়াছেন। যথার্থ একটি মানুষ যে, সে সহস্র-কোটি অভিনেতার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং শক্তিমান্, তাঁহার জীবন প্রতি পদক্ষেপে একমাত্র তাহারই প্রমাণ।
নিজের জীবনের আলোক-সামান্য মহত্ত্বের বৈচিত্র্য দিয়া যদি মানুষ-নামের গৌরব বাড়াইয়া দিয়া যাইতে না পারিলে, তবে আর তোমাকে বড় বলিব কেন? মানুষ বলিয়া পরিচয় দেওয়া এক কথা, আর, মানুষ-নামের গৌরব বাড়ান আর এক কথা।
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের ‘আপনার জন’ থেকে