চাঁদের জমি বরাবরই লোভনীয়! একসময় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা তাঁদের রাষ্ট্রপ্রধানদের হাতে আকাশের চাঁদটাকে ‘পেড়ে’ এনে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আমেরিকা ও সোভিয়েতের মধ্যে যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়। সেই যুদ্ধের উত্তাপে বারেবারেই তেতে উঠেছে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটি।
চাঁদ সম্পর্কে যত আবিষ্কার হয়েছে, ততই নতুনভাবে রহস্যের মোড়কে গা-ঢাকা দিয়েছে সে। সেই কবে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, চাঁদ আসলে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হচ্ছে না। বরং এর কিছু অংশ লুকোনো থাকে। ‘এই লুকোনো চাঁদ’-ই যে তাবড় রাষ্ট্রপ্রধানদের আস্তিনের গোপন ‘তাস’, সেটা অবশ্য ভিঞ্চি অনুধাবন করতে পারেননি। মহাকাশ বিজ্ঞানের এই ‘রাজনীতি’র পাশাপাশি অসংখ্য ব্যর্থতারও সাক্ষী চাঁদ। চন্দ্রলোকের দখল নিতে গিয়ে বারেবারে বড় রাষ্ট্রগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে। নাসার প্রকাশিত তালিকা ‘মুন ফ্যাক্ট শিট’ অনুযায়ী, সেই ১৯৫৮ সাল থেকে মোট ১০৯ বার চাঁদে মহাকাশযান পাঠিয়েছে বিশ্বের নানা দেশ, যার মধ্যে অন্যতম আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ইজরায়েল এবং ভারত। শেষ পর্যন্ত ২০১৯-এ চীনের একটি মহাকাশযান চন্দ্রপৃষ্ঠের সবচেয়ে দুরূহ স্থানে অবতরণ করেছিল।
এটাই ছিল ইসরোর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ! যে অংশে আমেরিকার মতো দেশের মহাকাশ গবেষকেরা চন্দ্রযান নামানোর ঝুঁকি নেননি। চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। খোদ ভারত বিফল হয়েছে চার বছর আগে। তবু হাল ছাড়েনি ইসরো। চাঁদের আঁধারে ঘেরা দক্ষিণ মেরুতেই দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় লক্ষ্যভেদ করেছে। কিন্তু কিসের টানে? কেন বিপদে মোড়া চাঁদের এই দক্ষিণ মেরুকেই বেছে নিয়েছে ইসরো? কী আছে সেখানে?
পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহের এই চত্বরে সর্বত্র পৌঁছয় না সূর্যের আলো। যেটুকু পৌঁছয়, তা কিছুটা তেরছা ভাবে। আলোর থেকে ছায়াই পড়ে বেশি। সূর্যালোক না পড়ায় চাঁদের দক্ষিণ মেরুর তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের অনেক নীচে। মাইনাস ২৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত নামতে পারে তাপমাত্রা। ফলে বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি বিগড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এই রুক্ষ পরিবেশের কারণে চাঁদের মেরু অঞ্চলগুলি অনাবিষ্কৃতই থেকে গিয়েছে। তবু ওই অংশটি নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ বহুদিনের। কারণ, এখানেই রয়েছে চন্দ্রলোকের সবচেয়ে পুরনো আর নানা উপাদানে সমৃদ্ধ এলাকা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে রয়েছে আইটকেন বেসিন। ধারণা করা হয়, কোটি কোটি বছর আগে একটি বিশাল উল্কাপিণ্ডের আঘাতের কারণে তৈরি হয়েছিল এই এলাকাটি।
২০০৯ সালে চন্দ্রপৃষ্ঠের এই তল্লাটেই ইসরোর চন্দ্রযান ১ জলের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছিল। চন্দ্রযান ২-এর অরবিটারও চাঁদে হাইড্রক্সিল এবং জলের উপস্থিতির সন্ধান দিয়েছে। ইসরোর বিজ্ঞানীদের আশা, চন্দ্রপৃষ্ঠে যেখানে জলের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে, সেখানে ‘লুনার ওয়াটার আইস’ বা বরফের খোঁজও মিলতে পারে। ২০২০ সালে নাসা এবং জার্মান এরোস্পেস সেন্টারের যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত সোফিয়া টেলিস্কোপ চাঁদের দক্ষিণ মেরু সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আবিষ্কার করে। জানা যায়, সেখানে জল এবং অন্যান্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে উপগ্রহটি। বিজ্ঞানীদের মতে, এই অংশে প্রাণের অস্তিত্বের জন্য উপযোগী সম্পদ পাওয়া যেতে পারে।
তবে চাঁদের দক্ষিণ মেরু যতটা সম্ভাবনাময়, ততটাই ‘বিশ্বাসঘাতক’। পদে পদে রয়েছে বিপদ এবং প্রতিকূলতার হাতছানি। গিরি এবং খাদ দুই-ই আছে। তার সংখ্যা চাঁদের অন্যান্য অংশের থেকে দক্ষিণ মেরুতে একটু বেশিই। সঙ্গে আবার উঁচু পাহাড়, বিশাল বিশাল কিছু খাদ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে খাদের বিস্তার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। যেখানে আজ পর্যন্ত পৌঁছয়নি সূর্যের আলো। তাই সেখানে থাকতে পারে জলীয় কণা, বরফ। তার সন্ধান করবে ভারতের চন্দ্রযান ৩-এর প্রজ্ঞান রোভার। একইসঙ্গে চাঁদের আগ্নেয়গিরি এমনকী, প্রাচীন সমুদ্রের উৎসেরও সন্ধান চালাবে। ভয় একটাই—আলো কম থাকায় উন্নত প্রযুক্তির মহাকাশযানও এই অংশে এসে কাবু হয়ে যায়।
ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বিক্রম ল্যান্ডার অবতরণের পর তার পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে রোভার প্রজ্ঞান। এরপর বিক্রম এবং প্রজ্ঞান একে অপরের ছবি তুলেছে। কাজ শুরু করেছে ল্যান্ডারের চার পে লোড— রম্ভা, চ্যাস্টে, ইলসা এবং অ্যারে। চারটি পে লোডের মধ্যে, চাঁদের বুকে সূর্য থেকে আসা প্লাজমা কণার ঘনত্ব, পরিমাণ এবং পরিবর্তনগুলি নিরীক্ষণ করছে রম্ভা। চ্যাস্টে মাপছে চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। একই সময়ে অবতরণস্থলের আশপাশের মাটির কম্পন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে ইলসা। পাশাপাশি ‘লেজার রেট্রোরিফ্লেক্টর’ অ্যারে চাঁদের গতিশীলতা বোঝার চেষ্টা করছে। একমাত্র উপগ্রহের প্রাকৃতিক কার্যপ্রণালী সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য নিরীক্ষণ করে তা পৃথিবীতে পাঠানোর দায়িত্ব এই চার পে লোডের কাঁধেই। আর একাধিক বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি নিয়ে চাঁদে নেমেছে রোভার প্রজ্ঞান। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চন্দ্রলোকের ভূমিরূপ কীভাবে তৈরি হয়েছে, কোন কোন উপাদান দিয়ে সেই মাটি তৈরি, সব খতিয়ে দেখে প্রজ্ঞান বার্তা পাঠাচ্ছে। স্পেকট্রোমিটার বিশ্লেষণের মাধ্যমে চাঁদের মাটিতে কোন ধরনের খনিজ বস্তু রয়েছে, তা খুঁটিয়ে দেখছে সে। খোঁজ চালাচ্ছে ‘হিমাটাইট’ নামে লোহার যৌগের। জানা গিয়েছে, দু’টি জটিল গ্যাসের সন্ধানও চালানো হচ্ছে।
চাঁদের চেয়ে এত ভালো ল্যাবরেটরি এই ব্রহ্মাণ্ডে আর কোথায় পেতে পারে ইসরো?