প্রচ্ছদ নিবন্ধ

মাফিয়া মার্ডার মিস্ট্রি

রামবাবুর গলায় হুমকির সুর
দেবাঞ্জন দাস: সালটা ১৯৯৬। নতুন বছর শুরু হতে তখনও মাসখানেক বাকি। সবে ‘রেলনগরীর আন্ডারওয়ার্ল্ড’ সিরিজের দুটো কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে। মেদিনীপুর শহরের মাইকো গলির যে বাড়িটা বর্তমান’এর জেলা অফিস বলে পরিচিত ছিল, এক বৃহস্পতিবারে সকাল ১০টা নাগাদ সেখানকার ল্যান্ড লাইনটা বেজে উঠল। ফোন ধরা মাত্র দক্ষিণ ভারতীয় ঢঙে হিন্দিতে ভেসে এল—‘নমস্কার, আমি রামবাবু, বাসব রামবাবু, খড়্গপুর থেকে বলছি।’ মেদিনীপুরে আসা ইস্তক যে নামটা সবচেয়ে বেশি শুনেছি, যার সাম্রাজ্য বিস্তারের কাহিনি নিয়ে প্রতিবেদন লেখা, সেই রামবাবু, গ্যাংস্টার, ডন! একটা ঠান্ডা স্রোত যেন নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। রিসিভারের অপরপ্রান্তের গলা কিন্তু নির্লিপ্ত —‘আপনি আমায় চেনেন না, অথচ আমাকে নিয়ে দুটো কপি লিখে ফেললেন! তাহলে 
একদিন আসুন, পরিচয় করি।’ লাইন কাটলেন ডন। জেলার ছাত্র রাজনীতির এক পরিচিত মুখের সঙ্গে রামবাবুর ‘দোস্তি’র বৃত্তান্ত শুনেছিলাম। সেও আশ্বস্ত করল, ‘যাও, ভালো স্টোরি মেটেরিয়াল পাবে।’
ঠিক দু’দিন পর আবার ফোন! এবার পি কৃষ্ণা রাও নামে একজন। দাড়ি, কমা না রেখে টানা বলে গেল—‘ভাইয়া (রামবাবু) আপনার সঙ্গে দেখা করবেন রবিবার বিকেলে। আমরা আপনাকে নিতে আসব।’ সেদিন ঠিক চারটের সময় নীল রঙের ঝকঝকে একটা এসইউভি নিয়ে হাজির হয়েছিল কৃষ্ণা। লম্বা, পেশিবহুল চেহারা, গলায় দুটো মোটা সোনার চেন, হাতে ততোধিক মোটা ব্রেসলেট। সঙ্গে বেঙ্কট রাও নামে আরও একজন এবং গাড়ির চালক দীপক বোরা। বলতে দ্বিধা নেই, ইষ্টনাম জপ করেই সেদিন গাড়িতে চেপেছিলাম। মোহনপুরর কাঁসাই নদীর ব্রিজ পার করে গাড়ি তখন ইন্দার পথে। খড়্গপুর শহরের অপরপ্রান্তে মথুরাকাঠি, রামবাবু সাম্রাজ্যের সদর দপ্তর। বাবা বাসব সত্যনারায়ণ ছিলেন রেলের কর্মী। সেই চাকরির সূত্রে পাওয়া কোয়ার্টারের সঙ্গে আরও চারটে জুড়ে নিয়ে নিজের কন্ট্রোল রুম বানিয়েছিলেন রামবাবু। বিকেলে সেই কন্ট্রোল রুমের সামনে গাড়ি থামতেই, জটলা করে থাকা এক ঝাঁক যুবকের নজর তখন আমার দিকে। সবার পরনে জিন্স, টি-শার্ট, পায়ে স্নিকার। যেন ডনের নিজস্ব বাহিনীর ইউনিফর্ম! পার্ক করা রয়েছে একগাদা মোটর সাইকেল। খয়েরি রংয়ের সাফারি স্যুট, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, হাতজোড় করে এগিয়ে আসা লোকটা নিজের নাম জানাল কঙ্কর রাও। বললেন—‘আইয়ে দাদা, আপ হি কা ইন্তেজার হো রাহা থা।’
পাঁচিল ঘেরা গোটা চত্বর। কয়েক হাত অন্তর অন্তর শক্তপোক্ত চেহারার একজন করে ছেলে দাঁড়িয়ে, পাহারাদার। ভিতরে না ঢুকলে বোঝার উপায় নেই, রেল কোয়ার্টারের ভিতরে এহেন ‘আলিশান’ ড্রইং রুম। নিঃশব্দে চলছে ঠান্ডি মেশিন, দামি সোফা, দেওয়ালে ঝুলছে ভগবান বালাজি স্বামীর তৈলচিত্র, ঘরের কোণে সুদৃশ্য ‘পেগাসাস’। ‘বৈঠিয়ে দাদা, ভাইয়া পুজা কর রাহা হ্যায়, আভি আয়েঙ্গে’—কঙ্করের কথা শুনে সোফায় বসেই পড়লাম। কাচের গ্লাসে শরবত এল। ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। উল্টোদিকের সোফায় আরও একজন বসে। পরে জেনেছিলাম, লোকটা প্রসাদ টাডি, রামবাবু সাম্রাজ্যের একজন ম্যানেজার। মাঝে ফাঁকা একটা আরাম কেদারা, সাদা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। এরই মাঝে ঘরে ঢুকল সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণ। তেলুগু ভাষায় কথা বলছিল কঙ্করের সঙ্গে। পাশে জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়স্ক আরও একজন, যার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রসাদ। 
ধুনোর গন্ধটা একটু একটু করে প্রকট হচ্ছিল। একসময় ধোয়ার ভরে গেল ঘরটা। কালো লুঙ্গি, কালো শার্ট, গলায় গোটাচারেক সোনার চেন, সোনায় মোড়া একটা রুদ্রাক্ষের মালাও ঝুলছে, দু’হাতে মোট আটটা আংটি, কপালে কালো তিলক সঙ্গে হাতে ধরা ধোয়ার উৎস সেই ধুনুচি! একজন এসে ধুনুচিটা নিয়ে গেল। পেশিবহুল চেহারা, সুদর্শন, দীর্ঘকায় লোকটাকে এবার স্পষ্ট দেখা গেল। ভারী গলায় কঙ্করের কাছে জানতে চাইলেন, দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কে? ‘ভাইয়া ইয়ে জামশেদপুর পার্টি!’ কঙ্কর কথাটা শেষ করা মাত্রই রামবাবুর গলায় হুমকির সুর—‘বিপদ ডেকে আনবেন নাকি তিন পার্সেন্ট দেবেন, এখানেই ঠিক করুন, এখনই!’ এবার আমার দিকে তাকিয়ে প্রসাদকে প্রশ্ন—আর ইনি? ‘ভাইয়া, ইয়ে দেবাঞ্জনজি, আপনে বুলায়া!’ মুহূর্তে রামবাবু হয়ে উঠলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিনয়ী। ‘সরি দাদা, পুজো করছিলাম, অনেকক্ষণ বসতে হল!’ শাগরেদদের কাছে জানতে চাইলেন, কিছু খেয়েছি কি না! শরবতের কথা শুনে রেগে গেলেন। হুকুম দিলেন, ‘মিঠাই লাও।’ সাদা তোয়ালেটা সরিয়ে বসে পড়লেন আরাম কেদারায়। দেখা মিলল এক প্রবীণার। ডন জানালেন, মা, কমলা বাই। দু’হাত নিজে নিজে উঠে প্রণাম জানাল। 
সেই সময় দক্ষিণ-পূর্ব রেলের টেন্ডার, ঠিকাদার, ঠিকাদারি আর স্ক্র্যাপ কেনাবেচা কারবারের নিয়ন্ত্রক—ডন বাসব রামবাবু। আর হ্যাঁ, জড়সড়ো হয়ে থাকা লোকটাকে ততক্ষণে কঙ্কর বাইরে নিয়ে গিয়েছেন। ঠায় দাঁড়িয়ে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সেই তরুণ। রামবাবুই নাম বললেন ছেলেটার—‘শ্রীনু! কাম কা লেড়কা।’ লজ্জা মিশ্রিত হাসি মুখে রামবাবুর হাঁটুতে একটা পেন্নামও ঠুকে দিল এ শ্রীনিবাস নাইডু। পাঁচ বছর পরে সেই শ্রীনুই কেড়ে নিয়েছিলেন ডনের মসনদ। 
সেদিন মথুরাকাঠির ‘এপি সেন্টার’এ বসে রামবাবু শুনিয়েছিলেন, ১০০ টাকা রোজে ঠিকেদারি কারবারের পাহারাদার থেকে কীভাবে ‘মেহনত’ করে গড়ে তুলেছেন নিজের ‘কারবার’। পরে জেনেছিলাম, প্রায় ১০০ যুবকের গ্যাং বানিয়ে ‘ভাইয়া’ রেল স্ক্র্যাপের কারবারিদের কাছ থেকে মাসে পাঁচ লক্ষ টাকারও বেশি ‘রংদারি ট্যাক্স’ (অনেকেই বলেন, ওটা আসলে প্রোটেকশন মানি) আদায় দিয়েই তাঁর শুরু। সেদিন রামবাবু শুনিয়েছিলেন, কীভাবে খড়্গপুরের ‘তেলুগুভাষী’ যুবকদের একটা বড় অংশকে তিনি ‘ভাত’ জোটাচ্ছেন, আর কীভাবেই বা মিটিয়েছেন লালপার্টি আর তাদের নেতা-চামচাদের নানা আব্দার। সিপিএম সংস্রব ত্যাগের ইঙ্গিতও সেবার দিয়েছিলেন ডন। আর শোনান, গার্ডেনরিচ থেকে টাটা হয়ে ভাইজাগ পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যে কীভাবে ফাটল ধরাতে চাইছেন সিপিআইয়ের প্রাক্তন এমপি নারায়ণ চৌবের দুই ছেলে গৌতম ও মানস। মেদিনীপুর ছাড়ার আগে রামবাবুর সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল যেদিন, সেদিন প্রবীণ জননেতা অশোক ঘোষের হাত ধরে ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি জেনে রেগে কাঁই হয়েছিলেন স্বয়ং জ্যোতি বসু! কিন্তু ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’কে ছাড়েনি ফব।
এরপর কাঁসাই নদী দিয়ে বিস্তর জল গড়িয়েছে। এই আবর্তেই প্রতিপক্ষ মানসকে ১৯৯৯ সালের ২৭ জুন আর তাঁর দাদা গৌতম চৌবেকে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেয় রামবাবুর গ্যাং। পুলিস রেকর্ডে আছে, মানস খুনের দিন মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে ঘটনাস্থলের কিছুটা দূরে গাড়িতে বসেছিলেন ডনের স্ত্রী বি মঞ্জু। ‘ভাইয়া’ তখন অন্ধ্রপ্রদেশে ডেরা সরিয়ে নিয়েছেন। খড়্গপুরের কারবার সামলানোর দায়িত্বে মঞ্জুই। অন্ধ্রপ্রদেশে রামবাবুর সঙ্গে থাকছে নিজের ভাই বি শ্রীনিবাস রাও, বিশ্বস্ত সহচর কঙ্কর, ছোটা শ্রীনু, আর চিন্না, পি কৃষ্ণা রাও, সঞ্জয় ঠাকুর এবং দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী গাড়ি চালক দীপক বোরা। কখনও ভাইজাগ, কখনও শ্রীকাকুলাম, কখনও বিজয়ওয়াড়া আবার কখনও হায়দরবাদে গা-ঢাকা দিচ্ছিলেন রামবাবু। খড়্গপুরে প্রতিপত্তি বাড়ছিল গৌতম চৌবের। খুঁজছিলেন ভাইয়ের খুনের বদলা নেওয়ার রাস্তা। তদন্তকারী এক পুলিস অফিসার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) বলেছিলেন, অন্ধ্রপ্রদেশে বসেই গৌতমকে খুনের ছক কষেছিল রামবাবু। ২০০১ সালের পয়লা নভেম্বর হায়দরাবাদের যোগিতা সার্কিটের এক অতিথিশালার ২০১ নম্বর রুম থেকে ছয় শাগরেদ সহ অন্ধ্র পুলিসের সহযোগিতায় ‘ডন’কে গ্রেপ্তার করে বাংলার উর্দিধারীরা। জোড়া খুনের ঘটনায় জেলে যান রামবাবু। দীর্ঘ ৯ বছরেরও বেশি সময় খড়্গপুর ছাড়া ‘ভাইয়া’! সেই শূন্যস্থান পূরণ করে রেলনগরীর নয়া ডন হয়ে ওঠে শ্রীনু। গুরু মারা বিদ্যে!
তবে খড়্গপুর থেকে রামবাবুর প্রভাব কমাতে পারছিলেন না শ্রীনু! ঠিক হয়, এবার একেবারে খতম অভিযান! সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দুপুরে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের গেট পার করে যখন বাইরে আসেন রামবাবু, বাইরে তখন অপেক্ষারত হাজার পাঁচেক মানুষ। ফুল-মালায় মোড়া ‘ভাইয়া’ রওনা দেন খড়্গপুরের মালঞ্চতে তাঁর নতুন বাড়িতে। তাঁর ‘কাফিলা’ যখন মোহনপুরে কাঁসাই নদীর ব্রিজে, আচমকাই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে রামবাবুর গাড়ি লক্ষ্য করে। রামবাবুকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন বেঙ্কট রাও নামে এক ব্যক্তি। গুলিতে জখম হয়েছিলেন আরও এক পথচারী। ‘ভাইয়া’ বাড়ি ফিরে আসেন। একদিকে হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন, অন্যদিকে মসনদ কেড়ে নেওয়া শ্রীনুকে ‘হটানোর’ পরিকল্পনার নিেয়। ২০১৬ সালের শেষের দিকে হঠাৎই খড়্গপুর থেকে বেপাত্তা হয়ে যান তিনি। ফের সিঁদুরে মেঘ দেখছিল ওয়াকিবহাল মহল! আশঙ্কাই সত্যি হল ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি। খড়্গপুরের নিউ সেটেলমেন্ট কলোনিতে নিজের তৈরি তৃণমূল পার্টি অফিসে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বসেছিল শ্রীনু। মুখ ঢাকা আততায়ীরা এসে তাঁকে এবং ঘনিষ্ঠ সহচর ডি ধর্মাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। তুমুল আলোড়ন শুরু হয় গোটা রাজ্যেই। তদন্তে নেমে অন্ধ্রপ্রদেশের ওরাঙ্গল থেকে খড়্গপুরের ডনকে গ্রেপ্তার করে পুলিস। জানা যায়, ‘খতম’ অভিযানে তাঁকে সাহায্য করেছিল শ্রীনুর কারবারের ম্যানেজার শঙ্কর রাও। পুলিসের বক্তব্য, তাকে ৫০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন রামবাবু। আর ঝাড়খণ্ডের দুই সুপারি কিলার রাধেশ্যাম সিং ও রঞ্জু সিং পেয়েছিল ২৫ লক্ষ টাকা করে।     

মাথা লক্ষ্য করে গুলি, ‘ডন’মোগল খতম!
সুজিত ভৌমিক: শালে কো খতম কর দো....। আঁধার ভেদ করে ছিটকে আসা এই কর্কশ চিৎকার কুয়াশায় মোড়া শীতের রাতে সন্ত্রস্ত করে দিল পথচলতি জনতাকে! মুহূর্তে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল রাজপথে। পর পর ছ’-সাত বার গুলির শব্দ। তারপর একটাই আওয়াজ.... ‘মোগল খতম’। রিভলভার হাতে আট-দশ জনের দুষ্কৃতীদল এক লহমায় মিলিয়ে গেল আঁধারে। তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে আয়রন গেট রোড। রাজপথে লুটিয়ে বন্দরের অঘোষিত ‘ডন’ মোগল ওরফে মহম্মদ জাহাঙ্গির। স্থানীয় নার্সিংহোমে থেকে এসএসকেএম নিয়ে গেলেও লাভ হল না।
গ্যাংওয়ারে খুন হয়েছেন মোগল। খবর ছড়িয়ে পড়ল বন্দর এলাকায়। রাতেই পথে নামল উত্তেজিত জনতা। আসলে বন্দর এলাকায় মোগলের ‘রবিনহুড ইমেজ’ ছিল। কারণ, ছোটখাট তোলাবাজিতে থাকত না মোগল গ্যাং। মূলত, বন্দরের কোটিপতি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আসত তাঁর কাছে। সেই টাকার একটা অংশ থেকেই গরিব মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন মোগল। তাই তাঁর জনপ্রিয়তা অস্বীকার করার উপায় ছিল না। ফলে জনতার রোষ গিয়ে পড়ল পুলিসের উপর। যেন তাদের নিষ্ক্রিয়তায় খুন হয়েছেন মোগল! লালবাজার থেকে বাড়তি বাহিনী গিয়ে কোনওমতে পরিস্থিতি সামাল দিল বটে। কিন্তু প্রথম থেকেই আততায়ীকে গ্রেপ্তারের চাপ বাড়ছিল কলকাতা পুলিসের উপর। তদন্তে নেমে প্রথমে আবুজার হুসেনকে গ্রেপ্তার করে লালবাজার। উধাও হয়ে যায় মূল অভিযুক্ত দারেন। বাধ্য হয়ে তাকে পলাতক দেখিয়ে চার্জশিট পেশ করে লালবাজার। এক বছর পর অবশ্য গ্রেপ্তার হয় সে। 
দিনটা ছিল ২০০১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। সময় রাত পৌনে দশটা। গার্ডেনরিচের বাঙালি বাজারের দিক থেকে সেদিন একাই হেঁটে আসছিলেন মোগল। বি-৩৫ আয়রন গেট রোডের মুখে পথ আটকাল দারেন, আবুজার হোসেন এবং তাদের আট থেকে দশজন সশস্ত্র সঙ্গী। ঘটনাচক্রে যারা কি না একদা মোগল সঙ্গীও বটে। 
তারপরের কাহিনিটা শুনুন, আততায়ী দারেনের মুখেই...। তাকে ঘিরে গোয়েন্দাদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না। বিশেষ করে, মেরেকেটে পাঁচ ফুট উচ্চতার দারেন কোন কৌশলে মোগলের মতো ছ’ফুটের ডনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে পারে? প্যারোলে ছাড়া পাওয়ার পর নিয়মিত গার্ডেনরিচ থানায় হাজিরা দিতে আসতে হতো দারেনকে। তখনই এক গোয়েন্দাকে গল্পের ছলে সে বলেছিল, ‘সেদিন আমিই প্রথমে ধাক্কা মেরেছিলাম মোগলকে। আমার মতো এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর কাছ থেকে এই অপ্রত্যাশিত ধাক্কাটাই সেদিন মানসিকভাবে ঘায়েল করে তাঁকে। ফলে মাটিতে ছিটকে পড়ে মোগল। তারপর আর সুযোগটা হাতছাড়া করিনি। বুকের উপর পা রেখে সটান মাথা লক্ষ্য করে পর পর গুলি চালিয়ে দিলাম! ...ব্যস! মোঘল খতম!’
বহিরাগত কারও হামলায় নয়, নিজের গ্যাংয়ের হাতেই সেদিন খুন হতে হয়েছিল মোগলকে। আর পাঁচটা ‘গ্যাং ওয়ার’-এর মতোই বন্দরের ডনের হত্যাকাণ্ডে চিত্রনাট্যে অদ্ভুত মিল! অর্থাৎ মূল বিরোধটা সেই ‘বখরা’ নিয়েই। তখন বন্দর এলাকায় মোগলের নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। তাঁর মুখের উপর কথা বলার সাহস তখন কারও ছিল না। বন্দরে টেন্ডার দখল, মাল খালাস, লেবার সাপ্লাই, গুদাম ভাড়া, স্মাগলিং, স্ক্র্যাপ লোহার কারবার—সবেতেই তখন শেষ কথা তিনি। 
এহেন দোর্দন্ডপ্রতাপ মোগলের মুখের উপর একদিন ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে নিজের অসন্তোষ জানিয়েছিল দারেন। বিষয়টি মোটেই ভালো ভাবে নেননি বন্দরের অঘোষিত ‘ডন’। গ্যাং তো বটেই, এমনকী দুনিয়া থেকে দারেনকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা তিনি করে ফেলেন। কারণ, আন্ডারওয়ার্ল্ডের অলিখিত নিয়ম, কোনও ইস্যুতে গ্যাং লিডারকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানেই মৃত্যু অবধারিত।
দারেনকে নিকেশ করতে তাই আদতে বিহারের আদি বাসিন্দা মোগল ‘সুপারি’ তুলে দিলেন গয়ার শার্প শুটারদের হাতে। এমনকী সেই শার্প শ্যুটারদের দল বন্দর এলাকায় ‘রেইকি’ও করে গিয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি কোনওভাবে জেনে ফেলে দারেন, যার মাসুল দিতে হয়েছিল মোগলকে। অন্ধকার জগতে একটাই নীতি—হয় মারো, নয় মরো। বেঁটেখাটো চেহারা ও হিমশীতল ঠান্ডা মাথার দারেন তাই দেরি করেনি। যদিও গোয়েন্দাদের প্রশ্নের উত্তরে তার সাফাই ছিল, বাধ্য হয়েই পাল্টা মারের পথে হেঁটেছিলাম।
লালবাজারের অবশ্য নথি বলছে, গ্যাংওয়ারে জেরে খুন হন মোগল। গার্ডেনরিচের ভিক্টোরিয়া জুট মিলে লেবার সাপ্লাই নিয়ে মোগল আর দারেনের মধ্যে বিবাদ বাধে। তার জেরেই এই খুন। আর দারেন? প্যারোল শেষে এখন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সেই খুনির ঠিকানা ফের জেল!

যিশুর মাথা ছিল বরফের মতো ঠান্ডা
তন্ময় মল্লিক: ৩১ মার্চ, ১৯৮৩। ভরদুপুরে বার্নপুরে খুন হয়ে গেলেন বিষ্ণু সাউ। বিষ্ণু সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করত। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই ফের খুন। এবার বিজয়। ২৪ জুন অবার খুন। সুমন ঝা। দু’জনেই বিষ্ণুর গ্যাংয়ের। তিন মাসে তিনজন খুন। পুলিস খোঁজ নিয়ে জানল, টিকিট ব্ল্যাক নিয়ে বিষ্ণুর টিমের কালিয়ার সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল সিনেমাহলের টিকিট কাউন্টারের কর্মী সুকুমার বিশ্বাস ওরফে যিশুর। একটা হিট সিনেমার থার্ড ক্লাসের সব টিকিট দাবি করেছিল কালিয়া। সুকুমার আপত্তি করতেই রড নিয়ে আক্রমণ। কোনওরকমে প্রাণে বাঁচেন। কিন্তু প্রতিশোধের ‘খুন’ চেপে যায় সুকুমারের মাথায়। খুনের পিছনে কার হাত আছে, তা পুলিসের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। অথচ কোনও অজ্ঞাত কারণে তারা স্টেপ নিল না। ফলে সুকুমার রাতারাতি হয়ে উঠলেন ‘যিশু বস’।
রাজ্যে তখন দ্বিতীয়বার সরকার গড়েছে বামফ্রন্ট। কিন্তু কিছুতেই ইস্কোয় ঢুকতে পারছে না সিটু। ‘পথের কাঁটা’ আইএনটিইউসি নেতা কানু গুহ ও তাঁর ভাই বাপি। সিপিএমের এক প্রবীণ নেতার নজর পড়ল যিশুর উপর। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে দূত মারফত গেল প্রস্তাব। কিন্তু যিশু রাজি হলেন না। তখন বাপি গুহর সঙ্গে তাঁর জোর টক্কর। লক্ষ্য বার্নপুরের ‘আনচ্যালেঞ্জড ডন’ হওয়া। সকালে যেখানে বাপির লোকজন বোমাবাজি করে, বিকেলে সেখানেই পাল্টা হামলা চালায় যিশুর টিম। ’৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিন মস্তানকে তুলে নিয়ে যায় বাপির টিম। তাদের ছিনিয়ে আনতে পারলেই হবে বাজিমাত। তাই শুরু হল তল্লাশি। দিনভর যিশুর টিমের সদস্যদের ইয়াজদি বাইকের কানফাটা শব্দে তটস্থ বার্নপুর। হঠাৎ সন্ধের মুখে চোখে পড়ল বারি ময়দানের কাছে জটলা। বাপির টিম ভেবে সেদিকেই ছুড়ে দেওয়া হল বোমার ব্যাগ। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। তবে, বাপি নয়, খুন হয়ে গেলেন বার্নপুর থানার এএসআই রবিলোচন দাস। যিশুও বুঝে গেলেন, এবার না পালালে এনকাউন্টারে মরতে হবে।
সত্যিই তাই! দারোগা খুন হওয়ায় পুলিস চটেছিল ভয়ঙ্কর। অনেক চেষ্টা করেও এলাকায় ঢুকতে পারছিলেন না যিশু। তাই এতদিন লেজের ঝাপটায় বারবার সরিয়ে দেওয়া ‘টোপ’টাই শেষপর্যন্ত গিললেন। রফা হল, ‘পথের কাঁটা’ সরিয়ে মসৃণ করতে হবে সিপিএমের ইস্কোয় পা রাখার রাস্তা। বিনিময়ে যিশু পাবেন ঠিকাদারির ছাড়পত্র।
এক দুপুরবেলা ইস্কো গেটে চা খাচ্ছিলেন কানু গুহ। সেই অবস্থায় তাঁর গলায় ক্ষুর চালিয়েই যিশুর টিম পেটে ভরে দিল বুলেট। কপাল জোরে বেঁচে গেলেন কানুবাবু। তবে হাসপাতালে থাকতে হল অনেকদিন। সেই সুযোগে ইস্কোর ১০ নম্বর ব্যাটারির দখল নিল সিপিএম। আর ‘যিশু বসে’র নতুন পরিচয় হল, ‘কনট্রাক্টর’। শুধু ঠিকাদারি নয়, অন্য ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা কমিশন, গাড়ি থেকে গুন্ডা ট্যাক্স আদায়—সবই চলত। তার প্রতিদানে? নির্বাচন এলে বিরোধীদের চমকানো, ধমকানো। তাতেও কাজ না হলে খুন। তবে দৌড় করিয়ে। মানুষ যেন খুনের কারণ বুঝতে পারে। তবেই না খালি হবে ময়দান! এভাবেই খুন করা হয় সুকুমার দাস, শঙ্কর গুপ্তকে।
এক পুলিস অফিসারের কথায়, ‘যিশুর মাথা ছিল বরফের মতো ঠান্ডা। খুনের ঘটনায় পুলিস পিছু নিলেই থানায় পৌঁছে যেত ওর টিম। বলত, কাজটা বস করেনি, আমরা করেছি। পুলিস তাদের অ্যারেস্ট করত। ফলে সবাই চুপ করে যেত। এই ছিল যিশু। প্রশাসন ও পার্টির প্রতি দায়বদ্ধ। তাই রাজ্যে ক্ষমতা বদলালেও সে লাইন বদলায়নি।’
প্রথমে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, পরে সিনেমাহলের কর্মী। সেখান থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক। সবেরই সৌজন্যে শাসক দল। আরও খুলে বললে, সিপিএম। দাপটের সুবাদেই পেয়েছিলেন বার্নপুর নেহরু পার্কের লিজ। তাঁকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য সেই পার্ককেই বেছে নিয়েছিল আততায়ীরা।
২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি। পার্কে উপচে পড়া ভিড়। বছরের প্রথম দিনটা পরিবারের সঙ্গে কাটানোর প্ল্যান করেছিলেন যিশু। পার্কের ক্যান্টিনেই ছিল খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। খাওয়ার টেবিলে বসতেই একজন খবর দিলেন, ‘বোটিংয়ের কাছে খুব ঝামেলা হচ্ছে।’ স্ত্রী খেয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু শোনেননি। ‘এখনই আসছি’ বলে বেরিয়ে যান। বোটিংয়ের কাছে যাওয়ার আগেই প্রথম গুলিটা মাথায়। তারপর গোটা শরীরে। মোট আটটা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ‘যিশু বস’। তপ্ত সীসার দুরন্ত আঘাতে তিন দশকের ‘সন্ত্রাসের নায়কে’র জীবনে পড়ল পূর্ণচ্ছেদ।
সাপুড়ের মৃত্যু হয় সাপের ছোবলে। তেমনই ‘ডন’, ‘মাফিয়া’, ‘গ্যাংস্টার’ হয়ে ওঠা মানুষগুলোর পরিণতিও এটাই। শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায় বুলেটের আঘাতে। ক্রমশ লম্বা হচ্ছে ‘যিশু’দের লিস্ট। নবতম সংযোজন রাজু ঝা। কর্মজীবন শুরু লরির খালাসি হিসেবে। কয়লার কারবারে কোটি কোটি টাকাও কামান। কিন্তু পরিণতি একই। এর আগে অধিকাংশ মাফিয়া খুনের কিনারা হয়নি। রাজুর ক্ষেত্রেও কি ব্যতিক্রম আশা করা যায়?
14Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা