মানুষ কাকু,
দেখেছ? শুরু করতে না করতেই কেমন হো হো হি হি শুরু হয়ে গেছে! চিরটাকাল আমি এইই দেখে এসেছি। আমার কোনও কথাই যেন সিরিয়াসলি নিতে নেই। আমি যেন দুধ-ভাত! আচ্ছা মানুষ কাকুকে আমি কী বলে ডাকব? ছাগল কাকু? গোরু কাকু? কুকুর কাকু?
বেশ, ‘মানুষকাকু’ নামকরণের ব্যাকগ্রাউন্ডটা এইখানে শুনিয়ে রাখি। এখন আমি খুব ছোট, মা ঢুকেছে বাথরুমে। ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। ফোন মানে এখনকার ঢাউস স্মার্ট-ফোন নয়। ছোট, হাতের মুঠোয় ধরে যায়— সেই ফোন। ফোনটা বেজেই চলেছে, মা-ও বেরচ্ছে না বাথরুম থেকে, কী মনে হল, আমি ফোনটা হাতে নিলাম। যে বোতাম টিপলে কথা শোনা যায় সেটুকু জানতাম। টিপলাম বোতাম, তারপর কানে লাগিয়ে বললাম, ‘হ্যালো’, ওদিকে কোনও সাড়া নেই। রাগ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তুমি? জবাব দিচ্ছ না কেন?’ এবারে একটা হাসির আওয়াজ শোনা গেল। উত্তর এল, ‘আমার নাম মানুষ।’
ততক্ষণে মা বেরিয়ে এসেছে। আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে জানতে চেয়েছে, ‘কে ফোন করেছে?’ জবাব দিয়েছিলাম, ‘মানুষ কাকু’, শুনে মা তো হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েছে। আমিও ভুল কোথায় করেছি বুঝতে না পেরে দুম দুম করে পা ফেলে ঢুকে গেছি শোবার ঘরে। ... সেই থেকে তুমি হয়ে গেলে মানুষ কাকু।
আস্তে আস্তে তোমার গলাটা চিনে গেলাম, মা ধারে-কাছে না থাকলে ফোন ধরে দিব্যি কথাবার্তাও চালিয়ে যেতাম। মা অবশ্য ফোনটা কেড়ে নিয়ে অন্য ঘরে চলে যেত। আর অনেকক্ষণ ধরে তোমার সঙ্গে কথা বলত। ক্রমশ লক্ষ করতে শুরু করলাম, বাবা যখন বাড়িতে থাকে না বেছে বেছে সেই সময়েই তোমার ফোন আসে। তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বললেই মার মুখটা খুশি খুশি হয়ে ওঠে। পুরোটা না খেয়ে উঠে গেলেও বকে না। কথা বলতে বলতে মা কখনও ব্যালকনিতে চলে যায়, গ্যাসে কী একটা চাপানো ছিল সেটা নামিয়ে অন্য কিছু চাপিয়ে দেয়, সিঁড়িতে বসে পা দোলাতে দোলাতে কিংবা জানলার সামনে চেয়ার টেনে বসে রাস্তা দেখতে দেখতে কথা বলে, বলেই চলে। সেই সময় মাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে জবাব আসে, ‘তোমার মোজা কোথায় রেখেছ আমি কী করে জানব?’ অথবা ‘রাতেই স্কুল-ব্যাগ গুছিয়ে রাখোনি কেন?’
আমারও রাগ হয়ে যায়। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করতে থাকি। চেয়ারটা টেনে সরাই, যাতে শব্দ হয়। মা তখন মুখ লাল করে এসে আমাকে টানতে টানতে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
স্কুল থেকে ফিরে যদি দেখতাম মা তোমার সঙ্গে কথা বলছে, বলে দিতে হতো না, মুখ দেখেই বোঝা যেত ফোনের অন্য পাশে তুমি ছাড়া কেউ নেই, নির্দেশ ছিল কোনওভাবেই যেন ডিসটার্ব না করি। স্কুলব্যাগ ঠিক জায়গায় রেখে বাথরুমে ঢুকে ড্রেস চেঞ্জ করে টেবিলে খাবার খেয়ে চুপচাপ উঠে যাওয়াই ছিল নিয়ম।
একবার হল কী, স্কুল থেকে ফিরলাম পেটব্যথা নিয়ে। স্কুলেই দু’বার যেতে হয়েছে। বাড়ি ফিরে সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম বাথরুমে। এত শরীর খারাপ লাগছিল যে সোজা গিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। কানে মোবাইল, কিন্তু আড়চোখে সবই নজর রাখছিল মা। ফোন কেটে ছুটে এল। জিজ্ঞেস করল— ‘কী হয়েছে রে? শরীর খারাপ?’ ঘাড় নেড়ে যেই না পাশ ফিরে শুয়েছি, শুরু হল বকুনি— ‘সেটা মুখ ফুটে বলতে কী হয়?’ দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করেছিলাম, কিন্তু একবারও বলিনি, ‘বারণ আছে যে! কেমন করে বলি বল?’
আমাদের সম্পর্কে শেষ পেরেকটা পড়ল মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়। ইতিহাস পড়তে বসলেই আমার গায়ে জ্বর আসত। সাল-তারিখ সব গুলিয়ে যেত। কোনটা আগে আর কোনটা পরে কিছুতেই মনে থাকত না। মা ছিল ইতিহাসের ছাত্রী। একদিন সাহস করে বললাম, ‘ইতিহাসটা একটু দেখিয়ে দেবে?’ মা একগাল হেসে বলল, ‘ইতিহাস? ও তো সবচেয়ে সহজ। পরীক্ষা আসুক। একদিন নিয়ে বসব। দেখবি সব জলের মতো হয়ে যাবে। সেই ‘একদিন’ ঠেলতে ঠেলতে গিয়ে পৌঁছল পরীক্ষার আগের দিন। আমি তো বইপত্র গুছিয়ে রেডি। কখন মা’র হাত খালি হবে। মা ছিল রান্নাঘরে, সন্ধ্যা হব-হব, তখনই ফোনটা এল। আমার তো বুক ঢিবঢিব শুরু হয়ে গেছে। উঁকি মেরে দেখলাম, যা ভেবেছি ঠিক তাই। আদুরে আদুরে মুখ করে মা তোমার সঙ্গে কথা বলছে। মার সামনে এক চক্কোর ঘুরে এলাম। মা তেড়ে এল,— ‘এখানে কী? কাল পরীক্ষা না? যাও বইখাতা নিয়ে বস।’ মুখ শুকনো করে ঘরে ফিরে এলাম। বই খুললাম। কিছুতেই মন বসাতে পারলাম না। অক্ষরগুলো চোখের সামনে নেচে বেড়াতে লাগল। এর মধ্যে মা রান্নাঘর থেকে ব্যালকনিতে গিয়ে বসেছে। কেটেও গেছে প্রায় একঘণ্টা। শেষ অবধি মরিয়া হয়ে মা-র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখেই মার মুখ কালো হয়ে গেল। বলল, ‘কী হল, কানে যায়নি কথা?’ জবাব দিলাম, ‘কাল ইতিহাস পরীক্ষা, তুমি বলেছিলে যে জায়গাগুলো আটকে গেছে বুঝিয়ে দেবে। তাই...।’ নিমপাতা খাবার মতো মুখ করে মা তোমাকে বলল, ‘এখন ছাড়ি। সারাদিন ঝি-গিরি করেও ডিউটি শেষ হয়নি। এবার যাব মেয়ের পড়া বুঝিয়ে দিতে।’ তারপর তো এল পড়া বুঝিয়ে দিতে। সে যে কী বোঝানো যে বুঝিয়েছে সে-ই শুধু জানে। সহজ জিনিসগুলো কেন বুঝতে পারছি না তাই নিয়ে মারতে শুধু বাকি রেখেছিল। পরদিন পরীক্ষার হলে বসে দেখলাম যেটুকু জানতাম তাও ভুলে গেছি। নিজেকেই অভিশাপ দিলাম, কী দরকার ছিল মাকে ডেকে আনার?
ও হ্যাঁ, আর একদিনের কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। সেটা অবশ্য আরও আগের। আমি তখন খুব ছোট। তিনজনে মিলে যাওয়া হয়েছিল দিঘায়। তখনকার দিঘাকে এখন কেউ খুঁজে পাবে না। বালিয়াড়ি তখন সোজা নেমে যেত সমুদ্রে। ঝাউবনও ছিল অনেক ঘন। সারাটা দিন বালি মেখে আর ছুটোছুটি করে হোটেলে ফিরে আমার তো চোখ জড়িয়ে এসেছে। জোর করে দুটো মুখে গুঁজে দিল মা। সবে শুতে গেছি— ফোন। ধড়মড় করে উঠে ফোন হাতে নিল মা। তারপর আড়চোখে বাবাকে দেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কতক্ষণ কথা বলেছিল বলতে পারব না, কারণ ওই অবধি দেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখেছিলাম একটা চাদর পেতে মেঝেতে বিছানা করেছে মা। আর খাটে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে বাবা। বাবা আর মা দু’জনেই যে জেগে আছে বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
পরের কথায় আসি। স্কুলের পাট তো চুকল। যেমন-তেমন রেজাল্ট করে ঢুকলাম কলেজে। কলেজে গিয়ে কিন্তু পড়াশোনা মাথায় উঠল। আমার মনপ্রাণ জুড়ে বসল থিয়েটার।
গোড়ার দিকটায় মন খারাপ লাগত। আমার তো বাংলা মিডিয়াম। কটকট ইংরেজি বলতে পারি না। ইংরেজি মিডিয়াম থেকে আসা মেয়েগুলোকে দেখে হীনমন্যতায় ভুগতাম। বন্ধুও ছিল না বিশেষ। সব পালটে গেল কলেজ সোশ্যালের পর। বসন্তসেনার ভূমিকায় অভিনয় করে ফাটিয়ে দিলাম। সেই থেকে আমাকে দেখলে অন্যরা সমীহ করে পথ ছেড়ে দিত।
স্কুলে পড়তে আবৃত্তি শিখতাম। আবৃত্তির ক্লাসে বাবা নিয়ে যেত হাত ধরে। দুয়েকটা ছোটখাট রোল-এ অভিনয়ও করেছি। স্কুলেই। বলার মতো কিছু নয়। মজার ব্যাপার হল, মা কিন্তু একসময় গান শিখত। ক্লাসিক্যাল। কিন্তু কখনওই আমাকে গানের দিকে টানার চেষ্টা করেনি। আমার মনে হতো, মা চায় না আমি মার থেকেও ভালো গান গাই। আমার আবৃত্তি শেখা এবং অভিনয়ের হাতেখড়ি যা কিছু সবই বাবার জন্য।
কলেজ সোশ্যালের ওই প্রোগ্রামটা, পরে শুনেছি নাট্যজগতের কেউ কেউ দেখতে এসেছিলেন। ডাক পড়ল থিয়েটারে। ছোটখাট দল, ছোটখাট রোল। সেখান থেকে বড় দল, ছোট রোল। এইভাবে একসময় বড় রোল। আর তারপরেই, মস্ত একটা লাফ। টিভি সিরিয়াল। এবং সিনেমা। হিরোইনের রোল এখনও পাইনি। তবে পাব যে সে আভাস পেতে শুরু করেছি। দরকার শুধু হিসেব করে পা ফেলা। তবে খেলার নিয়মকানুনগুলো রপ্ত হয়ে এসেছে। এখন ধৈর্য ধরে সুযোগ আর সময়ের অপেক্ষা করা।
হ্যাঁ, এইখানে মজার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে নিই। অভিজ্ঞতাটা মাকে নিয়ে। কোনও সিনেমা যখন রিলিজ করে তার আগে একটা বিশেষ শো হয়। সেখানে সাংবাদিক, সমালোচক, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব এঁদের ডাকা হয়। সিনেমাটা দেখানো হয়। সিনেমার পরিচালক— প্রযোজক অভিনেতা কলাকুশলী তাঁরাও উপস্থিত থাকেন। তেমনই একটা অনুষ্ঠানে আমার ডাক পড়ল। কার্ড খুলে দেখা গেল বাবা-মাও আমন্ত্রিত।
বাবা তো কোথাও যেতে চায় না, আমার ইচ্ছা ছিল বাবা আমার সঙ্গে যাক। মেয়ে কেমন অভিনয় করছে, তা দেখে সবাই কেমন তারিফ করছে তার কিছুটা স্বাদ পাক। ও হরি! অবাক হয়ে দেখলাম ফাংশন শুরু হওয়ার তিন ঘণ্টা আগে থেকেই মা সাজতে বসেছে। তারপর যখন বাবার সঙ্গে হলে ঢুকল, দেখতে তো ভালো, সবাই দেখি ঘাড় ঘুরিয়ে মাকেই দেখছে। আমার তো রাগে মাথার তালু অবধি দাউদাউ করে জ্বলছে। এই ভদ্রমহিলা, আমার অভিনেত্রী হওয়ায় যাঁর কনট্রিবিউশন শূন্য, তিনিই এখন সবার অ্যাটেনশনের কেন্দ্রে? অথচ যে মানুষটা রোদে জলে কষ্ট করে আমাকে নিয়ে আবৃত্তি শেখাতে যেত, মার পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে, তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না! কেউ কেউ আবার মাকে চিনতেও পারল। এমন কথাও শোনা যেতে লাগল, ‘হবে না? গান-সুর-অভিনয় সবই আর্ট-এর এপিঠ-ওপিঠ। রক্তে থাকলে কোনও না কোনওভাবে প্রকাশ ঘটবেই।’ দেখলাম সমস্তই অহঙ্কারী মুখ করে মা শুনছে। ভাবখানা, ‘তবে পেটে ধরেছিলাম বলেই না মেয়ে এতদূর আসতে পেরেছে!’
এবারে সময় হয়েছে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। ওর নাম রূপম। আমি রূপ বলে ডাকি। অভিনয়ের সূত্রেই আমার সঙ্গে আলাপ। তবে ও অভিনয় করে না— গান লেখে, সুর দেয়। তারপর সেই গান গুনগুন করে গিটার বাজিয়ে গায়। এর মধ্যেই একটা-দুটো গান হিট হয়েছে।
ও কিন্তু ভালো ছাত্র ছিল। ঢুকেছিল ডাক্তারি পড়তে, ‘ছাড়লি কেন’, জিজ্ঞেস করলে হেসে বলে, ‘নারে, ও রাস্তা আমার জন্যে নয়। কিছুদিন ক্লাস করেই বুঝে গেলাম ছুরি-কাঁচির আওয়াজের থেকে গিটারের সুর অনেক কাছের জিনিস। এই-ই বেশ আছি।’ আমার অবশ্য অন্য কথা মনে হয়। ও যদি ডাক্তারিই পড়ত, আমাদের তো দেখা হতো না। আর দেখা না হলে আমার কী হতো?
রূপকে ছেড়ে এক মিনিটও আমি থাকতে পারি না। ও যখন গান গায় ওর চোখের তারায় একটা গানের পাখি এসে বসে। ও দেখতে পায় না। আমি দেখি, আর মনে মনে বলি, পাখিটা যেন উড়ে না যায়। গলায় ঠিক ঠিক সুর লাগলে রূপ আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমি আত্মহারা হয়ে যাই।
রূপের একটা দুঃখের জায়গা আছে। রূপ যখন খুব ছোট, ওর মা অন্য কারও সঙ্গে চলে যায়। মা-র স্মৃতি রূপের কাছে আবছা। তবু হঠাৎ হঠাৎ মার কথা আমার কাছে বলে ফেলত রূপ। আর বলার সময় ওর চোখ ছাপিয়ে জল আসত।
রূপ যেদিন প্রথম আমাদের বাড়ি এসেছিল, মনে আছে মাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। পরে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেছিল নিজের মাকে ওর তো তেমন করে মনেই পড়ে না, কিন্তু কল্পনায় মাকে ও যেমন ভেবেছে আমার মা নাকি ঠিক তা-ই। তেমনি ফর্সা আর ঘন কালো চোখের তারা আর একঢাল পিঠ-ছাড়ানো চুল। মা-র গলার স্বরও নাকি সেইরকম নরম আর সুরেলা।
তারপর থেকে মাঝেমাঝেই রূপ আবদার করত আমাদের বাড়ি আসার। রূপ চাইলে আমি না করতে পারি না। কিন্তু ও যখন মার দিকে ‘হাঁ’ করে তাকিয়ে থাকত, আমার বুকের ভেতরটা কটকট করত। আর মাও দেখতাম ও এলে সামনে বসে থাকে। উঠতেই চায় না। মজার ব্যাপার, আমি মনে মনে খুব চাইতাম সেই সময় তোমার ফোনটা যেন আসে। অথচ কখনওই রূপ থাকতে তোমার ফোন পেয়ে মাকে উঠে যেতে হয়নি।
তারপরেই এল সেই আশ্চর্য দিন, আর আমার জীবনটা অন্যদিকে ঘুরে গেল।
সেদিন দুপুরে আমি রূপদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। রূপের বাবার অফিস ফ্ল্যাটের লাগোয়া। ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের বিজনেস ওঁর। ফ্ল্যাট-অফিস আসা-যাওয়া করেন। দু’জন বসেছিলাম ব্যালকনিতে। শীতটা হঠাৎ চলে যাওয়ায় হাওয়ার হিমেল কামড়টা আর নেই। পাখিগুলোও যেন শীতঘুম কাটিয়ে দেদার ডাকাডাকি শুরু করেছে। সামনের গাছটা ছেয়ে আছে লাল লাল ফুলে।
ব্যালকনিতে দু’জনে বসেছিলাম মেঝেতে, পিঠে পিঠ লাগিয়ে। আমি দেখছিলাম প্রকৃতির সৌন্দর্য। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, এই সময়টাকেই বোধহয় বসন্ত বলে। রূপ একটা নতুন বাঁধা গানে সুর লাগানোর চেষ্টা করছিল। আর বারবার ব্যর্থ হয়ে নতুন করে সুর করছিল।
হঠাৎ কী হল, গিটারটা নীচে নামিয়ে রাখল রূপ। তারপর আমার দিকে ঘুরে বসল। চোখে চোখ রাখল।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু বলবি?’
ঘাড় নাড়ল রূপ, ‘হ্যাঁ।’
—বল।
হাসল রূপ, ‘চল, আমরা বিয়ে করে ফেলি।’
‘বিয়ে করে ফেলি!’ যেন ‘চল, পার্ক স্ট্রিট থেকে একটু ঘুরে আসি। কিংবা ‘চল, মোমো খেয়ে আসি।’
কিন্তু এইভাবে প্রোপোজ তো রূপই করতে পারে।
কিছুই তো চেনা নেই, এর-ওর কাছে খোঁজখবর করে পাওয়া গেল একটা ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসের ঠিকানা। নোটিস দেওয়া হল, দু’জন বন্ধুকে পাকড়াও করে অবশেষে নির্ধারিত দিনে গিয়ে সইসাবুদও সেরে ফেলা হল। তারপর দু’জনে দু’জনের দিকে অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললাম। বিয়ে মানে তাহলে এ-ই? আমরা এখন থেকে আইনত স্বামী-স্ত্রী!
পার্ক স্ট্রিট-এর একটা রেস্তরাঁয় ডিনার করা হল। বেরিয়ে এসে দেখি কুয়াশা। বন্ধুরা আর একবার কনগ্র্যাচুলেট করে কুয়াশার আড়ালে মিলিয়ে গেল। আমরা দু’জনে দু’জনের হাত শক্ত করে ধরে কুয়াশার ঠিক পরেই যে মিটমিটে আলো জ্বলছিল সেগুলো লক্ষ করে হাঁটতে লাগলাম।
আমিই কথাটা তুললাম, ‘বাড়িতে খবর দিবি না?’
রূপ হালকা করে জবাব দিল, ‘দিলে হয়।’
ভেবেছিলাম খবর পেয়ে দুই বাড়িতে সামান্য হলেও একটা আলোড়ন উঠবে। কিছুই হল না। ওদের বাড়ির কাছাকাছি একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট নাকি আগে থেকেই কেনা ছিল। সাজিয়ে দিয়ে এল মা। আমরা উঠে এলাম।
সংসারের কাজকর্মে আমি গোল্লা, রূপ খানিকটা পারে। ক’টা দিন ফোন করে খাবার আনিয়ে খেয়াল হল জীবনটা পিকনিক নয়। রান্নাবান্নার সরঞ্জাম কেনা হল। ফ্রিজ-ওয়াশিং মেশিন-মাইক্রোওয়েভ ঢুকল ফ্ল্যাটে। রূপ বই দেখে রান্নায় হাত পাকাতে থাকল। তারপর একদিন কড়াইশুঁটি দিয়ে ছানার ডালনা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিল।
একটু একটু করে সব থিতিয়ে আসতে লাগল। আমাকে আবার ঢুকে পড়তে হল আমার চৌহদ্দিতে। সেই বাঁধা রুটিন। সেই রং-মাখা, স্টুডিওর আলো, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো আউড়ে যাওয়া। তফাতের মধ্যে আগে বাড়ি ফেরার কোনও তাড়া থাকত না। এখন যত সময় এগয়, ভেতরে ভেতরে কী যেন হতে থাকে। কখন দরজার বেল-এ আঙুল ছোঁয়াব, কখন রূপ এসে দরজা খুলে দেবে। কখন দরজার পাল্লা বন্ধ হওয়ার আগেই ওকে জড়িয়ে ধরব।
রূপ কিন্তু পাল্টে যেতে লাগল। আর ওর পরিবর্তনটা সবার আগে আমারই চোখে পড়ল।
রূপ কখনওই এক্সট্রোভার্ট ছিল না। গান বাঁধত, নিজেই সুর দিত, তারপর গিটার বাজিয়ে গাইত সেই গান। ওর গান যাদের ভালো লাগত, তারা নিত। কয়েকটা সিনেমায় ওর গান হিটও হল। ফাংশন-এ ডাক পড়তে লাগল। খুব যে ভালোবেসে যেত তা নয়, ঠেলেঠুলে আমিই পাঠাতাম। একটা-দুটো অনুষ্ঠানে গেছিও। এক শ্রেণির শ্রোতা ওর গান নেয়। বিশেষ কিছু শ্রোতা, যারা সেনসিটিভ, যাদের মনের কর্ড অন্য জায়গায় বাঁধা। যারা সূক্ষ্মতা বোঝে। যারা তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাস করে না। রূপও তো তা-ই। সেইসব শ্রোতাদের সামনে গাইতেই ও ভালোবাসে।
নতুন কোনও গান বাঁধলে ও চেপে ধরে আমাকে শোনাতে বসে। সময় বের করে আমিও শুনি। শেষ যে গানটা ও বাঁধল, একদিন মধ্যরাতে টেনে তুলে আমাকে শোনাল, সেটা এইরকম: নদীর ধারে একটা মাটির ঘরে এক মাঝি থাকে। খেয়ানৌকায় সে যাত্রী পারাপার করে। এক শেষ বিকেলে একটি মেয়ে এল নদী পার হতে। মাঝি তাকে অন্য পাড়ে পৌঁছে দিয়ে এল। সন্ধ্যা হল। মাঝি যখন ঘরে ফিরল, অবাক হয়ে দেখে সেই মেয়ে তার ঘরের দরজায় হাত রেখে নদীর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে।
গানটা এত সুন্দর, আর তেমনই তার সুর, যে শুনতে শুনতে আমার চোখে জল এসে গেল। কিন্তু এই গানটা কেউ নিল না। ওকে বলা হল, এসব গানের আর তেমন বাজার নেই। রিদম আছে, সবাই তালি বাজিয়ে নাচবে, এমন গানই নাকি এখন বাজার মাতাচ্ছে।
অবশ্য রূপেরও যে দোষ নেই তা আমি বলতে পারব না। আমাদের লাইনে পার্টি-গ্যাদারিং লেগেই থাকে। আমিও যে সব অ্যাটেন্ড করি তা নয়। কিন্তু যেতে হয়ই। বোকাবোকা কথাগুলো হাসি হাসি মুখ করে শুনতে হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে ‘দোজ হু ম্যাটার’ তাদের প্রশ্রয় দিতে হয়। তারা যেটা বলছে সেটাই যে শেষ কথা এমনটা ভান করতে হয়।
রূপ তা পারে না। না পারলেও যে একটু চেষ্টা করতে হয় ও সেটাও করে না। ড্রিঙ্ক আমিও করি না। কিন্তু হাতে গ্লাস নিয়ে মাঝেমধ্যে ঠোঁট ছোঁয়াতে ক্ষতি কী? বাড়িতেও ছোটখাট পার্টি থ্রো করতে হয়। তার জন্য ব্যবস্থা রাখতে হয়। সেইসব দিনে বিকেল হওয়ার আগেই ও ছুতোনাতায় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কারওকে মিট করে না।
ফলে একটু একটু করে ও লাইমলাইট থেকে সরে যেতে থাকল। ফাংশনে আগে যেটুকু ডাক পেত এখন তা-ও পায় না। ওর ভেতরে যে আশ্চর্য সজীবতা ছিল সেটাও যেন মরে যেতে লাগল। আগে আর কিছু না হলে নিজের জন্যও ও গান বাঁধত, সুর দিত, একাই গুনগুন করে গাইত। এখন সারাদিন বিছানায় একা-একা শুয়ে আকাশপাতাল ভাবে। একদিন সাজেস্ট করলাম সাইক্রিয়াট্রিস্ট দেখানোর। পাশ ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে রইল।
আমি সময় পেলেই গিটারটা পাড়ি, ধুলো মুছি, ও আড়চোখে দেখেও উঠে হাতে নেয় না। ওর পছন্দের গান চালিয়ে শোনাই। ও জানলা দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, পাখি গোনে, আকাশের রং বদল দেখতে থাকে। জিজ্ঞেস করলে একটা দুটো প্রশ্নের জবাব দেয়, নিজে থেকে কোনও কথা বলে না। খাবার সাজিয়ে দিলে যায়, খেয়ে উঠে যায়।
একসময় আবিষ্কার করলাম রূপ-এর কাছ থেকে সরে যাচ্ছি। বিশ্বাস করো, আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। রূপ যা যা ভালোবাসে আমি তা-ই তাই-ই করার চেষ্টা করেছি। ও নিষ্ঠুরের মতো দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। একসময় নিজেকে ভিখারির মতো মনে হয়েছে, তাও নিজেকে শক্ত করেছি, মনে মনে বলেছি, এই সময় ওর পাশে আমার দাঁড়ানো দরকার। সারা পৃথিবী যেখানে ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, আমি না থাকলে কে ওকে দেখবে?
যখন দিশেহারা হয়ে ভাবছি কী করব, তখনই জন্টি এল।
জন্টি অবশ্য ওর আসল নাম নয়, স্কুল কলেজের খাতায় ও জয়ন্ত সরকার। কিন্তু বন্ধু-বান্ধব সার্কলে ওকে সবাই জন্টি বলেই ডাকে। জন্টির ব্যাকগ্রাউন্ড অনেকটা আমারই মতন। স্কুল কলেজে নাটক করত। নায়ক নয়, পার্শ্বচরিত্র। আস্তে আস্তে ক্যারেক্টার রোল-এর দিকে সরে যায়। ঠাট্টার ছলে, যেন মজা করছে, নির্লিপ্তভাবে ও নিজেকে নিয়ে ইয়ার্কি করতে পারে। পরে বোঝা যায় তার মধ্যে কোথাও একটা গভীর দর্শন লুকিয়ে আছে। দর্শকরা দু’ভাবেই ওকে নিতে পারে, কৌতুক-শিল্পী। আবার সিরিয়াস অভিনেতা। যার যেমন পারসেপশন।
যখন থেকে জন্টির সঙ্গে আলাপ, লক্ষ করতাম ও বিশেষ চোখে আমাকে দেখে। আমি ঠিকমতো খেয়েছি কি না, আমার কিছু লাগবে কি না, এইসব। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগত আমার শরীর খারাপ থাকলে এমনকী মন ভালো না থাকলেও ও ঠিক বুঝতে পারত। জোর করে মন ভালো করার চেষ্টা করত না। শুধু মন-খারাপ করা পরিস্থিতিগুলো থেকে আমাকে আড়াল করে রাখত। গোড়ায় ওকে বন্ধু হিসাবেই দেখতাম— একজন ভালো বন্ধু। আস্তে আস্তে রিয়ালাইজ করতে লাগলাম সম্পর্কটা অন্য দিকে এগচ্ছে। আমরা দু’জনেই দু’জনের ওপর ডিপেন্ড করতে শুরু করেছি। এমনকী এমন কিছু শেয়ার করছি যা খুব কাছের মানুষ ছাড়া অন্য কারও কাছে মানুষ করে না।
এই জায়গায় এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমি কি রূপকে ঠকাচ্ছি? রূপ যেমন আমার কাছে সত্য, জন্টিও তো তাই। কিন্তু রূপের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে জন্টিকে ডেকে আনা তো দ্বিচারিতা। আবার এটাও নিজেকে বোঝালাম, রূপ আমাকে যা যা দিতে পারে না সেইসব নিয়ে যদি জন্টি এসে দাঁড়ায় তাকে ফিরিয়ে দিতে যাব কেন? জন্টি তো কোনও অপরাধ করেনি। তার চেয়েও বড় কথা, আমিই বা কেন রূপের বিগ্রহ সাজিয়ে রেখে রোজ ধূপ-ধুনো দিয়ে পুজো করব? রূপ আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না, তা সত্ত্বেও আজ যে আমার মুখের দিকে চেয়ে আমারই জন্য অপেক্ষা করছে— দিনের পর দিন— তাকে মুখের ওপর ‘না’ বলে দেব?
তখনই আমার মা-র কথা মনে পড়ল। তোমার কথাও। মনে পড়ল মা কেমন তোমার ফোন এলেই সবকিছু ফেলে ছিটকে উঠে যেত। তোমার সঙ্গে কথা বললেই একটা জ্যোতি মা-র মুখে এসে বসত। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠত, শ্বাস পড়ত ঘন ঘন, কথায় কথায় হেসে উঠত মা। মার গাল দুটো যেন অস্তসূর্যের আলোয় রাঙা হয়ে উঠত। মাকে আশ্চর্য সুন্দর দেখাত।
সেই অবস্থায় মাকে দেখলে আমার ভেতরে একটা রাগ জন্মাত। একটা অস্থিরতা। ইচ্ছে করে আওয়াজ করতাম। মা যেন বিরক্ত হয়। মা যেন ফোনটা কেটে দিয়ে ছুটে আসে। জানতাম মা-র রাগ আমার উপরই এসে পড়বে। তাও অমনি করতাম।
এখন মনে হল, মাকে যেন একটু একটু করে আমি বুঝতে পারছি। মা-র কষ্টের জায়গাটা, মা-র একাকিত্ব। মা-র না-পাওয়া। যা বাবা দিতে পারেনি, সংসার-আমি— কেউই যা দিতে পারেনি, অথচ যা পাওয়ার জন্য কাঙালের মতো মা তাকিয়ে থেকেছে। একটা মানুষের দিকে। সেই মানুষটা তুমি।
তাই মনে হল একটা চিঠি লিখি। যে কথাগুলো চিঠিতে লেখা যায় তার সবকিছু সামনে বসে চোখে চোখ রেখে বলা যায় না। আমাদের সংসার সাজিয়ে দিয়ে মা নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া এতগুলো বছর পার করে মা-র সামনে গিয়ে দাঁড়াব অতখানি মনের জোর আমার নেই। তোমাকেই লিখছি। জানি আমার কথাগুলো তুমি মা-র কাছে পৌঁছে দেবে।
রূপকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। রূপ আমার প্রাণ। আর এটাও জানি, ওকে ছেড়ে গেলে রূপ একদিনও বাঁচবে না। কিন্তু জন্টিকে আমি ফেরাব কেমন করে? রূপ যেমন আমাকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে, পড়ে থাকা দিনগুলো জন্টিকে আঁকড়েই আমাকে কাটাতে হবে। রূপ আমার দায়, জন্টি আমার অবলম্বন।
মাও তো সেটাই করেছিল। বাবাকে কি মা ঠকিয়েছিল? মনে হয় না। বাবা, আমার ধারণা তোমার সঙ্গে মা-র সম্পর্ক পুরোটাই জানত। সংসারের প্রতি কর্তব্যে মা অবহেলা করেছে এমনটাও বলা যাবে না। হ্যাঁ, আমার মাঝে মাঝে অভিমান হয়েছে, চোখে জল এসে গেছে। এতদিন পর মনে হয়, সেগুলোও, ছোট ছিলাম তো, ওভার রি-অ্যাকশান। মা-র পরিস্থিতি আমি এখন বুঝতে পারি। আমাকে আর বাবাকে যথাসাধ্য দিয়েও মা একজনকে, একটা সম্পর্ক আঁকড়ে ধরে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছে। সে জন্য একটা কুর্নিশ তো মা-র অবশ্যই প্রাপ্য।
আমার কথা শেষ। যা মা-কে কখনওই বলতে পারব না। সেগুলোই তোমার মারফত মা-র কাছে পৌঁছে দিলাম। আমি জানি মা আর আমার মধ্যে এত বছর ধরে জমে থাকা ভুল-বোঝাবুঝি, যা হিমালয়ের চেয়ে কম নয়, তা গলাতে একটু হলেও চেষ্টা তুমি করবেই। তুমি তো আমার মানুষ কাকু। ঠিক কি না বলো?
ইতি,
কে বলো তো?
অঙ্কন : সুমনকুমার সিংহ