প্রচ্ছদ নিবন্ধ

আইএনএ’র বিপ্লবী ডাক্তার
বিশ্বজিৎ মাইতি

‘অস্থায়ী হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন শয়ে শয়ে মরণাপন্ন রোগী। চিকিৎসক ও নার্সদের দাঁড়ানোর ফুরসত নেই। আচমকাই সাইরেন বেজে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে দৈত্যের মতো আওয়াজ তুলে হাজির যুদ্ধবিমান। প্রাণের ভয়ে পাশের পরিখায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন অনেকে। পরপর বিকট আওয়াজ। কেঁপে উঠল চারপাশ। মাথা থেকে ৩০-৪০ গজ দূরে বোমা পড়েছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে হাসপাতাল। বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ ঝাপসা। দিশেহারা লাগছে। উঠলেই হাওয়াই জাহাজ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে গুলি। গর্তের মধ্যে শুয়ে শুনছি রোগীদের শেষ আর্তনাদ। একের পর এক বারাক পোড়ার দৃশ্যে চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ধ্বংসস্তূপ থেকে আধপোড়া স্টেথোস্কোপ তুলে পকেটে ঢোকালাম।’
কী ভাবছেন? ইউক্রেন বা প্যালেস্তাইনের বধ্যভূমিতে থাকা কোনও চিকিৎসকের আঁখো দেখা কাহিনির বিবরণ? ঘটনাস্থল নিশ্চিতভাবে যুদ্ধক্ষেত্র হলেও প্রেক্ষাপট আলাদা। সেই সময়কে অনুধাবন করতে টাইম মেশিনে পিছিয়ে যেতে হবে আট দশক আগে। বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে সেদিন মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছিলেন বাংলার এক যুবা চিকিৎসক। হুগলির ইমামবাড়া লাগোয়া মোগলপুরা লেনের বাসিন্দা বিনয়কুমার নন্দী ডাক্তারি পাশ করে যোগ দেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। সিঙ্গাপুরে যুদ্ধবন্দি হওয়ার পরে শুরু হয় দেশকে মুক্ত করার মরণপণ সংগ্রাম। রেঙ্গুন ও বার্মার জঙ্গলে হার না মানা লড়াই। নেতাজির সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা। কাঁকর মেশানো চাল ও শুঁটকি মাছ পোড়া খেয়ে পাহাড়ি জঙ্গলে ইংরেজ সেনার সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ। লালকেল্লার বিচার শেষে মুক্ত হওয়া আইএনএ’র লেফটেন্যান্ট কর্নেল বিনয় নন্দী চিরকাল থেকে গিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেই।
১৯৪১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। মিলিটারি জওয়ানদের লখনউ নিয়ে যাওয়া হবে। হাওড়া স্টেশনে দাড়িয়ে স্পেশাল ট্রেন। সদ্য ডাক্তারি পাশ করা পঁচিশ বছর বয়সি বিনয়বাবুর কাঁধে ব্যাগের বোঝা। বাবা নরেন্দ্রনাথ নন্দী পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে নিয়ে ছেলের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ট্রেনের বাঁশি শুনে অস্ফুটে বললেন, ‘সাবধানে থেকো।’ ছুটল ট্রেন। থামল বর্ধমান স্টেশনে। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন মা প্রভাসনন্দিনীদেবী। চোখে জল। ছেলেকে একটিই প্রশ্ন করলেন, ‘কবে ফিরবে?’ উত্তর দেওয়ার আগেই হুইসেলের আওয়াজ। কান্না বুকে চেপে ট্রেনে উঠলেন যুবা। এরপর লখনউ আইএইচসি (ইন্ডিয়ান হসপিটাল কোর) থেকে স্পেশাল মিলিটারি ট্রেনে মিরাট হয়ে বম্বে। ১৯৪২ সালের ১৮ জানুয়ারি বম্বে ডক থেকে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে অজানা গন্তব্যে রওনা। মাথার উপর যুদ্ধবিমান ও এয়ার রেড অ্যালার্ম শুনে জলে ঝাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি, জাহাজের পাশে বোমা পড়ায় অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়ার স্মৃতি নিয়ে সিঙ্গাপুরে পৌঁছন বিনয়বাবু। ১১দিন পর ২৯ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরের মাটি ছুঁতেই জাপানি আক্রমণের মুখে পড়েন তাঁরা। ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, ‘জাপানি বোমায় ছিন্নভিন্ন হচ্ছে সিঙ্গাপুর। বোমার আঘাতে কারও পা উড়ে গিয়েছে। কেউ বা জলের জন্য হাহাকার করছেন। বোতল থেকে তাঁদের মুখে জল দিলাম। এমন ভয়াবহ দৃশ্য আগে দেখিনি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্রুত পট পরিবর্তনের শুরু। বিজয়ের গর্বে ছুটে আসছে জাপানিরা। আকাশে ঘুরছে জাপানি যুদ্ধবিমান। বিধ্বংসী হামলায় দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে ছবির মতো শহর সিঙ্গাপুর। বাড়ি-গাড়ি ফেলে হাজার হাজার মানুষ জাহাজে চেপে অন্য দেশে পালাচ্ছেন।’
এর পরেই টায়েরসাল পার্কের অস্থায়ী হাসপাতালের উপর শুরু হল জাপানি হানা। 
রাতজোরে বেঁচে যাওয়া বাঙালি ডাক্তার দেখলেন যুদ্ধের বীভৎসতা। বোমা-আগুনে ঝলসে মারা গেলেন কয়েকশো রোগী, চিকিৎসক ও নার্স। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে আধপোড়া রোগীদের উদ্ধার করে চলছে চিকিৎসা। শেষ পর্যন্ত জাপানি সেনার হাতে এল সিঙ্গাপুর। দখল নিয়েই তারা জানাল, ভারতীয় সেনার সঙ্গে কোনও শত্রুতা নেই। ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে রক্ষা করতে চায় তারা। যেসব বন্দি ভারতীয় সেনা দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ে যেতে চান, তাঁরা জাপানিদের সঙ্গে যেতে পারেন। যাঁরা চাইবেন না, তাঁদের ব্রিটিশদের সঙ্গে জেলে বন্দি রাখা হবে। ক্যাপ্টেন মোহন সিং, আলাগাপ্পান সাহেবরা একের পর এক বন্দি সেনাদের ক্যাম্পে মিটিং শুরু করলেন। ভালো-মন্দ নানারকম আলোচনার পর তৈরি হল আইএনএ। শুরু হল ট্রেনিং, প্যারেড। তৈরি হল পোশাক ও ব্যাজ। কিন্তু ৬০-৬৫ হাজার ভারতীয় জওয়ানদের মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার সেনার হাতে দেওয়া হল বন্দুক। তৈরি হল আজাদ, গান্ধী, নেহেরু ও সুভাষ ব্রিগেড। কিন্তু সকলের হাতে অস্ত্র না দিলে যুদ্ধে যেতে আপত্তি জানালেন আইএনএ’র অফিসার ও সেনারা। জেনারেল মোহন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনার পর পুড়িয়ে দেওয়া হল ব্যাজ ও পোশাক। ভারতীয় সেনার ক্ষোভ প্রশমনে রাসবিহারী বসুকে আনলেন জাপানিরা। আইএনএ পুর্নগঠনের পরামর্শ দিলেন তিনি। কিন্তু তখন তাঁর ছেলে জাপানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত। এমনকী রাসবিহারী বিয়েও করেছেন জাপানে। সেই কারণে তাঁকে সেভাবে কেউ বিশ্বাস করতে পারলেন না। দাবি উঠল, সুভাষচন্দ্র বসুকে না আনলে আমরা আইএনএ গঠন করব না।
রেডিওতে ভাষণের পর জার্মানি থেকে জাপানের বিদ্যাধরী ক্যাম্পে এলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সার্বিক বিশ্বের পরিস্থিতি বর্ণনা করে বললেন, ‘সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। সেনারা রাজি থাকলে দেশবাসীকে স্বাধীনতার যুদ্ধে আহ্বান করব।’ তাঁর সেই  অমোঘ ডাকে রাজি সকলে। রাতদিন এক করে শুরু হল প্রস্ততি। দেশকে স্বাধীন করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ সমস্ত জওয়ান। হিন্দু-মুসলিম-শিখ সবাই এক প্লেটে খাচ্ছে। উধাও জাতপাতের বেড়াজাল। গঠিত হল ইউনিট। গন্তব্য বার্মা। রেঙ্গুনে নেতাজির ভাষণ দেশাত্মবোধের আগুন জ্বালিয়ে দিল। বার্মার লোকজন এগিয়ে এল আইএনএকে অর্থসাহায্য করতে। সম্ভ্রান্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরাও সেনাবাহিনীতে নাম লেখালেন নির্দ্বিধায়। ততদিনে সুভাষচন্দ্র মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন নেতাজি।
অন্যদিকে, রেঙ্গুন হাসপাতালের উপর বোমাবর্ষণের পর তা স্থানান্তরিত হল মেমিওতে। ডায়েরিতে বিনয় নন্দী লিখছেন, ‘সুপ্রিম কমান্ড নিয়ে সেখানে এলেন নেতাজি। শুরু হল ইম্ফল দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশের জোরদার প্রস্তুতি। মাঝেমধ্যেই হাসপাতাল পরিদর্শনে আসতেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর কাছে দ্রুত সুস্থ হয়ে দেশের জন্য জীবন দেওয়ার ব্রত নিলেন প্রত্যেকে। কিন্তু প্রবল বর্ষা শুরু হওয়ায় পিছিয়ে পড়ল আইএনএ’র সেনারা। বাধ্য হলেন ইম্ফল ছেড়ে পিছিয়ে আসতে। বর্ষায় চিনডুই নদী পার হতে গিয়ে অনেকে ভেসে গেলেন। খাদ্য সঙ্কট ও ম্যালেরিয়ার দাপটে রাস্তায় শত শত সেনার দেহের সারি। 
এবার রেঙ্গুন থেকে আরাকান ফ্রন্ট লাইন। বাংলা ও বার্মার সীমান্ত লাগোয়া জঙ্গলে ওঁত পেতে বসে আইএনএ ও জাপানি সেনাবাহিনী। নৌকায় ইরাবতী নদী পেরিয়ে প্যাডং। সেখান থেকে পাহাড়ি জঙ্গল পথে প্রায় ২০০ মাইল পাড়ি দিয়ে জাপানি ক্যাম্প। ব্রিটিশ যুদ্ধবিমানের নজর এড়িয়ে রাতের পর রাত নৌকায় গোপন যাত্রায় পৌঁছনো গেল আলিচং হয়ে রাথিডংয়ে। আরাকানের জঙ্গল থেকে কাঠ জোগাড় করে সকালে মধ্যেই শেষ করতে হবে রান্না। বেলায় ধোঁয়া দেখতে পেলেই হামলা চালাবে ব্রিটিশরা। রান্না বলতে অবশ্য কাঁকর মেশানো চাল সেদ্ধ, নুন ও লঙ্কা। কপাল ভালো হলে জাপানি রেশনে পাওয়া শুঁটকি মাছের পোড়া। দীর্ঘ কয়েক মাসের যাত্রায় ক্লান্ত, অসুস্থ বাহিনী ক্রমশ পিছচ্ছে। ব্রিটিশদের দখলে আসছে সমগ্র বার্মা।
শেষ পর্যন্ত বন্দি হলাম ব্রিটিশদের হাতে। শাহনওয়াজ, ধিঁলো, সায়গল সহ প্রথম সারির সেনাধ্যক্ষদের সঙ্গে দেখা হল ব্রিটিশ ক্যাম্পে। জিগড়গাছা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সময় স্টিমারে শুনলাম, হিরোসিমায় অ্যাটম বোমা পড়েছে। আত্মসমর্পণ করেছে জাপানিরা। বিমান দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েছেন নেতাজি। তার মধ্যে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল দিল্লিতে। সেলের মধ্যে শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। আইএনএ’র কর্নেল আলাগাপ্পান, কর্নেল এ চট্টোপাধ্যায়, শাহনওয়াজ সহ আইএনএ’র রথী-মহারথীদের সঙ্গে ওই ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হল আমাকেও। জেলের মধ্যে অসুস্থতা, ভোপালে কারাবাস পর্ব মিটিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৬ সালের মে 
5Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা