উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
বাউলগণ নিজেদের ‘সহজিয়া বৈষ্ণব’ নামে পরিচয় দিয়ে থাকেন। বাউলগণ কোন সাম্প্রদায়িক মতবাদ স্বীকার করেন না। সহজিয়া বাউলগণ নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক সহজ পথের পথিক নামে আখ্যাত করেন এবং তাদের সাধনাকে রসসাধনা ও নিজেদেরকে রসিক নামেও পরিচয় প্রদান করে থাকেন।
বৈদিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত যে সমস্ত বৈষ্ণব মতবাদগুলি প্রচলিত আছে- যথাত্রূমে গৌড়ীয়, বল্লভ, নিম্বার্ক, শ্রী এবং মধ্ব-এই মতবাদগুলির সঙ্গে সহজিয়া বাউলদের মতের পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
সহজিয়া বাউলগণ বলে থাকেন- যা বৈদিক সম্প্রদায়ের অনুগত সাধনা তা হল সাম্প্রদায়িক সাধনা।
রসিকগণ বলেন বেদাদি শাস্ত্রে কেবল রসতত্ত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যথাঃ-
‘রসো বৈ সঃ।
রসং হ্যেবায়ং লবধ্বানন্দী ভবতি।
কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণাৎ
যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ
এষ হ্যেবানন্দয়াতি।’
কিন্তু রসতত্ত্বের সাধনা বেদে স্পষ্টতঃ উল্লিখিত বা নির্দিষ্ট নেই। এই রসতত্ত্ব হল অতি গুহ্য বিষয়। কেবলমাত্র ভগবৎ কৃপা এবং গুরুকৃপাবলে এটা অবগত হওয়া যায়। এই রস- সাধনারই নামান্তর বাউলদের সহজ সাধনা।
সহজিয়া বাউল্গণ বলেন- এই সাধনা সাধারণ মানবের পক্ষে উপযোগী নয়। সদগুরুর পরামর্শে এবং তাঁর নির্দেশিত পথে যোগের অভ্যাস দ্বারা পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়জয় সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রস- সাধনায় অধিকার লাভ করা যায় না। ইন্দ্রিয়বিজয়ী রসিকগণেরই কেবলমাত্র রস- সাধনায় জন্মে।
বৈদিক শাস্ত্রাদিতে রসতত্ত্বের বা সহজিয়া তত্ত্বের সাধনার কোন স্পষ্টতঃ উল্লেখ না থাকায় সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবমতগুলিতে এই রসতত্ত্ব বা সহজ সাধনা প্রচলিত নেই। আর যদিও থাকে, তাহলে তা প্রকাশ্যভাবে নেই গুপ্তভাবে থাকলেও থাকতে পারে। সেই হেতু সহজিয়া বাউলগণ নিজেদের অসাপ্রদায়িক বলে অভিহিত করেন।
এই সহজিয়া বাউলগণ ভক্তি ও প্রেমতত্ত্বকে যতটা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, অন্যত্র প্রেমভক্তির ঠিক ততটা বিশ্লেষণ দেখতে পাওয়া যায় না।
সহজিয়া বাউলদের উৎপত্তি বিষয়ে নানাজনের নানারকম মতবাদ প্রচলিত আছে। কেহ কেহ বলেন বৌদ্ধ বজ্রযান, সহজযান এবং হিন্দুতন্ত্রের সংমিশ্রণ-ধারা হতে এঁদের উৎপত্তি। কিন্তু বৌদ্ধ বজ্রযান, সহজযান এবং তন্ত্রের ধারা সংমিশ্রিত হয়ে কিভাবে তা সহজ সিদ্ধান্তরূপে আবির্ভূত হল- তা ঐতিহাসিক আলোচনা এবং পর্যবেক্ষণ-সাপেক্ষ বিষয়। সুতরাং এখানে সেই বিষয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন বা নিরর্থক।তবুও এটা নিশ্চিত যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবকালের পূর্বেও সহজিয়া সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল এবং তা যথেষ্ট প্রমাণসিদ্ধ।
যেমন-উল্লেখযোগ্যরূপে জয়দেব, বিল্বমঙ্গল, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস প্রভৃতি সহজিয়া বৈষ্ণবগণ বিদ্যমান ছিলেন। তাহলেও একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়—শ্রীমন্মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরবর্তী কাল হতে এই মতবাদের যথেষ্ট পুষ্টি তথা বিকাশ সম্ভব হয়েছিল, এমনকি এই মতবাদের পূর্ণ বিকাশও সম্ভব হয়েছিল। সহজিয়া বাউলদের ভিতর এইরূপ ধারণা প্রচলিত আছে যে- শ্রীমন্মহাপ্রভু-পার্ষদ স্বরূপ দামোদর গোস্বামী হলেন এই মতের আদি গুরু। তাঁর নিকট হতে শ্রীরূপ গোস্বামী রসতত্ত্ব এবং সহজ সাধনার রহস্য অবগত হয়েছিলেন। তাঁর পর যথাত্রূমে শ্রীরঘুনাথ গোস্বামী, শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ এবং সিদ্ধ মুকুন্দদেব গোস্বামী এই রসতত্ত্ব ও সহজ সাধনার রহস্য জ্ঞাত হয়েছিলেন।