প্রচ্ছদ নিবন্ধ

ফ্লাইং গার্ড ও মাস্টারমশাইরা

গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক কি শুধু বইয়ের পাতায় বাঁধা? বেধড়ক মার, কিছু ফাজলামো, আর বাকিটা ভালোবাসা। শিক্ষক দিবসের আগে নস্টালজিয়ার পথেঘাটে কৌশিক মজুমদার

মফস্‌সলের যে ছেলেদের ইস্কুলটায় আমরা পড়তাম, তাতে অনেক অভাব থাকলেও স্বাধীনতার অভাব ছিল না। খুব কম বয়সেই আমরা এমন সব স্বাধীনতা ভোগ করতাম, তার বর্ণনা শুনলে আজকের ছেলেমেয়েদের অনেকেই আঁতকে উঠবে। এমনকী শরৎচন্দ্র বা শীর্ষেন্দুর লেখার কথাও মনে পড়তে পারে। টিফিন বেলায় পাঁচিল টপকে পালানো, কিংবা স্যরের চেয়ারে ডেনড্রাইট মাখিয়ে রাখার মতো ভয়ানক সব কাজকর্ম অতি অল্প বয়সেই আমরা রপ্ত করে ফেলেছিলাম। সবাই জানে, সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমরা যখন ক্লাস এইটে পড়ি, ইস্কুলে মূর্তিমান বিভীষিকার মত হাজির হলেন এক মাস্টারমশাই। নাম হরেকেষ্ট মুখোপাধ্যায় (সামান্য পরিবর্তিত)। দেখতে ছোটখাটো হলেও তাঁর সুতীব্র বাক্যবাণ, আর প্রবল প্রতাপে গোটা স্কুলে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল। প্রত্যেক শিক্ষকের কিছু স্পেশালিটি থাকে। এঁর ছিলও। পরীক্ষায় গার্ড দেওয়া। 
গার্ড দেওয়ার মতো ভয়ানক বোরিং ব্যাপারকে কীভাবে হট অ্যান্ড হ্যাপেনিং করতে হয়, তিনি তা জানতেন। পরীক্ষা শুরুর পনেরো মিনিট আগেই ঢুকতেন ক্লাসে। আর প্রথমেই যে যার পাশে বসেছিল, তাকে সরিয়ে অন্য বেঞ্চে পাঠিয়ে দিতেন। কোনও ওজর-আপত্তি চলত না। যারা শেষ মুহূর্ত পযন্ত বইতে চোখ বোলাচ্ছিল, ভয়ঙ্কর তাগাদা দিয়ে তাদের বই কেড়ে নিতেন। অনেক সময় মৃদু টানাটানিতে বইয়ের মলাট বা পাতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তারপর সংক্ষেপে স্যর বলতেন, ওইদিন পর্যন্ত কী কী ভাবে তিনি টুকলি ধরেছেন এবং কেন তাঁর রাজত্বে টুকলি অসম্ভব। অনেক সময় এই পর্যায়ে লাইভ ডেমো দেওয়া হতো। তাঁর পূর্বের শিকাররা হয়তো সেই ঘর বা পাশের ঘরেই বসা। তাদের দেখিয়ে, বা তাদের মুখ থেকেই কৃতকর্ম বর্ণনা করানো হতো। কিংবা বলা ভালো, স্যরের শিকার অভিযান বলানো হতো। 
ততক্ষণে প্রায় পনেরো মিনিট কেটে গেছে। খাতা ও প্রশ্নপত্র দেওয়া হল। পরীক্ষা শুরু। খাতা দিয়েই স্যর ঘরের বাইরে। কেউ যদি এই ফাঁদে পা দিল তো মরল। কোনও এক গোপন কোণ থেকে তিনি লক্ষ্য রেখে চলেছেন সদা জাগরুক হয়ে। ঘাড় ঘোরানো মাত্র অগ্নি কিংবা নৈঋত কোণ থেকে বাজপাখির মত ছোঁ মেরে খাতা নিয়ে যেতেন স্যর। ‘এবারের মতো ছেড়ে দিন স্যর। আর জীবনে ঘাড় ঘোরাব না’ জাতীয় মুচলেকার পর খাতা পাওয়া যেত। তবে তাঁর অসামান্য পটুতা ছিল টুকলি ধরায়। দেহের নানা সম্ভব-অসম্ভব জায়গায় লুকিয়ে রাখা টুকলি কোন কায়দায় তাঁর হস্তগত হতো, তা আজও বিস্ময়ের ব্যাপার। টুকলি ধরতে ছাত্রের নানা শ্লীল-অশ্লীল অংশে খপাত করে হাত দিয়ে কাগজ বের করতে তাঁকে আমি নিজে দেখেছি। তবে তাঁর একবারের কীর্তি সমস্তকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস করুন, সুকুমার রায়ও এমন লিখতে দু’বার ভাবতেন।
সেবার স্কুলের দোতলায় ক্লাস নাইনের ঘরে আমাদের অঙ্ক পরীক্ষা চলছে। প্রশ্ন কঠিন। বাইরে থেকে সাহায্যর আশায় গালে হাত দিয়ে আছে অনেকে। আমাদের ঘরে হরেকেষ্ট স্যরের গার্ড। হঠাৎ তাঁর কপালে জানলা দিয়ে কী একটা উড়ে এসে লাগল। খুলে দেখেন, অঙ্ক প্রশ্নের কিছু উত্তর জানালাবাহিত হয়ে ভিতরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে তিনি অপরাধীকে দেখে নিলেন। সেও আমাদেরই এক সিনিয়র। নাম শ্যামল। চার চোখের মিলন হতেই তিনি সুতীব্র স্বরে ‘ওই ছেলে! দাঁড়া বলছি’ বলে বিকট এক হাঁক পাড়লেন। সে ছেলেও নিজের ‘ভুল’ হাড়ে হাড়ে বুঝেছে, আর ‘বাবা গো, মা গো’ বলে শুরু হয়ে গিয়েছে মরিয়া দৌড়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। হরেকেষ্ট স্যর দোতলার লবি বরাবর ‘থাম, থাম বলছি’ বলে দৌড়চ্ছেন, আর সে ছেলে প্যারালালি মাটিতে ‘না না’ বলে পালাচ্ছে। এরপরেই স্যর যা করলেন, তা আমাদের স্কুলে অন্তত কেউ আগে করেননি। ভবিষ্যতে কেউ করবেন, সে আশাও দেখি না। বগলে সাদা পাতার বান্ডিল আর হাতে ডাস্টার নিয়ে হরেকেষ্টবাবু সোজা লাফ মারলেন সানশেডে, আর সেখান থেকে সোজা ল্যান্ড করলেন শ্যামলের সামনে।
এই সুপারম্যান সুলভ আচরণের আকস্মিকতায় শ্যামল ভয় পেয়ে দাঁত ছরকুটে অজ্ঞান। স্যরই তাকে টিচার্স’ রুমে নিয়ে গেলেন। গরম দুধ খাইয়ে জ্ঞানও ফেরালেন। খানিক বোঝালেন, কেন এসব করা উচিত না। শুনেছি পরে তার সাথে স্যরের বেশ বন্ধুতা হয়ে গেছিল। তবে এইসব মিলিয়ে একটা রটনা হয়েছিল, আমাদের ইস্কুলে নাকি ফ্লাইং গার্ড দেওয়া হয়। যদিও ব্যাপারটা ঠিক কী, তা কিন্তু অনেকেই জানত না।
হরেকেষ্টবাবুর সঙ্গে এখনও দেখা হয়। মাথাভরা চুল, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর তাতে উপচে পড়ছে বই। বেশিরভাগই পড়ার বই। কোন ছেলে বইয়ের অভাবে পড়তে পারছে না, কার একটা রেফারেন্স বই হলে একটু সুবিধে হয়, এখনও তার খোঁজ নিয়ে বাড়িতে গিয়ে বই পৌঁছে দেন এই অকৃতদার ভদ্রলোক। রিটায়ার করার পর রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা ধরেছিলেন। রীতিমতো তালিম নিয়ে। আচমকা স্বরযন্ত্রে কী যেন হল, স্বর হারালেন। এখন কথা বললে তীব্র ফ্যাঁসফ্যাঁসে একটা আওয়াজ আসে মাত্র।
এইমাত্র আর একখানা ঘটনা মনে পড়ে গেল। এটাও মনে পড়ল, শিক্ষক দিবসের আশপাশেই সে ঘটনা ঘটেছিল। চোখ বুজে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ক্লাস এইটের ঘরে বেলুন আর কাগজের মালা ঝোলানো আছে। সেবার ক্লাস এইটের ইতিহাস বইতে ছিল ইউরোপের কথা। তাতেই একটা লাইনে লেখা, ‘মধ্যযুগের ব্যভিচার শেষে ইওরোপে রেনেসাঁস আসে’। 
নতুন নতুন বড় হচ্ছি, আর তখনই নানা কিসিমের বই পড়ে ফেলায় সব রকম ব্যভিচারের আইডিয়া আমার কাছে অন্তত পরিষ্কার ছিল। যেমন হয় আর কী, অনেককেই শব্দটার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলাম। সবাই খুশি। শুধু একজন বাদে। নাম তপন। ওঁর আচমকা কেন যেন ইচ্ছে হল, এটা নিয়ে একটু ফাজলামো করতে হবে। ইতিহাস পিরিয়ড টিফিনের পরে। তার আগে চার-চারটে ক্লাস। ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক আর ভূগোল। তপনের আর ধৈর্য ধরে না। সে ব্যাটা করলে কী, প্রতি ক্লাসের মাস্টারমশাইকে, ‘স্যর, একটা প্রশ্ন আছে। ব্যভিচার মানে কী একটু বলবেন?’ বলে বিব্রত করতে লাগল। 
সবাই প্রথমে থতমত। তাঁদের পড়ানোর বিষয়ের সঙ্গে ব্যভিচারের কী সম্পর্ক? তপন তাঁদের বোঝাল, ফিফথ পিরিয়ডে ইতিহাস আছে। সেখানে এই শব্দটাও আছে। আগের দিন স্যর এটা বুঝিয়ে যাননি, যদি আজ পড়া ধরেন! অর্থ না জেনে কিছু পড়া তো ঘোর অন্যায়। অতএব...
ব্যভিচার বোঝাতে সব স্যরই বেশ কুণ্ঠা বোধ করলেন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা অঙ্ক স্যরের। তাঁকে কেউ ব্যভিচার বোঝাতে বলবে, গোটা শিক্ষক জীবনে এ কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। সবাই আমতা আমতা করলেন। তপন ভাবল আজ ভারী ফাজলামো হল। 
টিফিন পিরিয়ডে সব মাস্টারমশাই মিলে ইতিহাস স্যরকে চেপে ধরলেন। ‘কী মশাই! কী পড়াচ্ছেন? ছেলেপেলে ব্যভিচার মানে জানতে চাইছে?’ টিফিনের পর উনি যখন পড়াতে ঢুকলেন, মুখ থমথমে। ঘোর বাঙাল ছিলেন ভদ্রলোক। রাগও তেমনি। ঢুকেই বললেন, ‘ব্যভিচার মানে জানতে চায় কেডা রে?’ তপন হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল। স্যর তখন ‘আয় দেহি। এহানে আয়’ বলে ডেকে নিলেন। কিছু বোঝার আগেই তপনের দুই কান ধরে মুচড়াতে মুচড়াতে দমাদ্দম মার। আর মুখে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘এই যে, এইডারে কয় ব্যভিচার। আমি তোর লগে ব্যভিচার করতাসি, বুঝঝস?’ বাকি স্কুল জীবন তপন খুব সিরিয়াস মুখে ক্লাস করত। ওর প্রতি স্যরের এই ব্যভিচারকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি বেচারা। 
স্কুল জীবন পেরিয়ে গেলাম বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলাম, তখন এগ্রিকালচারের ‘এ’ জানি না। বন্ধুদের প্রায় কেউই না। অনেকে আবার জয়েন্ট দিয়েছিল ডাক্তার হবে বলে। চান্স পায়নি, তাই মন খারাপ। একেবারে প্রথম চয়েস হিসেবে এগ্রিকালচার সে সময় কারও ছিল না। স্যরেরা সব জানতেন। বুঝতেন, ডিপ্রেশনের মানে মন খারাপ, আর আরও গভীর কিছু। একেবারে প্রথমে তিনদিন ওরিয়েন্টেশন ক্লাস হল। আমাদের সময় ডিন ছিলেন নীলাংশু মুখোপাধ্যায় স্যর। সদা হাস্যমুখ। প্রথম ক্লাসই তার। ঠিক লেকচার না, যেন গল্প করছেন, এই ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমাদের অনেকেই তো ডাক্তার হতে চেয়েছিলে, তাই না?’ মৃদু মাথা নাড়ল অনেকেই। মুখ গম্ভীর। 
‘পাওনি, তাই মন খারাপ?’ এবারও দু’-একটা মাথা নড়ল।
‘শোনো একটা কথা বলি, তোমরা এখানেও ডাক্তার হতে এসেছ। গাছের ডাক্তার। আর তোমাদের কাজ আরও কঠিন। আরও চ্যালেঞ্জিং। ভাবো তো, মানুষ তো নিজের অসুবিধা বলতে পারে। গাছের অসুখ হলে বলতে পারবে? তোমাদের দেখে বুঝতে হবে। চিকিৎসা করতে হবে। তাঁকে সারিয়ে তুলতে হবে। তোমরা একটু ভুল করলে যদি খেতের পর খেত নষ্ট হয়ে যায়, তবে শুধু একজন না, গোটা একটা সভ্যতা শেষ হবার দিকে চলে যেতে পারে...।’ একথা বলেই শুরু করলেন, কেমনভাবে আলুর নাবি ধ্বসা রোগে আয়ারল্যান্ডে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছিলেন তার গল্প। সবশেষে স্যর এমন একটা কথা বললেন, যা পরে আমিও অনেককে বলেছি—‘দ্যাখো, তোমরা ছাত্রছাত্রী। তোমাদের কাজ পড়াশুনো করা। কিন্তু কেউ যদি শুধু পড়াশুনো করে, আমি তবে তাকে ১ দেব। তার বেশি নয়। কেউ যদি পাশাপাশি কোন ক্রিয়েটিভ কাজ, লেখা, গান, নাচ ইত্যাদি করে, তবে পাশে একটা শূন্য বসে হবে ১০। কেউ যদি আর একধাপ এগিয়ে সমাজের জন্য কিছু করে, নিজেকে ছাড়াও অন্যকে নিয়ে ভাবে, তবেই আরও একটা শূন্য বসে একশোতে একশো পাবে। কিন্তু কেউ যদি সবই করল, কিন্তু পড়াশুনোটা করল না। তবে কী হবে বল তো? ওই ১টা জাস্ট কেটে যাবে।’ 
বিশ্বাস করুন এমন ক্লাসের পরে আমাদের ব্যাচের ছেলেমেয়েরা ডিপ্রেশনে আর কোনওদিন ভোগেনি। 
শিক্ষকদের গল্প বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এখুনি মনে পড়ছে এ পি জে আব্দুল কালামের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা। মনে পড়ছে উনি বলেছিলেন, ‘গবেষণা করতে গেলে তোমাকে সর্বদা বাঁকা পথটাই ধরতে হবে। সেটা কঠিন। ওখানে কেউ যায় না। সোজা পথে শুধু পিএইচডি থিসিস হবে। আর কিছু না।’ মনে পড়ছে নোবেলজয়ী বার্ট সাকমানের সঙ্গে কাটানো এক দুপুরের গল্প। লজ্জিত হেসে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘আমি অঙ্কের ছাত্র, তারপর ফিজিক্স, বায়োফিজিক্স হয়ে শেষে মেডিসিনে নোবেল পেলাম। একেবারে জ্যাক অব অল ট্রেডস বলতে পার।’ বলেই হো হো হাসি। কিন্তু এসব কিছু না। জীবনের সায়াহ্নে শঙ্খ ঘোষ কিছুদিন আমার মাস্টারমশাই হয়েছিলেন। সে গল্পটা বলি বরং।  
২০১৭ সালের শুরুর দিকে একটা দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া গেল। রিচার্ড ইয়ান্টুর নামে এক জার্মান শিল্পীর রবীন্দ্র-অনুবাদ এবং পাতায় পাতায় ছবিতে ভরপুর বইটি সবদিক থেকেই অসামান্য। বইটির নাম বাংলায় অনুবাদে হয় চৌদ্দ কবিতা। এক পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী থেকে একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। পিএইচডি পড়াকালীন জার্মান শিখেছিলাম। ফলে পাঠোদ্ধারে কোনওরকম সাহায্য করতে পারব কি না। ইয়ান্টুর মূল বাংলা থেকে কবিতা অনুবাদ করেননি। করেছেন কবিগুরুর ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত অনুবাদের ভাবানুবাদ। তাও গদ্যে। এবার সেই অনুবাদের অনুবাদ এমন চেহারা নিয়েছে যে, সেখান থেকে মূল কবিতা খুঁজে পাওয়া শুধু দুষ্করই নয়, প্রায় অসম্ভব। যদি না শঙ্খ ঘোষের মত কোন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সাহায্য করেন।
কপাল ঠুকে ফোন করেই দিলাম। ল্যান্ড লাইনের নম্বর। যথারীতি পরিচয় দিয়ে ফোনের কারণ বললাম। ‘এসব আলোচনা তো ফোনে করা যাবে না। আপনি বরং একদিন আমার বাড়ি আসুন।’ এক বুধবার বিকেলে তাঁর বাড়ি গেলাম। বইয়ের পাতাগুলোর ফটোকপি করে নিয়ে গেছিলাম। উনি উল্টেপাল্টে দেখে বেশ অবাক হয়েই বললেন, ‘এর কথা তো জানতামই না!’ তারপর শুরু হল লাইন অব অ্যাকশনের আলোচনা। ঠিক কীভাবে কাজটা হবে? কোন কোন কবিতা মাঝখান থেকে তুলে দেওয়া, কন্টিনিউয়িটি নেই, কোথায় একটা কবিতা শেষের পর বিরতি না দিয়েই অন্য কবিতা শুরু হয়ে যাচ্ছে? ততক্ষণে অহর্নিশের সদস্য হিসেবে আমার পরিচয় পেয়ে আপনি নেমে গেছে তুমিতে। বললেন, ‘তোমায় আসতে হবে না। তুমি আগে জার্মান কবিতাগুলোর আক্ষরিক অনুবাদ করে ফেল। তোমার যদি কিছু মনে হয় সেটাও লেখ। তারপর আমায় ফোন কর। ফোনেই আলোচনা করে নেওয়া যাবে।’ তখনই দেখেছিলাম একটা মানুষ নিজের কাজে কতটা ডেডিকেটেড হতে পারেন। আমি সব কবিতা আক্ষরিক অনুবাদ করে ওঁকে স্পিড পোস্টে পাঠালাম। পেয়েই প্রাপ্তি স্বীকার করলেন। প্রতি অনুবাদের পাশে আমি আমার ধারণায় মূল কবিতা কোনটা হতে পারে, সেটা লিখেছিলাম। তিনটে বাদে। সেই তিনটে উদ্ধার আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। রাতে এল ফোন। শুরু হল দীর্ঘ ফোনালাপ। মূল ধারণাগুলো প্রায় প্রত্যেকটাই মেনে নিলেন। শুধু তাই না, কেন সেটা হবে, সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। প্রথমদিন ফোনে মাত্র চারটে কবিতা নিয়ে আলোচনা হল। শুরু হয়ে গেল আমার শঙ্খ ঘোষের ক্লাস। ফোন আসে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। মাঝেমাঝে বলেন, ‘তোমার এই নিয়ে কী ধারণা, সেটাও বলো। অন্যমত থাকতেই পারে!’
মুশকিল হল একটা কবিতায় গিয়ে। আক্ষরিক অনুবাদের ফলে আমার নিশ্চিত মনে হচ্ছিল কবিতাটা ‘শুভক্ষণ’ ছাড়া কিছু হতেই পারে না।
‘ওগো মা,
রাজার দুলাল যাবে আজি মোর’
শঙ্খবাবু বললেন, ‘তুমি শুভক্ষণ বলছ বটে, কিন্তু আমার এটা পড়ে অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। খেয়া কাব্যগ্রন্থের ত্যাগ...’ বলেই তাঁর সুন্দর কণ্ঠে আবৃত্তি করে উঠলেন—
‘ওগো মা,
রাজার দুলাল গেল চলি মোর
ঘরের সমুখপথে...’
মুগ্ধতা কাটার আগেই প্রশ্ন, ‘আমি বলছি বলে না। তোমার নিজের অধ্যয়ন কী বলে?’ বলে আবার সেই শব্দ ধরে ধরে বোঝালেন, কেন ‘ত্যাগ’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ‘শুভক্ষণ’ নয়। যে তিনটে কবিতার হদিশ পাইনি, সেগুলোও কারণ সহ বলে দিলেন। লেখাটা তৈরি করলাম। ওঁকে ফোনে গোটাটা শোনালাম। উনি ধৈর্য ধরে শুনে সম্মতি দিলেন। আমি লেখা পাঠিয়ে দিলাম। এরপর হপ্তাদুয়েক কেটে গেছে। আচমকা আবার ওঁর ফোন। ‘তুমি কি লেখাটা পাঠিয়ে দিয়েছ? ওঁদের বলো একটু অপেক্ষা করে যেতে। কবিতাগুলো দিলেই তো শুধু হবে না, কোন কবিতা কোন কাব্যগ্রন্থে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল, তার প্রকাশকাল, সেটাও তো জরুরি।’ এভাবে তো ভাবিনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘আমি একটা তালিকা বানিয়েছি। হাতের সামনে কাগজ পেন আছে?’ কোনওক্রমে কাগজ পেন নিয়ে বসলাম। শঙ্খবাবু কবিতা ধরে ধরে তার কাব্যগ্রন্থ ও কবিতার প্রকাশকাল বলে গেলেন। আমার মতো এক অর্বাচীনের কথা তিনি মনে রেখেছেন। শুধু রাখেননি, কীভাবে সেই কাজ আরও নিখুঁত, আরও সুন্দর, আরও নির্ভুল করা যায় তাঁর দায়িত্ব নিয়েছেন নিজের কাঁধে। এমন শিক্ষকভাগ্য ক’জনের ঘটে? 
কার্টুন : সেন্টু
10Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা