প্রচ্ছদ নিবন্ধ

রাজধানী  কলকাতা 
গেল দিল্লিতে
হরিপদ ভৌমিক

কলকাতা একদিন গ্রাম ছিল। ডিহিদার আস্তানা গাড়লে ‘ডিহি কলকাতা’ নাম পায়। ১৬৭৬ সালে কবি কৃষ্ণরাম দাসের ‘কণিকা মঙ্গল’-এর সময়কালে ‘পরগনা-কলকাতা’কে পাই। ১৬৯৮ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতা-সুতানটি-গোবিন্দপুর তিনটি গ্রাম মিলে জমিদারি সত্ত্ব লাভ করে ইংরেজ কোম্পানি। এই সময় থেকে তারা কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ধীরে ধীরে পলাশির যুদ্ধের পর ভারতের শাসক হন। সেই সময় থেকে ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান নগরীর মধ্যে মুকুটমণির সম্মানে সম্মানিত ছিল কলকাতা। লর্ড ক্লাইভ স্বদেশে ফিরে গেলে সমগ্র দেশে একটা বিশৃঙ্খলা ভাব দেখা যায়।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে সিপাহী বিদ্রোহের পর দিল্লির মোঘল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তাচলে, এই সময়কালে কলকাতার জাতীয় ভাবনার বীজ রোপিত হয়। এই প্রসঙ্গে রসরাজ অমৃতলাল বসু স্মৃতিকথায় লিখেছেন— ‘১৮৬৭-৬৮ সালে ভারতবর্ষে ‘ন্যাশনাল’ নামের চার অক্ষরের স্বাধীনতার বীজমন্ত্র যিনি প্রথম দিয়েছেন তাঁর নাম নবগোপাল মিত্র। লোকে বলত, ‘ন্যাশনাল নবগোপাল’। উনিশ শতকের নয়ের দশকে প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি হল। ইংরেজ সরকারের বিষদৃষ্টি পড়ল বাংলা ও বাঙালির উপর।
১৮৯৮ সালে কার্জন সাহেব কলকাতায়  আসেন। বুদ্ধিজীবী মানুষেরা ভাবলেন এবার হয়তো নিয়মের শাসন চালু হবে। উল্টোটা হল। কার্জন হয়ে উঠলেন বাঙালি বিদ্বেষী। ১৯০৩ সালে শুরু হল কার্জন বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। বুদ্ধিমান বাঙালি জাতটাকে খোঁড়া করে দিতে কার্জন শুরু করল নতুন ভাবনা-চিন্তা। খবরে প্রকাশ পেল তিনি দেশভাগ বা সীমান্ত বিন্যাসের ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছেন। বাংলার গা ছুঁয়ে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রদেশ গড়ে তুলতে পারলে মোচকে দেওয়া সহজ হয়ে যাবে বাঙালির মেরুদণ্ড।
অন্যদিকে, বাঙালির হিন্দু-মুসলমান ঐক্য যাতে ভেঙে না যায় তার মুক্তির উপায় হিসাবে ‘রাখী বন্ধন’ (১৯০৫) অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিবাদ সংগঠিত হতে শুরু করে। ৭ আগস্ট তারিখে টাউন হলে বিরাট জনসভা, দোকানপাট-স্কুল-কলেজ সবকিছু মিলিয়ে পুরোপুরি কলকাতা বন্ধ। টাউনহলে এত মানুষ হলো যে ভিতরে এবং বাইরে আলাদা মঞ্চ করে বক্তব্য রাখতে হলো। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন— ‘আশ্বিনের তিরিশে বাংলাদেশ বিভক্ত করে সরকারিভাবে, কিন্তু সেটা যে ঈশ্বরের অভিপ্রায় নয় তা প্রমাণ করতে হবে আমাদের। ঐ দিনটিকে আমরা উদযাপন করব রাখী বন্ধনের ভিতর দিয়ে। যাতে ফুটে উঠবে বাঙালি জাতির অবিচ্ছিন্ন একতার বাণী।’
১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ৩০ আশ্বিন সার্বজনীনভাবে রাখী বন্ধন অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকার বাংলায় ধর্মীয় বিভেদের বিষ-বাতাস ছড়িয়ে দিতে প্রচার করল রাখী বন্ধন হিন্দুয়ানির মাতামাতি, এই উৎসব হিন্দু জাগরণের উৎসব। ধীরে ধীরে সরাতে শুরু  করল মুসলিম সম্প্রদায়কে।
১৯১০ সালে বড়লাট অর্থাৎ গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্চ কলকাতায় এলেন। এই সময় প্রতিদিন কলকাতা জুড়ে স্বদেশি আন্দোলন যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারি দমন-পীড়নও বেড়েছিল। ৮ জানুয়ারি ১৯১১ তারিখে গিরিশ ঘোষের ‘মীরকাশিম’ নাটকটির অভিনয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২ মার্চ তারিখে ডালহৌসিতে পুলিসের গাড়ি ভেবে ভুল করে অন্য একটি গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করার অপরাধে ১৮ বছরের ননীগোপাল মুখার্জি গ্রেপ্তার হন। ১৯ মার্চ এক ঘোষণায় জানানো হয় ‘জলপথে বা স্থলপথে গুরমুখী ভাষায় মুদ্রিত ‘স্বদেশী সেবক’ বহন করা বা রাখা নিষিদ্ধ করা হল।’
চারিদিকে আন্দোলন জোরদার হতেই,  আন্দোলনের মুখ ঘুরিয়ে দিতে বঙ্গভঙ্গ রোধ করা হবে বলে প্রচার করা হল,  খবরটি দিল ‘দি ইংলিশ ম্যান’— সেই সংবাদটির উদ্ধৃতি দিয়ে অমৃতবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে— ‘শোনা যাচ্ছে বঙ্গভঙ্গ রোধ করা হবে। বেকারকে পদত্যাগ করতে হবে— পুনগর্ঠিত বঙ্গের গভর্নর হবেন স্যার জন হেয়ার্ট।’  খবরটি প্রকাশিত হল ৯ জুন ১৯১১ সাল।
১৯১১ সালে জুলাই-আগস্ট মাসে দুটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছিল। ২৯ জুলাই তারিখে প্রথম আই.এফ.এ শিল্ড ফুটবল খেলা শুরু হয় ইস্ট ইয়র্ক দলের সঙ্গে মোহন বাগান দলের। ১১ জন বাঙালি খেলোয়াড় খালি পায়ে বুট জুতো পরা গোড়া সৈন্যদের মুখ থেকে জয়ের গৌরব ছিনিয়ে সাহেবী লালমুখগুলোকে কালো দিয়েছিল। সেই ফুটবল যুদ্ধ জয়ের উন্মাদনা স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে পূর্ণেন্দু পত্রী ‘কলকাতা সংক্রান্ত’ বইতে লিখেছেন— ‘আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ের সমকক্ষ হয়ে উঠল যেন ঘটনাটা। কলকাতা উল্লাসে মাতল, উল্লাসে উন্মাদ। মানুষের আবেগের ছাপ সংবাদপত্রের পাতাতেও সংবাদে, রিপোর্টে সম্পাদকীয় মোহন বাগানের ‘ইমমর্টাল ইলেভেন’-এর সংবর্ধনা। নির্বাক দর্শক হয়ে বসে নেই কবির কলম। সুরেন্দ্রনাথের ‘বেঙ্গলী’-র পাতায় বেরল এক প্রশান্তি গাঁথা। ‘থ্যাঙ্কস মাই ফ্রেন্ড ফুটবল রিনাউন
ফর ব্রিইংইং দ্য ব্রিটিশ টিমস ডাউন
এ ভিকট্রি গ্র্যান্ড টু বি হোল্ড,
সিরিন অ্যান্ড নোবল— ব্রাইট অ্যান্ড বোল্ড।’
ইংরেজি স্তব গানকে হার মানাতে কবি  করুণানিধন বন্দ্যোপাধ্যায় হাতে তুলে নিলেন বাংলা ছন্দের একতারা—
‘জেগেছে আজ দেশের ছেলে
পথে লোকের ভিড়,
অন্তঃপুরে ফুটল হাসি
বঙ্গ রূপসীর।
গোল দিয়েছে গোরার দলে
বাঙালির আজ জিত,
আকাশ ছেঁয়ে উঠছে উধাও
উন্মাদনার গীত।’
ফুটবল-যুদ্ধের এই জয় তাই তখন হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের আসন্ন অবশ্যম্ভাবী জয়ের প্রতীক।’
৭ আগস্ট ১৯১১ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা ১৬৬ নং বহুবাজার স্ট্রিটে স্বদেশি মেলার উদ্বোধন হয়। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির প্রস্তাবে এ.চৌধুরি সভাপতি হন ও উদ্বোধন করেন।  ১১ আগস্ট দিন স্বদেশি মেলায় প্রবেশাধিকার ছিল শুধু মহিলাদের। ১২ তারিখে প্রায় ৬০ হাজার লোক মেলা দেখতে যায়। তাই মেলা কমিটি আরও এক সপ্তাহ মেলা খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭ তারিখে মেলার পুরস্কার বিতরণী সভায় ভূপেন্দ্রনাথ বসু সভাপতিত্ব করেন। ৫ নভেম্বর তারিখে ঘনঘন জনসভা করে রাজা আসার আগেই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত তুঙ্গে তোলার আবেদন রাখেন। সকলে আশা করতে শুরু করেছে নতুন গভর্নর হয়তো নিজের মহানুভবতায় দু’টুকরো বাংলাকে জুড়ে দেবেন। জেলায় জেলায় সই সংগ্রহ শুরু হয়।
একদিকে ফুটবল যুদ্ধে সাহেবদের হারিয়ে আনন্দে যখন আত্মহারা, স্বদেশি মেলার জনসমর্থন স্বদেশি আন্দোলনকে জোরদার করার প্রস্তুতি চলছে— তখন রাজভবনে চলছে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের খসড়া তৈরির প্রস্তুতি। পরের মাসে ২৫ তারিখে হার্ডিঞ্চ রচিত ষড়যন্ত্রের খসড়াটি বিলেতের উদ্দেশে পারি দিল। সে খসড়াটির অফিসিয়াল নাম হল— ‘অফিসিয়াল ডেসপ্যাচ রিলেটিং টু দ্যা ট্রান্সফার অফ দ্যা শিট অফ গভর্নমেন্ট ফ্রম ক্যালকাটা টু দিল্লি।’ ২৫ আগস্টে লেখা এই ডেসপ্যাচের শব্দ সংখ্যা ৮ হাজারের মতো, ২৬টি পরিচ্ছদ। দ্বিতীয় পরিচ্ছদ থেকেই রাজার কাছে নিবেদন কী কী কারণে কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। মূল বক্তব্য
(১) দিল্লি সবচেয়ে নির্ভরশীল আদর্শ জায়গা।
(২) বঙ্গ বিভাগের ফলে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক আবহাওয়া ঘনিয়ে উঠেছে, তার থেকে দূরে থাকার জন্য ভারতের রাজধানীর এই প্রদেশিক পরিমণ্ডল থেকে স্থানান্তরিত হওয়া জরুরি।
(৩) ‘সুপ্রিম গভর্নমেন্ট’ কখনও ‘প্রভেন্সিয়াল গভর্নমেন্টে’-এর গায়ে গা লাগিয়ে থাকতে পারে না। দুটি গভর্নমেন্টের বর্তমান সদর দপ্তর কলকাতায়।
(৪) বিশেষ কোনও পরিস্থিতিতে কলকাতা কীভাবে গড়ে উঠেছিল তা অবশ্যই আমাদের অজানা নয়।
(৫) সারা দেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার হওয়ায় সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দেশের মাঝামাঝি জায়গায় হওয়া উচিত।
(৬)  ভৌগলিক, ঐতিহাসিক আর রাজনৈতিক— এই তিনটি বিচার্য বিষয়কে মনে রাখলে দিল্লিই সবচাইতে যোগ্য স্থান।
(৭) যোগাযোগ আর প্রাকৃতিক পরিবেশে সাতটা মাস নিশ্চিন্তে কাটাতে পারা যাবে।
(৮) ১ অক্টোবর থেকে ১ মে— প্রখর গ্রীষ্মে সিমলা পাড়ি দিতে অর্থ এবং সময়  দুটোই ব্যয় হবে সামান্য।
(৯) দিল্লিতে রাজধানী উঠে এলে ভারতের রাজন্যবর্গ,  উত্তর ভারতের সমস্ত সম্প্রদায় তো বটেই, সারা ভারতবর্ষের মানুষ উল্লসিত হবে।
(১০) পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধের কারণে হিন্দুদের কাছে দিল্লি পবিত্র স্থান। মুসলমান সম্প্রদায় কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়বে কারণ তাদের প্রাচীন রাজধানীর হৃত গৌরব ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
১২ ডিসেম্বর ১৯১১— মধ্যাহ্ন থেকে অপরাহ্ণ সমস্ত বাঙালি উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ নিয়ে কী ঘোষণা করে জানার জন্য। দিল্লির দরবারে সমারোহের শেষ মুহূর্তে সবাইকে বিস্মিত করে রাজা নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে লর্ড হার্ডিঞ্চের হাত থেকে তুলে নিলেন একখণ্ড কাগজ। আর ঘোষণা করলেন— ‘রাজধানী ফর্ম ক্যালকাটা টু দ্যা এনসিয়েন্ট ক্যাপিটাল অফ দিল্লি’ স্থানান্তরিত হওয়ার কথা ঘোষণা করা হল।
বিনামেঘে বজ্রপাত হল। শুধু কলকাতা নয়, ভারতবর্ষ নয়, রাজার নিজের দেশের রাজনীতিকরাও চমকে উঠেছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা রাজধানী বদলের জন্য সরাসরি আঙুল  তুললেন লর্ড হার্ডিঞ্চের দিকে।  কাগজে কাগজে প্রতিবাদের সংবাদ, চিঠি, কবিতা, ছড়া, কার্টুন ছাপা হতে থাকে। একটি কার্টুনের ছবিতে দেখা গেল রাজার রাজভবন শূন্য, সামনে ছেঁড়া কাপড় পরে শুকনো মুখে খোঁচা দাড়ি-গোঁফ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, পাশে প্ল্যাকার্ডে লেখা— ‘খালি  বাড়ি, ভাড়াটে চাই।’ তিনদিনের   দিনই হার্ডিঞ্চ দিল্লিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ফেললেন। সত্যি সত্যি ভারতের প্রথম রাজধানী কলকাতা তিন তিনটে দিন অবধারিত মৃত্যুর সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াই চালিয়েও শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে আশ্রয় নিল ইতিহাসের কবরখানায়।
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
16Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা