বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

স্বেচ্ছামৃত্যু
 

গ্রিক ভাষায় ‘ইউ’ মানে ভালো আর ‘থ্যানেটোজ’ মানে মৃত্যু। দুইয়ে মিলে ইউথ্যানেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু। গত বছর ভারতে আইনসিদ্ধ হয় প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়া। আইনত বৈধ হলেও, সেই পদক্ষেপকে ঘিরে দানা বাঁধছে সংশয়। স্বেচ্ছামৃত্যুর ইতিবৃত্ত খতিয়ে দেখলেন মৃন্ময় চন্দ

দীর্ঘদিনের সঙ্গী অসুস্থতা। এ থেকে আর মুক্তি নেই। এমন জীবনের থেকে মৃত্যুই শ্রেয়! জীবন সায়াহ্নে এসে এই কথাগুলিই মাথায় ঘুরছিল প্রাক্তন ডাচ প্রধানমন্ত্রী দ্রায়েস ভ্যান এগটের। সহমত পোষণ করেন স্ত্রী ইউজিন ভ্যান এগট ক্রেকেলবার্গও। দু’জনেরই বয়স ৯৩। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগতে ভুগতে ক্লান্ত দম্পতির কাছে মুক্তির পথ ছিল একটাই— ইউথ্যানেশিয়া। আইনি পথে স্বেচ্ছায় নিষ্কৃতি মৃত্যু। হাতে হাত রেখে সেই পথই বেছে নিলেন তাঁরা। ইতি টানলেন ৭০ বছরের দাম্পত্য জীবনের। একসঙ্গে। খবরটা প্রকাশ্যে এল ১৪ ফেব্রুয়ারি, প্রেমের দিবসেই।
দ্রায়েস-ইউজিনের স্বেচ্ছামৃত্যুর খবরটা মনে পড়িয়ে দিল অনেক বছর আগের একটি ঘটনা। ১৯৭৩ সালের ২৭ নভেম্বর। অন্যান্য দিনের মতোই কাজের শেষে পোশাক পাল্টাতে বেসমেন্টের একটি আধো-অন্ধকার ঘুপচি ঘরে লাফাতে লাফাতে ঢুকছেন অরুণা রামচন্দ্র শানবাগ। মুম্বইয়ের ‘কিং এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল হসপিটালের’ (কেইএম) ২৫ বছরের স্টাফ নার্স। অরুণার মনটা আজ একটু বেশিই খুশি। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে রাতের খাবারটা মা-বাবার সঙ্গে বসে খাওয়া যাবে। বেশ কিছুদিন ধরেই হাসিখুশি, সুশ্রী অরুণাকে বড্ড বিরক্ত করছে ওয়ার্ডবয় সোহনলাল ভার্তা বাল্মিকী। নানা অছিলায় গায়ে হাত দেওয়ারও চেষ্টা চালিয়েছে। এটাও দেখেছে, ঠিক কোন সময়ে পোশাক পাল্টাতে নির্জন অন্ধকার ঘুপচি ঘরটাতে ঢোকেন অরুণা। তক্কে তক্কে থেকে সেদিন একটা কুকুর বাঁধার ভারী ধাতব চেন হাতে সে নিঃশব্দে আড়ি পাতে। অরুণা পোশাক বদলাতে ঘরে ঢোকামাত্র অতর্কিতে চেন দিয়ে সজোরে টেনে ধরে গলা। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত বের হল না।
উন্মত্তের মতো অরুণার নার্সের পোশাক ছিঁড়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে সোহনলাল। সম্ভব নয় বুঝে লিপ্ত হয় বিকৃতকামে। কুকুর বাঁধার শক্ত চেনের ফাঁসে দমবন্ধ হয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল অরুণা। পাশবিক অত্যাচারে ‘ব্রেন স্টেম কনটিউশন’ বা ব্রেনের টিস্যু জখম হয়। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের জোগান বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অক্সিপিটাল কর্টেক্স। কর্টিকাল ব্লাইন্ডনেসে দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেন অরুণা। পরদিন সকাল পৌনে আটটা নাগাদ বেসমেন্টের সেই ঘরে রক্তে ভেসে যাওয়া অজ্ঞান-অচৈতন্য অরুণার দেহ দেখতে পান এক সুইপার। প্রাণটা তখনও ধুকপুক করছে। চিকিৎসকরা নাওয়া খাওয়া ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন অরুণাকে বাঁচাতে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রাণ ফিরে পেলেও পরবর্তী ৪২ বছর কেইএমের বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন অরুণা, ‘পার্শিয়াল ভেজিটেবল স্টেজে’। সকাল-সন্ধ্যায় আলো-আঁধারির ফারাকটুকু ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারতেন না। তরল খাদ্যবস্তু খাওয়ানোর সময় মুখটা আপনা থেকে ফাঁক হতো, রাত গভীর হলে ধীরে ধীরে বুজে আসত দু’চোখের পাতা। শরীরের পাশে শিথিল এলানো হাত আর প্রগাঢ় শ্বাসপ্রশ্বাসের হারে অতন্দ্র প্রহরী নার্স বুঝতে পারতেন, অরুণা ঘুমিয়ে পড়েছে।
৪২ বছর ধরে অরুণার ঠিকানা ছিল কেইএম হাসপাতাল। ২০১৫ সালের ১৮ মে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সেই অভিশপ্ত অদম্য লড়াকু জীবনের যবনিকা পতন হয়। ডাক্তার-নার্সদের অসাধ্য সাধনে, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত একটা বেডসোরও থাবা বসাতে পারেনি তাঁর শরীরে। ৬৭ বছরের অস্থিচর্মসার অরুণার অভিভাবক এবং পরম সুহৃদ ছিলেন কেইএমের নার্স এবং চিকিৎসকরা। শেষদিকে হাড়ের উপর পাতলা ফিনফিনে চামড়া ভাজা পাঁপড়ের মতো খসে খসে উঠে আসত। ভাঙা কব্জি বিশ্রীভাবে ঘুরে থাকত উল্টোদিকে। হাল্কা বাজনা পছন্দ করতেন অরুণা। পরিচিত চিকিৎসক বা নার্সদের গলা শুনে কখনও কখনও ভিজে উঠত চোখের কোলটা। 
যুক্তি-তক্কে স্বেচ্ছামৃত্যু
দশকের পর দশক প্রায় অচেতন, মৃতপ্রায়, বিছানায় লেপটে পড়ে অরুণার বেঁচে থাকা সহ্য করতে পারছিলেন না শুভাকাঙ্ক্ষীরা। শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক পিঙ্কি ভিরানি সুপ্রিম কোর্টের কাছে তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু বা প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়ার আবেদন জানান। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদনের যথার্থতা বিচার করে কেইএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে নোটিস পাঠায়। বিশদে জানতে চাওয়া হয় অরুণার সর্বশেষ অবস্থার কথা। ২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি তিন চিকিৎসকের এক কমিটি সুপ্রিম কোর্টে জানায়, গত ৩৭ বছর ধরে ‘পার্শিয়াল ভেজিটেবল স্টেজে’ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন অরুণা। কিন্তু তাঁর চিকিৎসা বা পরিচর্যার সামান্যতম ত্রুটি বা অভাব ঘটছে না কেইএমে।
২০১১ সালের ৭ মার্চ। এক যুগান্তকারী রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ‘প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়া’ বা স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারকে আইনসম্মত করতে জারি করা হয় একগুচ্ছ নির্দেশিকা। সুপ্রিম কোর্টের অভিধায়, ওষুধপথ্য বা চিকিৎসায় যে অসুস্থ মরণাপন্ন রোগীর সেরে ওঠার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাঁর ঘনিষ্ঠদের অনুমতিক্রমে জল-খাবার, অক্সিজেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেওয়া কোনও অপরাধ নয়।
তার পরেও যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই আশ! বকরূপী ধর্মরাজের প্রশ্নের জবাবে যুধিষ্ঠির এই চিরন্তন প্রহেলিকাকে অপরিসীম প্রজ্ঞায় খোলসা করেছিলেন। বলেছিলেন, মানুষ জানে একদিন তাকে মরতে হবেই। অথচ সজ্ঞানে কেউই মরতে চায় না। প্রতিটা মানুষের কাছেই মৃত্যু আসলে বিভীষিকা। মূল প্রশ্নটাও লুকিয়ে সেখানেই। লাস্ট স্টেজ কোলোরেক্টাল, ফুসফুস বা ব্লাড ক্যানসারের রোগীদের মতো অনেকেই শয্যাশায়ী হয়ে বুঝতে পারেন যে চিকিৎসায় কোনওদিনই রোগ নিরাময় সম্ভব নয়। যদি অক্সিজেন, খাবারের নল বা জীবনদায়ী ওষুধের জোগান বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি মারা যাবেন। কিন্তু তেমনটা হলে দিনগোনা ফাঁসির আসামির মতোই সেই ক্যান্সার রোগীর বলপূর্বক মৃত্যু মর্যাদাকর হবে না। হবে কষ্টকর, বেদনাময়।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও সেক্ষেত্রে অনিবার্য।  জীবনদায়ী ওষুধ, অক্সিজেন বা খাবার বন্ধ করে দিয়ে ‘অ্যাক্টিভ ইউথ্যানেশিয়া’য় ক্যান্সার রোগীর মৃত্যু কি আসলে পরিকল্পনামফিক খুন নয়? নিরাময় সম্ভব নয় জেনেও কারও চিকিৎসার অধিকার, সর্বোপরি বেঁচে থাকার অধিকারকে কোনও কল্যাণকামী রাষ্ট্র কি কেড়ে নিতে পারে? ক্যান্সার রোগী যদি চিকিৎসার খরচ জোগাতে না পেরে নিরুপায় হয়ে প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার চায়, সরকার কি তা মঞ্জুর করতে পারে? অনেকেই জবাব দেবেন, না। তাহলে তো সরকারের ঘাড়েই দোষ চাপবে। বলা হবে, নাগরিককে যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবা যখন দিতে পারেন না, ভোট চাইছেন কোন মুখে! খাদ্য, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানীয় জল বা স্বাস্থ্য পরিষেবা ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকবে কিভাবে? যদি বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্ত পূরণেই রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, তবে তো সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে মৃত্যুর অধিকারও স্বীকৃতি পেতে বাধ্য।
কেবল শরীর, মন নাই
অ্যাক্টিভ বা প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়ার প্রশ্নটি অবশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল মর্যাদাপূর্ণ চিরবিদায়ের রাস্তা খুঁজে দেওয়ার গোলকধাঁধায়। কারণ, শুধু শারীরিক জরা-ব্যাধিতেই মানুষ ‘ভেজিটেবল’ স্টেজে পৌঁছয় না, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা, বুলিমিয়ার মতো দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধি বহু মানুষকে তিলে তিলে ‘ভেজিটেবল’ করে তোলে। মানসিক ব্যাধিতে বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত, জীবনের প্রতি চূড়ান্ত হতাশ রোগীদের কেন স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া যাবে না? একযাত্রায় কেন পৃথক ফল হবে? আধুনিক চিকিৎসায় শরীর ও মন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সারা বিশ্বে, প্রতি পাঁচজন মানুষের একজন মানসিক রোগের শিকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু’র পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় আত্মহত্যার হার ১০.৯ শতাংশ। অথচ গত বছর কেন্দ্রীয় বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বরাদ্দ মাত্র ১৩৪ কোটি টাকা। সুতরাং মানসিক রোগে পঙ্গু মানুষদের ইউথ্যানেশিয়ার অধিকারও বিবেচিত হওয়া উচিত নয় কি? অ-নিরাময়যোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুকালীন যন্ত্রণা উপশমে, স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারকে নির্ঝঞ্ঝাট করতে একটি সুস্পষ্ট আইন প্রণয়নের দাবি বহুকালের। জ্ঞান কৌর বা অরুণা শানবাগের মামলার সূত্রে সে দাবির পালে বাতাস লেগেছে।
সুপ্রিম ন্যায়বিচারে অরুণা
পিঙ্কিকে সুপ্রিম কোর্ট কখনই অরুণার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে বিবেচনা করেনি। তাই তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর ব্যাপারে  সাংবাদিকের স্বতঃপ্রণোদিত আবেদনে অনুমতি প্রদানের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য বলেও মনে করা হয়নি। বদলে ৩৮ বছর অরুণার দেখভালকারী কেইএম হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদেরই অরুণার প্রকৃত বন্ধু বলে মনে করেছিল শীর্ষ আদালত। রায়ে বলা হয়, ‘লাইফ সাপোর্ট’ সরিয়ে কেইএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি অরুণাকে‘ফিজিসিয়ান অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’ বা স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার অর্পণ করতে চায়, তবে বম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে তাদের ২২৬ নং ধারায় আবেদন জানাতে হবে। তিন চিকিৎসকের কমিটি বিচার করে দেখবে ‘প্যাসিভ বা ফিজিসিয়ান অ্যাসিস্টেড ইউথ্যানেশিয়ার’ অনুমতি অরুণাকে দেওয়া যাবে কি না! 
২০১১ সালে পিঙ্কির অভিভাবকত্বের আবেদন সুপ্রিম কোর্টে নাকচ হয়ে যায়। যদিও পিঙ্কির ভূয়সী প্রশংসা করেছিল শীর্ষ আদালত। পিঙ্কির তৎপরতাতেই প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়ার মতো অতি স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা এবং তার রূপরেখা তৈরির পথ প্রশস্ত হয়েছিল। যদিও অরুণার প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়ার অধিকার কয়েক বছর পর সুপ্রিম কোর্টে নাকচ হয়ে যায়। ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘কমন কজ’ নামক একটি বেসরকারি সংস্থার দায়ের করা পিআইএলের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট অরুণার স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারটি খারিজ করে দেয়। 
মাননীয় বিচারপতিদের মনে হয়েছিল, জ্ঞান কৌর বনাম স্টেট অফ পাঞ্জাব মামলাটির প্রেক্ষিতে অরুণা শানবাগের মামলাটির বিচার সম্ভব নয়। প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়া বা ফিজিশিয়ান অ্যাসিস্টেড সুইসাইড, এমনই একটি সংবেদনশীল বিষয় যেখানে সর্বসাধারণের জন্য সর্বসম্মত এবং সর্বজনগ্রাহ্য একটি আইন থাকা জরুরি। ভারতের সামাজিক-চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি বিচার বিবেচনা করে তবেই ইউথ্যানেশিয়া আইনটি প্রণয়ন করা উচিত মনে করে বৃহত্তর সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে মামলাটি পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট। কেইএম হাসপাতালের নার্স-ডাক্তাররা প্রথম থেকেই অরুণার স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনের বিরোধিতা করেছিল। অরুণার শরীরে যতদিন প্রাণ থাকবে, বিনা পারিশ্রমিকে অরুণার সেবা করে যাবে বলে অঙ্গীকারও করে তারা। 
ইতিহাস ও বেয়াড়া কিছু প্রশ্ন  
গ্রীক ভাষায় ‘ইউ’মানে ভালো আর ‘থ্যানেটোজ’ মানে মৃত্যু। মর্যাদার সঙ্গে স্বেচ্ছামৃত্যুর অভিলাষই ইউথ্যানেশিয়া। জানা যায়, অগাস্টাস সিজারের স্বেচ্ছামৃত্যুকে প্রথম ইউথ্যানেশিয়া নামে অভিহিত করেছিলেন রোমান ঐতিহাসিক সুইটোনিয়াস। প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়া সেসময় পরিচিত ছিল ‘অর্থোট্যানেশিয়া’ নামে। স্পার্টায় কোনও শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মালে তখনই তাকে মেরে ফেলা হতো। প্লেটোর মতে, শারীরিক এবং মানসিকভাবে পঙ্গু ব্যক্তির বেঁচে থাকা নিষ্প্রয়োজন। উল্টো মত ছিল পিথাগোরাসের।
অ-নিরাময়যোগ্য অন্তিম পর্যায়ের শয্যাশায়ী রোগীদের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কথা প্রথম বলেন ফ্রান্সিস বেকন। ইউথ্যানেশিয়াকে ঘিরে তর্কবিতর্কের মধ্যেই ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ যে রোগীর সুস্থতার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাঁর ক্ষেত্রে প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়ার অনুমতি দেয়। রোগী যে বিভাগে ভর্তি সেই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এক কমিটি গড়ে রোগীর সর্বশেষ অবস্থার নিরিখে ইউথ্যানেশিয়ার সুপারিশ করতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের নেতৃত্বে আবারও তিন সদস্যের চিকিৎসক কমিটি রোগীর ইউথ্যানেশিয়ার আবেদনের চুলচেরা বিচার করে সবুজ সঙ্কেত দিলে একজন ফার্স্টক্লাস জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সবদিক খতিয়ে দেখে রোগীর স্বেচ্ছামৃত্যুর পরোয়ানা মঞ্জুর করবেন। 
এখনও পর্যন্ত ইউরোপের মাত্র চারটি দেশ— নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গে অ্যাসিস্টেড ডাইং অনুমোদিত। কানাডা, কলম্বিয়া এবং আমেরিকার বেশ কয়েকটি স্টেটেও অ্যাসিস্টেড সুইসাইড অনুমোদিত। ইনভলান্টারি বা প্যাসিভ ইউথ্যানেশিয়া আমেরিকার ৫০টি স্টেটেই অনুমোদিত। পৃথিবীর একমাত্র দেশ সুইজারল্যান্ড, যেখানে বিদেশি বহিরাগতরাও আল্পসের নয়নাভিরাম শোভা দেখতে দেখতে শান্তিতে মরবার বাসনায় নগদ মূল্যে কিনতেই পারেন অ্যাসিস্টেড ডাইং-এর সুবিধা। চিকিৎসক ছাড়াও সুইজারল্যান্ডে অ্যাসিস্টেড ডাইং-এর সুবিধা উপলব্ধ। 
মৃত্যুপথযাত্রী, স্থবির, জীবনের অনাবিল রসাস্বাদনে অক্ষম, বীতশ্রদ্ধ,কোনোরকম জাগতিক চিকিৎসায় সাড়া না দেওয়া রোগী তার পরিবার-পরিজন এবং নিজের সম্মান-মর্যাদার চিরবিদায়ের স্বার্থে স্বেচ্ছামৃত্যু চাইতেই পারেন। তার শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সচল-সজীব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে (যেমন কিডনি/লাঙ/কর্নিয়া) একজন অন্ধ অথবা বিকল অঙ্গের গুরুতরঅসুস্থ রোগী নবজীবনও লাভ করতে পারে। অন্তিম পর্যায়ের তমসাচ্ছন্ন অভিশপ্ত জীবন আরেকজনের কাছে আশীর্বাদেরঅনির্বাণদীপশিখা হয়ে দেখা দিতেই পারে। প্রকৃত আন্দোলনের চেহারা নিতে পারে অঙ্গ-দান। তবেদেশটার নাম যেহেতু ভারতবর্ষ, যেখানে ‘ল’ থাকলেও ‘অর্ডারের’ বড় অভাব; সেখানে পক্ষাঘাত/বিকলাঙ্গতার অজুহাতে অশীতিপর বা নবতিপর মানুষদের স্বেচ্ছামৃত্যুর আইনি নিদানে যদি হরবখত প্রাণটা কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত শুরু হয়, ন্যায়দণ্ড হাতে রুখে দাঁড়াবেকে অসহায় মানুষটির পাশে? অসাধু দালাল ও হাসপাতাল চক্রের খপ্পরে পড়ে, যদি বিপথগামী পরিবার-পরিজন মুফতে কিছু রোজগারের ধান্ধায়, খাবিখাও য়া শয্যাশায়ী রোগীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কালোবাজারির ফিকির খুঁজতে থাকে! অথবা স্রেফ পয়সাখরচ ও ঝামেলা এড়াতেই বিকলাঙ্গ নিকটজনকে নির্বিবাদে স্বেচ্ছামৃত্যুর আইনি আয়ুধে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়, কি হবে তখন?যে সমাজে বৃদ্ধ চলৎশক্তি-হীনক্ষীণদৃষ্টি ‘ভেজিটেবল’ বাবা-মাকে স্টেশনে ফেলে ছেলে-মেয়ে আকছার চম্পট দেয়, সেই সমাজে প্যাসিভ ইউথানেশিয়ার যে অপব্যবহার হবে না, সে গ্যারান্টি দেবে কে?
 গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল 
 সহযোগিতায় : সত্যেন্দ্র পাত্র

25th     February,   2024
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা