বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
সুখী গৃহকোণ

বিকেল বেলায়
ভগীরথ  মিশ্র

বুল্টিকে আমার চেনার কথা ছিল না একেবারেই। 
কারণ, যখন ওকে প্রথম ও শেষ দেখেছিলাম, তাও সাকুল্যে মাত্র মিনিট-কয়েকের জন্য, ও ছিল একেবারে ভুরভুরে কিশোরী। শরীরের খাঁজেভাঁজে কমনীয় লাবণ্য সবে সদ্যতোলা মাখনের মতো জমছে। সারা মুখে নিপাট সারল্যের সঙ্গে তাবৎ কিশোরীসুলভ কৌতূহল ও আরও অনেক কিছু মিলেমিশে একাকার। বয়স তেরো কিংবা চোদ্দো। ক্লাস সেভেন কিংবা এইট। আমি তখন আঠারো কিংবা উনিশ। 
এখন আমি পঁয়ষট্টি। বুল্টি নির্ঘাত ষাটের আশপাশে। 
আমার দিদির শ্বশুরবাড়ি দুর্লভপুর। খুব ছেলেবেলা থেকেই ওই গ্রামে আমার ছিল ঘন ঘন যাতায়াত। বুল্টিও ওই গাঁয়েরই। সেই সুবাদে, আমি হয়তো ছেলেবেলা থেকেই ওকে বহুবার দেখেছি, কিন্তু খুব সঙ্গত কারণেই খেয়াল করিনি। কারণ, আমাদের সেই ছেলেবেলায় বারো-চোদ্দো-পনেরো ওই বয়সগুলো ঠিক কোনও মেয়েকে চোখ খুলে দেখার বয়েস ছিল না। তার উপর ছেলেবেলা থেকেই আমি ছিলাম একটু বেশিমাত্রায় ‘গুডবয়’ টাইপের। 
কিন্তু একটা বিশেষ ঘটনার পর, আমি ওকে চোখ খুলে দেখেছিলাম। তাও দু’কিস্তিতে মাত্র মিনিট কয়েক। আমার সেই আঠারো কিংবা উনিশ বছর বয়েসে। ওর তখন তেরো-চোদ্দো।  
ওই বিশেষ ঘটনাটাই তবে আগে বলি। 
তখন আমি কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে সবে ভর্তি হয়েছি। গরমের ছুটিতে গিয়েছি দিদির শ্বশুরবাড়িতে। রয়েছি বেশ ক’দিন। তখনই একদিন দিদির শ্বশুর, আমার সুজন মেসো, খুব আমুদে, দিলখোলা আর ফূর্তিবাজ মানুষ ছিলেন তিনি, রাতের খাওয়া খেতে খেতে বলে উঠলেন, পল্টুর সঙ্গে  হিমাংশুর মেয়েটার বিয়ে হলে মন্দ হয় না। 
আজকের দিনে এটা একটা হাস্যকর প্রস্তাব বটে। উনিশ বছরের সদ্য যুবকের সঙ্গে চোদ্দোর কিশোরীর বিয়ে নিয়ে বাস্তবে তো নয়ই, আজকাল স্বপ্নেও ভাবে না কেউ। কিন্তু ওইসব দিনে ভাবত। তখন এমনিতেই খুব কম বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। ভাবাভাবিটা শুরু হতো আরও আগে থেকেই। কাজেই, সুজন মেসোর প্রস্তাবে আঁতকে ওঠেনি উপস্থিত কেউই। বরং পাশে বসে পরিবেশন করছিলেন দিদির শাশুড়ি, আমার সোনামাসি, সুজনমেসোর প্রস্তাবে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন, কে? আমাদের বুল্টি? 
—হুঁ। মানাবেনি? 
—তা মানাবে। একটুখানি চুপ থেকে  সোনামাসি বলেছিলেন, বুল্টিও তো তেরো পেরিয়ে চোদ্দো’য় পড়ল। 
আজকের দিনে কথাটা শুনলে হয়তো পল্টু নামের সদ্য কলেজে ঢোকা ছেলেটি বড় একটা গা-ই করত না। পাত্তাই দিত না মেসোর কথায়। কারণ, একালের পল্টুটি ততদিনে হয়তো বা অন্য কোনও বুল্টির সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে, অথচ উনিশ বছরে বিয়ের কথা স্বপ্নেও ভাবছে না। কিন্তু ওইসব দিনে, সব পল্টুই যে উনিশ-বিশ-এ বিয়ে করে ফেলত তা নয়, তবে, ওই বয়সে বিয়ের কথা ওঠামাত্র ‘সাপের গায়ে  পা পড়েছে’ গোছের আঁতকেও উঠত না। বরং সম্ভাবনাটা নিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলতেই অভ্যস্ত ছিল। কাজেই, যেহেতু আমারই ডাকনাম পল্টু, সুজন মেসোর প্রস্তাব এবং সোনামাসির প্রতিক্রিয়াটুকু শোনামাত্র বুকের মধ্যে শুরু হয়ে গেল হাজারো কিসিমের উবুর-ডুবুর খেলা। চলতে লাগল, ডুব সাঁতারে, বুকের মধ্যেকার সরসীটিতে এপাড় ওপাড় করা।
প্রথম প্রশ্ন, বুল্টি নামের মেয়েটি দেখতে কেমন? ফর্সা? সুন্দরী? পড়াশোনা কী করে? আমার সঙ্গে কতখানিই-বা মানাবে? তাছাড়া, কেবল সুজন মেসো আর সোনামাসি চাইলেই তো হল না, মেয়েটিরও তো সায় থাকা দরকার। সে কি আমাকে পছন্দ করবে? 
প্রথম দিকের প্রশ্নগুলোর সমাধান হয়ে গেল পরের দিন বিকেলে। 
দিদির ছোট দেওর রতন, আমারই বয়সি। ওর সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই আমার ভারি ভাব। যে ক’দিন দিদিদের বাড়িতে থাকি, বারোআনা সময়ই রতনের সঙ্গে কাটে। ওই বিকেলেও আমরা দুর্গা মন্দিরের লাগোয়া কাঠের গুঁড়িটায় বসে আড্ডা মারছিলাম। সামনের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল এক কিশোরী। তলায় কুঁচি দেওয়া গোলাপি রঙের ফ্রক পরে ওকে ঠিক ফুলপরির মতো লাগছিল। 
কিশোরীকে দেখামাত্র ডাক পাড়ে রতন, অ্যাই বুল্টি, শুন্‌।
রতনের ডাকে থমকে দাঁড়ায় কিশোরী। সারা মুখে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। একসময় সামনেটিতে এসে গল্প-উপন্যাসের ভাষায় ‘লজ্জাবনত’ মুখে দাঁড়ায়। 
রতন বলে, হিমাংশু-কাকা সদরে গিয়েছিলেন, ফিরেছেন ? 
মাথা দুলিয়ে সায় দেয় কিশোরী। 
—আমি একটা বই আনতে বলেছিলাম, আনছেন কি না জানিস? 
তার জবাবে কিশোরী দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেয়, জানে না।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে রতন বলে, আচ্ছা, যা তুই। 
যেন তৈরিই ছিল, বলামাত্র কলের পুতুলের মতো হাঁটতে শুরু করে কিশোরী। এবং বেশ দ্রুতপায়ে হেঁটে অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের নজরের বাইরে চলে যায় সে। 
ততক্ষণে অন্তত তিনটে বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার কাছে। এক, এই কিশোরীই বুল্টি, গতকাল রাত থেকেই যাকে নিয়ে অপার কৌতূহল জেগেছে আমার মনে। শুরু হয়ে গিয়েছে, বুকের মধ্যে অচেনা ঢাকের গুরুগুরু গুরুগুরু আওয়াজ । দুই, গায়ের রঙে, মুখশ্রীতে, ঢলঢল চাউনিতে, মেয়েটি আমার প্রত্যাশার চেয়েও ঢের বেশি সুন্দরী। আর তিন, যে ক’মিনিট আমাদের সুমুখে দাঁড়িয়ে ছিল ও, সারাক্ষণ চোখদুটো বিঁধিয়ে রেখেছিল পায়ের তলার জমিতে। পলকের তরেও দৃষ্টি তুলে তাকায়নি আমার দিকে। এতটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি এই কারণে যে, আমি তো ওই ক’মিনিট একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ওর মুখের দিকে।
এক লহমার তরেও পলক অবধি ফেলিনি। ইশ, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, পলকের তরেও আমার পানে তাকানোর প্রয়োজনই বোধ করল না ও! ইশ!  
আমার শেষতম কৌতূহলের অবসান ঘটেছিল ক’দিন বাদে। 
সেদিন, সেই এক শেষ বিকেলে, একা-একাই হেঁটে যাচ্ছিলাম দুর্গা মন্দিরের পাশের গলিপথ দিয়ে। কেন জানি বুল্টির কথাই ভাবতে ভাবতে খুব বুঁদ হয়ে হাঁটছিলাম। উল্টোদিক থেকে, কনেদেখা রোদ্দুরে সারা শরীর ডুবিয়ে, হেঁটে আসছিল বুল্টি। যখন হুঁশ হল, ও তখন আমার থেকে হাত পাঁচেক দূরে, এক্কেবারে মুখোমুখি। এবং আমি আমার শরীর দিয়ে সামনের সঙ্কীর্ণ পথটি আগলে রাখার কারণে, অপরপক্ষ, বন্দি পাখির মতোই, মনে মনে যারপরনাই অসহায়, বিপন্ন। 
তবে, বেশিক্ষণ বিপন্ন রাখিনি ওকে। ওই যুগের ‘গুডবয়’ আমি, তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়িয়েছিলাম পাশটিতে। 
সামনের রাস্তা ক্লিয়ার পেয়ে পুনরায় হাঁটতে শুরু করেছিল বুল্টি নামের কিশোরীটি। আমাকে পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমার মুখের উপর ঠিক এক পলকের তরে তাকিয়েছিল। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে ওর লালচে ঠোঁটজোড়া ভেঙে উঁকি মেরেছিল, কমলার ছাড়ানো কোয়ার মতো এমনই একচিলতে অনির্বচনীয় হাসি, আমি পলক ফেলতেই ভুলে গেলাম।
যখন হুঁশে ফিরলাম, ততক্ষণে আমার নজরের পুরোপুরি বাইরে চলে গিয়েছে বুল্টি। তবে, ততক্ষণে আমার শেষতম কৌতূহলটা পুরোপুরি মিটিয়ে দিয়ে গিয়েছে ও। সেদিন নৈশভোজের আসরে যে-কথাটা তুলে সুজন মেসো আমার বুকের সরসীতে একটা মৃদু অথচ স্থায়ী তরঙ্গ তুলেছিলেন, হয়তো ওই ক’দিনে কোনওভাবে ওর কানেও গিয়েছে কথাটা। ওইদিন, কনেদেখা ওই বিকেলে, কমলার কোয়াভাঙা ওই একপলক হাসি দিয়ে সে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সুজন মেসোর প্রস্তাবটা তার খুবই পছন্দ হয়েছে। 
পরবর্তীকালে, সেই একপলক হাসির সঙ্গে তুলনামূলক উপমা খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে, স্রেফ কমলার কোয়াভাঙা হাসি নয়, সেদিন মুঠোর মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা লাল গোলাপের আধফোটা কুঁড়িও যেন  চকিতে আমার গায়ে ছুড়ে মেরেই দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল বুল্টি।   
তারপর... দিন কেটে গেল, দিন থেকে মাস, বছর...। দেখতে দেখতে বুল্টি ষাটের আশপাশে, আর, আমি পঁয়ষট্টি, ওই লাল গোলাপের আধফোটা কুঁড়িটিকে বুকের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেই আমার কেটে গেল এতগুলো বছর! 
না, ওর কথা ভাবতে ভাবতে বিবাগী হয়ে গেলাম, তেমনটা  ঘটেনি। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে, যথাসময়ে বিয়ে-থা করেছি। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিও। কিন্তু এতকাল বাদে অস্বীকার করতে পারিনে, সেই এক কনেদেখা বিকেলে বুল্টি নামের এক কিশোরীর আমাকে লক্ষ্য করে চকিতে ছুড়ে মারা লাল গোলাপের কুঁড়িটিকে এতগুলো বছর শুকিয়ে যেতে দিইনি। 
সেটা বুঝতে পারলাম, যখন এতগুলো বছর বাদেও দেখামাত্তর বুল্টিকে চিনে ফেললাম। এবং তৎক্ষণাৎ পঁয়ষট্টি বছুরে বুকের মধ্যে গুরুগুরু... গুরুগুরু... মাদলের বাদ্যি!   
সাকুল্যে মিনিট কয়েকের দেখা সেদিনের সেই কিশোরীকে আমি কিনা দেখছি ওর ষাট ছুঁইছুঁই বয়সে! বাস্তবিক, ওই বয়সি একজন প্রৌঢ়ার মধ্যে একজন চোদ্দো বছরের কিশোরীকে আবিষ্কার করাটা মোটেও সহজ নয়। 
তাও যে বুল্টিকে প্রথম দেখাতেই চিনে ফেললাম, তার মূলত দুটো কারণ। এক, চোদ্দো বছরের ওই কিশোরী মুখখানি সেই যে আমার মনের মধ্যে থিতু হয়ে গিয়েছিল, এতগুলো বছরেও তা একতিল ফিকে হয়নি। দুই, কিছু মানুষের মুখের ধরনটাই এমন, বয়স যতই বাড়ুক, একটা আদল থেকেই যায়। বুল্টির মুখের আদলটাও তেমনই। বয়েস বেড়েছে। মুখমণ্ডলসহ সমস্ত শরীরে সময় তার থাবা বসিয়েছে যথাসাধ্য। কিন্তু তাও প্রথম দর্শনে আমার খুব নিশ্চিতভাবে মনে হল, এ বুল্টি না হয়ে যায় না।  
রতনের নাতনির বিয়েতে গিয়েছি আমি। বুল্টিও একই উপলক্ষে এসেছে। একা নয়, একেবারে বউমা এবং নাতি-নাতনি সহকারে। 
দেখার পর থেকেই সারাক্ষণ ওই প্রৌঢ়া শরীরটিকে অজান্তে অনুসরণ করছিল আমার দু’টি চোখ। 
এই দীর্ঘ সময়কালে খুব স্বাভাবিক কারণেই অনেকটাই বদলে গিয়েছে বুল্টি। বেশ গিন্নিবান্নি চেহারা হয়েছে ওর। সিঁথিতে ডগমগ সিঁদুর। কালো বুটি দেওয়া দুধসাদা ঢাকাই জামদানিতে গিন্নিপনাটা ফুটেছেও খুব। মাথার চুলগুলি হয়েছে শনের মতো সাদা। সারা শরীরে যৎপরোনাস্তি মেদ জমেছে। শরীরের ফর্সা ত্বকে বয়সজনিত কুঞ্চন। বাঁ হাঁটুতে ব্যথা থাকার কারণে ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। 
এসব তো নেহাতই বহিরঙ্গের পরিবর্তন। স্বভাবের পরিবর্তনও তো কিছু কম হয়নি বুল্টির।  
প্রথমত, ওই তেরো-চোদ্দো’র ‘লজ্জাবনতা’টি একেবারেই নেইও। বরং ঠিক তার উল্টো। বেশ রাশভারী গলায় অবিরাম কথা বলে চলেছে। বেশ দেমাকি পায়ে চলাফেরা করছে।  অল্পবয়সিদের বেশ দাপটের সঙ্গে নির্দেশাদি দিচ্ছে। আর, কথায় কথায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। দেখছিলাম, নাতি-নাতনিগুলো সারাক্ষণ ওর পিছে পিছে ছায়ার মতো ঘুরছে। ছেলের বউটিও পদে পদে নির্দেশ-পরামর্শ নিচ্ছে ওর থেকে। বুঝলাম, যে সংসারেই যাক, বেশ শক্ত হাতে সংসারের রাশটি টেনে রেখেছে বুল্টি।     
 অথচ, সেই যে তেরো নাকি চোদ্দো বছর বয়সে লালচে ঠোঁটজোড়াকে ঠিক কমলালেবুর কোয়া ভাঙার মতো করে হেসেছিল, ইশ, ওই একপলক হাসির সমতুল একটি যোগ্য উপমা খুঁজে বের করতে আমার এতগুলি বছর কেটে গেল! অথবা আমার গায়ে চকিতে ছুড়ে মারা লাল গোলাপের অদৃশ্য কুঁড়িটিকে তরতাজা রাখতে কত নিঃশব্দে এতগুলো বছর ডুবসাঁতারে পেরিয়ে এলাম আমি!   
দুই
আঠারো-উনিশে যে দৃষ্টিতে তাকানো চলে না কোনও তেরো-চোদ্দোর কিশোরীর মুখের পানে, যেসব কথা অকপটে বলা চলে না, ষাট-পঁয়ষট্টিতে পৌঁছে ওগুলোই যে কত অবলীলায় বলে ফেলা যায়, কতখানি সহজসাধ্য হয়ে ওঠে, তা টের পেলাম একটু বাদেই। ওই বয়সে পৌঁছে ষাট বছরের এক প্রৌঢ়ার সামনে যে কিঞ্চিৎ প্রগলভও হওয়া যায় স্বচ্ছন্দে, তার প্রমাণও পেয়ে গেলাম ওইসঙ্গে।  
শেষ বিকেলে সদরদিঘির পুবপাড়ে একা একা বসে স্থিরপলকে সূর্যাস্ত দেখছিল বুল্টি। 
কাছটিতে গিয়ে একেবারে অসঙ্কোচে শুধোই, কেমন আছো? 
চকিতে মুখ ফেরায় বুল্টি। ভারি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। দু’চোখে উপচে পড়ে কয়েক আঁজলা খুশি। 
আমার মুখের ওপর ওর মেদভরাট চোখের তারাদু’টি বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়। একসময় খুব উচ্ছল গলায় বলে ওঠে, ভালো আছি। আপনি তো পল্টুদা। 
...কী আশ্চর্য! আমি যারপরনাই অবাক হই, এতকাল বাদে কেমন করে এক লপতেই চিনে ফেললে আমায়? 
—মেমোরিটা বুঝুন তবে! বুল্টি চোখ নাচায়। চোখের তারায় হাসে। বলে, আপনি তো তাও প্রথম দিন মিনিট দেড়েক আর দ্বিতীয় দিন তিরিশ সেকেন্ড, সাকুল্যে পাক্কা দু’মিনিট দেখেছিলেন আমায়। আমি তো মাত্র ওই তিরিশ সেকেন্ড। প্রথমদিন তো চোখ তুলে তাকাইনি আপনার দিকে। তাও...। 
বলে কী! আমি বুঝি বিস্মিত হতেও ভুলে যাই, এই নাকি সেই কত বছর আগে দু’মিনিটের জন্য দেখা মুখচোরা কিশোরীটি! এ মেয়ের মুখে তো চড়াচ্চড় খই ফুটছে! আধা-শতাব্দী আগে কে কার দিকে কতক্ষণ তাকিয়েছিল, সবই তো মনে রেখেছে! 
বলে, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না। 
বলতে বলতে বুল্টির মুখমণ্ডল খুব নরম হয়ে ওঠে। কমনীয় গলায় বলে, একটু বাদেই সূয্যি ডুববে। এদের বাড়ির দিঘির ওই পাড়টা খুব ভালো একটা সানসেট পয়েন্ট। সেই ছেলেবেলা থেকেই এখানে বসে সানসেট দেখতে আমার দারুণ লাগে। 
পাশটিতে বসলাম। তারপর... একটু একটু করে গল্পগুজবে মেতে উঠলাম দু’জনেই। 
বুল্টির বিয়ে হয়েছিল মানিকপাড়ায়। ঝাড়গ্রামের থেকে বেশি দূরে নয়। ওখানেই কেটেছে স্বামীর ছেলেবেলাটা। পড়াশোনা বিএ অবধি ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে। ওকালতির পাঠ নিয়েছেন রাঁচিতে। এখন প্র্যাকটিস করেন মেদিনীপুর জেলা সদরে।  ছেলেটি পাঁশকুড়ার আশপাশে কোনও কলেজে পড়ায়। বউমা পড়ায় মেদিনীপুর গার্লস স্কুলে। রোজ চান-খাওয়া সেরে বেরিয়ে যায় দু’টিতে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে। কর্তা তো তাঁর ওকালতি, মক্কেল আর চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই, নাতিপুতি নিয়ে পুরো সংসারটা চেপেছে বুল্টিরই ঘাড়ে। আর, নাতি-নাতনি দুটোও হয়েছে তেমনি। সারাক্ষণ দিদা বলতে অজ্ঞান। বাবা-মাকে চেনেই না। একমাত্র মেয়েটির বিয়ে হয়েছে খড়্গপুর শহরে। জামাইয়ের ট্রান্সপোর্টের বিজনেস। জামাই অত ঘন ঘন আসতে পারে না, তবে মেয়েটা সপ্তাহে অন্তত একটিবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে আসে। বুল্টির শ্বশুর-শাশুড়ি কবেই মারা গিয়েছেন। মানিকপাড়ার বাড়িটা তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। আশপাশের চাষের জমিগুলো বিক্রি হয়ে গিয়েছে কবেই। বাড়িসুদ্ধ ভিটেটাও অ্যাদ্দিনে বিক্রি হয়ে যেত। কেবল পৈতৃক ভিটে বলেই  কিঞ্চিৎ দ্বিধায় রয়েছেন স্বামী। যতই হোক বাপ-মার স্মৃতি বিজড়িত ভদ্রাসন। বুল্টিও ওই নিয়ে জোর করে না। কেনই-বা  করবে! পৈতৃক ভিটের প্রতি মানুষের আবেগ তো থাকবেই। 
শুনতে শুনতে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, কোনও ভুরভুরে কিশোরীর সঙ্গে নয়, আমি কথা বলছি একজন জবরদস্ত প্রৌঢ়ার সঙ্গে, যে কিনা ইতিমধ্যেই দাপটের সঙ্গে পেরিয়ে এসেছে জীবনের অতগুলি বছর! 
বুল্টি থামলে পর শুধোই, দিনভর যে বাচ্চাগুলো তোমার পিছু পিছু ঘুরছিল, ওরা যে নাতি-নাতনি, তা বুঝেছি। ছেলেদের, না মেয়েদের?
—‘দের’ নয়, আমার ছেলে-মেয়ে একটি করে। উপস্থিত, নাতি-নাতনিগুলো ছেলের থেকে পাওয়া। মেয়ে তো তার বাচ্চাদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে। 
—কর্তা আসেননি ?
—কর্তা? যেন কী এক অসম্ভব কথা বলে ফেলেছি, সেজন্য বুল্টির ভুরুজোড়ায় ভাঁজ পড়ে। 
ঠোঁট উল্টে বলে, উনি মাত্র দু’দিনের জন্য এলেও দেশের বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ফিক করে হাসে বুল্টি, সদর কোর্টের জবরদস্ত উকিল উনি। দিনরাত কেবল কোর্ট, মক্কেল আর চেম্বার। এর বাইরে আর কিচ্ছুতে নেই উনি। সত্যি কথা বলতে কী, এতো তাও আত্মীয়তুল্য মানুষের বাড়িতে অনুষ্ঠান, স্বয়ং যমরাজ যদি কোনওদিন এসে বলেন, চলুন উকিলবাবু, আপনাকে নিতে এসেছি, তো আমার কর্তাটি অবলীলায় বলে দেবেন, এখন তো আমার মরারও সময় নেই ভাইটি। না-হোক আধা-ডজন শাঁসালো মক্কেল হাজতে পচছে। ওদের জামিনটা না করানো অবধি আমার তো কোত্থাও যাবার জো-টি নেই। 
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে বুল্টি। 
তখন থেকে বুল্টিই কলকলিয়ে বলে চলেছে সমানে। চুপটি করে শুনে চলেছি আমি। শুনছি, আর ভাবছি। ভাবছি সেই এক বিকেলের কথা। কথা বলা তো দূরের কথা, বুল্টি সেদিন এক পলকের অধিক তাকায়নি অবধি আমার দিকে। সেই বুল্টি আজ তখন থেকে প্রায় একাই কলকলিয়ে বলে চলেছে কতকিছু। আমাকে দু’একটি কথার বেশি বলবার অবকাশই দেয়নি। আর, কী সাবলীল ওর কণ্ঠস্বর! কত আড়ষ্টতাহীন ওর চোখমুখের অভিব্যক্তি! 
বুঝতে পারি, পরিণত বয়সই ওকে দান করেছে এইসব। এই সাবলীল, সপ্রতিভ, প্রগলভ আচরণ। তার বদলে কেড়ে নিয়েছে ওর বুকের ভেতর থেকে তাবৎ আড়ষ্টতা ও ব্রীড়াজাতীয় কিশোরীসুলভ অলঙ্কারগুলি। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে একজন পোড়খাওয়া প্রৌঢ়া মহিলা তাঁর ভরভরন্ত সংসারটি হাট করে মেলে ধরেছেন একজন স্বল্পপরিচিত প্রৌঢ়র সামনে। 
নিজের প্রিয় সংসারটির প্রায় সব কথা বলা হয়ে গেলে পর, একসময় পুরোপুরি থামে বুল্টি।        
ওই সময়টুকুর জন্যে বুঝি অপেক্ষা করছিলাম আমি। 
কাজেই, বুল্টি থামা মাত্তর, প্রগলভতার সুতোটিকে অল্প-খানিক ঢিলে দিই। বলি, একদা আমার সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা উঠেছিল, তা কি জানো? 
তৎক্ষণাৎ বুল্টির মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটে যায়। 
আমার কথায় প্রৌঢ় মুখমণ্ডলটি জুড়ে গোলাপি আভা জমে। মৃদু গলায় বলে ওঠে, জানি বইকি। কিন্তু সে বিয়ে তো হয়নি। 
—কেন হয়নি, তা কি জানো? 
—তাও জানি। বুল্টি একপলক অপাঙ্গে দেখে নেয় আমায়, আপনি চাননি, তাই হয়নি। 
—আমি চাইনি? সহসা বুল্টির সঙ্গে কলহের সাধ জাগে আমার, তোমাকে  কে বলেছে এই ডাহা মিথ্যেটা? তুমি জানো, ওই বয়সে কেবল তোমাকেই নয়, তোমার বুল্টি নামটিকেও খুবই পছন্দ হয়েছিল আমার! 
আমার শেষ কথাটা শোনামাত্র দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকায় বুল্টি। 
বিড়বিড় করে বলতে থাকে, বাব্বা, অ্যাদ্দিন বাদেও মনে রেখেছেন নামটা? তাও আবার ডাকনামটাই? 
বলতে বলতে সহসা প্রগাঢ় লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে বুল্টির মুখখানি। সলজ্জ দৃষ্টিতে আমার দিকে একঝলক তাকিয়েই পরমুহূর্তে নামিয়ে নেয় চোখ। তার মুখমণ্ডল জুড়ে বয়সের তাবৎ রেখাগুলি অতি দ্রুত মুছে যেতে থাকে।
পশ্চিম দিগন্তে সূর্যটা তখন একটা ডগমগ সিঁদুরের টিপ! 
অস্তগামী সূর্যটাকে দেখতে দেখতে, ষাট উত্তীর্ণা প্রৌঢ়া বুল্টি আমার চোখের সমুখে এক লহমায় কিশোরী হয়ে যায়!
অঙ্কন: সুব্রত মাজী
4Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পরিবারের কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্বাস্থ্য সমস্যায় বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। পেশাদারি কাজকর্মে হঠাৎ বাধা আসতে পারে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৮৬ টাকা৮৭.৬০ টাকা
পাউন্ড১০৭.৩১ টাকা১১১.০৭ টাকা
ইউরো৮৯.৩৪ টাকা৯২.৭৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা