নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি: ‘হিন্দুত্ব খতরে মে হ্যায়’—এই সতর্কবার্তা সরাসরি তাঁর মুখে শোনা যায়নি বহুদিন। উত্তর ভারতের পর ক্রমে দক্ষিণেও বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের ভোট রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়েছে হিন্দুত্ব। সেই তুলনায় ব্যতিক্রমী ছিল উপজাতি প্রভাবিত অরণ্য এবং দারিদ্র্যসঙ্কুল ঝাড়খণ্ড। সেখানে ধর্মের তুলনায় এতদিন রোটি, কাপড়া, মকান কিংবা বিজলি, পানি, সড়কই ছিল আদিবাসী নাগরিকদের চাহিদার অগ্রাধিকার। কিন্তু এবার বিধানসভা ভোটের আগে সেই উন্নয়নকে পিছনের সারিতে রেখে বিজেপির ভোটপ্রচারে প্রধান স্থান করে নিল হিন্দুত্ব। সেই প্রচার কৌশলের সেনাপতি হয়ে উঠলেন নরেন্দ্র মোদি। সোমবার ঝাড়খণ্ডের গাড়ওয়া জেলায় প্রচারে এসে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হিন্দুত্বকেই পাখির চোখ করলেন নিজের ভাষণে। বাংলার সঙ্গে ঝাড়খণ্ডকে একসারিতে বসালেন কংগ্রেস, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের জোটকে। সরাসরি চোখ রাঙালেন— ‘এরা ‘ঘুসপেটিয়া’ বা অনুপ্রবেশকারীদের জোট। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা এই রাজ্যকে গ্রাস করে নিয়েছে।’ কিন্তু ভোটপ্রচারে উন্নয়নের বদলে কেন হঠাৎ এমন উগ্র হিন্দুত্বের ফিরলেন মোদি? কারণ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) কড়া নির্দেশ। অমিত শাহের মতো প্রধানমন্ত্রীও সেই নির্দেশ শিরোধার্য করেছেন বলেই দৃঢ় বিশ্বাস রাজনৈতিক মহলের।
এদিন হাই ভোল্টেজ বক্তৃতায় মোদি বললেন, যখন স্কুলে সরস্বতী বন্দনা বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেটা কীসের বার্তা? সেটা থেকেই স্পষ্ট যে বিপদ সাংঘাতিক পর্যায়ে এসেছে। যখন দুর্গা পুজো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার অর্থ কী? অর্থ হল, ‘খতরা’ মারাত্মক। যখন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ঝাড়খণ্ডের মেয়েদের বহিরাগতরা বিয়ে করে নিচ্ছে, তার অর্থ হল, বিপদের জল এবার মাথার উপর দিয়ে বইছে। এই ‘খতরা’কে খতম করতে হবে। লোকসভা ভোটে গরিষ্ঠতা হারানোর পর থেকেই বিজেপির দিশা নির্দেশক হয়ে আরএসএস। জানা গিয়েছে, সঙ্ঘের পক্ষ থেকে মোদির বিজেপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে— উন্নয়ন কিংবা সব কা সাথ সব কা বিশ্বাসের স্লোগান যতই থাকুক, হিন্দুত্বকে সরিয়ে রাখলে চলবে না। বরং বিজেপি যেন আবার নিজের রাজনীতির চালিকাশক্তি হিন্দুত্বকেই করে। সেইমতো ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র এবং তাবৎ উপ নির্বাচনের প্রচার করতে হবে। এদিন মোদির উচ্চগ্রামের হিন্দুত্ব ভাষণ শুনে রাজনৈতিক মহল নিশ্চিত যে, সঙ্ঘের আদেশই অক্ষরে অক্ষরে মানতে শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ, লাভ জিহাদ এবং হিন্দুত্ব খতরে মে হ্যায়ের মতো সঙ্ঘ তথা বিজেপির নিজস্ব এজেন্ডাকেই আবার নিয়ে আসা হচ্ছে প্রচারের ফোকাসে।
লোকসভা ভোটের আগে সংসদে এবং ভোটপ্রচারে মোদির প্রিয় ভাষণ ছিল, নিজেকে ঈশ্বরপ্রেরিত দূত বলা। কিন্তু লোকসভা ভোটে ৪০০ আসন স্পর্শ করতে না পারার ধাক্কায় বেশ কিছু মাস সেই আত্মপ্রচার থেকে বিরত ছিলেন তিনি। কিন্তু এদিন আর সংযম বাঁধ মানেনি। তিনি বললেন, ‘যত ভালো ভালো কাজ আছে, যত বড় বড় কর্মসূচি আছে, সব আমার জন্যই যেন নির্ধারিত। সব উন্নত কাজ করাই আমার ভাগ্যে রয়েছে। অবিরত করে চলেছি।’ মোদি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির সুফল ঝাড়খণ্ড সরকার মানুষকে দিচ্ছে না। তাই একমাত্র সমাধান আবার বিজেপি সরকার।
ঝাড়খণ্ডে যে হিন্দুত্বকেই ভোটপ্রচারের অভিমুখ করা হচ্ছে, সেটা কিছুদিন ধরেই প্রকট। কারণ, প্রচারে সবথেকে বেশি আসছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা, যোগী আদিত্যনাথদের মতো হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’রা। এদিনও মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব প্রচারে এসে বলেছেন, সনাতন ধর্মকে রক্ষা করতেই হবে। আবার মোদির ভাষণ জুড়েও সতর্কবার্তা, হিন্দুত্বের বিপদ বাড়ছে। বিরোধীদের প্রশ্ন, ১০ বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন মোদি। তাহলে এখন হিন্দুত্ব ‘খতরে মে’ কেন?