কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
মঞ্চের বিশাল পর্দা সরছে। মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন ফোকলা চ্যাটার্জি। আলো এসে পড়েছে ফোকলা চ্যাটার্জির মুখে। আবছা আলোতে মঞ্চটাও দেখা যাচ্ছে। শাজাহান হোটেলের রিসেপশন কাউন্টার ডানদিকে। বাঁদিকে রয়েছে লিফট। ফোকলা চ্যাটার্জি উচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন; ‘স্যাটা হোয়্যারইজ স্যাটা’। আলো এসে পড়ত গেটের দিকে। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেন স্যাটা বোস। বললেন; ‘আই অ্যাম হিয়ার স্যার।’ সবাই অর্থাৎ দর্শকেরা পেছনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখতেন স্যাটা বোসের প্রবেশ। স্যাটা বোস ততক্ষণে একস্ট্রা সিটের দর্শকের গা ঘেঁষে, কারও বা পিঠ চাপাড়িয়ে ‘হাউ আর ইউ স্যার’ বলে স্টেজে এসে উঠতেন। উচ্ছ্বসিত হাততালিতে হল ফেটে পড়ত। যে নাটকের শুরুতেই এমন উত্তেজনার পারদ, সেই নাটকের নাম ‘চৌরঙ্গী’। কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার সর্বকালীন বেস্ট সেলার উপন্যাস শংকরের ‘চৌরঙ্গী’। তারই নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হচ্ছে বিশ্বরূপা থিয়েটারে (বটতলা থানার ঠিক পাশেই এ মঞ্চ ছিল)। এই নাটকেই প্রথম সাড়ম্বরে বিকাশ রায় অভিনয় করতে এলেন স্যাটা বোসের চরিত্রে। পাশে পেলেন তরুণকুমার (ফোকলা চ্যাটার্জি), মঞ্জু দে (মিসেস পাকড়াশি) দিলীপ রায় (শংকর), সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় (ন্যাটাহরি), জয়শ্রী সেন প্রমুখ শিল্পীকে। পরে কবরী চরিত্রে এলেন আরতি ভট্টাচার্য। বিপরীতে অজয় গঙ্গোপাধ্যায় (অনিন্দ্য)। প্রথমে যখন এ নাটকে অভিনয়ের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয় বিকাশ রায়ের সঙ্গে, তখন তিনি সম্মত হননি। কারণ যে চরিত্র উত্তমকুমার করে রেখে গেছেন বড় পর্দায়, সে চরিত্রে স্টেজে করতে মন থেকে সায় পাচ্ছিলেন না বিকাশ রায়। কিন্তু বিশ্বরূপার মালিক রাসবিহারী সরকারও নাছোড়বান্দা। তিনি গেলেন বিকাশ রায়ের ঢাকুরিয়ার বাড়িতে। পার্ট শোনালেন। যথোচিত মর্যাদা দিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। আর আপত্তি রইল না বিকাশ রায়ের। সামান্য ক’দিনের রিহার্সাল হল। এর আগে বিশ্বরূপায় ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ বা ‘ঘর’ একদম জমেনি। ‘কোথায় পাবো তারে’ একদম চলেনি। তাই সকলের উৎকণ্ঠা। ‘চৌরঙ্গী’ জমবে তো? পুজোর ঠিক আগেই শুরু হল ‘চৌরঙ্গী’ নাটক। প্রথম থেকেই হাউসফুল। সিনেমার এতগুলি শিল্পীকে চোখের সামনে দেখার আনন্দই তো আলাদা। প্রথম ক’দিন বিকাশবাবু খুব ঘাবড়ে ছিলেন, কণ্ঠস্বর যেন শেষের দিকে ঠিক পৌঁছচ্ছে না। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় পরামর্শ দিলেন, ‘হোটেলের কাউন্টার অংশ থেকে বেরিয়ে আসুন দাদা, কণ্ঠস্বরের আর অসুবিধা হবে না।’ তরুণ কুমার রাসবিহারী সরকারকে পরামর্শ দিলেন, ‘বিকাশদা প্রথম স্টেজে নামছেন। ওঁর প্রথম প্রবেশ দর্শকদের মধ্যে দিয়ে হোক।’ গোড়াতে যে দৃশ্যের বর্ণনা করলাম, সেই ভাবেই বিকাশ রায়ের প্রবেশ ঘটলও স্টেজে। নগদ বিদায়ও পেতেন দর্শকদের কাছ থেকে। ভালো লাগলে উচ্ছ্বসিত আবার যদি কোনওদিন পছন্দ মতো না হতো তাহলে ধমকও খেতেন দর্শকদের কাছ থেকে, ‘কী হচ্ছে কী?’ ১৯৭১ সালের শেষে এবং ১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে সবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, বড় বড় গাড়ি করে, এমনকী বাস ভরে বাংলাদেশিরা আসতেন যশোর সীমান্ত পেরিয়ে নাটক দেখতে—পুরনো আমলের শিল্পীদের দেখতে। ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে বিকাশ রায়ের খুবই ভালো লাগত।
হঠাৎ একদিন বিশ্বরূপার কর্ণধার রাসবিহারী সরকার ঘোষণা করলেন যে তিনি এবার নাটক বদলাবেন। বিকাশ রায় সহ সব শিল্পীরা হতবাক। তখন রমরমিয়ে চলছে ‘চৌরঙ্গী’। সেই অবস্থায় উঠিয়ে দেবার মানে বুঝতে পারলেন না কেউ। রাসবিহারীবাবু জানালেন চলতি নাটক উঠিয়ে দেবারও প্রয়োজন হয়, এছাড়া উনি একটা নজির স্থাপন করতে চাইছেন। প্রায় সাড়ে পাঁচশো রজনী চলল ‘চৌরঙ্গী’। নতুন নাটকের মহড়া শুরু হল। এবারের উপন্যাস ‘আসামী হাজির।’ বিমল মিত্রের সাড়া জাগানো কাহিনী। যথারীতি নাট্যরূপ ও নির্দেশনার রাসবিহারী সরকার। বিকাশ রায় রইলেন। মঞ্জু দে, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় গোড়া থেকেই বাদ। তরুণ কুমার, দিলীপ রায়, আরতি ভট্টাচার্য রইলেন। নতুন ঢুকলেন পাহাড়ি সান্যাল। প্রায় আটষট্টি বছর বয়সে স্টেজে অভিনয় করতে নামলেন পাহাড়ি সান্যাল। তিন বুড়ো (বিকাশ রায়, পাহাড়ি সান্যাল, রবীন মজুমদার) উইংস-এর পাশের বড় বেঞ্চে বসে জমিয়ে আড্ডা দিতেন। খোশ গল্প চলত। ভালোই চলছিল। হঠাৎ পাহাড়ি সান্যাল মারা গেলেন। আনন্দের হাট ভাঙল বিকাশ রায়ের। এ নাটক চলেছিল ৬৩৭ রজনী। সেই অবস্থায় নাটক বন্ধ করলেন রাসবিহারী সরকার। তখনও বিশ্বরূপার বাইরে ৭ টাকার টিকিট ১৫ টাকায় ব্ল্যাকে বিক্রি হচ্ছিল।
বিকাশ রায় এরপরে এলেন শ্যামাপ্রসাদ মঞ্চে। অধিকাংশ নাট্যমোদীরা এ মঞ্চের নামই হয়তো শোনেননি। বিকাশ রায় নিজেই তার বর্ণনা দিয়েছেন, ‘টালাপুলের পশ্চিম দিকে বস্তিটস্তির মধ্যে বিচ্ছিরি রাস্তা, রেল ইয়ার্ড, কাঁচা কয়লার ধোঁয়া, সন্ধ্যার পর যেতে গা ছমছম করে, বৃষ্টিতে রাস্তা তো ডুবে যায়ই হলের মধ্যেও জল ঢোকে। ছোট্ট একটি হল— রেলওয়ে ইনস্টিটিউট। শ’আড়াই লোককে কষ্টে বসানো যায়।’ এমন এক স্টেজে বিকাশ রায় করতে এলেন ‘বিষ’ নাটক। নাট্যকার সমর মুখার্জির লেখা নাটক, তাঁরই পরিচালনা। সঙ্গে অভিনয়ে ছিলেন মলিনা দেবী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত, অঞ্জনা ভৌমিক। ১৬০ রজনীর পর বিকাশ রায় নিজেই বিদায় নিলেন।
তরুণকুমার ও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বরাবর ভালো সম্পর্ক বিকাশ রায়ের। ‘চৌরঙ্গী’র সময়েই তাঁরা বিকাশবাবুকে বলেছিলেন, ‘আপনার কাছ থেকে আলাদা থাকতে ইচ্ছে করছে না দাদা। যদি সুযোগ পাই আপনাকে ডাকব, কথা দিন আসবেন।’ সে কথা বিকাশ রায় রেখেছিলেন। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও তরুণকুমার দক্ষিণ কলকাতার সদানন্দ রোডে তপন থিয়েটার ভাড়া নিয়ে শুরু করলেন ‘নহবৎ’ নাটক। সে নাটক রঙমহলে জমল না, সে নাটক তপন থিয়েটারে এ ইতিহাস তৈরি করল। এঁরা তিনজন ছাড়াও ছিলেন রত্ন ঘোষাল, প্রদীপ মুখোপাধ্যায় আর কিছুদিনের জন্য মহুয়া রায়চৌধুরী।
তবে এ সব অভিনয় নিয়মিত করতে করতে বিকাশ রায়ের আর ভালো লাগল না। বেরিয়ে এলেন নিজেই ‘নহবৎ’ ছেড়ে। কিছুদিন শ্রুতিনাটক পরিচালনা করলেন। তার মধ্যে একটি হল রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’। অমিতের চরিত্রে নিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে, লাবণ্যের ভূমিকায় লিলি চক্রবর্তী, কেটির চরিত্রে শ্রাবন্তী মজুমদার আর যোগমায়ার চরিত্রে নীলিমা দাস। এখানে তিনি নির্দেশক। নাট্যরূপ তাঁরই দেওয়া। প্রথম মঞ্চস্থ হল রবীন্দ্র সদনে। তারপর বহু জায়গায়। এর অডিও ক্যাসেটও বেরিয়েছে এইচ.এম.ভি’র তরফ থেকে।
পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে আসার আগে নামীদামি শিল্পীদের নিয়ে কম্বিনেশন নাটকে অংশ নিয়েছিলেন বিকাশ রায়। রঙমহল থিয়েটারে ‘পথের দাবী’ নাটকে অপূর্ব’র চরিত্রে। তাবড় তাবড় শিল্পী। ছবি বিশ্বাস, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, কমল মিত্র, ধীরাজ ভট্টাচার্য, হরিধন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ধীরাজ ভট্টাচার্য তলওয়ারকার-এর চরিত্রে। হরিধনবাবু তেওয়ারির চরিত্রে। ধীরাজবাবু লাইটসম্যানকে বলে রেখেছিলেন যে, দৃশ্যে সমস্ত আলোর ফোকাস যেন তাঁর মুখের উপরেই থাকে। লাইটসম্যান তাই করলেন, বিকাশবাবু ও হরিধনবাবু আছেন ফোকাসের বাইরে। দেখা গেল দর্শকেরা হাসতে শুরু করেছেন। ক্রমশ হাসিটা বাড়ছে। অল্প আলোতে বিকাশবাবু দেখলেন হরিধনবাবু নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে গঙ্গাজল ছেটাচ্ছেন। সিনের বারোটা বেজে গেছে। ছবি বিশ্বাসের কাছে ধীরাজবাবু নালিশ জানালেন। ছবি বিশ্বাসের গম্ভীর মুখ, তিনি বিচারক। তিনি হরিধনবাবুর কৈফিয়ত চাইলেন। হরিধনবাবু বললেন, ‘আমি তো ধীরাজবাবুর ফোকাসের বাইরে ছিলাম। আর আমার চরিত্রের যা করা উচিত তাই তো করব।’ ছবিবাবু বললেন, ‘ঠিক। তবে হরিধন, এবার থেকে আর অতটা জল ছিটিও না।’ ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল ছবি বিশ্বাসের এই বিচারে।
একবার ‘বিষ’ নাটকের অভিনয় করতে কলকাতার বাইরে গেছেন বিকাশবাবুরা। পেল্লায় বড় প্যান্ডেল পনের হাজার লোক বসার মতো। তারই পিছনে এক প্রাইমারি স্কুলের বাড়ি নেওয়া হয়েছিল শিল্পীদের জন্য। দুপুরে একটু বিশ্রাম করবেন। হঠাৎ একদঙ্গল মেয়ে এসে হাজির সেখানে। বিরক্ত হয়ে বিকাশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার? তোমরা কারা?’ একটি মেয়ে এসে বললে, ‘আমি বাংলার টিচার আর এরা সব ছাত্রী। শুনেছি আপনারা, বড় বড় আর্টিস্টরা মফঃসস্লে প্লে করতে এসে খুব ফাঁকি দেন। আপনাদের এই নাটক কলকাতায় আমি দেখে এসেছি। বাদটাদ দেবেন না যেন। আমরা সামনেই থাকব।’ ঘুম মাথায় উঠল। পার্ট মুখস্থ করতে বসে গেলেন বিকাশ রায়। সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী নট প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বন্ধুদের ডেকে অভিনয় জীবনের অবসরের কথা ঘোষণা করেছিলেন ১৯৮৭ সালের ১৬ এপ্রিল।