প্রচ্ছদ নিবন্ধ

সরাইখানার গপ্পো
অনিরুদ্ধ সরকার

 

শীত মানেই ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। কলকাতা সেই কবে থেকে মেতে আছে এই হুজুগে। ১৮ শতকের শেষ থেকে ১৯ শতকের শুরুর দিকে এ শহরে একটা জোয়ার এসেছিল—ট্যাভার্ন বা সরাইখানা ও কফি হাউসের। কিন্তু তাতে ভাটা আসতেও দেরি হয়নি। কেমন ছিল সরাইখানার সেই দিনগুলি?

ইতিহাস-পর্ব
লন্ডনের শহুরে জীবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল কফি হাউস ও ট্যাভার্ন। কলকাতার গায়েও লেগেছিল সেই ছোঁয়া। কারণ একটাই—লন্ডনের অভ্যাস বজায় রাখতে চাইত ইংরেজরা। সেই কারণেই প্লে হাউস থেকে প্লেসার হাউস—লন্ডনের আদলে কলকাতায় সবই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাঁরা। বিদেশিদের হাত ধরে পাঞ্চ-হাউস, ট্যাভার্ন ও কফি হাউস বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কলকাতায়। পাঞ্চ-হাউসে মিলত শুধুই পানীয়। কফি হাউসে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কফি, আর ট্যাভার্নে ছিল খাওয়াদাওয়া, সুরা পানের পাশাপাশি রাত্রিবাসেরও ব্যবস্থা। সঙ্গে সংবাদপত্র পাঠের বিশেষ সুযোগ। 
১৭৮০ সালের কথা। ট্যাভার্ন প্রসঙ্গে এক প্রত্যক্ষদর্শী লিখছেন, ‘আমাকে একদিন কলকাতার একটি ট্যাভার্নে নিয়ে যাওয়া হল। নাম লন্ডন হোটেল। একটি করে সোনার মোহর দিলে সেখানে প্রবেশাধিকার মিলত। সুরা পান ও ভোজনের দক্ষিণা ছিল আলাদা। কফি হাউসে এককাপ কফির দাম ছিল এক টাকা। অবশ্য তাতে ইংরেজি পত্রিকাগুলিও বিনা পয়সায় পড়া যেত।’ কলকাতার প্রথম যুগের ট্যাভার্নগুলি গড়ে উঠেছিল  ট্যাঙ্ক স্কোয়ার বা আজকের ডালহৌসি, লালবাজার বা এখনকার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ও বউবাজার সংলগ্ন এলাকায়। এগুলিই ছিল তৎকালীন কলকাতার প্রাণকেন্দ্র।

ট্যাভার্ন ‘হারমনিক’
উইলিয়াম হিকি নিজের স্মৃতিকথাতেও উল্লেখ করেন কলকাতার সরাইখানাগুলির কথা। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম পামারের আমন্ত্রণে তিনি গিয়েছিলেন অধুনা লালবাজার এলাকার ট্যাভার্ন ‘হারমনিক’-এ। সেটি ছিল ওই যুগে কলকাতার উচ্চসমাজের সেরা মজলিস কেন্দ্র। এর পাশেই একটি ট্যাভার্ন খোলেন এক ফরাসি ভদ্রলোক, ফ্রাঁসিস গ্যাল। ১৭৭৫ সালে প্রত্যেক শুক্রবার সেখানে বন্ধুবান্ধবদের মজলিস জমাতেন রিচার্ড বারওয়েল। মহারাজা নন্দকুমারের বিচারের সময় উকিলদের খাবার আসত ওই ট্যাভার্ন থেকে। শহরের বড় বড় ভোজসভাতেও খাদ্য সরবরাহ করতেন ফ্রাঁসিস।
ট্যাভার্ন ‘হারমনিক’-এর অন্যতম পেট্রন ছিলেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রী। প্রায় রোজ সেখানে চা-কফির মজলিস বসাতেন। তা নিয়ে ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকায় নিয়মিত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতেন হিকি সাহেব। তারপরেও দীর্ঘকাল জাঁকিয়ে বসেছিল ট্যাভার্ন ‘হারমনিক’। ১৭৮৫-র জানুয়ারিতে হেস্টিংসের বিদায় সংবর্ধনাও হয়েছিল সেখানে।

ফলতার ট্যাভার্ন
১৮ শতকে কলকাতার বাইরেও গড়ে উঠেছিল একের পর এক ট্যাভার্ন ও পাঞ্চ হাউস। মূলত ইউরোপীয়দের অন্যান্য বাণিজ্য এবং বসতিকে কেন্দ্র করে। কলকাতার ২৫ মাইল দক্ষিণে ফলতা তখন ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় ঘাঁটি ও বন্দর। নদীপথে কলকাতায় যাতায়াতের সময় সাহেবরা প্রায়ই থামতেন সেখানে। তাঁদের আপ্যায়নের জন্য গড়ে ওঠে ট্যাভার্ন। ১৮০৫ সালে এক ব্রিটিশ ভদ্রমহিলা ফলতার সরাইখানাটি দেখে খুশি হয়ে শংসাপত্রও দিয়ে এসেছিলেন।

শ্রীরামপুর ট্যাভার্ন
ফলতার মতোই শ্রীরামপুর, বারাকপুরেও এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। ইংরেজরা যখন কলকাতা দখলের ছক কষছে, শ্রীরামপুরে তখন ডাচদের রমরমা। ১৭৫৫ সালে নবাব আলিবর্দি খাঁর থেকে শ্রীরামপুরে কুঠি নির্মাণ ও বাণিজ্য করার ফরমান পান ড্যানিশ বা দিনেমার বণিকরা। দীর্ঘ ৯০ বছর শ্রীরামপুর ছিল তাদের উপনিবেশ। ডেনমার্কের সম্রাট ফ্রেডরিক পঞ্চমের নামে নতুন পরিচয় পায় শহরটি, ‘ফ্রেডরিক নগর’।
ড্যানিশদের হাত ধরে সেখানে গড়ে ওঠে গভর্নমেন্ট হাউজ, সেন্ট ওলাভ গির্জা সহ বিভিন্ন স্থাপত্য। ১৭৮৬ সালে, শ্রীরামপুরে ‘দ্য ডেনমার্ক ট্যাভার্ন অ্যান্ড হোটেল’ নামে একটি সরাইখানা খোলেন জেমস পার। সেটি ছিল তৎকালীন ফ্রেডরিক নগরের ফ্লাগস্টাফ ঘাটের তীরে, যা এখনকার ‘নিশান ঘাট’। ১৫ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে ট্যাভার্নটি। ইতিহাস বলছে, জেমস পার ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। এককালে কলকাতায় ‘লন্ডন ট্যাভার্ন’ পরিচালনাও করেছিলেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতাই তাঁকে টেনে আনে শ্রীরামপুরে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠে ট্যাভার্নটি। ১৭৮৬ সালের ১৬ মার্চ ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল—‘ট্যাভার্নের পার্শ্ববর্তী নদীপথ ব্যবহারকারী সজ্জন ব্যক্তিদের সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে অত্যন্ত উপযুক্ত ও যুক্তিসঙ্গত অর্থের বিনিময়ে মিলবে পানীয়। সংবাদপত্র পাঠের সুব্যবস্থার পাশাপাশি কফি-রুমও আছে। কোন ইউরোপীয় সজ্জন ব্যক্তি, যিনি কলকাতার কোলাহল থেকে দূরে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে নিজের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে চাইছেন, তাঁদের জন্য এই ডেনমার্ক ট্যাভার্নটি ভালো আলোচনার জায়গা হতে পারে।’ একটি বিলিয়ার্ড টেবিল ও স্কিটেল খেলার মাঠেরও উল্লেখ করা হয়েছিল।
১৮৪৫ সালে শ্রীরামপুর থেকে বিদায় নেয় দিনেমাররা। ক্রমেই ব্রাত্য হতে থাকে গির্জা, গভর্নর হাউস, ট্যাভার্নের মতো জনপ্রিয় জায়গাগুলি। একে একে সেগুলি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।

জনমানসে প্রভাব
কলকাতা গবেষক বিনয় ঘোষ লিখছেন, ‘ইংল্যান্ডের সমাজে ট্যাভার্ন-কফি হাউসের যে প্রবল প্রভাব ছিল, তার এক শতাংশও প্রভাব ছিল না বাংলার সমাজে। তাই এখানে বিদেশি ব্যবসায়ীদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বাংলায় সম্ভ্রান্ত ইংরেজ এবং ইউরোপীয়রা তো বটেই, বিশিষ্ট বাঙালিরাও এগুলিকে আপন করে নিতে পারেননি। বেডফোর্ড, কোভেল্ট গার্ডেন বা জনসন ট্যাভার্নের মতন একটি কফি হাউস বা সরাইখানা কলকাতা-শহরতলিতে গড়ে উঠতে পারেনি। কোনও শ্রদ্ধেয় বাঙালি সমাজ নেতা কলকাতার ট্যাভার্নের মজলিসে যোগ দিয়েছেন বলে শোনা যায় না। রামমোহন রায় থেকে দেশের সাধারণ লোকের জীবনে ঘর এবং বৈঠকখানার প্রভাবই ছিল সর্বাধিক।’

বন্ধ সরাইখানা
উনিশ শতকের শুরু থেকে ধীরে ধীরে ট্যাভার্নের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। কলকাতা গবেষকদের মতে, একটা সময়ের পর ইংরেজদেরও আর ট্যাভার্ন নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। তাই যে সরাইখানাগুলি নিয়ে তুমুল মাতামাতি হতো, সেগুলি ক্রমে বন্ধ হতে শুরু করে। একইভাবে ইংরেজদের উদাসীনতায় ডেনমার্ক ট্যাভার্ন কার্যত একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এর অস্তিত্বের কথা বেমালুম ভুলে যায় সাধারণ মানুষ।

ডেনমার্ক ট্যাভার্নের ‘পুনর্জীবন’
প্রায় দেড়শো বছর পরের কথা। শ্রীরামপুরের ট্যাভার্ন সম্পর্কে কিছু তথ্য খুঁজে পান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ডেনমার্কের একটি দল। মেলে কিছু ছবিও। এর পরেই ভারত সরকারের সহায়তায় অতীত সন্ধানে নামেন ড্যানিশ আধিকারিকরা। একটি ধ্বংসস্তূপও খুঁজে পান। ২০১০ সালে ‘শ্রীরামপুর ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে ডেনমার্কের জাতীয় মিউজিয়াম। দায়িত্বে ড্যানিশ নৃবিজ্ঞানী বেন্তে ওল্ফ। ওই প্রকল্পের অধীনে ড্যানিশ ট্যাভার্নটির পাশাপাশি এলাকার বেশ কিছু ঐতিহাসিক কাঠামো পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’ তকমা দেয় ডেনমার্ক ট্যাভার্নকে। সেই বছরের অক্টোবরে শুরু হয় পুনর্নির্মাণের কাজ। নামানো হয় মুর্শিদাবাদ, সুন্দরবন ও শ্রীরামপুরের দক্ষ কারিগরদের। সিমেন্টের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় চুন-সুরকি। অতীতের আদলে সেগুন কাঠ দিয়ে বানানো হয় ট্যাভার্নের দরজা, জানালা এবং আসবাবপত্র। তিন বছর পর, ২০১৮ সালে উদ্বোধন হয় নবনির্মিত ডেনমার্ক ট্যাভার্নের।

বর্তমান চিত্র
উদ্বোধনের পর থেকেই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ‘ডেনমার্ক ট্যাভার্ন’। রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন এই ট্যাভার্ন পরিচালনার দায়িত্বে ‘দ্য পার্ক গ্রুপ’। চা, কফির সঙ্গে মেলে হরেক রকমের ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-ডিনার। সোনালি অতীতের মতো এখনও মেলে রাত্রিবাসের সুযোগ। ঘর, ঐতিহাসিক সিঁড়ি, বিলিয়ার্ড বোর্ড—সর্বত্রই আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী এই সরাইখানার দেওয়ালজুড়ে রয়েছে অতীত আমলের নানান ছবি। 
এই ইতিহাসের শেষ নেই, আছে শুধু স্মরণ আর রোমন্থন!
6Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা