কারও অভিনয়জীবন দীর্ঘ, কারও বা সবে শুরু। কেউ আবার ক্যামেরার পিছনে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসেন। ইন্ডাস্ট্রির অভিজ্ঞতা, ভালোলাগা-মন্দলাগা, চাওয়া-পাওয়া মন খুলে জানাচ্ছেন তাঁরা। এবার কলম ধরলেন রেশমী সেন।
সন্তানভাগ্য এবং বাবা-মায়ের ভাগ্য একইসঙ্গে ভালো হয়তো কম মানুষেরই হয়। আমি সেই বিরলদের দলে। আমার বাবা-মা ছিলেন পৃথিবীর সেরা বাবা-মা। আর আমার ছেলে ঋদ্ধি (সেন, অভিনেতা) ভীষণ ভালোমানুষ। এমন সন্তানভাগ্য খুব কম মায়ের হয়।
১৯৯২-তে আমাদের থিয়েটারের দল ‘স্বপ্নসন্ধানী’ তৈরি হয়। আমি স্বপ্নসন্ধানীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০০০ সাল থেকে থিয়েটার করতে শুরু করি। এছাড়া অন্যান্য মাধ্যমে আমার পেশাদার কাজের শুরু ২০১০-’১১ থেকে। বাংলা থিয়েটার এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এসেছে। এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু থিয়েটার করে দিন গুজরান অসম্ভব। আগে থিয়েটারে টাকা কম ছিল, এখন এসেছে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এখনও বহু দলকে সরকারি অনুদানের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। যদিও ‘স্বপ্নসন্ধানী’র অনুদান ২০১৬ থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত অনুদান দিলেও আমরা আর নেব না। আমি একটা রাজনৈতিক কথাই বলছি। কেন্দ্রে যে সরকার রয়েছে, তাদের মন জুগিয়ে না চললে অনুদান পাওয়া যাবে না। আমরা সেই দয়ার দানের উপর নির্ভরশীল নই। অনুদান চলে যাওয়ার পর থেকে দর্শকের ভালোবাসায় হাউসফুলের টাকায় পরের শো চালাতে পেরেছি। কিন্তু ভাতের একটা দানাও থিয়েটার থেকে আসে না। সে কারণেই ধারাবাহিক, ওটিটি বা সিনেমায় আমরা কাজ করি। কারণ সেটা আমার খাবার জোগায়।
টেলিভিশনে প্রতিদিন কাজ করলে মাসিক একটা টাকা নিশ্চিত থাকে। যে টাকা দিয়ে সংসার চালানো যায়। এখন স্টার জলসায় চলছে ‘জল থই থই ভালোবাসা’ এবং ‘রোশনাই’। বহু ধারাবাহিক করলেও এখনও এমন কোনও চরিত্র পাইনি, যেটার জন্য নিজেকে নিঃশেষিত করে দিতে হয়েছে। মহান কিছু কাজ দেখে লোভ হয়েছে। যেমন মেরিল স্ট্রিপের ‘ডোন্ট লুক আপ’ দেখে মনে হয়, এমন একটা চরিত্র আমি যদি কোনওদিন করতে পারতাম। আমার বয়সি কাউকে দেখে মনে হয়নি, ইশ ও এই চরিত্রটা করে ফেলল, আমি করতে পারতাম। আসলে থিয়েটার আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে। ম্যাকবেথে লেডি ম্যাকবেথ, হ্যামলেটে গার্ট্রুড, মাদার কারেজে মাদার, ইবসেনের এনিমি অব দ্য পিপল-এ ডক্টর স্টকম্যান, জীবনানন্দ দাশের মাল্যবান-এ উৎপলা— নিজের শেষটুকু দিয়ে অভিনয় করেছি। বরং আমার মনে হয়েছে, কেউ থিয়েটারে আমার চরিত্র দেখে হিংসে করবে, রেশমী এই চরিত্রটা করেছে, আমি এটা করতে পারতাম। আমাদের ‘হাজার চুরাশির মা’ মঞ্চস্থ হবে। সেখানে আমি ব্রতীর মা করছি।
আমার শুরুরও একটা শুরু আছে। সেটা বলি। অনেক ছোট থেকে কৌশিকের (সেন, স্বামী তথা অভিনেতা) সঙ্গে আমার পরিচয়। ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করি। দর্শনে আমি মাস্টার্স করেছিলাম। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সাইকোলজি নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছি। চার বছর বয়স থেকে নাচ শিখেছি। ১২ বছর বয়সে কত্থকে প্রভাকর কমপ্লিট করেছি। টানা ২০ বছর ওড়িশি করেছি। আমি হয়তো খুব ভালো চাকরিও করতে পারতাম। কিন্তু বিয়ের পর কোনওটাই করতে পারিনি। আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। চাকরি, নাচ, অভিনয় কিছুই করবে না। শুধুই গৃহবধূ হয়ে থাকো। যে ২৪ ঘণ্টা সংসারে মুখ গুঁজে থাকবে।
আমি যে পরিবারে বিয়ে করেছিলাম, তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত পরিবার বলেই তাদের পরিচয় দেওয়া হয়। পুরনো কথা এখন আর তুলতে চাই না। কিন্তু কেন আমার স্বামী এবং শাশুড়ি মা (চিত্রা সেন, অভিনেত্রী), ওটা করেছিলেন, আমি জানি না। আমি কোনওদিন প্রশ্ন করিনি। হয়তো সেটা আমার ভুল। তবে কৌশিকের মতো বন্ধু পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। সেই কারণে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি। আমি বোকা ছিলাম। এত কিছু জানা সত্ত্বেও কোনও কিছু নিয়ে এগইনি। যা বলেছে মেনে নিয়েছি। দোষটা নিজেকেই দিই। নিজের দক্ষতা বাসন মাজা, কাপড় কাচার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম। তা নিয়ে আপশোস রয়েছে।
আমার জীবনের সবচেয়ে জোরের জায়গা আমার ছেলে। কৌশিক যখন বুঝতে পেরেছে আমার কেরিয়ারের কতটা ক্ষতি করে ফেলেছে, তখন থেকে ও অনেক চেষ্টা করেছে। অপরাধবোধে ভুগেছে। এখন আমি প্রচুর কাজ করি। এখন বিষয়টা অনেক সহজ। এখনও একটা স্বপ্ন আছে।
আবার একটা গল্প বলি। নাসিরুদ্দিন শাহ একবার আমার বাড়িতে এসে দেখিয়েছিলেন, মাথার মুভমেন্টের জন্য একটা চরিত্রের ডাইমেনশন কত বদলে যায়। এটা শিখিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আমি যা যা শিখেছি, সেগুলো শেখাতে ইচ্ছে করে। ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং কাকে বলে, ভয়েস মডিউলেশন কী, সেটা শেখানোর ইচ্ছে আছে। অভিনয়ের ধাপে ধাপে শিক্ষাটা প্রয়োজন। আর রান্না আমার প্যাশন। ভবিষ্যতে হয়তো রান্না নিয়ে কিছু করব।