ওয়েবসাইটে খবর পড়ে নেওয়ার অভ্যাস বেশ কয়েক বছর ঋষির। রাতের খাওয়া শেষে ল্যাপটপ খুলে বসেছে। মোবাইলে অপরিচিত নম্বর ভেসে আসতে ফোন ধরেছে সে।
হিন্দি-বাংলায় জড়িয়ে অচেনা পুরুষ কণ্ঠস্বর, ‘ভেরি স্যরি টু ডিস্টার্ব ইউ মিস্টার রয়! আমি পুরুষোত্তম বাজাজ আছি। আপনি ঋষি রয়, রাইট?’
‘ইয়েস মিস্টার বাজাজ! হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?’
‘বলছি বলছি। আমি নবি মুম্বইয়ে খার ইস্ট-এ থাকি। বিজনেস ফাইভ জেনারেশন ধরে। একটা কমপ্লিকেটেড কেস...। আমার ওয়াইফ... ’, বলে একটু থেমে গেলেন পুরুষোত্তম। গলা খাঁকারি দিয়ে তারপরেই বললেন, ‘হাঁ, মানে আমার সেকেন্ড ওয়াইফ, উনি বাঙালি আছেন, প্রজ্ঞা। ওয়াইফই আমাকে সাজেস্ট করল আপনাকে কনট্যাক্ট করতে। একটা হচপচ খিচড়ি ব্যাপার! একটু বেশিই কমপ্লিকেশন! বাই দ্য ওয়ে, আপনার কি টাইম আছে কথা বলার জন্য? কিছু চিন্তা করবেন না, আপনার টাইমের রেমুনারেশন আপনি পাবেন, যা চাইবেন।’
ল্যাপটপ বন্ধ করে বিছানায় টানটান হয়ে বসল ঋষি, বলল, ‘আপনি বলুন। আমার টাইম না থাকলে বলতাম। আগে ইন আ নাটশেল বলুন।’
গলা খাঁকারি দিলেন আবার পুরুষোত্তম। প্রাথমিক উত্তেজনামুক্ত এখন তিনি, কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল বললেন, ‘প্রজ্ঞা আমার সেকেন্ড ওয়াইফ। আমাদের এজ গ্যাপ টুয়েন্টি ইয়ারের। আমি ফিফটি ওয়ান, ও থার্টি ওয়ান। ভেরি বিউটিফুল অ্যান্ড চার্মিং শি ইজ। আমাদের আলাপ একটা ডেটিং অ্যাপ-এ।’
‘ওক্কে। দেন?’
‘আমি উইডোয়ার ছিলাম। ওয়াইফের ডেথ হয়ে গেছিল সাডন হার্ট অ্যাটাকে, টু ইয়ার্স ব্যাক। কী বলব একদম লোনলি হয়ে পড়েছিলাম। চিত্রার এগজিস্টেন্স আমার লাইফে যে কতটা ছিল নোবডি ক্যান ইমাজিন!... সিরফ চালিস সাল কি থি ও! আমাদের দো বিটিয়া.. ষোলা ঔর আঠরা সাল কি!’
‘প্রবলেমটা বলুন প্লিজ।’
‘ইয়েস ইয়েস। এইগুলো না জানলে প্রবলেম বুঝবেন না স্যর।’
‘ওক্কে। ক্যারি অন।’
কথা বলতে বলতে আলিয়াকে লাইনে জুড়ে নিয়েছে ঋষি। সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট চলছে, ‘ভদ্রলোকের কথায় কোনওরকম অসঙ্গতি পেলে নোট করে নিস!’
‘স্যর! যা বললাম, আমাদের পাঁচ জেনারেশনের বিজনেস। আমার দাদাজির বাবার বাবাকে একজন বড় শিল্পপতি একটা সূর্যমূর্তি উপহার দিয়েছিলেন। খুব প্রেশাস। মূর্তিটা আমাদের ফ্যামিলির জন্য খুব লাকি আছে। আমার মায়ের মুখে শুনেছি আমাদের যত প্রসপারিটি সব এই মূর্তি আসার পর!’
‘মূর্তিটা চুরি হয়ে গেছে! এই তো?’ ঋষি বলল।
‘হাঁ জি। খুব ভয়ে আছি। ইন দ্য মিন টাইম, আমার ছোট মেয়ের মধ্যে র্যাডিক্যাল চেঞ্জ এসেছে যেটা নট গুড ফর হার। আমরা বেসিকালি মাড়োয়ারি। আমার জেনারেশন থেকে নন ভেজ খাই। মেয়েরা ননভেজ প্রেফার করে।’
‘ওক্কে..!’
‘প্রবলেম হচ্ছে প্রজ্ঞার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে এক সাল। তার আগে দো মাহিনা ডেটিং অ্যাপে কথা বলেছি। আমার এক ফ্রেন্ড এই অ্যাপের কথা বলে। ওই শিখিয়ে দিয়েছিল কী করতে হবে। আমি ব্যবসা নিয়ে থাকতাম, এসবের কিচ্ছু জানতাম না, স্যর।’
‘মূল সমস্যাটায় আসুন। তারপর আমি জেনে নেব দরকার মতো।’
‘দেখিয়ে, সো মেনি প্রবলেমস আর দেয়ার অ্যাট দিস মোমেন্ট। আমার ছোট মেয়ের কিছু আনইউজুয়াল অ্যাক্টিভিটিজ নোটিস করছি। প্রজ্ঞার কিছু চালচলনও খুবই ফিশি লাগছে। কিন্তু ওর মধ্যে একটা ইনোসেন্স আছে যেটা ডিনাই করতে পারছি না। প্রজ্ঞারও এটা সেকেন্ড ম্যারেজ। ও ডাইভোর্সড! আমাকে বিয়ে করার আগে ওর একটা বাচ্চা ছিল। একটা সেভেন এইট মান্থের বেবি।’
‘ছিল? এখন নেই?’
‘নেহি। মর চুকি শাদি সে পহলেই! আনন্যাচরাল ডেথ! সাসপেক্টেড শি হ্যাজ বিন কিলড!’
‘আপনি সেই বেবিকে দেখেছেন কখনও?’
‘তখনও আমরা মিট করিনি। জাস্ট আলাপ হয়েছে। চ্যাট করি। ভিডিও কলিং করি। তখন ভিডিওতে একবার দেখেছিলাম।’
‘আর দেখেননি?’
‘না, বলত অফিস করে টায়ার্ড থাকি, বেবি তাই আয়ার কাছেই ঘুমোয়।’
‘কয়েকটা প্রশ্ন করব। সঠিক উত্তর দেবেন। না জানলে বলে দেবেন।’
‘জি পুছিয়ে।’
‘প্রজ্ঞার এক্স হাজব্যান্ডের কথা কিছু জানেন? কেন ডিভোর্স? প্রজ্ঞার সারনেম?’
‘দেখিয়ে আই ওয়াজ নট ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট হার পাস্ট, ইসলিয়ে কভি নহি পুছা। ও সেইসময় ফেসবুকে আপডেট দিত ওর হাজব্যান্ড ওকে মেন্টালি ফিজিক্যালি টর্চার করেছে ম্যারেজের পর থেকে। ও বেবি চাইত কিন্তু হাজব্যান্ড চাইত না... এটসেটরা। বেবি আইভিএফ করে নিয়েছিল অনেক স্ট্রাগল করে কিন্তু বাচ্চার ফাদার নাকি বাচ্চার কোনও জিম্মেদারি নেয়নি। ইভন বাচ্চা যে ওরই, তাও ডিনাই করছে। আর আমি একবার আউট অব কিওরিওসিটি ওর প্রোফাইল চেক করে দেখেছিলাম, হি ইজ জেনুইনলি হ্যান্ডসাম অ্যান্ড ওয়েল এডুকেটেড। আইটি ব্যাকগ্রাউন্ড। মুম্বই আইআইটি-র স্কলার স্টুডেন্ট ছিল। ব্যাঙ্গালোরেও টিসিএস-এ হাই পোস্টে জব করতেন। তারপর ইউএসএ-তে চলে গেছিলেন উইথ প্রজ্ঞা। ওখানে এইট ইয়ার্স ছিল ওরা। রিসেন্টলি দু’জনেই ইন্ডিয়ায় ব্যাক করেছিল। বাট সেপারেটেড থাকত। প্রজ্ঞা মায়ের কাছে ছিল সিক্স মান্থস, পরে ব্যাঙ্গালোরে শিফট করে জব নিয়ে। প্রজ্ঞাও আইটি সেক্টরে ছিল। প্রজ্ঞার সারনেম ছিল মুখার্জি।’
‘চুরি বাদে আপনার আর কী প্রবলেম, সেটা বলুন।’
‘প্রজ্ঞা বলল, পুলিস মূর্তি চুরি সলভ করতে পারবে বলে মনে হয় না। পুলিসের সঙ্গে ক্রিমিনালদের অনেক যোগসাজশ থাকে অনেক সময়। কলকাতার ঋষি রয়কে কনট্যাক্ট করো। অনেক বড় ডিটেকটিভ উনি। তখনই মনে হল আমার মেয়ের কেসটাও যদি আপনাকে বলি...! ইনফ্যাক্ট প্রজ্ঞার চালচলনেও কিছু ফিশি ব্যাপার লাগছে। কাউকে বলতেও পারছি না! আবার ওকে খুবই আমার প্রতি ডেডিকেটেড লাগে। খুবই ছেলেমানুষ টাইপের! খুব কনফিউজড, স্যর।’
‘ওক্কে। মিস্টার বাজাজ মূল সমস্যায় আমরা এখনও রিচ করতে পারিনি। আপনি কি কলকাতায় আসতে পারেন? মুখোমুখি বসে ডিটেলস জানতে হবে। ম্যাটারটায় অনেক শেডস আছে।’
‘আপনি বললে কাল আফটারনুন ফ্লাইটেই আসতে পারি। নাইটের দিকে ব্যাক করব।’
‘দেন, কাম প্লিজ। কোথায় উঠবেন?’
‘এয়ারপোর্ট হোটেলে। পৌঁছে একটা কল করব।’
‘ইয়েস। ডান।’
‘আরেকটা কথা, আপনি যে আসছেন কেউ যেন না জানে। শুধু আপনি আর আমি, ব্যস। রাইট?’
পুরুষোত্তম ফোন কেটে দিতেই আলিয়া ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘কেসটার সঙ্গে আমি আরেকটা কেসের সিমিলারিটি পাচ্ছি, বুঝলি? প্রায় এক বছর আগেই ফেসবুকে আমার এক কাজিন সিস্টারের ফেসবুক ফ্রেন্ড-এর এরকম একটা কেস...। বেবিকে মার্ডার করা হয়েছিল বলে সবাই গেস করছিল। তার নামও ছিল প্রজ্ঞা। আমিও কেসটা পার্সোনালি নাড়াচাড়া করেছিলাম। কিন্তু কেসটা ধামাচাপা পড়ে গেছিল।... ওয়েট দিদিকে কল করে ওর অ্যাকাউন্টটা পাই কি না দেখছি।’
‘ওক্কে।’
সকাল সাতটায় ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙল ঋষির, ‘বাজাজ কলিং!’
উত্তেজিত সে, ‘ইয়েস গুড মর্নিং, বলুন!’
‘বাই ইলেভেন আমি কলকাতায় রিচ করছি। এখন এয়ারপোর্টে। আপনি বাই ইলেভেন থার্টি চলে আসুন দাদা।’
উত্তেজনার পারদ এখন তুঙ্গে ঋষির। আলিয়াকে ফোন করতে যেতেই আলিয়ার মেসেজ ঢুকল হোয়াটসঅ্যাপে, ‘গুড মর্নিং! কখন আসব বল।’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল সে, ‘ইলেভেন থার্টি এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবি। বাজাজ ফোন করেছিল।’
আলিয়া যে সময়কে বারবার হারিয়ে দিয়েছে আজ আবার তার প্রমাণ পেল ঋষি। নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে সে দেখল আলিয়া আগেই এসে গিয়েছে।
টাক মাথা, ধবধবে ফর্সা মাঝারি উচ্চতার সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোককে তাদের দিকে আসতে দেখেই আলিয়া বলল, ‘আই থিঙ্ক উই আর ওয়েটিং ফর দিস গাই!’
ভদ্রলোক ফোন বের করে ফোন করে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতেই ঋষির ফোন বেজে উঠেছে, ‘বাজাজ কলিং।’
ঋষি হাত নাড়তেই এগিয়ে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন পুরুষোত্তম বাজাজ, ‘নাইস মিটিং। চলুন রেস্তরাঁয় বসি?’
আলিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই পুরুষোত্তম বললেন, ‘এর কথাও শুনেছি। নাইস মিটিং। ...আপনারা এখন আমাকে এই প্রবলেম থেকে বের করে আনতে পারলে যা ফিজ চাইবেন আমি দেব।’
হট চকোলেট খেতে খেতে ঋষি বলল, ‘আমি আর আলিয়া কিছু প্রশ্ন করব, আগে সেগুলোর উত্তর দেবেন প্লিজ।’
‘প্রজ্ঞা মুখার্জির বেবি যে মার্ডার্ড সে বিষয়ে আপনি কী জানেন?’ আলিয়া প্রশ্ন করল। ‘প্রজ্ঞার ফোটো নিশ্চয়ই আছে আপনার কাছে, একটু দেখাবেন প্লিজ।’
মোবাইলে ফটো গ্যালারিতে প্রজ্ঞার অসংখ্য ছবি। সঙ্গে সঙ্গে বের করে এগিয়ে দিলেন পুরুষোত্তম।
‘স্বাস্থ্যবতী, অতীব ফর্সা নজরকাড়া সুন্দরীই বলা যায় প্রজ্ঞাকে। তবে সে যে অতিরিক্ত শরীর প্রদর্শনে উৎসাহী তা তার সব ছবিতেই স্পষ্ট। সমস্ত পোশাক অতিরিক্ত খোলামেলা এবং সে প্রদর্শন করছে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে!’
ছবিগুলো দেখতে দেখতে আলিয়া বলল, ‘আল্লাহ! এই তো সেই মেয়ে তোকে যার কথা বলছিলাম। কাল দিদি ওর অ্যাকাউন্ট থেকে ছবি পাঠিয়েছে, দেখলাম। ইনিই। বিয়েও করেছে, ম্যারেড টু পুরুষোত্তম বাজাজ লেখা।’
পুরুষোত্তম অবাক, বললেন, ‘চেনেন ওকে?’
‘হুঁ। অল্প। ফেসবুকে। আপনি বলে যান প্লিজ।’
‘তারপর একদিন ফেসবুক পোস্ট দেখলাম ওর বেবি মারা গেছে! ওকে ফোন করলাম। দেখলাম ও খুবই স্টেডি অ্যান্ড কুল। এতটা কুল কোনও মম হতে পারে, নেভার থট অফ! আমি অবাক হয়েছিলাম। ও বলল, ভালোই হয়েছে গডের চাইল্ড গড নিয়ে নিয়েছে। ওর বাবা থেকেও ছিল না। আমি একলা মানুষ করতাম কীভাবে, জানি না! ঈশ্বর ওকে নিয়ে শান্তি দিয়েছে...! ওকে কনসোল করলাম, মনখারাপ কোরো না। আমি আছি। ও বলল, না করছি না। আমি এখন রিলিভড। তাছাড়া আমার বেবিকে নিয়ে কেই বা আমাকে বিয়ে করত বলো? ওর নিজের বাবাই নিল না! জানেন মিস সিদ্দিকী আমার মন খুবই দুখী হয়েছিল সেইদিন। ওর বাবা মা-ও নাকি ওকে জায়গা দিচ্ছে না! তক্ষুনি ডিসাইড করলাম ওকে বিয়ে করব। ঘর দেব। আমার দুই বেটিকে ও সন্তান হিসাবে পাবে। ওর জব করারও দরকার হবে না। আমার প্রচুর অর্থ ঈশ্বরের দয়ায়। সেইদিন রাতেই বিয়ের প্রোপোজাল দিই। আমার দোনো বিটিয়াই খুব মডার্ন, ওদের সব বলতে ওরাও বলল, পাপা তুম আকেলা, শাদি কর লো। আমার মাকে ওর পিকচার দেখালাম, বললাম শাদি করতে চাই। মা ভি রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, তুমি যদি ভালো থাকো, মেয়েরাও যদি রাজি থাকে, আমার কোনও অবজেকশন নেই। দেন আই ডিসাইডেড।’
আলিয়া বলল, ‘উনি রাজি হয়ে গেলেন? বেবির কেসটা..?’
‘যেদিন প্রোপোজ করি সেইদিনই বলল, আমি খুব প্রবলেমে আছি, বেবির ডেথ আনন্যাচারাল, হসপিটাল রিপোর্ট দিয়েছে। ওকে পয়জন করা হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলে জানতে পারব একজ্যাক্ট কারণ।’
ঋষি বলল, ‘রিপোর্ট কী বলেছিল জানেন?’
‘জি। সামথিং টক্সিন থেকে ডেথ। কোনও ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল পায়ের পাতার নীচে। বাচ্চাটাকে ও ডে-কেয়ারে রেখে অফিসে গেছিল। ওখান থেকেই ফোন পায় যে বাচ্চার ভমিটিং হচ্ছে। ও অফিস থেকে ডে-কেয়ারে এসে দেখেছিল বাচ্চা ঝিমিয়ে পড়েছে ভমিট করতে করতে। সামথিং বটুলিনাম টক্সিন ওর ডেথের কারণ!’
আলিয়া বলল, ‘ঋষি, সেম কেস!’
পুরুষোত্তম পানীয়তে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘প্রজ্ঞার বিহেভিয়ার কিন্তু আমার নর্মাল লাগেনি বুঝলেন? ও ওর হাজব্যান্ডের সঙ্গে ডিভোর্স নিয়েই যেন বেশি দুখী, মনে হচ্ছিল। তখন ওর রূপে মুগ্ধ আমি, সন্দেহকে ইমপর্ট্যান্স দিইনি, ভেবেছি এত অল্প বয়সে এতগুলো প্রবলেম একসঙ্গে ফেস করতে হলে এরকমই হয়।’
ঋষি বলল, ‘পুলিস ইনভেস্টিগেট করেনি?’
‘হাঁ তদন্ত চলছিল। ও সেইসময় ভুলভাল কথা বলছিল। আমাকেও জেরা করেছিল পুলিস। আমিও সাসপেক্টেড ছিলাম। লাগাতার ইন্টারোগেট করেছে পুলিস। আমাদের চ্যাট, কল হিস্ট্রি সব চেক করে পুলিস আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।’
আলিয়া বলল, ‘এইবার আপনার এখন যে প্রবলেম, সেটা বলুন। ডিটেলস। কিচ্ছু লুকোবেন না।’
গম্ভীর হয়ে গিয়েছে পুরুষোত্তমের মুখ। বললেন, ‘আমাকে ছুপিয়েছিল প্রজ্ঞা যে ও ওর হাজব্যান্ডের থেকে কিছু পায়নি। একটা টু স্টোরিড হাউস অন সিক্স কাঠা’জ ও নিয়েছে। প্লাস ফিফটি ল্যাকস অ্যালং উইথ আ কার ও ডিমান্ড করেছিল সেটা পরে জেনেছি। পুলিসি তদন্তে এসেছে। আই ওয়াজ শকড! আমাকে বলেছিল অয়ন ওকে ভালোবেসে ফিরিয়ে নিক। মোটা ভাত কাপড় দিক সেটাই ও চায়। ওর কোনও লোভ নেই প্রপার্টিতে। ও সংসার করতে চায়।’
‘তখন কি আপনার সঙ্গে ডেটিং চ্যাট করছিল?’ আলিয়া জিজ্ঞেস করল।
‘হাঁ। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে অয়নের সঙ্গে যদি মিটমাট হয়ে যায় আমার কী হবে? আমাকে কি তুমি ভালোবাসো না? ও বলেছিল, দেখো আমার সেভেন-এইট ইয়ার্স ম্যারেজ, তার আগে দু’মাস কোর্টশিপ। আমি তো ওকে ছাড়তে চাইনি, ভালোবাসি ওকে খুব। আমি তো টাকাপয়সার জন্য বিয়ে করিনি। তুমি আমাদের কিনে রাখতে পারবে এত রিচ। কিন্তু তোমাকেও যদি বিয়ে করি তাহলে ভালোবাসলেই করব। তোমাকে আমার ভালো লাগে খুব। একটু কি ওয়েট করতে পারো না?... জানেন, ওর এই কথা শুনে রেসপেক্ট বেড়ে গেছিল। ডেটিং অ্যাপের অন্য মেয়েদের মতো ও নয় ভেবেছি। বলেছিলাম, আমি অপেক্ষা করব। আমার মধ্যে তখন খুব একটা ওঠাপড়া... ওকে ভালোবেসে ফেলেছি খুব, কাছে পেতে চাইতাম, আবার ভাবতাম যদি ওদের রিইউনিয়ন হয়ে যায় ও খুব হ্যাপি হবে। আই ওয়াজ টোটালি কনফিউজড অ্যান্ড এগজস্টেড! বিয়ে করলে ওকেই করব আর না তো বিয়ে করব না, ঠিক করেছিলাম।’
‘আপনি খুব অনেস্ট আর গুড হিউম্যান বিয়িং,’ আলিয়া বলল। ‘এবার মেন পয়েন্টে আসুন।’
‘জি। আফটার ওয়ান মান্থ ও একদিন ফোন করল, বলল, তুমি কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো? বললাম, জান দিয়ে। আমার ওয়াইফকে যেমন বাসতাম। কোনওদিন কোনও মেয়ের দিকে আমার ইনটারেস্ট ছিল না। ও বলল, পুলিস বেবির ডেথের জন্য প্রাইম সাসপেক্ট করছে। আমার হাজব্যান্ডের ফ্যামিলি আমাকে বাঁচতে দেবে না পুরুষোত্তম! ওরাই বেবিকে মার্ডার করে আমাকেই জেলে পাঠাতে চাইছে। আমি তো বেবিকে ডে-কেয়ারে রেখে অফিসে গেছি সেইদিন। তখন তো আমার বাচ্চা সুস্থ! তাহলে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে কী এমন হল যে ওর ব্রিদিং ট্রাবল, ভমিটিং, বডি শক্ত হয়ে...!’
কথা বলতে বলতেই লাঞ্চের অর্ডার করলেন পুরুষোত্তম। নিজের জন্য বেঙ্গলি কুইজিন। ঋষি-আলিয়া শুধুই ফ্রুট স্যালাড।
রীতিমতো ভাত-মাছ মাংসের বিভিন্নরকম ডিশ অর্ডার করে খুশি পুরুষোত্তম। বললেন, ‘খেতে খুব ভালোবাসি। ভেবেছিলাম প্রজ্ঞার কুকিং-এ ইন্টারেস্ট থাকবে কিন্তু... উঁহু, নেই!’
আলিয়া চট করে বলে উঠল, ‘ওর কীসে ইন্টারেস্ট?’
‘নাথিং... বুঝি না। ও সারাদিন জিম, বিউটি কেয়ার নিয়েই থাকে। শপিং করে প্রচুর। আমার এমনি ভালোই লাগে যে ওর মুখে হাসি আনতে পেরেছি। বয়স কম। তবে খুবই ডেয়ারিং আউটফিট পরে। খুবই ফ্লনটিং। ওর জন্য ক্যামেরাম্যান রেখেছি, আই মিন পার্সোনাল ফোটোগ্রাফার! প্রচুর ফোটো তোলায়। হবি। আমার আগের ওয়াইফ খুব সিম্পল ছিলেন।’
ঋষি প্রসঙ্গ ধরিয়ে দিয়ে তখনই বলল, ‘হ্যাঁ যেখানে আপনি থেমে গেছিলেন...!’
‘ইয়েস ইয়েস...! প্রজ্ঞা দু’দিন ধরে সারাদিন ফোনে কানেকটেড থাকত আর কাঁদত, বলত, কোনও অপরাধ না করে আমি জেল খাটব, তুমি সহ্য করতে পারবে? অয়নরা ক্রিমিনাল মাইন্ডেড। আমাকে অ্যালিমনি না দিয়ে ডিভোর্স তো করবেই, প্লাস জেল খাটাতে চাইছে। অথচ আইভিএফ করা বেবিকে বাচ্চার স্বীকৃতিও দিতে চায়নি ও। আমার সঙ্গে অনেক অন্যায় করল ওরা। দেন এক উইকের মধ্যে ও বলল, মিউচুয়াল দিয়ে দিচ্ছি, কথা হচ্ছে। আমি কিছু নেব না।’
লাঞ্চ সার্ভ করে দিয়েছে ওয়েটার। ইলিশ পাতুরির দিকে তাকিয়ে পুরুষোত্তম বললেন, ‘আমি কেমন বাঙালি কুইজিন লাইক করি এবার বুঝতে পারছেন তো?’
ঋষি কথা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘প্লিজ কাম টু দ্য মেন টপিক।’
পুরুষোত্তম খেতে খেতে একমনে বলে চলেছেন, ‘আমরা বিয়ে করে নিলাম যদিও ওর একটা শর্ত ছিল। সেটাও আমি জাস্টিফায়েড ভেবেছিলাম। বলেছিল, বিয়ের সময়েই ওর নামে অ্যাকাউন্টে ওয়ান ক্রোড় রাখতে হবে। ওকে অয়ন যেভাবে ঠকিয়েছে ও আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমার মনে হয়েছিল সত্যিই এইভাবে কেউ চিটেড হলে কী করে মানুষকে বিশ্বাস করবে? দেন আমি ভাবলাম, ইনোসেন্ট একটা মেয়ে এত স্ট্রাগল করছে আমি বিয়ে করে ওকে নিশ্চয়ই হ্যাপি রাখতে পারব। নেক্সট মাহিনা আমরা বিয়ে করে নিলাম।’
মাথা নাড়ল আলিয়া ঋষি দু’জনেই, ‘ওকে।’
ঋষি বলল, ‘এখন প্রবলেমটা কী?’
‘আমার বড় মেয়ের সঙ্গে প্রায়ই ওর ঝামেলা চলছে। ইয়ংগার ওয়ান সাডেনলি খুব প্রজ্ঞার ভক্ত হয়ে উঠেছে। মানে উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে। আগুনে হাত পোড়াতে বললেও পোড়াবে, এমনই অবস্থা!’
‘মেয়েদের সঙ্গে ওর রিলেশন প্রথম থেকে কেমন ছিল?’ আলিয়া জিজ্ঞেস করল।
‘স্বাভাবিক। মেয়েরা তো লিবারাল, বিয়েতে খুশি হয়েছিল। প্রজ্ঞাও ফ্রেন্ডলি ছিল।
‘তাহলে, এখন?’
‘বড় মেয়ে দীপ্তির সঙ্গে সম্পর্ক এখন একদম ভালো না।’
‘কেন? হঠাৎ? মেয়ের কাছে জানতে চেয়েছেন?’
‘হাঁ। দীপ্তি নিজেই কমপ্লেন করেছে যে ও বোনকে কিছু খাওয়াচ্ছে বা কিছু করেছে যে বোন ওর কথা শোনেই না! অথচ দুই বোনে খুব ভাব ছিল। আর একটা ব্যাপার, সুপ্তি মানে ছোট মেয়ে হঠাৎ করেই ফুল ভেজিটেরিয়ান হয়ে গেছে। চোখে পড়ার মত চেঞ্জেস...! আমার মাও অত বাছবিচার করেন না যতটা ও শুরু করেছে! আগে দুই বোন এক ঘরে থাকত। ওদের মা মারা যাওয়ার পর তো দীপ্তি একেবারে মায়ের মতো আগলে রাখত সুপ্তিকে! সেই অবস্থা থেকে সুপ্তি এখন ওর বেডরুম আলাদা করে নিয়েছে!’
‘স্ট্রেঞ্জ! কেন এরকম করছে জিজ্ঞেস করেননি আপনারা?’
আলিয়ার প্রশ্নে হতাশা রীতিমতো পুরুষোত্তমের মুখে। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, ‘খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছে মেয়েটা আমার। উত্তর দেয় না কথার। বলে, ওর প্রাইভেট লাইফে যেন আমরা ইন্টারফেয়ার না করি। ও নাকি জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে! ও ঈশ্বরের আরাধনা করে, তাই আলাদা থাকে। সবচেয়ে দুঃখ পাচ্ছে বড় মেয়ে। দিদি অন্ত প্রাণ মেয়েটা দিদির সঙ্গে কথাই বলে না এখন! দীপ্তি তো এখন কলেজে আর সুপ্তি এইবার বোর্ড এগজাম দেবে।’
ঋষি অবাক হতে হতে বলে ফেলল, ‘বাপ রে! মহিলার গুণ আছে! কিন্তু কারণ কী? ওয়াইফকে জিজ্ঞেস করেছিলেন?’
‘হুম। বলল, সুপ্তি নাকি খুব স্পিরিচুয়াল। প্রজ্ঞার গুরুমা ওকে দেখে নাকি বলেছেন, ও সাধারণ নয়।’
ঋষি বলল, ‘গুরুমা! উনি কি এসব মানেন, নাকি?’
‘জানি না!’
‘কাল ফোনে আপনি বলছিলেন প্রজ্ঞার বিহেভিয়ার ফিশি লাগছে! কেন বলেননি!’
‘জি! প্রজ্ঞা প্রায়ই বাড়ির গাড়ি নিয়ে বেরলেও মাঝপথে গাড়ি ছেড়ে দেয়। আবার বাড়ি ফেরার আগে কোনও একটা পয়েন্টে গাড়িকে আসতে বলে পিক আপ-এর জন্য। মাস ছয় হল নিজে ড্রাইভার রেখেছে ওর দুটো গাড়ির জন্য। আমাদের যে পুরনো সব ড্রাইভার আছে তাদের ও রাখছে না ওর নিজের গাড়ির জন্য! কারণ জিজ্ঞেস করতেই খুব ঝামেলা হল। আমি নাকি ওর প্রিভেসিতে নাক গলাচ্ছি।’
আলিয়া কথার মধ্যেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি ওর কন্ডিশন মেনে টাকা দিয়েছিলেন?’
‘জি হাঁ। এইট্টি ল্যাকস দিয়েছিলাম। বলেছিলাম বিয়ের পরে তোমাকে নিশ্চয়ই দেব।’
‘আপনার মেয়েদের নামে অ্যাকাউন্টেও নিশ্চয়ই মোটা অঙ্কের সেভিংস আছে?’
‘হাঁ, দুই মেয়ের নামেই ওদের জন্মের পর দিনেই অ্যাকাউন্ট খুলে আমার বাবা টাকা আর অর্নামেন্টস গিফট করেছিলেন। যেহেতু ওরা ইনফ্যান্ট তখন, তাই ওর মা ছিলেন কেয়ারটেকার। এখন তো দু’জনেই ম্যাচিওরড।’
‘প্রজ্ঞা কি খুব গ্রিডি? স্যরি টু আস্ক।’
‘পাজলড হো যাতা হুঁ ম্যায় কভি কভি। দেখিয়ে কভি কভি মুঝে লগা, উমর কম হ্যায়, ইস উমর মে ইয়েহি নর্মাল হ্যায়। কভি কভি লগ রহা হ্যায় কুছ...! ছোড়িয়ে... দেখিয়ে প্রজ্ঞা ইজ বিউটিফুল। অনেক লেখাপড়া ডিগ্রি ভি আছে। লাইফে অনেক স্ট্রাগল করেছে, শি ডিজার্ভস আ গুড লাইফ। ও আনন্দ করে থাকবে আমি চাই। মেন চিন্তা আমার সুপ্তিকে নিয়ে। আচানক ও দিদির থেকে ডিসট্যান্স তৈরি করল এমন যে দিদি ওর এনিমি! প্রজ্ঞা ওর সবচেয়ে ক্লোজ হয়ে গেল! দেন লাইফস্টাইলই চেঞ্জ হয়ে গেল! হাউ অ্যান্ড হোয়াই? এই ম্যাটার নিয়েই আমি আপনাদের হেল্প চাই। মেয়ে আমার সঙ্গেও বেশি কথা বলে না! অথচ দুই মেয়েই আমাদের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ছিল! তবে এটা প্রজ্ঞা জানে না কিন্তু যে আমি এসব নিয়ে প্রসিড করছি। আচ্ছা, আমাদের বাড়ি থেকে একটা প্রেশাস অ্যান্টিক সূর্যমূর্তি চুরি গেছে চার-পাঁচ দিন হল, সেটা তো বলেছি। চুরির কেসটার জন্য আপনাকে রেকমেন্ড করল প্রজ্ঞাই। তখনই মনে হল সুপ্তির কেসটা যদি আপনাদের বললে সলভ করা যায়...!’
আলিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘ওর রুমে ঢুকেছেন কখনও? কী পুজো করে জানেন?’
‘নাহ্! সবসময় লকড। আমাকে অ্যাভয়েড করে। আমি প্রজ্ঞাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলল, সুপ্তি খুব স্পিরিচুয়াল। ও যদি মেডিটেশন করে পুজো করে নিজেকে বেটার রাখে সেটাতে অসুবিধা কী?’
আলিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘মূর্তিটা বড় না ছোট?’
‘মাঝারি হাইট। দেড় ফিট হবে। মূর্তিটার শরীর দিয়ে অন্ধকারেও জ্যোতি বেরয়! চোখ দুটো এমারেল্ড-এর।’
আলিয়া বলল, ‘আমরা একবার আপনার বাড়িতে যেতে চাই।’
‘আপনারা কি দু’জনেই আসবেন? কবে আসতে চান বলুন। আমি টিকিট করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
ঋষি বলল, ‘আমরা নিজেরা একটু কথা বলে জানাচ্ছি।’
ঋষির দুটো হাত জড়িয়ে ধরেছেন পুরুষোত্তম, প্রবল আকুতি তার কণ্ঠে, বললেন, ‘প্লিজ হেল্প করুন। আপনার রেম্যুনারেশন নিয়ে টেনশন করবেন না। এখনই ওয়ান ল্যাখের চেক কেটে দিচ্ছি।’
মাথা নাড়ল ঋষি, ‘না এখন কোনও অ্যাডভান্স দিতে হবে না। আমরা দু’জনে আলোচনা করে জানাচ্ছি। আজ তাহলে উঠি? উইল কল ইউ।’
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসেই ঋষি বলল, ‘বেশ কমপ্লেক্স আর ইন্টারেস্টিং, না? নিয়ে নিই তবে কেসটা?’
গম্ভীর মুখ আলিয়ার, মাথা নাড়ল শুধু।
‘কিছু ভাবছিস মনে হচ্ছে?’
‘হুঁ। প্রজ্ঞার বেবির মার্ডার কেসটা চাপা পড়ল কীভাবে? ওর এক্স-এর সঙ্গে আমরা আগে কনট্যাক্ট করব। এইভাবে প্রসিড করব। মূর্তি চুরির সঙ্গে এটা কোনওভাবে লিঙ্কড!’
ঋষি উত্তেজিত, বলল, ‘রাইট!’
আলিয়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এক কাপ চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি খেয়ে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে শুয়ে পড়ল ঋষি। এইভাবেই অনেক প্রবলেমের উত্তর সে আগে পেয়েছে।
চিন্তা করতে করতে চোখ জুড়িয়ে এসেছে ঋষির। ফোনের শব্দে তন্দ্রা কেটে গেল।
‘ক্র্যাক করেছি। প্রজ্ঞা মুখার্জির হাজব্যান্ডের সঙ্গে কথা বললাম জাস্ট নাউ।’
‘হোয়াট!’ লাফিয়ে উঠেছে ঋষি, ‘হাউ? এত তাড়াতাড়ি! আমি তো ফ্রাসট্রেটেড হয়ে শুয়ে গান শুনছিলাম।’
হাসছে আলিয়া, ‘কারা যেন বলে মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুতে থাকে? উঁ? ওক্কে শোন, আমি ওর হাজব্যান্ড অয়নকে এখন ফোনে নিচ্ছি আবার, কনফারেন্সে তুই থাক।’ নিমেষের মধ্যেই আলিয়া আর অয়ন মুখার্জির গলা শোনা গেল। আলিয়া ঋষির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই অয়ন বলল, ‘কী জানতে চান বলুন মিস্টার রয়।’
ঋষি বলল, ‘মিস্টার মুখার্জি, আপনাদের ডিভোর্সের কারণটা ছোট করে যদি বলেন। মিস সিদ্দিকী নিশ্চয়ই বলেছেন আমরা একটা অদ্ভুত কেস নিয়েছি যেখানে আপনার এক্স-ওয়াইফ জড়িয়ে আছে।’
‘শিওর! আমাদের পরিচয় একটা বন্ধুদের আড্ডায়। আমি তখন রিলেশনশিপে ছিলাম অনন্যার সঙ্গে। অনন্যা ওয়াজ মাই ক্লাসমেট। প্রজ্ঞা ফেল ফর মি ম্যাডলি। এতটাই পাগল হয়ে গেছিল যে অনন্যা বুঝতে পেরে সরে গেছিল নিজেই। আমারও মতিভ্রম! প্রজ্ঞার সঙ্গে সিক্স মান্থস ডেটের পর বিয়ে করে নিই পেরেন্টসদের অমতেই। আমার মা ওর সঙ্গে কথা বলেই বুঝেছিল ও আমাদের স্টেটাস, অর্থ দেখে বিয়ে করতে চাইছে। দেখুন ও নিজেও আইআইটি-র স্কলার। কিন্তু ওর ধান্দা হল কাজ না করে বড়লোককে বিয়ে করে ফুর্তি করবে। বিয়ের কিছুদিন পর আমরা আমেরিকায় চলে গেলাম। ডালাসে থাকতাম। ওকে বলতাম, তুমিও জব করো। কিন্তু করবে না। ওর ইচ্ছা হল ঘরে বসে খাবে, লাক্সারিয়াস লাইফ লিড করবে। আমি একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিলাম। হ্যাঁ, প্রচণ্ড রেগে কয়েকবার গায়ে হাতও তুলেছিলাম। আমার নিজেরই মনে হতো সুইসাইড করি! উফফ! কী প্রচণ্ড পাগলামি করত! হঠাৎ বায়না তুলল বেবি নেবে। আমি বাচ্চা চেয়েছিলাম প্রথম দিকে, কিন্তু ও তখন ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে এবং ফুর্তি করতে পারবে না বলে রিফিউজ করে। আমি টাচ করতে গেলেই সিন করত যেন আমি ওকে রেপ করব! দেখুন সবকিছুরই একটা লিমিট থাকে। আমি নিজেকে উইথড্র করে নিলাম। সেপারেট রুমে শুতাম তখন থেকে। অনন্যার সঙ্গে তখন আবার কনট্যাক্ট হয়। ও বিয়ে করেনি। আমরা আবার রিলেশনশিপে আসি। প্রজ্ঞার মাকে বলেছিলাম, মেয়েকে বোঝান ডিভোর্সের জন্য। এই ম্যারেজ কনটিনিউ করা যায় না। উনিও মেয়ের মতো। আমাকেই গালিগালাজ করলেন। তারপর নরম হয়ে বোঝাতে চাইলেন যে ওঁর মেয়ে বয়সের তুলনায় ইমম্যাচিওর, একটু মেনে নিই যেন। আমি বললাম সম্ভব না। উনি বললেন, তোমরা একটা বেবি নাও। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে, এটসেটরা। এরপরেই প্রজ্ঞার নতুন নাটক হল বেবি চাই। বাট স্বীকার করতে অসুবিধা নেই, আই হ্যাভ লস্ট অল মাই ইমোশনস ফর হার। আমাকে না জানিয়ে ও আইভিএফ-এর সাহায্যে কনসিভ করে ফোর মান্থসে জানায় শি ওয়াজ ক্যারিং!’
আলিয়া বলল, ‘মাই গড! দেন?’
‘এই নিয়ে প্রচণ্ড ঝামেলা হয়। ঠিক চার মাসের মাথায় আমি জব রিজাইন করে চলে আসি। ওখানকার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিই। আমি ব্যাঙ্গালোরে নিজেদের বাড়িতে চলে আসি নতুন জব নিয়ে। প্রজ্ঞাও বাধ্য হয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসে। এরপর ওর বেবি হয়। আমি ডিভোর্সের নোটিস পাঠাই। তখন ওর ফ্যামিলি থেকে স্ক্যান্ডাল করে আমার ক্যারেক্টার নিয়ে। অবভিয়াসলি আমি সবার সামনেই বলি, আমি অনন্যার সঙ্গে রিলেশনে কেন এলাম আবার। আ ভেরি ফিকল মাইন্ডেড গ্রিডি গোল্ড ডিগার... শি ইজ। বাচ্চার জন্মের পর থেকে আবদার বাচ্চার দায়িত্ব নিতে হবে। বলুন তো যে বাচ্চার বাবা আননোন কেউ, তার দায়িত্ব আমি কেন নেব?... ও ওর এক লইয়ারকে দিয়ে থ্রেট করে, বাচ্চার জন্য টাকা না দিলে জেল খাটাবে আমায়। আমি পাল্টা বলি, ডিএনএ টেস্টে যদি প্রুভ করতে পারো বাচ্চার বাবা আমি, তাহলে নিশ্চয়ই দেব। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অয়ন, বলল, নটোরিয়াস। আট বছরে আমাকে নরক দেখিয়ে দিয়েছে। আমার ব্যাঙ্গালোরের বাড়ি আর ফিফটি ল্যাখস নিয়ে ডিভোর্স দিয়েছে। তারপরেই শুনলাম, দ্যাট বেবি হ্যাজ বিন মার্ডারড!’
ঋষি বলল, ‘যদি দরকার পড়ে কল করব।’
‘ওক্কে। এনি টাইম ইউ ক্যান কল মি, যদি দরকার পড়ে। আর কিছু জানার ছিল কি?’
‘থ্যাংকস। এখন এইটুকুই। বাই দ্য ওয়ে ওর কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আপনি টাকা দিয়েছিলেন?’
‘ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক, চৌরঙ্গি ব্রাঞ্চ।’
‘মেনি থ্যাংকস।’
অয়ন ফোন ছেড়ে দিতেই ঋষি রীতিমতো উত্তেজিত, ‘আরে এ তুই তো একাই কামাল করে দিচ্ছিস! কাজ তো অর্ধেক এগিয়ে গেল।’
‘সবে শুরু। আমার গাট ফিলিং হল, সব ক’টা ক্রাইমের পিছনেই প্রজ্ঞা! আবার বাজাজকেও ছেড়ে রাখা যাবে না। বাজাজকে বলে দে, কালই আমরা মুম্বই যেতে চাই। রাতের ফ্লাইটে যাব। হোটেল আমরা বুক করব। আমি এদিকে আর কিছু কাজ করি আজ। বাই।’
শুয়ে পড়ার পরেও মাথার কাজ চলছে আলিয়ার। প্রজ্ঞার বেবির একটা ফোটো দেখেছিল সে, সেই সময়ে মনে পড়ছে!
সময় কত হল খেয়াল নেই তার। ঘুম আসছে না। এমন সময়ে ঋষির ফোন আসতেই ধড়মড় করে উঠে বসেছে সে, ‘হোয়াট হ্যাপেনড! এনি প্রব?’ কথা শেষ করার আগেই ঋষির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, ‘বাবি! বাজাজের ছোট মেয়ে পালিয়েছে! সুপ্তি! ব্যালকনি থেকে শাড়ি ঝুলিয়ে পালিয়েছে রে! বাজাজ এখনই ফোন করল।’
‘ঘটনা কখন ঘটেছে? উনি তখন কোথায় ছিলেন?’
‘বললেন, উনি এগারোটায় বাড়ি পৌঁছে গেছিলেন। ডিনার করে শুয়ে পড়েছিলেন। দুই মেয়ের সঙ্গেই তার আগে দেখা হয়। প্রজ্ঞা নাকি এগারোটা নাগাদ বাজাজকে ফোন করে জানিয়েছিল ফিরতে দেরি হবে। একটা পার্টিতে আছে। ... শোন বাবি, এখন আড়াইটে বাজে। বাজাজের কথার হিসেব মতো আধ ঘণ্টা আগে ওরা জেনেছে! বাড়ির সিকিওরিটি গার্ডের একজন সুপ্তির ব্যালকনি থেকে প্যাঁচানো শাড়ি ঝুলতে দেখে সন্দেহ হওয়ায় খোঁজ করে দেখে সুপ্তির ঘর খালি। বাজাজ সেই মোমেন্টেই ফোন করেছে আমায়।’
‘এইরকম একটা কিছু ডাউট করছিলাম রে!’
‘কী বলছিস! আমি তো কোনও ক্লুই পাচ্ছি না!’
‘আমি পেয়েছি। আমিও পেতাম না প্রজ্ঞার কেসটা যদি ফেসবুকে হইচই না ফেলে দিত, আর আমার দিদির কাছে না শুনতাম। দুইয়ে দুইয়ে চার করেছি জাস্ট। শোন, বাজাজকে বল যত দামই লাগুক আমাদের কালকের আর্লি ফ্লাইটে টিকিট করে পাঠাতে। হারি আপ।’
এক ঘণ্টার মধ্যেই ফোন করল ঋষি, ‘ফাইভ ফর্টিফাইভের ফ্লাইট। রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়। আমিও বেরিয়ে যাচ্ছি।’
‘দুটো ট্র্যাক স্যুট, দুটো টি শার্ট ও লাইসেন্সড রিভলভারটি গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আলিয়া দশ মিনিটের মধ্যে।
বাজাজের উৎকণ্ঠিত গলায় ফোন এল বোর্ডিং করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ‘প্রজ্ঞা কেম ব্যাক ইনজিওরড!’
ভ্রুর ভাঁজ গভীর ঋষির, ‘হোয়াট! হোয়াট ডু ইউ মিন?’
গলার স্বর কাঁপছে বাজাজের, ‘হাঁ জি। প্রজ্ঞাকে কেউ ইনজিওর করেছে... চাকু দিয়ে কোপ মেরেছে পার্টি থেকে ফেরার সময়। আপনারা কোথায়? পুলিসে কি খবর দেব?’
‘অবশ্যই। কিন্তু ম্যাডামের ইনজুরির খবর দেবেন না। সুপ্তির মিসিং ডায়েরি করুন। সুপ্তির ফোটো পাঠিয়ে বলুন এখনই সব মেন চেকপোস্ট, এয়ারপোর্ট, বাসডিপো আর রেলওয়ে স্টেশনে ছড়িয়ে দিতে আর প্রজ্ঞাকে বাড়ি থেকে বেরতে দেবেন না কোনওমতেই। আমরা বাই এইট থার্টি পৌঁছে যাচ্ছি আপনার বাড়িতে। আচ্ছা, প্রজ্ঞাকে কে বা কারা মেরেছে কিছু বলতে পারল? কতটা সিরিয়াস ওর ইনজুরি?’
‘না, ও খুবই ট্রমার মধ্যে আছে, কিছু বলতে পারছে না। তবে ইনজুরি খুব সিরিয়াস নয়। বাট ব্লিডিং হয়েছে। হাতে কয়েকটা জায়গায়..! ডক্টর এসে ট্রিটমেন্ট করছেন এখন। সিডেট করে রাখা হয়েছে।’
‘একটু ওয়েট করুন প্লিজ। আমাদের ফ্লাইট টেক অফ করছে, ফোন সুইচ অফ করছি। প্লিজ কিপ পেশেন্স।’
দুধ সাদা প্রকাণ্ড বাড়িটাকে রাজপ্রাসাদ বললে অত্যুক্তি হবে না! সর্বত্র রুচির ছাপ। ঋষি আলিয়া বাড়িতে প্রবেশ করতেই পুরুষোত্তম স্বয়ং অভ্যর্থনা করলেন। মুখ শুকনো, বললেন, ‘কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না! আমার মেয়েটা...।’ বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন।
একতলার বিশাল হলঘরে ঋষিরা বসতেই ট্রলি ঠেলে চা কফি শরবত ড্রাই ফ্রুটস আর কিছু ফল নিয়ে এসে পরিবেশন করল অল্পবয়সি একটি মেয়ে।
বাজাজকে আশ্বস্ত করল আলিয়া, ‘ডোন্ট ওরি। থানায় ইনফর্ম করেছেন তো?’
‘জি হাঁ।’
ঋষি আশ্বস্ত করল, ‘একটু শান্ত হোন প্লিজ। চলুন প্রজ্ঞা ম্যামের সঙ্গে কথা বলব।’
‘ঘুমোচ্ছে।’
‘ওর ঘরে যেতে হবে আমাদের।’ গম্ভীর গলায় বলল আলিয়া।
‘আমরা কি তারপর মিউজিয়ামটা দেখব?’ ঋষি আলিয়াকে জিজ্ঞেস করল।
‘আপাতত থাক। ওখানে পরে...।’
এত সুসজ্জিত সুদৃশ্য কক্ষ আগে কখন??