নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া: দেবী কৃষ্ণবর্ণা। তাঁর মাথার উপর চক্রস্তম্ভ। নীচে পরীদের মূর্তি। দেবীমূর্তির বয়স প্রায় দু’হাজার বছর বলে অনুমান ইতিহাসবিদদের। এহেন প্রাচীন দুর্গাকে বিদায়ের সময় সময়ে পোড়া চ্যাংমাছ খাওয়ানো হয়।
পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় ৩০কিলোমিটার দূরে আড়ষা ও জয়পুর ব্লকের সীমানা দেউলঘাটায় কংসাবতী নদীর তীরে দু’টি সুপ্রাচীন মন্দির জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও একটি মন্দির ছিল। তবে সংরক্ষণের অভাবে প্রায় দু’ দশক আগে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপ। মন্দিরের গায়ে রয়েছে অসাধারণ পাথরে খোদাই ভাস্কর্য। মন্দিরের দরজা ত্রিভুজাকৃতি। সেখানেই অধিষ্টিত কালো পাথরে খোদিত দেবী দশভুজা। দেবী মূর্তির মাথার উপর রয়েছে চক্রস্তম্ভ। পায়ের তলায় আছে পরীদের মূর্তি। মায়ের দু’পাশে রয়েছে অষ্ট মাতৃকা রূপ। তবে প্রচলিত দুর্গা প্রতিমায় যেমন দেবীর ডান পা সিংহের উপর ও বাঁ পা মহিষের উপর দেখা যায়, এই মূর্তির ক্ষেত্রে তা বিপরীত। দেবীর সঙ্গে নেই তাঁর সন্তানেরা।
তবে, মন্দিরে এখনও নিয়ম মেনে করা হয় নিত্যপুজো। প্রতি সোমবার আশেপাশের বহু মানুষ পুজো দিতে আসেন। দুর্গাপুজোর চারদিন থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। প্রথা মেনেই মহালয়ার দিন থেকে চণ্ডীপাঠ দিয়ে শুরু হয় পুজো। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে হয় ছাগবলি। পুজোর দায়িত্ব পালন করেন মন্দিরের অদূরের বসবাসকারী রাজপুত পরিবার। সেই পরিবারের সদস্য ষাটোর্ধ্ব ভুবন সিংহ এখনও মন্দির আগলে বসে থাকেন। তিনি বলেন, বংশ পরম্পরায় আমরাই পুজোর দায়িত্ব পালন করে আসছি। সপ্তমী, অষ্টমীতে একটি করে ছাগবলি হলেও নবমীতে প্রচুর ছাগবলি হয়। বহু মানুষের মানসিক থাকে। পুজো দেখতে ভিড় জমান বহু মানুষ। দশমীর দিন ঘট বিসর্জন হয়। মাকে চিড়ে, দই, গুড় সঙ্গে পোড়া চ্যাংমাছ খাইয়ে বিদায় দেওয়া হয়।
তবে, এই মন্দিরে পাথরে খোদিত দশভুজার মূর্তি ছাড়াও আরও অনেক দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। যেমন, পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে থাকা চার ফুট উচ্চতার চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি, সিংহের পিঠে দণ্ডায়মান চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি, আট হাতের রণচণ্ডী দেবীমূর্তি, তিন ফুট উচ্চতার গণেশ মূর্তি, ভগ্ন ধ্যানমগ্ন মূর্তি, শিবলিঙ্গ ইত্যাদি। বহু মূর্তি চুরিও গিয়েছে। শোনা যায়, মন্দির থাকলেও আগে নাকি মাতৃমূর্তি ছিল গাছের তলায়। সেখানেই হতো পুজো। রোদ জলে মূর্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে বিগ্রহ স্থাপন করা হয় মন্দিরের ভিতরে। তবে, এই মন্দির কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, এইসব মূর্তিই বা কত বছর পুরনো সেনিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, দশভুজা মূর্তিটি আজ থেকে দু’-আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো বৌদ্ধ যুগের। মন্দিরের গঠন, মূর্তির কারুকাজে রয়েছে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছাপ। আবার ভিন্নমতে, এসবই জৈন সংস্কৃতির। পরে ব্রাহ্মণদের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এনিয়ে বিতর্ক বিতর্ক চললেও এটি স্পষ্ট যে, প্রাচীনকাল থেকেই দুর্গার উপাসনা হয়ে আসছে। প্রসঙ্গত, দেউলঘাটা নামটি এসেছে দুটি শব্দ ‘দেউল’ অর্থাৎ মন্দির এবং ‘ঘাট’ অর্থাৎ কাঁসাই নদীঘাট থেকে। জনশ্রুতি, প্রাচীন সময়ে তাম্রলিপ্তের (বর্তমান তমলুক) বণিকরা ঝাড়খণ্ডে যেতেন বাণিজ্য করতে। তখন কংসাবতী নদীর ঘাটে নৌকা রেখে তাঁরা এই মন্দিরে পুজো দিতেন। কাঁসাই নদী তীরবর্তী মানভূম-পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ছোটনাগপুরের কমিশনার এডওয়ার্ড টুইট ডাল্টন। এনিয়ে ১৮৬৪-৬৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তিনি ‘নোটস অন অ্যা ট্যুর ইন মানভূম’ প্রবন্ধ রচনা করেন। ডালটনের এই প্রবন্ধেই সর্বপ্রথম দেউলঘাটা মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। স্থানীয়দের দাবি, অবলম্বে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুক সরকার। নিজস্ব চিত্র