রাগ ও উদ্বেগ ইদানীং জীবনযাত্রার প্রতি ঘরে সেঁটে বসে রয়েছে। অফিসের রাজনীতি সামলাতেও মেজাজ গরম হয়। ক্ষোভ বেরিয়ে আসে। জিততে হলে নিখুঁত দক্ষতায় ছেঁটে ফেলুন টেনশন ও রাগের ভিলেনকে। পরামর্শে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জয়রঞ্জন রাম।
কারও সময় ১০টা-৫টা। কেউ আবার কাজ শুরু করেন আর একটু বেলা করে। কারও ক্ষেত্রে রাতেই মূল কাজ। বাঙালির অফিস টাইম! তা যেমন নিয়মমাফিক, তেমনই রোমাঞ্চেরও। রোমাঞ্চ, কারণ কর্মক্ষেত্র আমাদের অভিজ্ঞতাকে পুষ্ট করে। শুধু তা-ই নয়, কর্মক্ষেত্র মানুষ চেনার মঞ্চও। অফিস পলিটিক্স সামলানোর মন্ত্র জানার আগে একটি কথা শুরুতেই মেনে নিতে হবে, সাধারণত, অফিস সহকর্মী কখনও বন্ধু হন না। কারও কারও ক্ষেত্রে একই স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা বন্ধু বা সিনিয়ররা চাকরি করেন, সেক্ষেত্রে পুরনো সৌহার্দ্য ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু সে সুযোগ সকলে পান না।
স্কুল-কলেজের দিন শেষ
অফিসের পরিবেশে নানা পলিটিক্স বিভিন্ন সময়ে উঁকি দেয়। সেই জাঁতাকলেই কাজ করতে হয় অনেককে। কবি সেই কোন যুগে বলে গিয়েছেন, ‘পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ চাকুরি’! কথাটা এক্ষেত্রেও খাটে। অফিস মানেই কাজের সূত্রে ও কাজের স্বার্থে হরেক মনের মানুষের একত্রে বাস। এরা কেউই রক্তের সম্পর্কের নয়। এখানে বাড়তি কোনও আবেগ কাজ করে না। এখন বলবেন, সে তো স্কুল কলেজেও হয় না! তবে একটা কথা ভুললে চলবে না, স্কুল ও কলেজ জীবন বন্ধুত্ব দিয়ে ঘিরে থাকার সময়। পড়াশোনার পাশে সেখানে আড্ডা, গল্প, মজা এগুলোও একটি মানুষকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু অফিস কখনও স্কুল-কলেজের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সেখানে বেতনের বিনিময়ে নিজের শ্রম দিতেই আমরা অভ্যস্ত। তাই অফিসে এসেও যদি স্কুল-কলেজের উষ্ণতা খুঁজতে যান, তা কিন্তু বোকামি!
তাহলে কি সবাই শত্রু?
না, অফিসে বন্ধু হয় না মানেই সকলে শত্রু, এমন একেবারেই নয়। বরং অফিসে কাজ সারতে গেলে, বিশেষ করে টিম ওয়ার্ক সারতে গেলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া, সম্পর্ক ও সর্বোপরি বিশ্বাস না থাকলে তা সম্ভব নয়। আর এগুলো বন্ধুত্ব বা সহমর্মিতা তৈরি না হলে আসেও না। অফিসেও কেউ কেউ ভালো বন্ধু পান। তাঁরা ভাগ্যবান তো বটেই। তবে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা থেকে সরে, একে অন্যকে বুঝতে পারা, ভালো ব্যবহার, সহমর্মিতা ও একজোট হয়ে কাজ করার মানসিকতা থাকলেও অফিসের চাপ সামলানো সহজ। সেভাবেও তৈরি হতে পারে বন্ধুত্ব। কাজেই রাগ ও মেজাজ সরিয়ে অফিসের পালে হাওয়া বইয়ে কাজ সারার কৌশল জানতে হবে। তারও আগে বুঝতে হবে রাগ কেন হয়?
কেন এত মাথাগরম হয়!
রাগ অনেকটাই ‘লার্নড থেরাপি’। অনেকে এর সঙ্গে বংশগত বা জিনগত কারণ খোঁজেন, তবে তা নিয়ে এখনও কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। তবে বিশেষ কিছু কারণে রাগের বহিঃপ্রকাশ সাধারণত দেখা দেয়। রাগ ও মেজাজ হারানো এসবই মনের চেয়েও বেশি মাথার খেলা। রাগ একটি আবেগের বহিঃপ্রকাশ। রাগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিজ্ঞানের অঙ্ক। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বললে মস্তিষ্কের লিম্বিক লোবের অ্যামিগডালা অংশ থেকে রাগ সক্রিয় হয়। এই অ্যামিগডালা আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। অ্যামিগডালাকে বলা হয় ‘স্টোর হাউজ ফর ইমোশনাল মেমরিজ’। এখান থেকেই আমাদের মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয়, রাগপ্রকাশ করব কি না, সেটাও ঠিক করে এই অংশ। রাগ নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্স থেকে। মস্তিষ্কের লিম্বিক লোব থেকে ফ্রন্টাল লোবের দিকে যখন আমাদের নির্দেশগুলো আসার পথে যদি কোনও বাধা আসে, তাহলে যে অবস্থা হবে, রাগও সেরকম। শুধু রাগ নয়, যে কোনও আবেগের স্ফূরণই এই বাধার কারণেই হয়। কাজেই ওই অংশেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে রাগের রহস্য। নানা সামাজিক, পরিস্থিতিজনিত অবস্থা ও জৈবিক কারণেই মূলত রাগের উদ্রেক হয়। রাগের সঙ্গে যে বিজ্ঞান রয়েছে, তাতে কিছু হতাশার পারদও আছে। অফিসে সৃজনশীল জায়গায় কাজের ন্যায্য মূল্য না পেলে এক হতাশা গ্রাস করে। সেখান থেকেও চাপা ক্ষোভ ও রাগ আসতে পারে। মানুষ নিজের চাহিদা পূরণ না হলে সেখান থেকে রাগের শিকার হয়। অফিসে ধরা যাক, আপনি চাইছেন অধস্তন আপনার সব কথা মেনে চলুক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তেমনটা হচ্ছে না। সেখান থেকেও বাড়তে পারে রাগ। অনেক সময় লাইফস্টাইলের কারণে মস্তিষ্ক থেকে সুখী হরমোন ডোপামিনের ক্ষরণ কমে যায়। ফলে অল্পেই রেগে যায় মানুষ। ইগো, অহংকার ও নিজেকে নিয়ে বেশি চিন্তা করা মানুষদেরও রাগের ক্ষেত্রটি চড়া। জীবনে কোনও বড় অসুখ (স্কিৎজোফ্রেনিয়া, মৃগী, ডিমেনশিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার), চরম কোনও অপমান বা দুর্ঘটনার ইতিহাস থাকলে সেখান থেকেও রাগ বা ক্ষোভ জন্ম নিতে পারে। যখন কেউ রেগে যাচ্ছে, তার লিম্বিক সিস্টেম প্রচণ্ডভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। রাগের বহিঃপ্রকাশের অর্থ, মস্তিষ্কের যেখানে ভাবনাচিন্তা তৈরি হয়, সেই কর্টেক্স হল, আমাদের ‘লজিক’ বা ‘জাজমেন্ট’ তৈরি করার জায়গা। সেই জায়গাটি কাজ না করলেই আমরা রাগের আতিশয্য দেখাব। এমনটা হলেই আমরা রেগে যাব।
অফিসে টেনশনের কারণ
অফিসে টেনশনের হাজারো একটা কারণ রয়েছে। বরং বিভিন্ন পরিবার থেকে অনেকে একসঙ্গে জড়ো হয়ে কাজ করলে সেখানে মতবিরোধ না হওয়াই অস্বাভাবিক। কাজ করেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মন না পাওয়া, সহকর্মীদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা, অহেতুক ‘বুলি’ হওয়া বা অপমানের শিকার হওয়া, দপ্তরের প্রধানের কড়া মেজাজ বা দুর্বব্যহার, তাঁর আঁতে লাগলেই প্রকাশ্যে অপমান, কোনও কোনও সহকর্মীর অন্যায্য গুরুত্ব, বসকে হাতে রাখতে নানাভাবে তাঁকে প্রভাবিত করে এমন সহকর্মীর উপস্থিতি, যাঁর অধীনে রয়েছেন, তাঁর কাজ করার বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার অভাব, অধস্তন কারও অবাধ্যতা, দলের কারও অকারণে ঝগড়া করা স্বভাব, সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকতা, আপনার অনুপস্থিতিতে আপনাকে নিয়ে চর্চার কথা কানে আসা, আপনার কোনও দুর্বলতা বা সক্ষমতাকে ঘুরিয়ে ‘বুলি’ করা, বসের পক্ষপাত করার দোষ, উচিত কথা উচিত জায়গায় বলতে না পারায় নিজের ব্যর্থতা ইত্যাদি নানা কারণে টেনশন তৈরি হয়।
উদ্বেগ নয়, বুদ্ধি লাগুক কাজে
সকল অফিস কর্তৃপক্ষই অফিস পলিটিক্সের আবহের কথা জানেন। তাই বিভিন্ন অফিসে ‘অ্যান্টি পলিটিক্স স্কোয়াড’ থাকে। সমস্যা বাড়লে সেখানে অভিযোগ করা যায়। যাঁদের সেই স্কোয়াড নেই, তাঁরা এইচ আর-কে নিজেদের সমস্যা বলতে পারেন। তবে তা বলার আগে বুঝতে হবে এই ভাবনা একেবারেই আপনার মনগড়া নাকি সত্যিই কোনও প্রামাণ্য তথ্য আছে। প্রমাণ না থাকলেও নিজের অভিযোগের ভিতটি যেন পোক্ত হয়, সেটুকু খেয়াল রাখতে হবে।
মেজাজ না হারিয়ে অফিস পলিটিক্সের সঙ্গে মোকাবিলা করাই দস্তুর। চুপ করে থেকে এসব সমস্যার সমাধান হয় না। বরং বাড়তেই থাকে। তাই অশান্তি না করলেও ফোঁসটুকু করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে রাজনীতি সামাল দেওয়ার আগে খেয়াল রাখুন কয়েকটা বিষয়—
পরিস্থিতি বিচার করুন: কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইলে আগে তাঁদের উদ্দেশ্য, ক্ষমতা, দুর্বলতা ও গোটা পরিস্থিতি বিচার করে নিন। নিজের কাজের ক্ষেত্রেও নিখুঁত থাকুন। আপনার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন, কীভাবে নির্দেশ আসে, তা কীভাবে রূপায়িত হয়, এই প্রক্রিয়াটি করায়ত্ত না করতে পারলে আপনার প্রতিবাদ বা বক্তব্য কোনওকিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না।
কাজের সিস্টেম বুঝে গেলে রাজনীতির শিকার কম হতে হয় ও হলেও তা কাটিয়ে এগনো যায়।
মুখ খুলুন: মুখ বুজে অপমান বা মানসিক নিগ্রহ স্বীকার করবেন না। যদি কোনও ঘটনায় আপনার কোনও দোষ না থাকে, স্পষ্টভাবে বলুন।
বসের সঙ্গে আলোচনায় কাজ না হলে অফিসের এইচ আর বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তা জানান। একটি অপমান মুখ বুজে সইলে অফিসের প্রতিপক্ষ ফের অপমানের সুযোগ পাবে।
নিখুঁত কাজ: অফিস পলিটিক্স সামলাতে নিজের কাজে কোনও ত্রুটি রাখবেন না। যে কাজটি করেন, তা যেন নির্ভুল হয়। যাঁরা অফিসে আপনার বিরুদ্ধে রাজনীতি করছেন, কাজের দিক থেকে কোনও ফাঁক না পেলে তারা এমনিই একসময় রণে ভঙ্গ দেবেন।
ব্যক্তিত্বে শান: নিজেকে এমন করে উপস্থাপন করবেন না যেখানে যে কেউ আপনাকে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ করে ফেলেন। নিজের কথা বলার সময় বেফাঁস কিছু বলে ফেলা, অফিস গসিপ-এ অংশ নেওয়া, কোনও কথা বা কাজ ভুলে যাওয়া, এগুলো সবই রাজনীতির শিকার করে তোলে।
অফিসের সহকর্মীকে কী বলবেন ও কতটুকু বলবেন তা যেন আপনার কাছে স্পষ্ট থাকে। যে কথা বলেননি, তা বলেছেন বলে দাবি উঠলে তখনই প্রতিবাদ করুন।
বিপদ বাড়াবেন না
গসিপে না: রাজনীতির শিকার যেমন হতে চান না, তেমন রাজনীতির শিকারী হওয়ারও দরকার নেই। দলের অন্য সহকর্মী সম্পর্কে তাঁর আড়ালে আলোচনা, গসিপ কেউ ছড়ালে তার পালে হাওয়া জোগাবেন না। মনে রাখবেন, আপনাকে সঙ্গে নিয়ে অন্যের সম্পর্কে যে এমন কথা বলে, আপনার আড়ালে আপনার সম্পর্কেও তিনি একই কথা প্রচার করতে পারেন। এমনকী সহকর্মী তেমন বিপজ্জনক মানুষ হলে, সেই গসিপ আপনিই ছড়িয়েছেন এমন দাবিও তিনি করতে পারেন। পরে হয়তো শুধু অংশ নেওয়ার সময় যে মন্তব্য করেছিলেন তা ধরেই গসিপটি তিনি ছড়িয়ে দিলেন সকলের মধ্যে। ভিলেন হলেন আপনি! কাজেই সাবধান থাকুন প্রথম থেকেই। সব অফিসের কর্তৃপক্ষ এই গসিপ নিয়ে বাড়তি সচেতন থাকেন, তাঁদের কানে সকল কথা পৌঁছয়। কাজেই নিজের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে ও অকারণ সমস্যা থেকে বাঁচতে গসিপে যাবেন না।
অফিসের নিন্দে নয়: সরকারি, বেসরকারি বা কর্পোরেট অফিসের সব নীতি, সব নিয়ম, কাজের পদ্ধতি পছন্দ না-ই হতে পারে। তবু অফিসের পলিসি, পদ্ধতি, কর্তৃপক্ষের কাজ এসব নিয়ে প্রকাশ্যে নিন্দে নয়। কোনও অসন্তোষ থাকলে নিজের ঘরের পরিসরে খুব কাছের লোকজনের সঙ্গে তা ভাগ করুন। কিন্তু অফিসের ভিতরে বা কোনও পাবলিক প্লেসে এসব নিয়ে কোনও মন্তব্যে যাবেন না। কে বলতে পারে, আপনার চেনা কোনও সহযাত্রী বা চালকের সঙ্গে হয়তো সেই অফিসেরই অন্য কারও পরিচিতি রয়েছ! তা যদি নাও হয়, লোকমুখে নানা কথা ছড়ায়। সে কথা কর্তৃপক্ষের কান অবধি পৌঁছতেও সময় লাগে না। সরকারি চাকরি করলে ইউনিয়নের কোন কথায় রাজি হবেন, কোন কথায় যোগ দেবেন না সেই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। নিজেদের দাবিদাওয়া বুঝে নেওয়া অন্যায় নয়, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যেন বড় বিপদ না আসে।
বিবেচনা জিতে যাক
সহকর্মীকে চিনুন: বাড়ির পরেই সবচেয়ে বেশি সময় আমরা কাটাই অফিসে। তাই সেখানে দমবন্ধ করা পরিবেশ হলে মুশকিল। মাঝে মাঝে আড্ডা, গল্প, একসঙ্গে খেতে যাওয়া, মাঝে মাঝে বাড়িতে যাতায়াত, নানা ব্যক্তিগত কাজে সঙ্গ দেওয়া অফিসের সহকর্মী এসবই করতে পারেন। তবে এতটা স্পেস কাকে দেবেন আর কাকে দেবেন না, সে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। তাই সহকর্মীকে বাজিয়ে নিন প্রথমেই। বিশ্বাসভঙ্গ বা অসৎ কোনও কাজ করলে তাঁকে এড়িয়ে চলুন। আপনার সঙ্গে নয়, অন্যের সঙ্গে তিনি কেমন আচরণ করছেন, সেটাই করুন বিচার্য। যিনি মূলত ভদ্র ও ভালোমানুষ হবেন, তিনি বন্ধু-শত্রু সকলের সঙ্গেই সাধারণ মূল্যবোধ বজায় রেখে আচরণ করবেন।
খতিয়ে দেখুন: অফিসে কেউ আপনার নামে কিছু বলেছে শুনলেন, তার সত্য-মিথ্যা বিচার না করে, নিজের কানে না শুনেই ছুটলেন তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করতে বা মনে মনে শত্রু ভেবে নিলেন তাঁকে— এটা চলতে থাকলে একসময় নিজেই একা হয়ে যাবেন। বরং যাঁর সম্পর্কে শুনেছেন, সরাসরি তাঁকেই প্রশ্ন করুন, তিনি এ কথা বলেছেন কিনা, কার কাছ থেকে শুনলেন সবটুকু। প্রয়োজনে সেই দু’জনের উপস্থিতিতে সরাসরি জিজ্ঞাসা করুন। এতে এটি মিথ্যে রটনা হলে জানতে পারবেন। সত্যি হলে সচেতন হবেন। আর এটুকু করতে না পারলে সেই কথা ধরে তলে তলে শত্রুতা বা রাজনীতি করে চলা অনর্থক। নিজে এমন কিছুর শিকার হচ্ছেন দেখলে হয় কথা বলুন, নয়তো পাত্তা না দিয়ে কাজ করুন। দরকারে জানিয়ে রাখুন অফিসের এইচ আর দপ্তরকে।
অফিস কী চায়: কোনও কাজ সমাধান করার আগে অফিস সেই প্রোজেক্ট নিয়ে কী চায় বা তার লক্ষ্য কী, এটা আগে বুঝুন। সেই বিষয় নিয়ে অন্যরা কী ভাবছে, কীভাবে তাঁদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন সেটা মাথায় রেখেই নিজের ভাবনাচিন্তায় শান দিন। আরও ভালো কোনও উপায় পেলে অফিস মিটিংয়ে নম্র হয়ে সে প্রস্তাব রাখুন। দরকারে তার আগে নিজের বসের সঙ্গে কথা বলে নিন। অফিস মিটিংয়ে বা টিম মিটিংয়ে কোনও সংঘাত তৈরি হলে মাথা ঠান্ডা রেখে, যুক্তি ও তথ্য দিয়ে নিজের মত পেশ করুন।
সব জায়গায় জিতবেন না: সব তর্ক বা সব মতে আপনার জয় হবে, এমন ধারণা রাখবেন না। ইগো সরিয়েই অফিসের কাজ সারতে হবে। হতে পারে, আপনি দলের প্রধান বা দপ্তরের উচ্চপদে। তারপরেও আপনার অধীনস্থ কেউ আপনার চেয়ে ভালো কাজ করলে বা ভালো মত দিলে তা গ্রহণ করুন। এতে শুধু কাজের উন্নতি হল, তা-ই নয়, সেই অধস্তন কর্মীটিও আপনার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করবেন। অফিসে রাজনীতির শিকার হলে তাঁরাই সহায় হবেন।
নিজের দিকে আঙুল
পক্ষপাত নয়: অনেক সময় আপনি নিজেও এই রাজনীতিতে অংশ নিয়ে ফেলেন। খেয়াল রাখুন সেদিকটি। যদি আপনার পক্ষপাতের দোষ কাউকে বিপদে ফেলে বা তাঁর গুণের মর্যাদাহানি ঘটায়, সেই দোষ সচেতনভাবে পরিহার করুন। বরং কোনও কাজের জন্য দল গঠন করতে হলে নিজের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিন কাজটির উপর। সেই কাজটি যিনি ভালো করবেন, তাঁকেই দায়িত্ব দিন। এতে কাজের মান বাড়বে, অফিসে এমনিই আপনি নেকনজরে থাকবেন। রাজনীতি করতে গিয়ে কাজের মান খারাপ হলে তা ভুগতে হবে আপনাকেই। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কাজে ফোকাস করুন, ব্যক্তিগত আবেগ, বন্ধুত্বে নয়।
চোখ-কান খোলা: অফিসের পরিবেশে রাজনীতি থেকে বাঁচতে সজাগ থাকুন। কে কী বলছেন, কতটুকু বলছেন, আসলে কী বলতে চাইছেন এগুলো ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন। অকারণ সন্দেহ করবেন না, তবে নিজেও সজাগ থাকবেন। আপনার বিরুদ্ধে কোনও কাজ বা কথা আপনার গোচরে এলে খুব শান্তভাবে, যুক্তি দিয়ে নিজের কথাটি বলুন। আপনি যে এই ধরনের কথা পছন্দ করেননি সেই বার্তা যাক অন্যদের কাছে।
সম্মান করুন: কোনও সহকর্মীকে পছন্দ করুন, বা না-ই করুন, অফিসের কিছু নিয়ম মেনেই আপনাকে চলতে হবে। সকলকেই দিতে হবে তাঁর প্রাপ্য সম্মান। আপনাকে কেউ অসম্মান করলে তাঁকে এড়িয়ে চলুন। সৌজন্যের সম্পর্ক বজায় রাখুন। অপমানের জবাব দিন, কিন্তু কখনও পাল্টা অসম্মান করবেন না।
ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়: অফিস আদতে কাজের জায়গা। সেখানে যেভাবেই হোক, কাজ তুলে দেওয়ার চাপ থাকে। এখানে সকলেই কমবেশি চাপ নিয়েই কাজ করেন। নিজের ক্ষোভ, রাগ বা হতাশা থেকে জন্ম নেওয়া ঈর্ষাকে মাথায় চড়তে দেবেন না। কোনও সহকর্মীকে তিরস্কার করার সময়ও তাঁকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না। এতে আপনার ঈর্ষা প্রকট হয়ে আসে। পরে সেই সহকর্মী সুযোগ পেলেই আপনার ক্ষতি করতে পারেন। এড়িয়ে চলুন ক্ষতির রাজনীতি।
বসকে সম্মান করুন, ভয় নয়: হয়তো দপ্তরের প্রধান আপনার প্রতি তেমন সদয় নয়, আপনার কাজের প্রশংসায় ভাগ বসান। কিংবা অন্যায়ভাবে আপনাকে নানাসময় নাস্তানাবুদ করেন, বসের অনেক ক্ষমতা ধরে নিয়ে দিনের পর দিন চুপ করে অন্যায় সইবেন না। বসের নামে কিছু বললেই চাকরি যাবে— এই ধারণা থেকে আগে বেরন। অফিসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর যতই মাখোমাখো সম্পর্ক থাক না কেন, কর্তৃপক্ষ কাজকেই বেশি গুরুত্ব দেন। তাঁরা ব্যক্তিগত আবেগ ও সম্পর্ক গুলিয়ে ফেলেন না। তাই সমস্যা হলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন। নিজের মত, সুবিধা-অসুবিধা, কোথায় সমস্যা হচ্ছে, এগুলো নিয়ে খোলাখুলি কথা বলুন।
অধস্তনের বেয়াদবিও রেয়াত নয়: অধস্তন জটিল মানুষ, কিংবা অধস্তন হলেও তাঁর অনেক উচ্চপদের সঙ্গে অনায়াস যোগাযোগ এই ভাবনা থেকে অনেকে তাঁর অধস্তনের প্রতিও পদক্ষেপ করতে ভয় পান। ক্ষতির ভয়ে চুপ করে থাকলে জানবেন, নিজের আরও বড় ক্ষতি ডেকে আনছেন। কাজের ক্ষেত্রে সেই অধস্তন সমস্যা তৈরি করছে বুঝলে তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরিশীলিতভাবে কথা বলুন।
ছুটি নিন: সারাবছর অফিসের ব্যস্ততা থাকে। নানা চাপ থাকে। কাজের চাপ কমিয়ে একটু ছুটি নিন। কোথাও ঘুরে আসুন। একনাগাড়ে অফিস, কাজ, সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা এই রুটিনে অভ্যস্ত মন একটু বিরাম চায়। এতে মন ভালো থাকে। ‘ভালো লাগছে না’ অচিরেই ‘ভালো লাগা’-য় পরিণত হয়। রাগ, ক্ষোভ, হতাশাকে কব্জায় এনে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা যায়।
লং-টার্ম যোগাযোগ তৈরি করুন
ব্যবহারে যত্ন নিন: সহকর্মীদের সঙ্গে বা অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন। নিজের ব্যবহার, বিশ্বাসযোগ্যতা, কাজের দক্ষতা দিয়ে তা অর্জন করার চেষ্টা করুন। পক্ষপাতের দোষে ভালো কাজ করেও তেমন ফল না পেলে সরাসরি কথা বলুন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। আপনি নিজে যে আপনার কাজ ও ভূমিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, সেই বার্তা পৌঁছনো দরকার।
মন থেকে মিশুন: ফেক বা মিথ্যে ভান না করে সহকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা করুন। তাঁকে যেটুকু বলছেন, তাতে যেন অন্যের নিন্দে, নিজের হতাশা এসবের চেয়ে পজিটিভ কথা বেশি থাকে। তাঁর কোনও কাজ ভালো লাগলে মন খুলে প্রশংসা করুন। সৎ পরামর্শ দিন। বিপদে পড়লে উপদেশ দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করুন। এতে আপনার প্রতি তাঁরা আস্থাশীল হবেন। কেউই আপনার ক্ষতি করার কথা ভাববেন না। কোনও একজন ভাবলেও অন্যদের সহযোগিতায় সে সমস্যা কাটাতে বেগ পেতে হবে না।
কাজের সম্পর্কে শান: অফিসে যেহেতু কাজ করতেই আসেন, তাই সকলের সঙ্গেই কাজের সম্পর্কটি ঠিক রাখুন। পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ তুলে দেওয়ার চেষ্টা করুন। কর্মক্ষেত্র সরকারি, বেসরকারি বা কর্পোরেট যাই হোক না কেন, আপনি কখনও কারও কাজে সাহায্য করলে সেই সাহায্য ফিরে পাওয়ার সুযোগও তৈরি হবে। অন্য গসিপ থেকে সরে তাই কাজের দিকেই ফোকাস করুন বেশি।
কাজের প্রতি সৎ: সময়ে কাজ সারুন, যে কাজটির দায়িত্বে আছেন, তা সততার সঙ্গে করুন। এতে নিজের মধ্যেই একটি আত্মবিশ্বাস পাবেন। উৎকোচের প্রলোভনে পা দেবেন না। অন্য সহকর্মী নির্দ্বিধায় ঘুষ খান বুঝলেও সে পথ এড়িয়ে চলুন। আসলে যাঁরা উৎকোচ দেন, তাঁদের সারাজীবন ভয় পেতে চলতে হয় উৎকোচ গ্রহীতাকে। আপনার কোনও দুর্বল সময়ে তিনি সেই উৎকোচ গ্রহণের কথা তুলে নিজে ভিকটিম কার্ড খেলতে পারেন। এটাও এক ধরনের রাজনীতি। দুর্নীতি করলে যেমন তা একটা সময় প্রকট হয়ে পড়ে, সৎ থাকলেও তা একসময় প্রকাশ্যে আসে।
বিপদের সঙ্কেত চিনুন: বিশেষ করে যাঁরা সরকারি ক্ষেত্রে উচ্চপদে আছেন, তাঁদের নানা গোপনীয় নথি নিয়ে কাজ করতে হয়। সেসব গোপনীয়তা বজায় রাখুন চিরতরে। সব কাজ ও ফাইলের একটি করে কপি নিজের কাছে রাখুন। আজকাল ডিজিটাল দুনিয়ায় আমরা অনেক উন্নতি করেছি, কাজে লাগান প্রযুক্তিকে। আপনার কাজের প্রমাণ যেন আপনার কাছেই থাকে। আপনার কোনও সই বা কাজের নথি নিয়ে কেউ যাতে বিপদে ফেলেতে না পারেন, তার যাবতীয় ব্যবস্থা সেরে রাখুন।
শেষ পাতে
অফিস নিয়ে অহেতুক টেনশন করবেন না। নানা সমস্যা আসবে, আবার তা মিলিয়েও যাবে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে বা অবিশ্বাসে না চলে বরং দলের সকলের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখুন। দেখবেন, লাভ-ক্ষতির অঙ্ক ছাপিয়ে আপনি অনেক এগিয়ে গিয়েছেন। রাজনীতির শিকার না হয়ে বা রাজনীতিতে অংশ না নিয়েও অফিস জীবন শেষ করছেন আনন্দের সঙ্গে।
অনুলিখন: মনীষা মুখোপাধ্যায়