প্রচ্ছদ নিবন্ধ

ভারতের  স্বাধীনতা-যজ্ঞের 
প্রধান ঋত্বিক  স্বামী বিবেকানন্দ
সন্মাত্রানন্দ

১৯১৪ সালের ১৫ মে। কলকাতা পুলিসের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট চার্লস টেগার্ট তৎকালীন বাংলা-সরকারের পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের আন্ডার-সেক্রেটারিকে একটি সুবিস্তৃত গোপন রিপোর্ট পাঠালেন। এই গোপন রিপোর্টে স্বামী বিবেকানন্দ, তদীয় গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ-প্রবর্তিত রামকৃষ্ণ মিশন ও মিশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের বিপজ্জনক পরামর্শদাতারূপে চিহ্নিত করা হয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের বহু ঘটনা ও তাঁর শিক্ষার বহু অংশ এই বিস্তৃত রিপোর্টে তুলে ধরে চার্লস টেগার্ট লিখেছিলেন: ‘...enough has perhaps been said to show how the main principles of the Swami’s teachings appealed to the revolutionary party of the present day and how they have been able to use his sayings and writings to sow the seed of revolution and anarchy in the minds of the Indian youths.’    
ভক্ত বা অনুরাগীদের শংসা তথা স্তুতিবাদের থেকেও বিরুদ্ধশক্তির এই বিষোদ্গার ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বামী বিবেকানন্দের বিপুল আগ্নেয় ভূমিকার অধিকতর জোরালো প্রমাণ। ব্রিটিশ সরকারের চোখে বিবেকানন্দ অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যক্তি, তাঁর শিক্ষা ও তাঁর দ্বারা প্রবর্তিত আন্দোলন নিছক ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় আন্দোলনমাত্র নয়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির চির-অবসান ঘটানোর জন্যেই বিবেকানন্দের জীবনের সকল প্রয়াস ও প্রচার—সেদিন এমন কথাই মনে হয়েছিল অত্যাচারী শাসকদলের। মনে হওয়ার সঙ্গত কারণ ছিল বই-কী! বিশেষত ১৮৯৭-এ বিদেশ থেকে ফিরে বিবেকানন্দ ভারতের দক্ষিণ থেকে উত্তর যে সমস্ত বক্তৃতায়  নবভারতের উত্থানগাথা গেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে যা লেকচারস ফ্রম কলম্বো টু আলমোড়া (বাংলা অনুবাদে ভারতে বিবেকানন্দ) নামে গ্রন্থিত হয়েছে, সন্দেহাতীতভাবে সেই ভাষণগুলিই ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের শুভ সূচনা করেছিল। এ সমস্ত বক্তৃতায় ভারতের ভাবসত্তাকে জনমানসে জাগরূক করার পাশাপাশি বিবেকানন্দ তাঁর অদ্বৈত-বেদান্ত দর্শনের এক বিশিষ্ট ফলিত রূপ তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মানুষ মৃত্যুহীন; মৃত্যুতে  কেবল এই পার্থিব শরীরের নাশ হয়, মানুষের প্রকৃত স্বরূপ কিন্তু অদ্বয়, জন্মমৃত্যুরহিত। শরীর যখন যাবেই, তখন  তা কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে যাওয়াই শ্রেয়স্কর। অন্যান্য সব দেব-দেবতারা এখন ঘুমোচ্ছেন, আগামী পঞ্চাশ বছর দেশমাতৃকাই ভারতবাসীর একমাত্র উপাস্যা এবং শৃঙ্খলিতা ভারতমাতা আজ সহস্র যুবক-যুবতীর বলিদান চান।  
বিবেকানন্দের এই আত্মা-জাগানিয়া মন্ত্রের অভিপ্রায় বুঝে উঠতে ভারত তথা বাংলার যুবশক্তির বিলম্ব হয়নি। কিন্তু প্রকাশ্যে তা অভিব্যক্তি পেল কিছু পরে। ১৯০৮-এর ২০ সেপ্টেম্বর ‘বন্দেমাতরম’-পত্রিকার এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধে অরবিন্দ ঘোষ লিখলেন, ‘these dynamic transformation is the ideal in these days and its birth is already heralded by the teachings of Sree Ramakrishna and Vivekananda.’ ভারতের জাতীয় সত্তায় এক বিরাট গতিময় পরিবর্তন আসছে; এবং সেই পরিবর্তনের সূচনা রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের শিক্ষার ভেতর দিয়েই ইতোমধ্যে প্রধ্বনিত হয়েছে। ১৯১২-র ১৪ জানুয়ারি বাল গঙ্গাধর তিলকের ‘মারাঠা’ পত্রিকা সকল সংশয় দূর করে দিয়ে লিখেছিল, ‘Swami Vivekananda is the real father of Indian Nationalism.’ ভারতের জাতীয়তাবাদের প্রকৃত জনক স্বামী বিবেকানন্দ। সমভাবাপন্ন মন্তব্য সমকালীন পত্রপত্রিকায় বহুল পরিমাণে প্রকাশিত হয়েছিল।
কিন্তু এই পরোক্ষ অনুপ্রেরণাই ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে স্বামীজীর একমাত্র ভূমিকা নয়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বয়ান অনুসারে দেখা যায়, ১৯০১-এ স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় কয়েকজন নাগরিকের সহায়তায় জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। বিবেকানন্দ ক্রিস্টিন গ্রীনস্টাইডেলের কাছে একথা কবুল করেছেন, পাশ্চাত্যে ম্যাক্সিম গানের আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী হিরাম ম্যাক্সিমের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব করেছিলেন ভারতের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা মাথায় রেখেই। এমনকী পাশ্চাত্য-গমনের আগেও দেশীয় রাজাদের নিয়ে বিবেকানন্দ ব্রিটিশ-শক্তি উচ্ছেদের জন্য এক শক্তিজোট নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। নিবেদিতার জীবনীকার লিজেল রেমঁ-র সাক্ষ্য অনুযায়ী বিবেকানন্দ তাঁর আন্দোলনের সহমর্মী জোসেফিন ম্যাকলাউডের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র আনয়নের তাগিদ থেকেই। সেই প্রয়াস সফল হয়নি, কিন্তু সেই সুদূর ১৯০১-এ বসেই স্বামীজী সশস্ত্র অভ্যুত্থানেরই চেষ্টা করছিলেন, সন্দেহ নেই।      
স্বামী বিবেকানন্দের সমকালে জীবিত বিপ্লবীদের সঙ্গে স্বামীজীর বার্তা-বিনিময় থেকেও এ ব্যাপারটি বেশ পরিষ্কার হয়ে আসে। ১৯০১-সালেই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের প্রাণপুরুষ মহাবিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ ঢাকায় স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করেন। কথায় কথায় ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল। স্বামীজী বলেছিলেন, ‘সর্বপ্রথম পরস্বাপহারী ইংরেজদের এ দেশ থেকে তাড়াতে হবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।’ হেমচন্দ্র প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কীভাবে প্রবল প্রতাপান্বিত ইংরেজ-শক্তিকে হঠিয়ে দেওয়া সম্ভব?’ প্রশ্নটা শোনামাত্রই বিবেকানন্দের মুখ গভীর বেদনা ও তীব্র ক্রোধে আরক্তিম হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘তোমাদের উদ্দেশ্য দেশজননীর শৃঙ্খল-মোচন। তার জন্য যা প্রয়োজন মনে করবে, তাই করবে। যেকোনো উপায়ে, বাই এনি মিনস হোয়াটসোএভার! ওরা আমাদের মায়ের বুকে বসে রক্ত খাচ্ছে। যেভাবে হোক, যেকোনো প্রকারে হোক, তাদের বিনাশ করতে হবে।’ হেমচন্দ্র জানিয়েছেন, ‘বস্তুত সেইদিনই আমি এবং আমার সতীর্থরা বিপ্লবজীবনের যথার্থ মন্ত্রলাভ করেছিলাম। মুক্তি-সঙ্ঘ তথা পরবর্তী কালের বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সত্যিকারের জন্ম হয়েছিল সেইদিনই।’    
বিপ্লব-আন্দোলনের আরেক পথিকৃৎ ‘হিতবাদী’-পত্রিকার সম্পাদক সখারাম গণেশ দেউস্কর, যাঁর লেখা ‘দেশের কথা’-বইটি সেকালে অনুশীলন, যুগান্তর ও অন্যান্য সকল ক্রান্তিকারী-গোষ্ঠীর অবশ্যপাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল, কয়েকজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক সহ স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করেন। সেসময় পাঞ্জাবে এক ভয়াবহ খাদ্য-সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। সমস্ত দিন এই সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গেই স্বামীজী কথা বলে চলেছিলেন। দিনান্তে দর্শনপ্রার্থীরা যখন এই বলে খেদ করেছিলেন যে, সারা দিনটা জাগতিক বিষয়ে আলোচনায় বৃথা গেল। তৎক্ষণাৎ তাঁদের এ কথার প্রতিবাদ করে স্বামীজী বলে উঠেছিলেন, ‘যতদিন আমার দেশের একটি কুকুরও অভুক্ত থাকবে, ততদিন তাকে খাওয়ানোই আমার জীবনের একমাত্র ধর্ম।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পরাধীন জাতিভুক্ত আমাদের পূর্বপুরুষের শ্রাদ্ধাধিকার পর্যন্ত নেই। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন বিপন্ন করা।’ পরবর্তীকালে সখারাম গণেশ দেউস্কর সশ্রদ্ধ চিত্তে বলেছেন, “স্বামীজীর সঙ্গে কথা বলে জীবনে প্রথম ‘দেশপ্রেম’ কাকে বলে, তা বুঝতে পেরেছিলাম।”    
‘কেবল কি গলাবাজিতে কাজ হয়? বেপরোয়া হয়ে কাজ করতে হবে। বিধিমতো কাজ করে যাব, তাতে যদি গুলি বুকে পড়ে, প্রথমে আমার বুকে পড়ুক। পড়ুক গুলি আমার বুকে, আমেরিকা ইউরোপ একবার কীরকম কেঁপে উঠবে। তখন বুঝবে বিবেকানন্দ কী জিনিস! আমেরিকায় এমন স্থান নেই, যেখানে বিশ-ত্রিশ হাজার লোক আমার অনুগত নয়। আমার রক্ত পড়লে সারা জগতে একটা সাড়া পড়ে যাবে,’ এসব কথা স্বামীজী মহেন্দ্রনাথ দত্তকে বলেছেন লণ্ডনে বসেই। তখন ১৮৯৬।   
একভাবে দেখলে, স্বামী বিবেকানন্দের সমস্ত জীবন পরপদানত ভারতবর্ষের অভ্যুদয়ের জন্যই উৎসর্গীকৃত। কীভাবে ঘুমন্ত ভারত জেগে উঠবে, কীভাবে ভারত তার বিস্মৃত ইতিহাস, তার কৃষ্টি, তার সমুচ্চ মানবতার ধারণায় উজ্জীবিত হয়ে উঠবে, আত্মশ্রদ্ধা ও আত্মশক্তির বিকাশে মহীয়ান হয়ে উঠবে—এই-ই ছিল বিবেকানন্দের অবিরল ধ্যানের বস্তু। ভগিনী নিবেদিতা যথার্থই বলেছেন, ‘ভারতবর্ষ ছিল স্বামীজীর গভীরতম আবেগের কেন্দ্র। ভারতবর্ষ নিত্যস্পন্দিত হত তাঁর বুকের মধ্যে, প্রধ্বনিত হত তাঁর ধমনীতে, ভারতবর্ষ ছিল তাঁর দিবাস্বপ্ন, ভারতবর্ষ ছিল তাঁর নিশীথের দুঃস্বপ্ন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষ—রক্তমাংসে গড়া ভারত-প্রতিমা।’ অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী হয়েও স্বামী বিবেকানন্দ তাই ভারতের অগণ্য যুবক-যুবতীর চিত্তকে আকর্ষণ করে বলেছিলেন, ‘ভুলিও না, তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত।’ স্বামীজীর সেই অমোঘ আহ্বানে সাড়া দিয়েই দেশমাতৃকার বন্ধনমোচনের জন্য প্রাণদান করেছিলেন কত উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণী। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, চিত্তপ্রিয়, সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, সুভাষচন্দ্র বসু, বিমল দাশগুপ্ত, বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত অবশ্যই তাঁদের অন্যতম। কিন্তু মাতৃ-উপাসনার সেই পুণ্য যজ্ঞাগ্নিতে প্রথম যে জ্বলন্ত আহুতিটি সমর্পিত হয়েছিল, সে-আহুতি— সে রুধিরাক্ত হৃৎপিণ্ড স্বামী বিবেকানন্দের।
18Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা