ফরিদকোটে ব্যবসা বাণিজ্য জীবিকার তেমন সুবিধা হয়নি। তাই আমির আলি লাহোরে কনস্ট্রাকশন এজেন্সিতে নাম লিখিয়ে ৪০০ টাকা দৈনিক মজুরিতে বিল্ডিং নির্মাণের মিস্ত্রি। ফরিদকোট বাসস্ট্যান্ডের পিছনের রাস্তা দিয়ে ১ কিলোমিটার গেলে আমিরের ঘর। বস্তির মধ্যে। সার দেওয়া ভাড়াবাড়ি। টিনের দরজা। টয়লেট কমন। টয়লেটের জল এসে সারাক্ষণ রাস্তাটা ভিজিয়ে রাখে।
বাবা না থাকায় আমিরের মেজ ছেলে আজমল মা নূর ইলাহিকে পাত্তা দেয় না। সংসারের সুরাহার দিকেও মন নেই। এভাবে বেশিদিন চলল না। আমিরের যক্ষ্মা ধরা পড়েছে। লাহোরের এজেন্সি আর কাজ দেবে না। অতএব ফরিদকোটে ফেরা। কোনওমতে আয় হচ্ছে ২৫০ টাকা। আমির আজমলকে বলল, লাহোরে গিয়ে কাজে লেগে পড়তে হবে। এভাবে চলছে না।
লাহোরে যে কাজটা পাওয়া গেল ১৩ বছরের ছেলের ভালো লাগার কথা নয়। পাবলিক টয়লেট সাফ করা। ভাগ্যক্রমে সিনেমা হলে একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। ওই সিনেমা বারংবার দেখতে যায় আজমল। সিনেমার নাম ‘শোলে’। মুজফফরই আজমলকে নিয়ে এল নিজের কাজের জায়গায়। ওয়েলকাম টেন্ট হাউস। ডেকরেটর আর ক্যাটারিং দুটোই। খাওয়াটা অন্তত নিশ্চিন্ত। এসব করে লাভ নেই। বড় কিছু করতে হবে। হতে হবে স্বাবলম্বী। আজমল জানালো মুজফ্ফরকে। স্বাবলম্বী হতে গেলে সবার আগে দরকার একটা বন্দুক। রাওয়ালপিন্ডির কাছের এক বাজারে পাওয়া যায়।
ছুটির দিন যাওয়া হল রাওয়ালপিন্ডি। সেই বাজার এমনিতে দেখতে জামকাপড় আর খাবারের বাজার। আড়ালে পাওয়া যায় দু’টি জিনিস। অস্ত্র ও ড্রাগ।
নভেম্বর। ২০০৭। অস্ত্র কেনার সময় তাদের বলা হল পরদিন আসতে। পরদিন গেল তারা। কিন্তু অস্ত্র নয়। একটা কাগজ দেওয়া হল হাতে। যেখানে লেখা দাউরা-ই-সুফা। বলা হল, লাহোরের কাছেই একটি জায়গা মুরিদকে। সেখানে যেতে হবে। কেন?
মুরিদকে এসে দেখা গেল একটি মসজিদ। বাইরে ক্যাম্প অফিস। বেশ কিছু বাস দাঁড়িয়ে। ক্যাম্পের সামনে লাইন পড়েছে। ক্যাম্পে উঁকি দিল দেখা যায়, টেবিল-চেয়ারের সারি। নাম, ঠিকানা, বয়স লেখা হচ্ছে। তারপর হাতে দেওয়া হচ্ছে একটা করে চিরকুট। বড় করে ব্যানার লেখা মারকাজ-ই তোইবা।
সাধারণ জীবন থেকে লস্করসেনা হওয়ার প্রশিক্ষণ শিবির। আজমল অবাক হয়নি। ফরিদকোটে সে এসব দেখেছে। ফরিদকোটে এটাই সবচেয়ে সহজ পেশা। গ্রামে গ্রামে তরুণদের রিক্রুট করা হয় লস্করে। তাদের বলা হয়, শহিদ হলে তাদের নামে জয়জয়কার হবে পাকিস্তানে। শহিদ হবে কেন? ইন্ডিয়া থেকে কাশ্মীর ছিনিয়ে নিতে গিয়ে। শহিদ হলে পাকিস্তানের সংবিধানে তাদের নাম লেখা হবে। তাদের নামে স্কুল তৈরি হবে। এসব মিথ্যা কথা ১৬ থেকে ২২ বছর বয়সিদের বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। আজমলও করেছে।
ভোর চারটে থেকে প্রশিক্ষণ শুরু। মিলিটারির থেকেও কঠিন জীবন। আর শৃঙ্খলা। আজমল আর মুজফফরকে যে ব্যাচে দেওয়া হয়েছে, তাতে ১৭৫ জন আছে। প্রথম মাস শুধুই ধর্মীয় শিক্ষা। আর বিকেলে নামাজের পর একটি করে ফিল্ম। সিনেমা নয়। ভারতে কীভাবে কোথায় কোথায় লস্কর আত্মঘাতী বাহিনী আক্রমণ করেছে, তারই হাইভোল্টেজ তথ্যচিত্র। আত্মঘাতী হওয়াই সবথেকে বড় জেহাদ। আজমলদের সেই এলিট গ্রুপে নেওয়া হচ্ছে। ফিঁদায়ে। আজমল খুশি।
আল কামা আর জাকি কাহাফা দায়িত্বে। আল কামা জানাচ্ছে, একটা বড় অপারেশন আছে। হিন্দুস্তান কেন, গোটা দুনিয়া কল্পনা করতে পারবে না, এমন এক অভিযান হবে। আর তোমাদের মধ্যে থেকেই বাছাই করা হবে তাদের, যারা এই কাজটা করবে। তাই কারা সেই ভাগ্যবান, সেটা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে জানা যাবে। যারা ওই অভিযানে যাবে, তারা যদি শহিদ হয়, তাহলে জন্নতের এমন একটি কামরায় তাদের নিয়ে যাওয়া হবে, যেটা সবথেকে মধুর আর আনন্দময়। ওই কামরায় কারা কারা যেতে চাও? চিৎকার করল আল কামা। ১৭৫ জনের পাল্টা চিৎকার, ‘আমি!’
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি। ভোর তিনটের সময় বাস। আজমল আর মুজফফর দেখল ১৭৫ জনের মধ্যে মাত্র ২৪ জন রয়েছে বাসের সামনে। নাম ধরে ধরে তাদের তোলা হল। এবার যাওয়া হবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। রুক্ষ, শুষ্ক পাহাড়। শীর্ণ নদী। আর অসহনীয় শীত। নির্জন জায়গার নাম বাট্টাল। কিছু জংলা বন আছে। তবে সেইসব গাছও কেমন যেন প্রাণহীন সবুজ। ঠিক মাঝে একটা গ্রাম। এই হল লস্কর-ই-তোইবার অন্যতম প্রশিক্ষণ শিবির। জঙ্গি তৈরির কারখানা।
এই প্রথম আজমল ও মুজফ্ফর সহ ওই ২৪ জন একটি ধাতব বস্তু স্পর্শ করল। এ কে ৪৭। শুরু হল বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবির। কীভাবে বন্দুক চালাতে হয়, সেটাই নয়। প্রশিক্ষণ দেওয়া হল পাহাড়ে দৌঁড়ে ওঠানামা, ২৪ ঘন্টা অনাহারে থাকা। জলে কতক্ষণ ডুবে থাকা সম্ভব, তা পরীক্ষা করতে নিয়ে যাওয়া হল নিকটবর্তী হ্রদে। কয়েক মাসের লাগাতার ট্রেনিং।
মুজফফরবাদে কাটল কিছুদিন। তারপর ট্রেন। গন্তব্য করাচি। ১৩ জনের দল পৌঁছল আজিজাবাদ। দোতলা বাড়ি। সাদা রঙের। বাইরে ঊর্দুতে লেখা, ‘কেন আমরা জিহাদ করছি? জানতে হলে এসো, যোগ দাও।’
একজনকে দেখিয়ে আল কামা ১৩ জনকে বলল, ইনি আমাদের আমের! বয়স্ক এক লোক। কলপ করা দাড়িগোঁফের সেই আমের বলল, তোমাদের কাজ হিন্দুস্তানকে আক্রমণ করা। লক্ষ্য—মুম্বই। হিন্দুস্তানের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেটাই ধ্বংস করে দাও। তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে মোবাইলে। যখন ইচ্ছে ফোন করবে। আমরা করাচিতে বসে তোমাদের মুভমেন্ট দেখব। বলে দেব, কোনদিকে যেতে হবে। আমেরের নাম? হাফিজ সঈদ।
নিউ জার্সির ক্যালফোনেক্স সংস্থা থেকে নেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট কল সিস্টেম। আজমলদের দেওয়া হবে ভারতীয় সিমকার্ড। সেটা থেকে ফোন যাবে অস্ট্রিয়ায়। যা ক্যালফোনেক্স পাঠাবে পাকিস্তানে। ইন্টারসেপ্ট করতে পারবে না ভারত। এই হল প্ল্যান।
প্রথমে ঠিক হয় ২৭ সেপ্টেম্বর হবে আক্রমণ। কিন্তু দু’বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়। ঝড় ও বোটের সমস্যায়। আক্রমণ হবে সমুদ্রপথে। কিন্তু করাচি থেকে কোথায় কোথায় যেতে হবে? তাজ হোটেল, লিওপোল্ড কাফে, চাবাদ হাউস, সি এস টি স্টেশন... এসব কোথায়? চেনা যাবে কীভাবে?
সেই কারণেই গত একমাস ধরে এই জায়গাগুলির ভিডিও প্রতিদিন দু’বার করে দেখানো হয়েছে। ঠিক যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেভাবেই এগতে হবে। কে ভিডিও করেছে এমন নিখুঁতভাবে? দাউদ গিলানি। বাবা ছিলেন পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিক। ওয়াশিংটনে পোস্টিংয়ের সময় পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মী, এক মার্কিন যুবতীকে বিয়ে করেন দাউদের বাবা সৈয়দ সেলিম গিলানি। মেয়েটির বাবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক জনপ্রিয় ফুটবলার, কোলম্যান হেডলি। কিন্তু মার্কিন কন্যার সঙ্গে পাকিস্তানি প্রশাসনিক অফিসারের বিবাহ সুখের হল না। ডিভোর্স হল। তাঁদেরই পুত্র দাউদ গিলানি।
ছেলেটি তখন পাকিস্তানের স্কুলে, ক্লাস নাইনের ছাত্র। সে সময় একদিন শহরে বোমা ফেলে ভারতীয় বিমান বাহিনী। স্কুল বিল্ডিংয়ের একাংশ ভেঙে যায়। সেই থেকেই ভারতের উপর রাগ তার। তবে বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করায় আর পাকিস্তানে থাকা হয়নি দাউদের। মা তাকে ডেকে নেন শিকাগোয়, নিজের কাছে। মা তখন একটি সংস্থা চালাচ্ছেন। সাহায্য করতে বলেন ছেলেকে। কাজ করলেও তার মন বাইরের জগতে। ড্রাগ ব্যবসায় যুক্ত হল সে। অপেশাদার হওয়ায় ধরাও পড়ল।
আমেরিকার ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি তাকে জানাল, হয় তোমার মাদকচক্রের সবার তথ্য দাও, নয়তো ২০ বছরের জেল। বহু ঝুঁকি সত্ত্বেও ড্রাগচক্রের হদিশ দিয়ে দিল ছেলেটি। তার পরেও জেল হল। তবে মাত্র চার বছরের জন্য। জেল থেকে বেরিয়েই সোজা পাকিস্তান। কারণ স্বাভাবিক। ড্রাগ চক্র তাকে পেলেই হত্যা করবে বেইমানির জন্য।
লাহোরের কাদিশিয়া জামা মসজিদের বাইরে পোস্টার লেখা থাকে, ‘ডোনেশন দিন জেহাদের জন্য। এই টাকা কাশ্মীরের ভাইদের মুক্তির জন্য।’ দাউদ গিলানি সেই পোস্টার দেখে ৫০ হাজার পাকিস্তানি টাকা ডোনেশন দেয়। একজন সাহেব কীভাবে এত টাকা দিল? এ তো কাজের লোক! দ্রুত গিলানিকে আনা হল কাদিশিয়া জামা মসজিদের শুক্রবারের বিশেষ আকর্ষণের কাছে। কী সেই আকর্ষণ? নামাজের পর শুক্রবার বিকেলে একজন বক্তৃতা দেয়। ভারত বিরোধী। জ্বালাময়ী। তার নাম হাফিজ সঈদ। সেই শুরু। সাহেব নয়, সাহেবের মতো দেখতে। আসলে পাকিস্তানি বাবার পাকিস্তানি পুত্র। পাসপোর্টে নাম ডেভিড কোলম্যান হেডলি! সেই হেডলিকেই হাফিজ সঈদ পাঠিয়েছিল মুম্বইতে, ভিডিও করার জন্য। মাসের পর মাস থেকে ভিডিও করে ফের করাচিতে গিয়ে সে সিডি জমা দেয়।
২২ নভেম্বরের বিকেল। আজমল কাসব আর তার ৯ সঙ্গী রওনা হল একটি নৌকায়। আরব সাগরে। কিছুটা এগিয়ে সামনেই অপেক্ষা করছে লঞ্চ। আল হুসেইনি। ২৬ নভেম্বর প্রথম ক্লু পেল মহারাষ্ট্র পুলিস। আজ সন্ধ্যায় বাধওয়াড় পার্ক সমুদ্রসৈকতে একটি নৌকা এসে থেমেছিল বলে জানাচ্ছে মৎস্যজীবীরা। তবে কোনও চেনা মানুষ নামেনি। ছিল একঝাঁক অচেনা যুবক। কাঁধে ব্যাকপ্যাক। এই খবর যখন এসেছে, ততক্ষণে মুম্বইয়ে গণহত্যা শুরু করে দিয়েছে আজমল কাসবরা। ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস, তাজ হোটেল, লিওপোল্ড কাফে, চাবাদ হাউসে রক্ত, মৃত্যু আর হাহাকারের নরকদৃশ্য। চলে তিনদিন ধরে।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড, মুম্বই এসটিএফ, স্পেশাল নেভি ফোর্স যখন ভয়ঙ্কর এই জঙ্গিদের একে একে খতম করেছে, তখন একমাত্র বেঁচেছিল ফরিদকোটের ছেলে আজমল কাসব। ১১ হাজার পৃষ্ঠার চার্জশিট দেওয়া হয় তার ও পিছনে থাকা মাস্টারমাইন্ডদের বিরুদ্ধে।
তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় বাইকুল্লা জে জে হাসপাতালে। সঙ্গীদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখে উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে আজমল কাসব। ফাঁসি হয় তার। প্রবল চাপে পাকিস্তান হাফিজ সঈদ, আবু কামা, জাকিউর রহমান লাখভিকে জেলে দিতে হয় পাকিস্তানকে। কেউ কেউ আবার জামিনও পায়। সবটাই লোকদেখানো। পাকিস্তান কোনও ব্যবস্থাই নিল না মুম্বই হামলার চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে।
২০২৩। করাচির গুলিশান-ই-জানওয়ার মসজিদের সামনে হেঁটে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন মওলানা জিয়াউর রহমান। তৎক্ষণাৎ মৃত। লস্কর-ই- তোইবার উচ্চপর্যায়ের কমান্ডার। হাফিজ সঈদের হাতে গড়া। ঠিক কয়েকদিনের মধ্যে গুলশান-ই-উমর সমাধিস্থলে তিনজন বাইক আরোহী গুলি করে খুন করল মুফতি কাইসার ফারুখকে। লস্করের কমান্ডার হাফিজ সঈদ পুত্র তানহার ঘনিষ্ঠ সেনাপতি। মর্নিং ওয়াকের সময় পরমজিৎ সিং পাঞ্জওয়াড়কে গুলি করে হত্যা করা হয় মে মাসে। লস্করের সাহায্যে চলা ভারত-বিরোধী খালিস্তানি নেতা ছিল পরমজিৎ। হাফিজ-পুত্র তানহার উপরেও দু’বার অ্যাটাক হয়েছে। কোনওমতে বেঁচে গিয়েছে সে।
কারা করছে এসব? কেন লস্কর-ই-তোইবার কয়েক ডজন কমান্ডার পাকিস্তানে আইএসআই হেডকোয়ার্টারে গিয়ে আশ্রয় চেয়ে কাতর আবেদন করছে? বলছে, আমাদের রক্ষা করুন। আপনাদের গেস্ট হাউসে রাখুন। নয়তো খুন হয়ে যাব। লস্কর বিরোধী কোভার্ট অপারেশন কারা করছে?
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়