প্রচ্ছদ নিবন্ধ

নবজাগরণের নবদূত
পূর্বা সেনগুপ্ত

শেষ শয্যায় শায়িত তথাগত বুদ্ধ। চারিদিকে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন অন্তরঙ্গ স্থবিরগণ। আকাশ-বাতাসে গুমোট ভাব। তথাগত যেখান থেকে এসেছিলেন, ফিরে যাচ্ছেন সেই লোকে। তাঁর বিরহ কেমন করে সহ্য করবেন, সেই চিন্তায় সর্বাধিক অন্তরঙ্গ শিষ্য আনন্দের চোখে জল। তা দেখে বুদ্ধ বলে উঠলেন, ‘হে আনন্দ তুমি কাঁদছ? কেঁদো না আনন্দ, তোমরা প্রদীপ হয়ে জ্বলে ওঠ। আত্মদীপ ভব।’ ঠিক এরকম ১৩ জন অন্তরঙ্গ শিষ্যের মধ্যে নিজের আধ্যাত্মিক ভাবনাকে রোপন করেছিলেন বেথলেহেমের যিশু। দুই ধর্মচিন্তা রূপ নিয়েছিল ধর্ম আন্দোলনের। পৃথিবীর ইতিহাসে ঠিক এভাবেই ধর্মাচার্যগণ অন্তরঙ্গ শিষ্য ও ভিক্ষুদের মাধ্যমে নিজের অর্জিত আধ্যাত্মিক সম্পদকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্যতিক্রম নন শ্রীরামকৃষ্ণও। নরেন্দ্রনাথ দত্তকে মাথার মণি করে, তাঁর উপর সঙ্ঘ নির্মাণের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিহাস আসলে স্বামী  বিবেকানন্দের নেতৃত্বে কয়েকজন সন্ন্যাসীর আত্মত্যাগের ইতিহাস।
এর সূচনা অবশ্য হয়েছিল
শ্রীরামকৃষ্ণ জীবিত থাকাকালীন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে আর থাকতে পারলেন না তিনি। কর্কট ব্যাধি ক্রমশ শরীরকে দুর্বল করছে। ভক্তগণ ঠিক করলেন, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের 
স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া থেকে একটু শুষ্ক স্থানে এনে রাখলে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। তাই প্রথমে 
বাগবাজারের কাছে শ্যামপুকুরে, পরে কলকাতার উপকণ্ঠে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে নিয়ে আসা হল তাঁকে। এখানেই সঙ্ঘ গঠনকে তরান্বিত করতে চাইলেন যুগপুরুষ। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে অনুরাগী ভক্তেরা পরস্পরের পরিচিত হলেও একত্র বাস তাঁদের একে অপরের কাছাকাছি এনে দিল। আর অবতারের কি ক্যান্সার হয়? এই দ্বন্দ্বে অবিশ্বাসী ভক্তগণ কিছু দূরত্বে চলে গেলেন। চিহ্নিত হলেন অন্তরঙ্গ ভক্তগণ। প্রতিটি অবতারেই আমরা দু’ধরনের অন্তরঙ্গ ভক্তের দেখা পাই।  গৃহী আর ত্যাগী। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী অন্তরঙ্গদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন  সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। গিরীশ ঘোষ, বলরাম বসু, কথামৃত রচনাকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, রামচন্দ্র দত্ত, নবগোপাল ঘোষ, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ। ত্যাগী ভক্তগণ তখনও যুবক। অন্তর গেরুয়া রঙে রঞ্জিত হলেও বাইরের সন্ন্যাস নেওয়া হয়নি। তাঁদের নেতা নরেন্দ্রনাথ। আছেন শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র রাখাল আরও অনেকে। নরেন্দ্রনাথ বুঝতে পারছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ আর বেশিদিন এ জগতে বিচরণ করবেন না। তাই তাঁর দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। একদিকে পিতার মৃত্যুর পর বাড়িতে অভাব। বিধবা মা ও ভাইদের পোষণের চিন্তা। আবার ব্যক্তিজীবনে ঈশ্বর লাভ হল না। নির্বিকল্প সমাধি তাঁর চাই। একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ এ জগতে তা দিতে পারেন। অপরদিকে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে এক নতুন সন্ন্যাসী সঙ্ঘ গঠনের দায়িত্ব  দিয়েছেন। কী করে তিনি তা বাস্তবে পরিণত করতে সক্ষম হবেন? কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গে তাঁর কথোপকথন ছিল এইরকম,
শ্রীরামকৃষ্ণ—নরেন তুই কি চাস?
নরেন্দ্রনাথ—শুকদেবের মতো সমাধিতে বুঁদ হয়ে থাকতে চাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ছি ছি, তোর এত ছোট নজর? না রে, এত ছোট নজর করিসনি। তুই যে গান গাস, যো কুছ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়? আমি ভেবেছিলাম তুই বিরাট বটগাছের মতো হবি। তোর আশ্রয়ে এসে কত লোক শান্তি পাবে।
পুরাণ পুরুষ শুদ্ধ পবিত্র শুকদেবের মতো হতে চাওয়াও শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে ছোট নজর। কারণ, এ জগতে যা কিছু সবই পরম ঈশ্বরের প্রকাশ। তাই সকলের জন্য বিরাটকার বটগাছ হতে হবে নরেন্দ্রনাথকে। একটি কাগজে লিখলেন, ‘নরেন শিক্ষে দিবে, যখন ঘরে বাহিরে হাঁক দিবে।’ নরেন্দ্রনাথ কেবল বিরাট বটবৃক্ষ নন, তিনি জগৎশিক্ষকও বটে। কাশীপুরে নরেন্দ্রনাথকে চাপরাস দানের সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। তখন গঙ্গাসাগর স্নানের কাছাকাছি সময়। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য বুড়ো গোপালদা কয়েকজন গঙ্গাসাগর আগত সন্ন্যাসীকে গেরুয়া বস্ত্র দান করতে আগ্রহী। ঠাকুর একথা জানতে পেরে তাঁকে নিজের অন্তরঙ্গ যুবক ভক্তদের দেখিয়ে বললেন, ‘দিতে ইচ্ছে হলে এঁদের দাও। এঁদের মতো সন্ন্যাসী তুমি কোথায় পাবে।’ তাঁর উক্তিকে সার্থক করে উপস্থিত ১২ জন যুবককে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং নিজ হাতে গেরুয়া বস্ত্র দান করেন। ১৬ জন অন্তরঙ্গের মধ্যে এঁরা অন্যতম। 
নরেন্দ্র, রাখাল, তারক প্রমুখদের গেরুয়া বস্ত্র দান করে শ্রীরামকৃষ্ণ ভিক্ষান্ন গ্রহণ করার আদেশ দিলেন। তাঁরা প্রথম ভিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন শ্রীমা সারদাদেবীর কাছে। সমবেত হয়ে আকুতি জানিয়েছিলেন—
‘অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে সারদে শঙ্কর বল্লভে জ্ঞান বিজ্ঞান সিদ্ধর্থং ভিক্ষাং দেহি মে পার্বতী।’ শঙ্করাচার্য কৃত এই স্তবের মাধ্যমে ভিক্ষা চাইলে শ্রীমা তাঁদের একটি টাকা অর্থাৎ ১৬ আনা ভিক্ষা প্রদান করেছিলেন।
কাশীপুরের এই ঘটনাই ছিল 
শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘ গঠনের সূচনা। এছাড়াও ত্যাগী যুবকদের নিয়ে 
দ্বারবদ্ধ ঘরে নাকি নির্দেশ দিতেন শ্রীরামকৃষ্ণ। ভাবী সঙ্ঘের রূপ সম্বন্ধে সার্থক ধারণা গড়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। ত্যাগীদের প্রত্যেকেই বুঝতে পারছিলেন নতুন একটা কিছু ঘটতে চলেছে। তবে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন দু’জন। শ্রীমা সারদা দেবী ও নরেন্দ্রনাথ, অর্থাৎ স্বামী 
বিবেকানন্দ। সংগ্রাম ছাড়া কিছু গড়ে ওঠে না, তপস্যাই হল সার্থক গঠনের মূল কথা। শ্রীরামকৃষ্ণ চলে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে শুরু হয়েছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কঠিন দ্বন্দ্ব। কাশীপুরের বাগানবাড়ির ভাড়া দিতেন গৃহী ভক্তগণ। তাঁদের মধ্যে রামচন্দ্র দত্ত প্রভৃতি যুবক অন্য ভক্তদের বললেন ঘরে ফিরে যেতে। শ্রীরামকৃষ্ণ তো গেরুয়া ধারণ করে সন্ন্যাসী হননি। তাই সন্ন্যাসী হওয়া, সঙ্ঘ গঠনের পক্ষে রইলেন না অনেকে। বিশেষ করে রামচন্দ্র দত্ত। ছেড়ে দেওয়া হল 
কাশীপুরের বাগানবাড়ি। সারদা দেবী গৃহী ভক্ত বলরাম বসুর পরিবারের সঙ্গে তীর্থে চললেন। আর নরেন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য যুবকরা বরাহনগর অঞ্চলে এক ভূতের বাড়িতে নতুন মঠ স্থাপন করলেন। এই হল প্রথম মঠ।
বরানগর মঠের স্মৃতিকথা খুব চিত্তাকর্ষক। আশ্রমিক কয়েকজন যুবক। পরিধানে কৌপীন। বাইরে যাওয়ার বহির্বাস মাত্র একটি, যার দরকার হবে, সে পরে বেরোবে। ঘরে মাদুর পাতা। যদিও সেটা মাদুর নাকি মাছ ধরার জাল, বোঝা দায়। মাথায় দেওয়ার জন্য রয়েছে একটি করে ইট। আহারে বরাদ্দ তেলাকুচা পাতার ঝোল-ভাত। কোনও দিন একটু দুধ জোগাড় হলে তা রাখা হতো সকলের মাঝে। একটু করে আঙুল ছুঁইয়ে মুখে দিয়ে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কি হে ভাই, বল পাচ্ছ?’ শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী যুবকরা প্রায় প্রত্যেকেই অবস্থাপন্ন ধনী বাড়ির সন্তান। কিন্তু প্রত্যেকেই বুদ্ধের মতো স্থির সংকল্প গ্রহণ করেছেন—‘এই আসনেই আমি সিদ্ধিলাভ করব।’ বুদ্ধ উক্ত সেই বিরাট সংকল্পবাক্য বরানগর মঠের দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা থাকত। আর এশিয়াটিক লাইব্রেরি থেকে আনা হতো তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের নানা বিখ্যাত গ্রন্থ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘দেখ বাছা! নিজেকে মারতে একটা নখ কাটার নরুণই যথেষ্ট। কিন্তু অপরকে মারতে চাইলে প্রয়োজন ঢাল-তলোয়ার। নিজের বিশ্বাস জন্মাতে অল্প কিছু হলেই হয়, কিন্তু অপরের কাছে সত্যকে তুলে ধরতে চাই বহু পুস্তক অর্জিত জ্ঞান।’ 
বরাহনগরের মঠ হয়ে ওঠে 
ছোটমাপের বিশ্ববিদ্যালয়। বলরাম বসুর গৃহ থেকে অনেক সময় মঠে খাবার পাঠানো হতো। একদিন মঠ থেকে বাড়ি ফিরে বলরাম বসু  জানালেন, শাক-ভাত ছাড়া কিছু খাবেন না। অনেক জিজ্ঞাসা করার পর জানা গেল, মঠের ভাইদের শাক-ভাত খেতে দেখে দুঃখে এই সিদ্ধান্ত 
নিয়েছিলেন। এই মঠেই স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের কাছে অঙ্ক শিখতে এসেছিলেন কালীকৃষ্ণ। কিন্তু তাঁর আর গৃহে ফেরা হল না। কালীকৃষ্ণ অর্থাৎ পরবর্তীকালে স্বামী বিরজানন্দজী হলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রথম সাধু।
চরম দারিদ্র্যপূর্ণ, কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ 
তপস্যার জীবন, এমন কঠোর যে দেখে ‘ভূত পালায়’, সেই 
সঙ্ঘজীবনেও সঠিকভাবে পালন করা গেল না। কারণ, নিদারুণ অর্থকষ্ট। মঠ চালাতেন বলরাম বসু ও সুরেন্দ্রনাথ দত্ত। দু’জনে ইহলোক ত্যাগ করলে বরানগর মঠে সকলের একসঙ্গে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। একমাত্র থেকে গেলেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। বাকিরা পরিব্রজ্যায় নির্গত হলেন। পরিব্রাজক জীবনের শেষেই স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকা যাওয়া ও বিখ্যাত শিকাগো বক্তৃতা প্রদান। মঠ ততদিনে বরাহনগর থেকে আলমবাজারে স্থানান্তরিত। বেড়েছে সদস্য সংখ্যাও। একদিন ঘর্মাক্ত কলেবরে হাজির গিরীশ ঘোষ। একদিকে প্রবল খিদে, অন্যদিকে গাড়োয়ানের তাড়া। কিন্তু খিদের টান তাঁকে নিয়ে গেল মঠের ভাইদের কাছে। খিদের কথা জানাতেই স্বামীজির দ্বিতীয় সন্ন্যাসী সন্তান, স্বামী সদানন্দ দ্রুত তামাক সেজে দিলেন। ভাঁড়ারে অবশিষ্ট ছিল সামান্য আটা। তা বের করে উনুন ধরালেন। তৈরি করলেন একটা লিট্টি। এক গ্লাস ঠান্ডা জল আর একটি গরম লিট্টি গিরীশ ঘোষের মুখের কাছে ধরলেন। ভক্ত ভৈরবের চোখে জল। কাশীপুরে ঠাকুর তাঁকে ঠিক এভাবেই খাওয়াতেন। ক্যান্সার আক্রান্ত শরীর নিয়ে কোনওমতে উপস্থিত হতেন জল রাখার কুঁজোর কাছে। তখন উঠে বসার ক্ষমতাও হারিয়েছেন তিনি। তাই হেঁচড়ে হেঁচড়ে কুঁজোর কাছে যেতেন। জলে আঙুল দিয়ে তা কতটা শীতল, বুঝতে চাইতেন। এরপর তা তুলে দিতেন গিরীশের মুখের কাছে। পাপী, আচণ্ডালে প্রেম বিতরণের জন্যই তো এই সঙ্ঘ। বিবেকানন্দের এত কান্না। শ্রীমায়ের এত আকুতি। এত প্রার্থনা।
বিদেশ থেকে ফিরে বেলুড়ে মঠ নির্মাণের জন্য জায়গা কিনলেন স্বামীজি। সাহায্য করেছিলেন বিদেশিনী তিন শিষ্যা। মঠ আলমবাজার থেকে এল বেলুড়ে, নীলাম্বর 
মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়িতে। বেলুড় মঠের গা লাগোয়া সেই বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অমূল্য। সেখানে বসেই নতুন সঙ্ঘের নিয়মাবলি তৈরী করেছিলেন বিবেকানন্দ। মার্গারেট নোবেলকেও এখানে ব্রহ্মচর্য প্রদানের মধ্যে দিয়ে ভগিনী নিবেদিতা করে তুলেছিলেন। 
অনেক আগের কথা। শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘তুই আমাকে কাঁধে করে যেখানে বসাবি, আমি সেখানেই থাকব।’ ক্রমেই এল ১৮৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর। স্বামী বিবেকানন্দের গৃহী শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর কলমে এই দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনি ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ গ্রন্থে লিখছেন,‘নূতন মঠাভিমুখে উত্তর দিকে একটি ক্ষুদ্র শোভাযাত্রা আরম্ভ হইল। পুরোভাগে চললেন স্বয়ং স্বামীজি। দক্ষিণ-স্কন্ধোপরি শ্রীরামকৃষ্ণের পুতদেহাবশেষপূর্ণ তাম্রপাত্র বহন করিয়া। অন্যান্য সন্ন্যাসিবৃন্দের সহিত শিষ্য শরচ্চন্দ্রও পশ্চাতে চলিলেন। ঘন ঘন শঙ্খধ্বনি ও জয়ধ্বনি রবে পার্শ্ববর্তী জাহ্নবী যেন আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে স্বামীজি শিষ্যকে বলিলেন, ঠাকুর আমায় বলেছিলেন, তুই কাঁধে করে আমায় যেখানে নিয়ে যাবি, আমি সেখানেই যাব ও থাকব, তা গাছতলাই কি আর কুটিরই কি! সেই জন্যই আমি কাঁধে করে 
নূতন মঠ ভূমিতে নিয়ে যাচ্ছি।’ উপস্থিত গৃহী ভক্তদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা আজ কায়মনোবাক্যে ঠাকুরের পাদপদ্মে প্রার্থনা করুন যেন মহা যুগাবতার ঠাকুর আজ থেকে বহুকাল ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়’ এই পুণ্যক্ষেত্রে অবস্থান করে একে 
সর্বধর্মের অপূর্ব সমন্বয় কেন্দ্র করে রাখেন।’
তথাগত বুদ্ধ তাঁর সঙ্ঘভুক্ত ভিক্ষুদের বলেছিলেন, ‘চরত্থ ভিক্ষবে, বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায়। হে ভিক্ষুগণ তোমরা চল, অনেকের সুখের জন্য, অনেকের হিতের জন্য, অন্যের প্রতি অনুকম্পা নিয়ে এগিয়ে চল।’ এই মহাবাক্যকেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের উদ্দেশ্য বাক্যরূপে নির্দিষ্ট করেছিলেন বিবেকানন্দ। তবে একটু সংযোজন করে বলেছিলেন,
‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় চ
আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ।’
অর্থাৎ বহুজনের সুখ ও হিতের মাধ্যমে নিজ আত্মার মুক্তি সাধনের কথা সংযোজন করলেন। আর সঙ্গে রইল জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি, যোগের সমন্বয়ে  গঠিত নবীন পথ। একটি দিক বুদ্ধের, অপরটি হিন্দু ধর্মের সনাতন ধারা থেকে। আর দুয়ের মিশ্রিত রূপ নিয়ে জন্ম হল ভারতের দ্বিতীয় 
সন্ন্যাসী সঙ্ঘ, যা নিজেকে 
‘অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়’ রূপে চিহ্নিত করল। স্বামীজি বলেছিলেন, ‘সেদিন যখন মঠের জমিতে ঠাকুরকে স্থাপন করলুম, তখন মনে হল যেন এখান হতে তাঁর ভাবের বিকাশ হয়ে চরাচর বিশ্ব ছেয়ে ফেলেছে...শঙ্কর 
অদ্বৈতবাদকে জঙ্গলে পাহাড়ে রেখে গিয়েছেন, আমি এবার সেটাকে সেখান থেকে সংসার ও সমাজের সর্বত্র রেখে যাব বলে এসেছি। ঘরে ঘরে, মাঠে ঘাটে, পর্বতে প্রান্তরে 
এই অদ্বৈতবাদের দুন্দুভিনাদ তুলতে হবে। [বাণী ও রচনা,পৃঃ ১২৮-২৯]
১৮৯৭ সালের ১ মে বলরাম বসুর বাড়িতে স্বামীজির হাত ধরে ‘রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন’-এর যাত্রা শুরু। সেদিন সভায় স্বামীজি বলেন, ‘নানা দেশ ঘুরে আমার ধারণা হয়েছে, সঙ্ঘ ব্যতীত কোনও বড় কাজ হতে পারে না।...আমরা যাঁর নামে সন্ন্যাসী হয়েছি, আপনারা যাঁকে জীবনের আদর্শ করে সংসারাশ্রমে কার্যক্ষেত্রে রয়েছেন,...এই সঙ্ঘ তাঁরই নামে প্রতিষ্ঠিত হবে। আপনারা এ কাজে সহায় হোন।’ এই অ্যাসোসিয়েশন 
স্থাপনের মধ্যে দিয়েই প্রচার বা মিশনারি কাজের সূত্রপাত। এর মধ্যে শিল্পে উন্নতি সাধনে উৎসাহ প্রদানও ছিল একটি অংশ ছিল। গৃহীদের জীবনযাত্রার মান 
উন্নতিতে সহায়তা করা 
সন্ন্যাসীদের একটি কার্য বলেও গণ্য হল। এর মধ্যে দিয়ে সন্ন্যাস ও সমাজকে কাছাকাছি এনে দিলেন স্বামীজি। নতুনকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বললেন, ‘এখন সব নতুন ছাঁচে গড়তে হবে। এই দেখ না, আগেকার কালের সন্ন্যাসীদের চালচলন ভেঙে দিয়ে এখন কেমন এক নূতন ছাদ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!...দেশ, সভ্যতা ও সময়ের উপযোগী করে সকল বিষয়েই কিছু কিছু পরিবর্তন করে নিতে হয়।’ [বাণী ও রচনা, ৯/৯৩]
শ্রীরামকৃষ্ণ দেহরক্ষার পরেই মঠ তৈরি হয়। যদিও নিজেদের আশ্রয় ছিল না। এই তাজা যুবকদের তাঁদের প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ে স্থান দিতে আগ্রহী ছিলেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও নিত্যগোপাল অবধূতের কথা বইতে পাওয়া যায়। কিন্তু যে যুবকদের শ্রীরামকৃষ্ণ রেখে গিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন নতুনের দূত। পুরাতন বোতলে নতুন হওয়ার সাধ তাঁদের ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন নিয়ে যে জন্ম হয়েছে নতুন আন্দোলনের, সেই বিষয়ে তাঁরা সচেতন ছিলেন। এই ধারাকে বহন করাই ছিল তাঁদের জীবনাদর্শ। আমরা আজ বলি ‘শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন’। যদি কৌশল জানা থাকে, তাহলে এখানে ঘর মোছা ও জপধ্যান সমতুল্য হয়ে যায়। যে যেখানেই থাকুক, সেখান থেকেই অনায়াসে জপ শুরু করতে পারেন। কারণ, 
আধ্যাত্মিকতা ও কার্য—দুই ডানা বিশিষ্ট এক পক্ষী। যার মুখ ঊর্ধ্বে উত্তোলিত, সে সাধন পিয়াসী, কিন্তু পা দু’টি বাঁধা রয়েছে জগতের কার্যে। সাধনে যা অর্জিত কর্ম, তাই প্রবাহিত হয়ে জন্ম দিয়েছে নতুন এক সন্ন্যাসী সঙ্ঘের। বনের বেদান্তকে ঘরে আনার প্রচেষ্টায় তা উন্মুখ।
6Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা