সুখী গৃহকোণ

মাননীয়েষু
অমর মিত্র

 

আমি আপনাকে লিখতে চাইছি, কিন্তু লিখতে পারছি না। ভয় পাচ্ছি। আপনার সময় নষ্ট হবে, আপনি বিরক্ত হবেন। জানি না এই চিঠি বা এই লেখা আপনার কাছে পৌঁছবে কি না, অথবা আপনি খুলে দেখবেন কি না। আপনার মেল ঠিকানা অতিকষ্টে পেয়েছি। আপনাকে মেল করব না ডাকে চিঠি পাঠাব, তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। আপনার ফোন নং পেয়েছি। কিন্তু ফোন করার সাহস আমার নেই। দেখেছি ওই নম্বরেই হোয়াটসঅ্যাপ। একদিন আমাদের গ্রামের ছবি পাঠিয়েও ডিলিট করে দিয়েছিলাম। ভয় করেছিল। অনুমতি না নিয়ে কি ছবি পাঠানো ঠিক হয়েছিল? আমাদের গ্রামের চাষের জমিতে টম্যাটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ফলে আছে, সেই ছবি। আপনি কত দূরের মানুষ, আপনার কত খ্যাতি, কত মানুষ আপনার স্বাক্ষর পেলে ধন্য হয়ে যায়, আপনার দেখা পেলে অবাক হয়ে দেখে, সেখানে আমি কে? আমি সামান্য কুসুমজোড় গাঁয়ের সেই রবিঠাকুরের কবিতার সাধারণ মেয়ে। 
আমাদের গ্রাম উদয়নারায়ণপুর থানার অধীনে। কাছেই দামোদর। দামোদর পেরিয়ে আমাকে ইশকুল যেতে হতো সাত মাইল সাইকেল চালিয়ে। বর্ষায় ইশকুল বন্ধ করতে হতো। বান বন্যা লেগেই রয়েছে আমাদের এদিকে। আগে কাঁচা রাস্তা ছিল, এখন পাকা হয়েছে, কিন্তু সে রাস্তা ভেঙেচুরে একাকার। পঞ্চায়েত কবে সারাবে তা প্রধান জানবেন। প্রধান আমাদের গ্রামের মানুষ। তিনি খুব রাশভারী। তাঁর কাছে অভিযোগ জানানো যায় না। প্রার্থনা করা যায়। কিন্তু আমার কথা প্রধান নিয়ে নয়। প্রধান ছিলেন চাষি মানুষ, এখন তাঁর ধান ভানা কল হয়েছে, দামোদরের তীরে ইটভাটা হয়েছে। পাকা বাড়ি হয়েছে দোতলা। আমাদেরও পাকাবাড়ি। সঙ্গে মাটির বাড়িও আছে। দাদার কিছু হলে বাড়িটা বড় করা হবে মাটির বাড়ি ভেঙে। ছোট এই কোঠা বাড়ির জন্য তিন বিঘে জমি বেচতে হয়েছে বাবাকে। সেই কাজটা করোনার আগে করা হয়েছিল। বাবা সেই জ্বরে পড়ে আর আগের মতো সুস্থ হলেন না। এখন একটু খেটেই হাঁপ ধরে যায়। শুধু ঘুমাতে চান। আগে নিজ হাতেই চাষ করতেন। ধান রোয়া, ধান কাটা-সব কাজেই মজুরদের সঙ্গে হাত লাগাতেন। মোষের মতো দেহ ছিল বাবার। সেই দেহ ভেঙে দুমড়েমুচড়ে গেছে। আপনার বইয়ে যে লেখক পরিচিতি দেখেছি, তা পড়ে বুঝেছি, বাবা আপনার চেয়ে দশ বছরের ছোট। আপনার চেহারায় গাম্ভীর্য আছে, বিদ্যার ছাপ আছে, উদাসীন ভাব আছে। ছবিই দেখেছি, মনে হয়েছে আপনি ভাবুক প্রকৃতির। ভাবুক তো হবেনই। না ভাবলে কি অত কম বয়সে অমনি এক বুড়োর গল্প লেখা যায়? অমনি দুই বুড়ির কথা ভাবা যায়?
আমি নন্দিনী। রক্তকরবীর নন্দিনী নই। অতি সাধারণ এক নন্দিনী। বাবার পড়া মাধ্যমিক অবধি। উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় এই অঞ্চলে ছিল না। যেতে হতো উদয়নারায়ণপুর। তখন রাস্তাঘাট ছিল অগম্য। আর পড়াশোনার খরচও কম ছিল না। বাবা আর না পড়ে জমিজমা নিয়ে থাকলেন। গোরু-বাছুর নিয়ে থাকলেন। পড়ে কী হবে? কত দূর যাওয়া যাবে, উদয়নারায়ণপুরের বেশি তো নয়। বড়জোর হাওড়া সদরে। তার বেশি না। হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে কলকাতায় যাওয়া অনেক কষ্ট। আবার ফিরে আসতে হবে তো এই কুসুমজোড় গ্রামে। উদয়নারায়ণপুর নেমে সাইকেলে চেপে দামোদর পেরিয়ে নিজের গাঁ-ঘরে। বাবা এখনও বলেন, হাওড়া গেলে তাঁর ভয় করে, কলকাতা গেলে দম আটকে আসে। উদয়নারায়ণপুরেও যে বাবা খুব যেতে চান তা নয়। কিন্তু বিডিও অফিস, বিএলএলআরও অফিস যেতে হয়। জমিজমা নিয়ে থাকলে এসব জায়গায় যেতেই হয়। 
মাননীয়েষু, কথা বাবাকে নিয়ে নয়। আমাকে নিয়ে। আমাদের বাড়িতে আগে কেউ এত দূর পড়তে যায়নি। আমি গিয়েছি। বাবার যেখানে ভয় করে, দম আটকে আসে, সেখানে আমি গিয়েছি পড়তে। গ্রামের ইশকুল ছেড়ে উদয়নারায়ণপুর ভারতচন্দ্র উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছি ক্লাস ফাইভ থেকে। গ্রামের আর কয়েকটি মেয়ে যেত। তাদের সঙ্গে আমিও। আমার একটা সাইকেল ছিল। বিডিও অফিস থেকে দিয়েছিল। সাইকেল পেয়েছিলাম বলে ইশকুল যেতে পেরেছিলাম। আমাদের এসব জায়গা বন্যাপ্রবণ। প্রতি বছর দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ে, সেই জল দামোদর বেয়ে এতদূর চলে আসে ভাসাতে। জল আসে জল যায়। তার ভিতরে চাষবাস হয়। না হলে চলবে কীভাবে? জল নেমে যায় বলেই চাষ নষ্ট হয়েও কিছুটা হয়। আর শীতের ফসল ভালো হয়। এসব আপনি জানেন, আপনাকে আমি কী বলব? 
আমি উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করেছিলাম। কলকাতায় যেতে হবে বিএ পড়তে। আমি বড় কলেজে সুযোগ পেলাম, বড় কলেজের কথা আমাকে স্কুলের স্যার বলেছিলেন। আর বলেছিলেন ভারতচন্দ্রর কথা। কে ভারতচন্দ্র? অন্নদামঙ্গলের কবি ভারতচন্দ্র। তাঁর জন্মস্থান পেড়ো আমাদের বাড়ি থেকে আট মাইল। প্রতি শীতে ভারতচন্দ্রের জন্মস্থানে ভারতচন্দ্র মেলা বসে। সেই মেলার সময় অনেক প্রতিযোগিতা হয়, আমি কবিতা বলা এবং গল্পলিখনে দুইবার শংসাপত্র পেয়েছিলাম। মা আমাকে নিয়ে যেত। মায়ের খুব ইচ্ছে আমি অনেক কিছু করি। মায়ের নিজের খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। ক্লাস টেন অবধি পড়েই শেষ। মাধ্যমিক দেওয়ার আগে বিয়ে। আমার মামারবাড়িও চাষির বাড়ি। ওদিকে আলু, কুমড়ো, কলা প্রভৃতি খুব হয়। আলু চাষে লোকসান হয় তবু কিছু লাভও থাকে। এসব চাষিদের কথা। তারা যেরকম বলে, আমরা সেরকম শুনি। মামারবাড়ি যেতে আমার খুব ভালো লাগত। একটু অন্য জায়গায় যাওয়া হল তো। আবার পেড়োর মেলায় যেতেও খুব ভালো লাগত। মেলায় যেতে কার না ভালো লাগে বলুন মাননীয়েষু? 
আমি বারবার অন্য বৃত্তান্তে চলে যাচ্ছি। চাষিঘরের মেয়ে তো। আমার তো আপনাকে আমার কথা জানানোর কথাই নয়। আমার মাও বই পড়তে খুব ভালোবাসে। হ্যাঁ, এখনও ভালোবাসে। কতদিন মায়ের মনে হয়েছে একটা চিঠি লিখবে আশাপূর্ণা দেবীকে। কিন্তু লেখা কি হয়েছে? সাহস ছিল? উনি তো গৃহবধূ, আমার মাও গৃহবধূ। উনি সংসারের কথা লিখতেন। মা সংসার করত। মা বলে, কতবার চিঠি লিখেও সে চিঠি আর পোস্ট করতে পারেনি পত্রিকা অফিসের ঠিকানায়। কী মনে করবেন উনি? হয়তো বিরক্ত হবেন। রাগ করবেন। হয়তো তাঁর কোনও গল্প বা উপন্যাসে এইসব কথা লিখে দেবেন। কিন্তু কোন সব কথা? মা তাঁর সুবর্ণলতা উপন্যাস নিয়ে লিখতে গিয়ে নিজের অনেক কথা লিখে দিয়েছিল। কেন লিখল মা, মা তা বলতে পারে না। মায়ের খুব ভালো লাগত তাঁর লেখা, পরে মহাশ্বেতা দেবীর লেখা। মা চিঠিতে যা লিখেছিল, তা নিজের অজ্ঞাতেই যেন লিখেছিল। লিখতে লিখতে লেখা হয়ে গিয়েছিল। খামে ভরার আগে যখন রিভাইস করতে যায়, তখন বুঝল, অবান্তর সব কথা লিখেছে। সে লেখা কেমন হতে পারে তা আমি জানি না। মা জানে। তবে আমি বুঝতে পারি, মা তার বাবা-মা, ভাই-বোন আর একটা যুবকের কথাও লিখতে পারে হয়তো। মা প্রায়ই বলে সেই মানুষটি মারা গিয়েছিল। শঙ্কর স্যার। শঙ্কর স্যার ছিল মায়ের গ্রামের মাস্টারমশায়। অন্য জায়গা থেকে এসেছিল, সবে এমএ পাশ করে। এক রাত্তিরে পুলিস এল গ্রামে। সেই স্যারকে তুলে নিয়ে গেল। তারপর স্যারের গুলিবিদ্ধ দেহ পাওয়া গেল ধানখেতের ভিতর। কেউ বলল না যে থানার বড়বাবুর সঙ্গে কালো পোশাকের পুলিস এসেছিল মাওবাদী ধরার জন্য। সকলে চুপ করে থাকল। পার্টি বলে দিয়েছিল চুপ করে থাকতে। চুপ না করলে আবার পুলিস আসবে। মা নাকি খুব কেঁদেছিল সেই স্যারের জন্য। সারাদিন। লাশ নিয়ে গেল পুলিস এসে। মা দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। তারপর ক’দিন ধরে স্কুল যায়নি। তখন টেস্ট পরীক্ষা হচ্ছিল মাধ্যমিকের। বাংলা পরীক্ষা দিয়ে আর পরীক্ষাই দিল না। স্যার মরে গেলে মায়ের পড়ার ইচ্ছেটাই চলে গেল। তখন তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিয়ে দিল দাদামশায়। গাঁয়ে হয়তো গুঞ্জন হচ্ছিল। সেই যে শঙ্কর দত্তর মৃত্যু, সেই মৃত্যুর কথা মা লিখে দিয়েছিল আশাপূর্ণা দেবীকে। তারপর মনে হয় মহাশ্বেতা দেবীকে। কিন্তু শেষ অবধি পাঠানো হয়নি কোনও চিঠিটাই। অনেকদিন নাকি চিঠিটা ছিল। নতুন করে করে লেখা হতো। কিছুতেই পছন্দ হতো না। তারপর মা নাকি তা নিজেই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মায়ের মনে আছে তো সব। আমাকে বলেছে, আমারও মনে আছে। আমাদের এই মনে থাকা একটা বইয়ে কি লিখে রাখা নয়? অদৃশ্য একটি পুস্তক। 
মাননীয়েষু, মা পড়তে পারত। পড়েনি। মাধ্যমিকের টেস্টই দিল না। তবু ফাইনাল পরীক্ষায় বসা যেত প্রি-টেস্টের রেজাল্ট অনুসারে। কিন্তু মায়ের ইচ্ছাই চলে গিয়েছিল। বিয়ের পর বাবা বলেছিল, তুমি পড়বে, পড়তে পারো, কিন্তু পড়ে কী করবে, চাকরি তো করবে না। 
মা বলেছিল থাক আর না হয় না-ই পড়লাম। তুমি মাধ্যমিক। আমি মাধ্যমিক দিলাম না। বিয়ে হয়ে গেল। এখন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে হবেটা কী? আমি কি তোমার উপরে যেতে পারি? 
তাই তো, বাবা মাধ্যমিক, মা মাধ্যমিক পাশ করলে বাবার সমান। উচ্চমাধ্যমিক পড়লে মায়ের পড়া বাবার চেয়ে বেশি হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি মা বাবার চেয়ে অনেক বেশি পড়েছে। এত বই পড়েছে, এখনও পড়ছে, বাবা কি পড়েছে এসব? সংসার, চাষবাস, আয়-উপার্জন ছাড়া বাবার অন্য দিকে নজর ছিল না। মাটির ভিটে কী করে পাকা দালানে পরিণত করতে পারে, বাবা সেই সব নিয়েই ভাবত বেশি। আমার তখন ক্লাস ইলেভেন। সেবছর বন্যা এল দামোদরে। ক্লাসেই স্যার বললেন, বাড়ি যাও সুপর্ণা, জল আসছে। সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম। তখন ব্রিজ অবধি জল এসে গেছে প্রায়। সাইকেল পার করে দেখতে পেয়েছিলাম বাঁধের রাস্তার নীচে জল এসে গেছে। ক্রমশ সবুজ ধানের খেত সাদা হয়ে যাচ্ছে। জল যেভাবে আসছে বাঁধের কিনারা ছুঁয়ে যাবে কিছু সময় বাদে। ভয় করছিল। সেই সময়ই আমার সঙ্গে দেখা বিকাশ রায়ের। বিকাশদাকে আমি চিনতাম না বললে ভুল হবে, সেও পড়তে আসত আমাদের স্কুলে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পড়েছে। বয়সে বছর পাঁচ সিনিয়র। তারপর হয়তো দাদাটা হাওড়া বা কলকাতার কলেজে চলে গিয়েছে। সে বলল, তুমি তো কুসুমজোড় থাকো, জানি, বান আসছে, তুমি পারবে একা যেতে? বুঝতে পারছিলাম, না পারতেও পারি। বাঁধের রাস্তা থেকে নামতে হবে। ধানখেতের পাশ দিয়ে যে পঞ্চায়েতি রাস্তা তা জমি থেকে একটু উঁচু। সেই রাস্তা পাকা হয়েছে, কিন্তু বন্যার জলে ডুবে গিয়ে ফি বছর ভেঙে যায়। বিকাশ রায় বলল, আমি তোমাকে গ্রাম অবধি পৌঁছে দিই।
না করলাম না। সত্যি কি আমার ভয়ই করছিল! বাঁধ থেকে নামতে তো হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোন কলেজে পড়েন?
—পড়ি না, আমি ইলেকট্রিকের কাজ করি।
—কেন, পড়লেন না কেন?
—ইচ্ছে হল না তাই পড়লাম না, তোমার ইচ্ছে হলে পড়ো। 
—আপনি কোন গ্রামে থাকেন ?
যে গ্রামের নাম বলল সে, তা আমাদের গ্রামের দুটো গ্রাম পরে। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে যেতে হয়। সে গিয়েছিল মালপত্তর কিনতে। নিজের একটা দোকান আছে। সেই দোকানের জন্যই উদয়নারায়ণপুরে আসা। সেই একবার দেখা। আর দেখা হয়নি। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভয় পেতে পেতে বানের জল দেখতে দেখতে সাইকেল চালিয়ে চলে এলাম। তার কথা বললাম কেন? এমনি বললাম। মাননীয়েষু, বিকাশ এরপর কোভিডের আগের বছর এল আমাদের নতুন কোঠা বাড়িতে। ইলেকট্রিক ওয়্যারিং করবে। আমি তাকে চিনতে পেরেছি। তখন ডিসেম্বর মাস। ধান উঠে গেছে। আমাদের উঁচু জমিতে আলু লাগানো হয়েছিল, কুমড়ো, ফুলকপি, বাঁধাকপি। আমাদের বড়দিনের ছুটি ছিল। আমি ভর্তি হয়েছি বেথুন কলেজে। হোস্টেলে থাকি। বাবা রাজি ছিল না। মা বলেছিল, অত নামী কলেজে চান্স পেয়েছে, পড়বে না কেন? 
বিকাশ বলল, উফ, কত নাম করা কলেজ, বেশ বেশ, খুব ভালো রেজাল্ট করো। 
বাবা পাকা বাড়ি করতে জমি বেচে দিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, যে করে হোক পড়ব বাবা।
জুন মাসে যখন ভর্তি হচ্ছি বাবা বলেছিলেন, আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ অত দূর যায়নি, হাওড়ার কলেজে যাওয়া আসা করতে পারতিস।
ডিসেম্বর মাসে ইলেকট্রিক ওয়্যারিং করতে এসে বিকাশ আমাকে এই বাড়িতে দেখে অবাক, বলেছিল, সেই বন্যার কথা মনে পড়ে?
আমি কি ভুলতে পারি? সেই বানের জল ঢুকছে। আকাশ নীল। কিন্তু মনে হচ্ছিল, ঘোর করে আসছে। দুর্গাপুর কতদূর জানি না, সেখানে জল ছেড়েছে , সেই জল এতদূরে এসে আমাদের ভাসিয়ে দিচ্ছে। বিকাশ বলল, গ্রাজুয়েট, পোস্ট গ্রাজুয়েট সব করতে হবে। 
—বাবা বলছেন খরচে পারবেন না। আমি নতমুখে বললাম। 
 বিকাশের কাজ শেষ হল বড়দিনের ছুটির ভিতরে। সুন্দর সব ল্যাম্প শেড এনে ঝুলিয়ে দিল ঘরে ঘরে। বারান্দায়। তারপর একদিন তখন শীতের সন্ধ্যা নেমে এসেছে, ছায়ায় ঢেকে গেছে সব, বিকাশ সুইচ দিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিল আচমকা। সেই আমাদের বাড়ি প্রথম বিদ্যুতের আলো। আলো জ্বালিয়ে বিকাশ চলে গেল। বিকাশ চলে যাওয়ার পর আমিও ফিরলাম কলেজ হোস্টেলে। হাওড়া কিংবা ডোমজুড় হলেও আমি যাতায়াত করতে পারতাম। কিন্তু আমাদের কুসুমজোড় থেকে যাতায়াত করা যায় না বেথুন কলেজ। সারাদিন পথে পথে কেটে যাবে যেন। এরপর কলেজের একটা সেমিস্টার শেষ হতে হতে কোভিড এসে গেল। বাড়ি ফিরে এলাম দোল পূর্ণিমার সময়। লকডাউন হয়ে গিয়েছে। বাড়ি এসে দেখি সকলের মুখে ভয় ভয় ভাব। আমার ভাই মাধ্যমিক দেবে। তার পরীক্ষা কবে হবে ঠিক নেই। মাধ্যমিকের আরম্ভে আমি থাকতে পারব কি না জানি না। তবে কলকাতায় যেমন কোভিড জ্বর নিয়ে ভয়, এদিকে তেমন নেই। বাজার দোকান বন্ধ হচ্ছে সময় পেরিয়ে। হাট হচ্ছে না। সব জমায়েত বন্ধ। যেদিন এলাম সেদিন অনেকটা রাতে মা আমাকে ডাকল, খুকু এদিকে আয়।
বারান্দায় বসলাম আমরা। বারান্দার সামনে উঠোন। উঠোনে বাঁধাকপি, ফুলকপির ডাঁই। বিক্রির উপায় হচ্ছে না। লকডাউনে ফড়েরা আসছে না। এগুলো সব আগে কাটা হয়েছে। এখনও ফসল আছে জমিতে। যারা ফসল কাটতে আসত, তারা সকলে চলে গেছে। জ্যোৎস্না হয়েছে খুব। অনেক দূর অবধি দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। হিমেল ভাব ছিল বাতাসে। মায়ের দিকে তাকালাম। গায়ে চাদর দেয়নি। আমি এনে দিলাম। আমার তো সোয়েটার ছিল। মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মাথার চুল ঝরে গেছে অনেক। মুখ গম্ভীর। বলল, খুকু তোর হোস্টেলে কী খেতে দেয়?
—সকলকে একই খাবার দেয় মা, তোমার চিন্তা নেই।
—হোস্টেলের ফি মকুব করতে প্রেয়ার দিয়েছিস?
—দিয়েছি মা, কলেজ খুললে জানতে পারব হয়েছে কি না, তবে কলেজ কবে খুলবে জানি না। 
—খুকু তোর বাবা বলছে আর পড়তে হবে না, বিয়ে ঠিক করছে, আমাদের ক্ষমতা নেই অত বড় হওয়ার। 
মাননীয়েষু, কথাটা বলতে বলতে মায়ের চোখ ছলছল করতে লাগল চশমার আড়ালে। অতি কষ্টে নিজেকে সংবরণ করছে মা। আমি চুপ করে আছি। বিএ, তারপর এমএ, আমার পড়া হবে কি? বাবা পারবেন না। বাবা বলেছেন, চাষে লাভ নেই, সংসার চলে যায় মাত্র। আর মহামারী এসে কী ভবিষ্যৎ কেউ জানে না। চাষের খরচ উঠবে না। ফসল কিনবে কে? আমি চুপ করে থাকলাম। একটা সেমিস্টার হয়েছিল, তাতে সিক্সটি ফাইভ পারসেন্ট পেয়েছি। আমি বুঝেছিলাম এই বন্যায় ভাসা কুসুমজোড় থেকে বেরতে হলে আমাকে পড়তে হবে। কিন্তু এমন মহামারী এল! কেউ কি ভেবেছিল এমন হবে? 
মা বলল, ওই বিকাশ, বিকাশের সঙ্গে তোর সম্বন্ধ ঠিক করছে তোর বাবা।
আমি বললাম, তুমি কী বলেছ মা! আমি এখন পড়ব। 
মা চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে মুখ খুলল, বলল: বললাম, ছেলেটা এইচএস, তারপর আর পড়েনি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করে, আমার মেয়ে এমএ পাশ করে নিজের পায়ে দাঁড়াক, তখন বিয়ের কথা ভাবা যাবে, কত ভালো পাত্র আসবে।’ 
আমি চুপ করে মায়ের কথা শুনছি। মা বলছিল, মায়ের জীবনে মা যা ভুল করেছে, সে ভুল যেন আর না হয়।
—সে তো মা পুলিস তাঁকে মেরে দিল, তিনি মার্ডার হলেন, তাই। 
—তিনি তো চাইতেন আমি পড়ি, আমি ভালো রেজাল্ট করি, তিনি আমার ভিতরে বই পড়ার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। 
—তাঁর কথা মনে রেখেই পরীক্ষায় বসা উচিত ছিল তোমার।
—সেই ভুলটা আর যেন না হয়, তবে আশাপূর্ণা, মহাশ্বেতা দেবীর বই পড়তে পড়তে তার কথা মনে পড়ে আমার এখনও, তুই কী করবি ভাব।
—আমার কী করার আছে মা, আমি তো পড়তে চাই। 
সেদিন রাতে আমার ঘুম এল না। বিকাশ রায়ের ফোন নং আমার কাছে ছিল, আমি তাকে হোয়াটসঅ্যাপ করলাম, দরকার আছে, দেখা করতে চাই।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম জবাব এসেছে, আমি কি তোমাদের বাড়ি যাব, ইলেকট্রিক লাইনে গোলমাল হয়েছে?
আমি লিখলাম রথতলায় আসো।
—এখন কোভিডের সময়, তুমি তো কলকাতা থেকে এসেছ।
—ভয় করলে আসতে হবে না।
সে এসেছিল। সমস্ত গ্রাম নিঝুম। বিডিও অফিস থেকে মাইকিং করে যাচ্ছে, সকলে যেন ঘরে থাকে। কে ঘরে থাকবে? আমি তো ঘর থেকে বেরিয়েছি। আরও বেরব, এমএ, পিএইচডি, সব করব যে করে হোক। আমাদের দেখা হল। সে অপেক্ষা করছিল রথতলায়। পুরনো রথ রয়েছে। একটা জগন্নাথ বলরামের মন্দির আছে। মন্দিরের পুরোহিত আসেনি। মন্দিরে তালা দিয়ে আমতা চলে গেছে বড়গাছিয়া গিয়ে ট্রেন ধরে। আমি বিকাশকে বললাম, আমার বাবা কি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন?
বিকাশ বলল, হ্যাঁ, এসেছিলেন, আমি বলেছি তোমার সঙ্গে না কথা বলে হ্যাঁ বলব না।
—আমি যদি না বলি?
বিকাশ বলল, বলতেই পারো, তাহলে আর কারও সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক করা হবে, তোমার বিয়ে দেবেন তিনি, পারছেন না খরচ চালাতে, এবার তো ফসল খেতেই শুকোবে। 
মনে হল বিকাশের ইচ্ছা নেই তা নয়, কিন্তু সরাসরি বলতে পারছে না। আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। আমি বললাম, আমি পড়ব।
—কে বারণ করেছে, কিন্তু তোমার বাবার উপায় নেই, আয় নেই।
চুপ করে থাকলাম। চোখে জল এসে গিয়েছিল। মনে হচ্ছে বাড়ির বোঝা হয়ে গিয়েছি। তখন বিকাশ বলল, তুমি এমএ পড়ো, তারপর গবেষণা করো, পিএইচডি, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। 
—কী করে করব ?
—করতেই হবে, খরচ আমি দেব সুপর্ণা।
মাননীয়েষু, তারপর বিকাশ আমাদের ভরসা। বাবার কোভিড হল, বিকাশ নিয়ে গেল কোভিড হাসপাতালে। বাবা ফিরেও এল। তারপর কোভিড গেল। আমি পড়ছি। এমএ ভর্তি হয়েছি। সব খরচ দেয় বিকাশ। সত্যি কথা বলতে গেলে ওর সাহায্য ছাড়া আমি পড়তে পারতাম না। আমি যখন হোস্টেল থেকে ফিরি, বিকাশ নিয়ে আসে, আমি যেদিন হোস্টেলে যাই, বিকাশ দিয়ে আসে। ওর পড়া হয়নি, ও বলে আমি পড়লেই ওর পড়া হবে। একবার আবার সেই বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছি, সামনে এমএ ফাইনাল, রাতে মা আর আমি বসেছি বারান্দায়। বেশ শীত পড়েছে। আরামদায়ক। এবার ধান হয়েছে ভালো। বাবা আগে নিজে সব করত, এখন বিকাশ মজুর দিয়ে চাষ করিয়ে দেয়, ধান কাটিয়ে দেয়। মা বলল, তোর বাবা বলছিল, তুই ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারকে বিয়ে কর।
—কী বলছ মা?
—আমি বলিনি, তোর বাবা।
—তুমি কী বললে?
—বললাম, বিকাশের কী হবে?
—আমারই বা কী হবে মা, আমি যে ওকে ভালোবেসেছি।
মা চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ভালোবাসা কি সফল হয় খুকু, হয় না, তুই একটা কাজ করবি? বলে মা চুপ করে থাকে অনেকটা সময়, তারপর বলে, আমার কী মনে হয় জানিস, সেই লোকটা, সেই স্যারই যেন ফিরে এসেছে। মা বলে একেবারে সে। পড়াশোনায় এত উৎসাহ, একেবারে তার মতো লাগে। সেই রকম চোখ, সেই রকম তাকানো, সেই রকম কথা বলা। বেশিদূর পড়েনি বটে কিন্তু আমার সঙ্গে আশাপূর্ণা নিয়ে কথা বলে তো চমৎকার। 
তারপর মা মুখ নিচু করে বসে থাকে। সেই লোকটার কথা ভাবছিল, নতমুখেই বলল, একটা চিঠি লিখেছে, আমি বিকাশকে পৌঁছে দেব কি না।
আমি চুপ করে শুনেছি মায়ের কথা। আচ্ছা এইটা কি সম্ভব? আপনি বলুন স্যার, আমি কি খাম বন্ধ সেই চিঠি বিকাশের হাতে দিতে পারি? ষাটে পৌঁছনো আমার মায়ের চিঠি? 
অঙ্কন: সোমনাথ পাল
8d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

মৃৎশিল্পী, ব্যবসায়ী প্রমুখদের বিশেষ কর্মোন্নতি যোগ প্রবল। পেশাদারি কর্মে শুভ ফল প্রাপ্তি। মানসিক চাঞ্চল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.০৯ টাকা৮৪.৮৩ টাকা
পাউন্ড১০৯.৪৭ টাকা১১৩.০৪ টাকা
ইউরো৯১.০৬ টাকা৯৪.২৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা