প্রচ্ছদ নিবন্ধ

জিপিও ২৫০

সুদীপ্ত রায়চৌধুরী: বুধবারের দুপুরবেলা। দোল-হোলি পর্বের টানা ছুটি কাটিয়ে এবার ছন্দে ফেরার পালা। কিন্তু একটু বড় ছুটি পেলেই মানুষের মতো শহরটাকেও জড়িয়ে ধরে আলস্য। অফিস-কাছারি খুলে সবে আড়মোড়া ভাঙছে শহর, তার মধ্যেই ট্যাক্সি চেপে মায়ের সঙ্গে জিপিওতে এসে হাজির তিন্নি। কিছুটা জেদ ধরেই এসেছে। খবরের কাগজে জিপিও’র ২৫০ বছর নিয়ে খবরটা দেখেছিল। তাই দোলের দিন থেকেই বায়না জুড়েছিল। মেয়ের মন রাখতে তাকে নিয়ে এসেছেন প্রতিমাদেবী। জিপিওর রোটান্ডায় উঠেই চোখ কপালে তিন্নির। কী মোটা মোটা থাম! ছাদটাও কত্ত উঁচুতে। এর আগে বেশ কয়েকবার সামনে দিয়ে গেলেও ভিতরে ঢোকা হয়নি। চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতেই দুই প্রজন্ম পা রাখল প্রদর্শনীর প্রাণকেন্দ্রে।
২৫০ বছরের প্রদর্শনী
ঘরে ঢোকার আগেই অবাক ক্লাস ফাইভের এই খুদে। দরজার ডানপাশে রাখা একটা রকেট! না, মানে ঠিক রকেট নয়, একটা মডেল। তার মাঝখানে রয়েছে লাল রঙের একটা লেটার বক্স। দু’পাশে নীল রঙের রকেটের দু’টি অংশ। আর লেটার বক্সের মাথার কালো অংশের উপরে আটকানো নীলরঙা রকেটের উপরের অংশ। ‘এটা কী! লেটার বক্স নাকি রকেট?’—প্রশ্ন তিন্নির। উত্তর শোনার মতো ধৈর্য অবশ্য তার নেই। ততক্ষণে চোখ চলে গিয়েছে ঘরের মাঝে। কালো পাথরের রানারের মূর্তিতে। দেখলেই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাটা মনে পড়ে যায়।
রানারের মূর্তির চারদিকে লাল ফিতের বৃত্তাকার ব্যারিকেড। ভিতরে চারটি মডেল। মায়ের হাত ধরে পায়ে পায়ে ডানদিকে সরে এল তিন্নি। একটা নৌকা রাখা। একদিকে বসে মাঝি। হাতে বৈঠা। ছইয়ের একপাশে বসে আরও একটি লোক। চিঠির বস্তা নিয়ে। নৌকার গায়ে একদিকে হিন্দি ও অন্যদিকে ইংরেজিতে লেখা ‘মেইল বোট’। বাঁ-পাশে পালকি কাঁধে খালি গায়ে দু’টি লোক। ভিতরে বসার জায়গায় ছোটখাটো চিঠির পাহাড়। তার পাশে একটি গোরুর গাড়ি। ডানপাশে ট্রেনের একটা বগি। লালরঙের। লেখা, ‘রেলওয়ে মেইল সার্ভিস।’ গেট থেকে বস্তা নামাচ্ছেন ডাক বিভাগের এক কর্মী। ‘এভাবে চিঠি বিলি হতো?’ খুদে দর্শনার্থীর প্রশ্ন শুনে এগিয়ে আসলেন জিপিওর এক কর্মী। বললেন, ‘আগে তো এখনকার মতো গাড়িঘোড়া সেভাবে কিছু ছিল না মা। তাই প্রথমে নৌকা করে, পরে পালকি ও গোরুর গাড়িই ছিল ভরসা। ১৮৫৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর লর্ড ডালহৌসি প্রতিটি রেল কোম্পানিকে বিশেষ কোচে চিঠি ও পার্সেল বহন করার নির্দেশ দেন।’
রাজ্যের এই প্রধান ডাকঘর ভবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় ১৫৫ বছরের ইতিহাস। মায়ের মুখে একথা শুনেই ভ্রুতে ভাঁজ পড়ল তিন্নির। ‘তাহলে ২৫০ বছর কেন?’ উত্তর হাতড়াচ্ছিলেন প্রতিমাদেবী। আবারও মুশকিল আসান সেই কর্মীই। জানালেন, আসলে গোড়াতেই এই বাড়িতে চালু হয়নি জিপিও। জিপিও হিসেবে কলকাতায় প্রথম যে পোস্ট অফিস খোলা হয়েছিল তা এবার ২৫০ বছর ছুঁল। তারই উদযাপন করা হয়েছে।
শুনতে শুনতে তিন্নির চোখ গেল দেওয়ালের ধারে রাখা কয়েকটি কাচের শোকেস ও পাশের বোর্ডে। ভিতরে রাখা পুরনো সময়ের ৩২টি পোস্টকার্ড। বোর্ডে আটকানো নানান ছবি। কোনওটা এই জিপিওর, আগেকার। কোনওটা আবার অন্য কোনও জায়গার পোস্ট অফিসের। আর রয়েছে জিপিওর বাড়িটির নানান রেপ্লিকা। তার কোনওটি শোলা বা মাটির, কোনওটি আবার কাঠের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে তৈরি।
ফিলাটেলিক ব্যুরোতে ঢুঁ
প্রদর্শনী ঘোরা শেষ। মা-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিমাদেবী এলেন ফিলাটেলিক ব্যুরোতে। এক সময় নিয়মিত স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতেন। কাউন্টারে এসে জানতে পারলেন, প্রকাশিত হয়েছে ১৪টি বিশেষ পোস্টকার্ড ও সাতটি কভার। সবক’টি অবশ্য স্টকে নেই। ২৫০ বছরের লোগোবিশিষ্ট পিকচার-পোস্টকার্ড মিললেও ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’ ও ‘বঙ্গতরী’ নামাঙ্কিত পোস্টকার্ড শেষ। তা পেতে অপেক্ষা করতে হবে কয়েকদিন। তাই শেষ পর্যন্ত কিনলেন ‘ট্রান্সপোর্টেশন অব মেইলস থ্রু এজেস’, ‘গ্র্যান্ড ক্লক অব কলকাতা জিপিও’, ‘পোস্ট বক্স থ্রু এজেস’ ও ‘ব্যাজেস অব পোস্ট অফিস’ নামাঙ্কিত বিশেষ কভার।
গন্তব্য পোস্টাল মিউজিয়াম
‘এখনই কী বাড়ি ফিরতে হবে?’ মাকে প্রশ্ন করল তিন্নি। প্রতিমাদেবী উত্তর দেওয়ার আগেই একটা অন্য পরামর্শ দিলেন কাউন্টারে থাকা পোস্টাল কর্মী। ‘পাশের বাড়িতেই রয়েছে পোস্টাল মিউজিয়াম। ঘুরে দেখতে পারেন।’ নতুন গন্তব্য পেয়ে আনন্দে তিন্নি তো প্রায় নেচে উঠল। জিপিও থেকে বেরিয়ে পশ্চিমদিকে কয়েক পা এগতেই লাল ইটের একটি বাড়ি। ইতালীয় ধাঁচের। ভিতরে ঢুকলেই চোখ চলে যায় একটি মার্বেল ফলকে। তাতে লেখা, ১৮৮৫ সালে ‘ডিরেক্টর জেনারেল অব দি পোস্ট অফিস অব ইন্ডিয়া’র এই অফিসটি তৈরি হয়েছে। সেই সময়ে ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন ফ্রেডরিক রাসেল হগ। এঁর সঙ্গে হগ মার্কেটের কোনও যোগ আছে নাকি! গুগলের শরণাপন্ন হয়ে তাজ্জব প্রতিমাদেবী। আন্দাজ ঠিক। স্যার স্টুয়ার্ট সন্ডার্স হগ—যাঁর নামে আমাদের হগ মার্কেট বা নিউ মার্কেট, সেই ব্যক্তি ফ্রেডরিকের আপন দাদা!
সংগ্রহশালাতেও ঢোকার মুখে ডানদিকে রানারের একটি মূর্তি। দরজা ঠেলে ঢুকতেই বাঁদিকে তিনটি ঘর। তারই একটিতে রয়েছে বিতর্কিত ব্ল্যাক হোলে নিহত সেনাদের স্মৃতিতে লর্ড কার্জনের তৈরি কালো মার্বেল স্মারক। তা দেখতে দেখতেই মেয়েকে ‘অন্ধকূপ হত্যা’র ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পাঠও দিলেন মা। ব্রিটিশ আমলে বিদেশ থেকে ডাক নিয়ে আসত জাহাজ। সেই খবর পৌঁছে দিতে হুগলি নদীতীরে ওড়ানো হতো পতাকা। বাজানো হতো বিউগল। পতাকা উত্তোলনের সেই যন্ত্র, বিভিন্ন মাপের বিউগল রয়েছে এই সংগ্রহশালায়। এছাড়াও রয়েছে রানারের ব্যবহৃত পোশাক, তলোয়ার, ঘণ্টা বাঁধা বর্শার ফলা, লণ্ঠন, দাঁড়িপাল্লা এবং কলকাতার ডেপুটি পোস্টমাস্টার, প্রেসিডেন্সি পোস্টমাস্টার, মেইল পিওন, বয় রানারের বেল্ট। সঙ্গে খুঁত থাকা পয়সা বাতিল করার জন্য কয়েন কাটার যন্ত্র, পুরনো কলকাতার মানচিত্র, টেলিগ্রাফ যন্ত্র, নানা ধরনের টেলিফোন, ডাকবাক্স, সিল, স্ট্যাম্প। বাড়ি তৈরির সময় উদ্ধার হওয়া মিশকালো একটি ছোট কামান দেখে তিন্নি তো হা! ডানপাশের বড় হলঘরে দীনবন্ধু মিত্র, বিজ্ঞানী সিভি রমনের বড় ছবি। দু’জনেই যুক্ত ছিলেন ডাকবিভাগের সঙ্গে। পাশাপাশি রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাক্ষরিত সেভিংস বইও। রবি ঠাকুরের ছবি-লেখা দেখলেও সই প্রথমবার দেখল তিন্নি।
ঘুরতে ঘুরতে চোখ আটকাল নীল রঙের একটি বোর্ডে। পাশে একটা পোস্টার। সেখানে খালি গা-সাদা ধুতি পরা একজনের সঙ্গে কথা বলছেন শিবঠাকুর! উপরে বড় বড় লেখা—‘কুইনাইন ম্যালেরিয়ার একমাত্র ঔষধ।’ এমন পোস্টার তিন্নি কখনও দেখেনি। পাশে নীলরঙা বোর্ডে লেখা—‘ম্যালেরিয়া কম্পজ্বর কিম্বা প্লীহাজ্বর প্রতিকারের জন্য কুইনাইন। একমাত্র অব্যর্থ মহৌষধ ইহাই সেবন কর। গভর্ণমেন্টের বিশুদ্ধ কুইনাইন এখানে পোষ্ট আফিস এবং রেল ষ্টেসনে পাওয়া যায়। প্রত্যেক শিশিতে ২০টী বড়ী থাকে। মূল্য চার আনা।’ বিষয়টি বোঝালেন প্রতিমাদেবী— ১৯ শতকের শেষদিকে ম্যালেরিয়ার দাপট ছিল মারাত্মক। তখন এনামেল প্লেটে হাতে লেখা এমন বিজ্ঞাপন দেখা যেত ডাকঘরে।
শেষবেলায় ‘ডাকঘর কাফে’
তিন ধাপে ইতিহাস সফর শেষে বেশ ক্লান্ত তিন্নি। অগত্যা মেয়েকে নিয়ে ডাকঘর কাফেতে এলেন প্রতিমাদেবী। পোশাকি নাম ‘শিউলি পোস্টাল কাফে।’ এও যেন প্রদর্শশালার একফালি অংশ। কফি, স্যান্ডউইচে আহার-পর্ব সেরে দু’জনে ঘুরে ঘুরে দেখলেন কাফের চার দেওয়াল। কোথাও নানান স্ট্যাম্পের বড় প্রতিকৃতি, কোথাও বা সুদৃশ্য তৈলচিত্রের মধ্যে ইনসেট করা স্ট্যাম্পের ছবি। মাথার উপরে ঝাড়লণ্ঠন আর দেওয়ালে সাজানো ঢাল-বর্শা। তিন্নি ব্যস্ত হয়ে উঠল সে সব মোবাইলবন্দি করতে।
সারাদিনের এই সফর হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুদের না পাঠালে চলে!
 
3Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা