বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

পাবনা কইন্যা সুচিত্রা

পাবনার হেমসাগর লেনে গড়ে উঠেছে ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’। ভিতরে ঢুকতেই সুচিত্রা সেনের কাট আউট। ডানদিকে কফি রঙের আবক্ষ মূর্তি। দু’দিন পর তাঁর নবম প্রয়াণ বার্ষিকী। শোকের সেই দিনের আগে ‘পাবনা কইন্যা’র বাড়ি ঘুরে এসে লিখেছেন সুখেন বিশ্বাস।

শেষবার তিনি এখানে এসেছিলেন ১৯৬৮ সালে। তখনই বলেছিলেন বাড়িটি সংস্কারের কথা। মায়ের মৃত্যুর পর একবার মাতৃভূমিতে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন সুচিত্রা-কন্যা মুনমুন। কিন্তু সম্ভব হয়নি।
আমরা যাচ্ছিলাম ঈশ্বরদী থেকে। সেখান থেকে অটোয় পাবনা মিনিট চল্লিশের পথ। পাবনা শহরে ঢোকার মুখে বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে তিরচিহ্ন জানান দিচ্ছে সুচিত্রা সেনের বাড়ির দিক নির্দেশ। পাবনায় যে কোনও টোটোওয়ালাকে বললেই নিয়ে যাবে গোপালপুর মহল্লায়। হেমসাগর লেনে, সুচিত্রার বাড়ি। কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘সুচিত্রা সেন’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তুমি ছিলে প্রিয়ার প্রতীক/ প্রেমের প্রকর্ষে, কামের দহনে/ আমি তোমাকে পেয়েছি স্বপ্নে,/ আলিঙ্গনে, বারবার।’
নয় ভাইবোনের মধ্যে সুচিত্রা ছিলেন পঞ্চম। বাড়ির ছোটরা ডাকতেন রাঙাদি বলে। মা-বাবা নাম রেখেছিলেন রমা। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের সহকারী নীতীশ রায় তা বদলে রাখলেন সুচিত্রা। কিন্তু পাবনার মহাকালী পাঠশালায় খাতায় কলমে তাঁর নাম ছিল কৃষ্ণা দাশগুপ্ত। প্রতি সন্ধ্যায় মায়ের (ইন্দিরা দাশগুপ্ত) সঙ্গে উলুধ্বনি সহ শঙ্খ বাজিয়ে বাড়ির তুলসীতলায় প্রদীপ দিতেন। একতলা বাড়ি। সংলগ্ন মূল প্রবেশপথ এখনও অন্যের দখলে। হয়েছে দোকানঘর। তার সামনে দিয়ে ঢাকা যাওয়ার পাকা রাস্তা। একসময় বাড়িটি ফুলের বাগানে ঘেরা ছিল। সঙ্গে দেবদারু, আম, নারকেল আর পেয়ারা গাছের সারি। অপেক্ষাকৃত নিচু ছড়ানো পেয়ারা গাছটি ছিল রমার খুবই পছন্দের। ছোটবেলায় খালি তাতে উঠে পা দোলাতেন। পেয়ারা খেতেন। কাউকে পরোয়া করতেন না। সেই তুলসীতলা নেই, নেই সেই পেয়ারা গাছও। শৈশবের বান্ধবী অঞ্জলি গোস্বামী জানিয়েছেন, ‘আমি, কৃষ্ণা ও আরও চার-পাঁচজন ছিলাম খুবই ঘনিষ্ঠ। আমরা সবসময় একসঙ্গে স্কুলে যেতাম, শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতাম, দুষ্টুমি করতাম, গান শুনতাম, গান গাইতাম, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ঘুরতাম...।’ মহানায়িকার মৃত্যুর পর সেই কলেজের গার্লস হস্টেলের নাম এখন সুচিত্রা সেন ছাত্রীনিবাস। 
দেশবিদেশ থেকে কেউ পাবনায় এলে তাঁর পৈতৃক-বাড়িতে যাবেই। বাদ যায় না মহাকালী পাঠশালাও। বর্তমানে তার নাম অবশ্য ‘পাবনা টাউন গার্লস হাই স্কুল’। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত এখানেই পড়েছিলেন রমা। তারপর পাবনা সরকারি গার্লস স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত। জীবনের প্রথম পারফর্ম্যান্স পাবনার বনমালী ইনস্টিটিউটে। সেখানেই তাঁর সঙ্গীত, আবৃত্তি, নৃত্য ও অভিনয়ের প্রথম পাঠ নেওয়া।  
সুচিত্রা সেনের বাড়ির কিছুটা দূরে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী। ওপারে শিলাইদহ, রবীন্দ্রকুঠি। এপারে পাবনা। শহরের বুক চিরে বয়ে চলা ইছামতীর জলধারা ছিল তাঁর শৈশবের সঙ্গী। ইছামতীতে নৌকা বাইচ দেখা এবং পদ্মা তীরের কাশবনে দৌড়নো ছিল প্রতিদিনের কাজ। সুচিত্রার পৈতৃক-বাড়ি দেখতে আসা মানুষ আজও ছুটে যায় সুচিত্রার ছেলেবেলার সেই স্কুল, ইছামতীর চর বা পদ্মার কাশবনে। পাবনা সরকারি গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল জব্বার বললেন, ‘স্কুলের গর্ব, পাবনাবাসীর গর্ব সুচিত্রা সেন। ওঁর মতো গুণী মানুষ আমাদের স্কুলের প্রাক্তনী, আমাদের স্কুলে পড়াশোনা করেছেন ভাবলে বুকটা গর্বে ভরে ওঠে।”  
একসময় পাবনার বেশিরভাগ মানুষ জানতই না, পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লায় সুচিত্রার পৈতৃক-বাড়ি রয়েছে। কারণ, বিশ শতকের পাঁচের দশকের শুরুতে ভিটে ছাড়েন তাঁর বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত। বাড়িটি পাকিস্তান সরকারের হাতে চলে যায়। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তার ভাগ্য বদল হয়নি। এক যুগ পর, ১৯৮৩ সালে বাড়ির দখল নেয় জামাত-ই-ইসলামি। ১৯৮৭-তে আইনিভাবে ইজারা নিয়ে তারা সেখানে গঠন করে ‘ইমাম গাজ্জালী’ নামে একটি ট্রাস্টি বোর্ড। একসময় ৯৯ বছরের জন্য বাড়িটি ইজারা নিতেও চায় তারা। পাবনা জেলা প্রশাসনও সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিল। কিন্তু সুচিত্রা সেনের বাড়ি বলে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দিতে অস্বীকার করেন বাংলাদেশের তৎকালীন ভূমিসচিব। ইতিমধ্যেই পাবনা জেলা প্রশাসনের সহায়তায় বাড়িটির সিঁড়ি, ছাদ ইত্যাদি ভেঙে ফেলে জামাত। অনেক গাছ কাটে। উঠোনে একাধিক কাঁচা-পাকা ঘর তোলে। একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলও চালু করে। মাঝে এক বছর তারা টাকা দেয়নি। তাই ইজারা বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু পরের বছরই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তা নবীকরণ করে নেয় জামাত।
অবশেষে ২০০৮ সালে পাবনায় গঠিত হয় ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ’। আমৃত্যু প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এম সাইদুল হক চুন্নু। বাড়িটি উদ্ধারে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিষদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডাঃ রামদুলাল ভৌমিক বলেন, ‘আমরা মনে করি বাড়িটি পাবনার ঐতিহ্য। পরিষদ গঠনের পরপরই বাড়িটি জামায়েতের কাছ থেকে উদ্ধার করতে সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিই। পথসভা হয়। বিক্ষোভ মিছিল করি। মানববন্ধন হয়। সাংবাদিক সম্মেলন করি। আমাদের দাবির প্রেক্ষিতেই পাবনা জেলা প্রশাসন জামায়েতের ইজারা নবায়ন করতে অস্বীকার করে।’ 
পরবর্তীকালে বাড়িটি উদ্ধার করতে চার বার সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসব করে এই পরিষদ। ২০০৯ সালে পাবনা টাউন হলে তা শুরু হয়। সাত দিনের উৎসবে দেখানো হয় সুচিত্রা অভিনীত সাতটি ছবি। প্রতিদিন বিকেলে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে অনুষ্ঠিত হতো আলোচনাসভা, চলচ্চিত্র ভাবনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাতে সিনেমা। প্রথম দিন দেখানো হয়েছিল উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘হারানো সুর’। তারপর একে একে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘শিল্পী’, ‘শাপমোচন’, ‘সপ্তপদী’, ‘পথে হল দেরি’ এবং শেষ দিনে ‘সাগরিকা’। এতে সংবাদমাধ্যম এবং জনমানসে বাড়ি উদ্ধারের দাবি আরও জোরদার হয়। রামদুলালবাবু আরও জানালেন, ‘জামায়েতের পক্ষ থেকে দু’বার হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। পাল্টা রিট আবেদন করেন ঢাকার সংস্কৃতিমনস্ক বিখ্যাত আইনজীবী মঞ্জিল মোরশেদ। তিনটে রিট হবার পর মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। বিচার শেষে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট জামায়েতের দুটো রিটই বাতিল করে। পাশাপাশি সরকারকে নির্দেশ দেয় বাড়িটির দখল নিতে। সঙ্গে সেটির সংস্কার করে ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’ গড়ে তোলার পরামর্শও দেওয়া হয়।’
সুচিত্রা সেন যখন বেলভিউয়ে ভর্তি, তখন থেকেই উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছিল পাবনাবাসীর। একটা উড়ো খবর শোনা গিয়েছিল। মহানায়িকা নাকি চিকিৎসার সময়ে জানিয়েছিলেন, তাঁর শেষকৃত্য যেন পাবনায় করা হয়। কিন্তু তা ছিল নিছকই গুজব। তবে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা সুচিত্রা-গবেষক এম আবদুল আলিম জানালেন, ‘মহানায়িকার মহাপ্রয়াণে এখানেও বসেছিল শোকসভা। প্রচুর মানুষ এসেছিলেন।’ চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি সুচিত্রার দশম প্রয়াণ দিবস। তাঁর পৈতৃক-বাড়িতেই স্মরণ অনুষ্ঠান করার চিন্তাভাবনা করেছে পরিষদ। তবে প্রতি বছরই পাবনার কোনও না কোনও জায়গায় তাঁর জন্মদিন (৬ এপ্রিল) এবং মৃত্যুদিন (১৭ জানুয়ারি) মহাসাড়ম্বরে পালিত হয়। দখলমুক্ত হবার পর একাধিকবার ওই অনুষ্ঠান হয়েছে সুচিত্রার পৈতৃক বাড়িতে। বক্তৃতা, স্মৃতিচারণের পাশাপাশি তাঁর লিপে গাওয়া গানগুলি পরিবেশন করেন পাবনার স্থানীয় শিল্পীরা। সুচিত্রা যে দু’টি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন, সেখানকার ছাত্রীদের নিয়ে হয় বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। থিম অবশ্যই মহানায়িকা। 
সুচিত্রার পৈতৃক বাড়িটি দখলমুক্ত হয় ২০১৪ সালে। সেটি সকলের জন্যে খুলে দেওয়া হয় তাঁর জন্মদিন ৬ এপ্রিলে। বর্তমানে বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তা দেখভাল করে পাবনা জেলা প্রশাসন। এখানেই গড়ে উঠেছে ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মূল দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে সুচিত্রা সেনের কাট আউট। আর ডানদিকে কফি রঙে উজ্জ্বল মহানায়িকার আবক্ষ মূর্তি। তিনি কি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’, রবীন্দ্রনাথের ‘ঊর্বশী’, নাকি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’? কবিকল্পনার মূর্ত প্রতীক পাবনার সুচিত্রা সেন। সাগরিকা, মল্লিকা, অর্চনা বা বিপাশার সাবলীল মহানায়িকা!
উঠোন শেষে সিঁড়ি-বারান্দা, তারপরেই মূল ঘর। সেখানে মহানায়িকা অভিনীত ছায়াছবির গানগুলি ভিডিওতে চলে সারাদিন। ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘এই পথ যদি শেষ না হয়’, ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে’ গানে মুখর থাকে সংগ্রহশালা। সঙ্গে মায়াবী চাহনি, নির্মল হাসি বা মধুমাখা আধো আধো কণ্ঠে অসাধারণ সব সংলাপ। ঘরগুলোর দেওয়াল জুড়ে ছোট বড় ফ্রেমে ধরা পড়েছে তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবি। কোনওটা পারিবারিক, কোনওটা বিশেষ অনুষ্ঠান, কোনওটা বা সিনেমার। মাঝে মাঝে ঝুলছে তাঁর পছন্দ-অপছন্দ এবং অনেক অজানা বিষয় নিয়ে লেখা একাধিক ফেস্টুন। কোনওটা বিয়ে, কোনওটা চলচ্চিত্র জগৎ, কোনওটা শোবার ঘর, কোনওটা বা মহানায়িকার আধ্যাত্মিক ভাবনা নিয়ে লেখা। সংগ্রহশালার ঘরগুলো দেখতে দেখতে নস্টালজিক হয়ে পড়বে যে কেউ। সুচিত্রা সেনের লিপে সিনেমার গান মুগ্ধ করবেই দর্শককে—আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি/ মোর নিশীথ বাসর শয্যায়/ মন বলে ভালোবেসেছি/ আঁখি বলিতে পারেনি লজ্জায়...!
 লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বাংলা িবভাগ
 গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
 সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়

15th     January,   2023
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা