বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

ধন্বন্তরি নীলরতন
রজত চক্রবর্তী

চলতি মাসেই ছিল তাঁর জন্মদিন। নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল সেই দিনটি। প্রাতঃস্মরণীয় বাঙালি চিকিৎসকদের মধ্যে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। তিনি ডাঃ নীলরতন সরকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একসময়ের শিয়ালদহ মেডিক্যাল স্কুলের নামকরণ করা হয় এই প্রাক্তনীর নামেই যা আমাদের চিরপরিচিত— এনআরএস হাসপাতাল।

১৯১১ সালের অক্টোবর মাসের কুয়াশার চাদরে ঢাকা দার্জিলিং। শিশির ভেজা পাকদণ্ডী পথ। আবছা আবছা বৃক্ষরাজির আড়ালে আবডালে কাঞ্চনজঙ্ঘা। শৈল ছুটছেন পাহাড়ের পথ দিয়ে। শৈলেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাকসাইটে উকিল মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে শৈল। মায়ের কথায় সকাল সকাল এসেছিল রায় ভিলায় খবর নিতে, সিস্টার কেমন আছেন! সিস্টার নিবেদিতা দিনকয়েক হল অসুস্থ। জগদীশচন্দ্র বসু, অবলা বসু ও নিবেদিতা উঠেছেন ‘রায় ভিলা’য়। সান্দাকফু যাওয়ার কথা ছিল। যাওয়া হয়নি। জ্বর নিবেদিতার। জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে কথা বললেন শৈল। ডাঃ নীলরতন সরকার এখন দার্জিলিংয়ে আছেন। শৈল জানেন ডাক্তারবাবু দার্জিলিং এলে কোথায় ওঠেন। ডাকতে চলেছেন দ্রুত।
বছর পঞ্চাশের ডাঃ সরকার তখন বাংলার ধন্বন্তরি। তাঁকে দেখলেই রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যান। তাঁর চিকিৎসার গুণ সম্পর্কে কিছু সত্যি এবং কিছু মিথ ছড়িয়ে আছে দার্জিলিং থেকে সুন্দরবনে। দ্রুত চলে আসেন ডাক্তারবাবু রায় ভিলায়। নিবেদিতা তন্দ্রাচ্ছন্ন। অবলা পাশে বসেছিলেন উঠে দাঁড়ালেন। জগদীশচন্দ্র ডাঃ সরকারকে নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। ডাঃ সরকার নিবেদিতার কব্জিটা ধরে নাড়ি দেখলেন। বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে ধীরে। জগদীশচন্দ্র এগিয়ে এসে বললেন, ‘কলকাতা নিয়ে গেলে...!’ ডাক্তার ঘাড় নেড়ে জানালেন ধকল নিতে পারবেন না। কয়েকদিন পরই ১৩ অক্টোবর নিবেদিতা চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। এর ঠিক ছ’বছর আগে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সেই উত্তুঙ্গ অবস্থায় নিবেদিতা অসুস্থ হয়েছিলেন। তখনও ডাঃ সরকার দেখেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ব্রেইন ফিভার’। বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিশ্রাম নিতে পারেননি নিবেদিতা। তারপর গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে।‌ গিয়েছিলেন মায়াবতীতে। সভা করেছেন। বক্তৃতা করেছেন।‌ রাতের পর রাত জেগে জগদীশচন্দ্রের বইয়ের খসড়া কপি করেছেন। বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে। চির বিশ্রামে চলে গেলেন তিনি।‌
....
নীরবে মাথা নামিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ডাঃ নীলরতন সরকার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তন্দ্রাচ্ছন্ন কবিকে দেখে। ১৯৪১ সালের ৫ আগস্ট। ৩০ জুলাই কবির প্রোস্টেট অপারেশন হয়েছে। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের তত্ত্বাবধানে ডাঃ ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন অপারেশন। নীলরতন সরকার বারণ করেছিলেন অপারেশন করতে। উল্লেখ করেছিলেন কবির মনের কথা। সতর্ক করেছিলেন, খুব ছোট অপারেশন হলেও বাইরের আঘাত সহ্য নাও করতে পারেন। সাধারণ রোগী এই অপারেশনে সুস্থ হলেও উনি কিন্তু সাধারণ নন— উনি রবীন্দ্রনাথ। নীলরতন সরকার চিকিৎসা শাস্ত্রের বাইরের এক অনুভবের কথা উল্লেখ করেছেন। তীক্ষ্ণ অনুভবে বুঝতে পারে শরীর ও মনের রসায়ন। ফলে রোগ নির্ণয় ও তার সমাধান ছিল সাধারণ মানুষের ভাবনার অতীত।
নির্মলকুমারী মহালনবিশের মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় রানুর স্বামী প্রশান্ত মহালনবিশের মেজমামা হলেন নীলরতন সরকার। নীলরতনের বাড়িতে থেকেই তাঁর পড়াশোনা। জ্যোতিন্দ্রনাথের ফোনে খবর পান যে, বন্ধু রবীন্দ্রনাথ সঙ্কটাপন্ন। সঙ্গে সঙ্গে চলে আসেন জোড়াসাঁকোয়। বিধান রায়ের সঙ্গে ঢুকলেন জোড়াসাঁকোর ‘পাথরের ঘরে’। অচৈতন্য কবি। মাঝে মাঝে সাড়া দিচ্ছেন অস্ফুট স্বরে। চোখ তাঁর বোজা। নীলরতন সরকার বন্ধুর হাতটা ধরলেন। রানু কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে জোরে বললেন, ‘দেখুন, কে আপনার কাছে এসেছেন।’ কোনও সাড়া নেই। আবার বললেন, ‘নীলরতনবাবু আপনাকে দেখতে এসেছেন।’ চমকে উঠে ‘অ্যাঁ’ বলে ওঠা ছাড়া কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। নীলরতন সরকার বললেন, ‘থাক।’ কবির হাতটি তুলে নিলেন হাতে। ঘড়িতে চোখ রেখে দেখলেন নাড়ি। হাতটি নামিয়ে রাখলেন ধীরে। সস্নেহে হাত বোলাতে লাগলেন। মুখে যন্ত্রণার রেখা লুকোতে পারলেন না ডাক্তার। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। পেছনে বিধান রায়। স্তব্ধতা অনেক কিছু উচ্চারণ করে। তিন দিন পর ২২ শ্রাবণের ধারা নেমে এল বঙ্গভূমে।
সমবয়সি দু’জন। দু’জনেই জন্মেছেন ১৮৬১ সালে। রবীন্দ্রনাথ ৭ মে আর নীলরতন ১ অক্টোবর। কথিত আছে, রবীন্দ্রনাথ ডাকতেন ‘নীলু’ বলে। ১৯১৬ সাল থেকেই তিনি ছিলেন কবির চিকিৎসক ও পরামর্শদাতা। ১৯৩৮ সালে জীবনের শেষ প্রান্তে কবি তাঁর ‘সেঁজুতি’ কাব্যগ্রন্থটি বন্ধু ডাক্তার নীলরতন সরকারকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ পত্রটি কুড়ি পঙ্‌ক্তির রবীন্দ্র-স্বাক্ষরিত একটি কবিতা। শিরোনামে লেখা আছে— ‘ডাক্তার স্যার নীলরতন সরকার বন্ধুবরেষু।’
যার শেষ চারটি পঙ্‌঩ক্তি এইরকম—
‘সে ভাষার আমি চরম অর্থ
জানি কিবা নাহি জানি,-
ছন্দের ডালি সাজানু তা দিয়ে
তোমারে দিলাম আনি।’
....
‘ফুটবল খেলেন?’ ডাক্তারের প্রশ্নে চমকে ওঠেন রোগী। সেই সময়ের নামকরা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ডি পি বসু। তাঁর বাবা স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ কে পি বসু।
—হ্যাঁ খেলি তো!
—কোন পজিশনে খেলা হয়?
—ফরোয়ার্ডে!
—খেলতে খেলতে হাঁফ ধরে?
—নাহ্!
—ফুলটাইম খেলা হয় না হাফটাইম?
—ফুলটাইম।
—হুম। হার্টের অর্গানিক কোনও রোগ নেই। অপারেশন করা যেতে পারে।
ডাক্তার নীলরতন অপারেশন থিয়েটার রেডি করার রায় দিলেন। নিজে থেকে অপারেশন করলেন। সফল অপারেশন। অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করা দরকার ছিল ডাঃ ডি পি বসুর। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলে হবে কী! কোনও অ্যানেসথেসিস্ট রাজি হচ্ছেন না ওঁকে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অজ্ঞান করাতে। কারণ, ওঁর সাইনাস অ্যারিদমিদিয়া রয়েছে। সেই সময় হার্টের অবস্থা নির্ণায়ক কোনও যন্ত্রপাতি বা টেস্ট ছিল না। নির্ভর করতে হতো ডাক্তারের ‘ক্লিনিকাল আই’-এর উপর। ‘ক্লিনিকাল আই’ কত নির্ভুল হলে চূড়ান্ত আস্থা শুধু ডাক্তারের নিজের উপর নয়, রোগীরও আস্থা তৈরি হয় ডাক্তারের উপর।
....
‘সময় চলিয়া যায়
নদীর স্রোতের প্রায়,
যে জন না বুঝে,
তারে ধিক্ শত ধিক্!’
যোগীন্দ্রনাথ সরকারের এইসব ছড়া তখন বাংলার ছোট-বড় সকলের প্রিয় হয়ে উঠছে। বঙ্গ শিশুর মন ভালো করা ছড়ার  বই আসছে একের পর এক যোগীন্দ্রনাথের হাত ধরে। আর ঠিক তখনই দাদা ধন্বন্তরি নীলরতন সরকার বঙ্গজনের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। ১৮৯০ সালে এমডি হবার পর বাঁধা মাইনের চাকরি না নিয়ে ৬১, হ্যারিসন রোডে নিজের বাড়িতে শুরু করলেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস। দেশীয় চিকিৎসকদের ভিজিট ছিল ২ টাকা, ৪ টাকা, ৮ টাকা।‌ সেখানে সাহেব ডাক্তারের ভিজিট ছিল ১৬ টাকা, ৩২ টাকা, ৬৪ টাকা। তখন একটা তাচ্ছিল্যের কথা চালু ছিল— ‘দু’টাকার ডাক্তার’। মানে তার কোনও গুরুত্ব নেই। নেটিভদের কৃতিত্বের প্রতি ব্রিটিশদের এই খাটো করার মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ করলেন নীলরতন সরকার। ভিজিট করলেন ১৬ টাকা। সবাই অবাক। দেশীয় ডাক্তারের এত ভিজিট! কিন্তু অপরদিকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করে কত মানুষের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন তার হিসেব কোনও গবেষণাগারে নেই। ৭, শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে একটা ক্লিনিক্যাল ল্যাব তৈরি করেছিলেন। যা বহু দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ভারতের প্রথম ‘ইলেক্ট্রো কার্ডিওগ্রাফ’ যন্ত্র তিনিই আনিয়েছিলেন এই ক্লিনিক্যাল ল্যাবে। শুরু করলেন ‘দাই’দের প্রশিক্ষণ। 
....
বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রকৃতির আক্রোশের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হয় সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষজনকে। ঊনবিংশ শতকের ডায়মন্ডহারবার থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বসতির জীবনসঙ্গী এই লড়াই। নন্দলাল সরকারের অসচ্ছল পরিবারে নীলরতনের জন্ম হয় ১৮৬১ সালে ডায়মন্ডহারবারের প্রত্যন্ত নেত্রা গ্রামে। রুগ্ন মায়ের ব্যাধি দেখেছেন ছোট থেকেই। চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা ও অর্থ কিছুই নেই। ঝড় ও বন্যায় ঘরবাড়ি তছনছ হয়ে যাওয়ার পর স্ত্রী থাকমণি, পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে নন্দলাল এই সময়ে চলে এসেছিলেন জয়নগরে। সেখানেই নীলরতনের পড়াশোনা শুরু। ১৮৭৬ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষার আগেই প্রায় বিনা চিকিৎসায় মায়ের মৃত্যু দেখেছেন কিশোর নীলরতন। দারিদ্র্যের যেটা সম্পদ— লড়াই করার অনমনীয় মানসিকতা আর জেদ। এই দুটোই ছিল শান্ত-ধীর-স্থির নীলরতনের লড়াই করার অস্ত্র। তাঁর এন্ট্রান্স পাশের কয়েক বছর আগেই শিয়ালদার মার্কেট বিল্ডিংয়ে খোলা হয় ‘শিয়ালদহ মেডিক্যাল স্কুল’। ১৮৭৩ সালের ১ ডিসেম্বর। আর্থিক অনটনের কারণে ওখানেই ভর্তি হলেন নীলরতন। ডাক্তার হওয়ার একরাশ স্বপ্ন বুকে। ১৮৮০ সালে পাশ করলেন সেখান থেকে। দেখলেন, নেটিভ ছেলেরা যেহেতু বাংলায় পড়ত, তাই তাদের এলএমপি পাশের পর সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন হিসেবে জয়েন‌ করতে হতো। কিন্তু ব্রিটিশ প‌ড়ুয়ারা একই ডিগ্রি নিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন হিসেবে জয়েন করত। অপমানিত হলেন এই দ্বৈত ব্যবস্থায়। তাই চাতরা হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। একদিকে প্রধান শিক্ষকের কাজ করে চলেছেন আর অপরদিকে নিরলস পড়াশোনা। এলএ এবং বিএ পাশ করার পর ১৮৮৫ সালে ভর্তি হলেন মেডিক্যাল কলেজে।‌ আর এই সময়েই সরোজিনী নাইডুর বাবা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত অঘোরনাথ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করছেন। তাঁর সহকর্মী ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পরবর্তীতে বিবেকানন্দ। একদিকে মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা, অপরদিকে শিক্ষকতা। 
১৮৮৮ ‘গুডিভ’ স্কলারশিপ নিয়ে হন এমবি। মেয়ো হাসপাতালে নিলেন ‘হাউস স্টাফশিপ’। ততদিনে ছেড়ে দিয়েছেন শিক্ষকতা। ১৮৮৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাশ করে ১৮৯০ সালে যখন এমডি পাশ করছেন, তখন কলকাতায় মাত্র ছ’জন এমডি ডাক্তার— মহেন্দ্রলাল সরকার, চন্দ্রকুমার দে, জগবন্ধু বসু, আর ডব্লু কার্টার, ভাগবত চন্দ্র রুদ্র ও রামপ্রসাদ বাগচী। 
জেদ ও ‘দারিদ্র্যের অহংকার’ ছিল তখন বাঙালির ভূষণ। ব্রিটিশ শাসন ও নিয়মের দ্বৈত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেমন প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বোসের লড়াই ছিল সমসাময়িক ঘটনা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছিল স্বদেশি উদ্যোগ। নীলরতন সরকার শুধু মোটা ভিজিটের নামকরা ডাক্তার হয়েই থামলেন না। এমডি হয়ে প্রাইভেট পসার যখন খ্যাতি পেয়েছে, তখন তিনি ও সুরেশ সর্বাধিকারী মিলে ১৬৫, বউবাজার স্ট্রিটে বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তুললেন ভারতের প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। সাল ১৮৯৫। নাম দেওয়া হল— কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জনস অব বেঙ্গল। মননের গভীরে ছিল স্বদেশ চেতনা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগেই এই স্বদেশি কলেজ মিলে গেল ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলের সঙ্গে (১৮৮৭ সালে রাধাগোবিন্দ কর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন)। ঠিকানা পরিবর্তন হল। ২৯৪, আপার সার্কুলার রোড। কলেজ বড় হচ্ছে। ছাত্র সংখ্যা বাড়ছে। নীলরতন সরকার গেলেন একদিন লর্ড কারমাইকেলের কাছে। মেডিক্যাল কলেজ করা প্রয়োজন এবং তাঁর সহযোগিতা তথা আর্থিক সাহায্য দরকার। কারমাইকেল এড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তাব দিলেন, সরকারের টাকা অত নেই, এক মাসের মধ্যে যদি এক লক্ষ টাকা জোগাড় করে আনতে পারেন, তবেই সম্ভব হবে মেডিক্যাল কলেজ। নীলরতন রাজি হয়ে সোজা গিয়ে বললেন বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের ধনী বন্ধুবান্ধব এবং নিজে টাকা ধার করে এক মাসের মধ্যেই এক লক্ষ টাকা নিয়ে হাজির হলেন লর্ড কারমাইকেলের কাছে। ইংরেজ সাহেব হতবাক। রাজি হয়েও জানতে চাইলেন, কার নামে হবে এই কলেজ। নীলরতনের পরিষ্কার মনোভাব, আপনার নামে হলেও আপত্তি নেই। কিন্তু দেশের ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা শাস্ত্রের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ও সম্মানহানি না হলেই হবে। নীলরতন জানতেন খোদ লর্ডের নামে কলেজ হলে কোথাও আটকাবে না। কিন্তু দেশীয় নামে হলেই বিশ বাঁও জলে! ১৯১৬ সালের ৫ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হল কারমাইকেল কলেজ। যা পরবর্তীকালে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। 
স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ নীলরতন সরকার ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের পাশেই। স্বদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাবনা গড়ে উঠছে। ডাক্তার নীলরতন সরকার তখন ঝাঁপিয়ে পড়লেন কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে। তারকনাথ পালিত ছিলেন তাঁর অন্যতম ধনী রোগী। তাঁর কাছে রাখলেন প্রস্তাব। তারকনাথ পালিতের সার্কুলার রোডের জমিতে তৈরি হল নীলরতন সরকারের নেতৃত্বে ‘বেঙ্গল টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট’। 
‘বিজয়া’ সাবান সেই সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে শুরু করে অনেক অভিজাত পরিবারে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। জগদীশচন্দ্র নিজে বলেন ভালো সাবান। স্বদেশি শিল্পোদ্যোগের সূচনায় সাবান কারখানা করলেন নীলরতন সরকার ১৯০৬ সালে। উত্তরবঙ্গে রাঙামাটি চা-বাগান নিলেন। শুরু করলেন চায়ের ব্যবসা। লেদার টেকনোলজির জন্য গড়ে তুললেন ট্যানারি। কিন্তু সরস্বতী যাঁর রক্তে লক্ষ্মী সেখানে বসত করে না। স্বদেশি প্রতিষ্ঠান গড়তে গিয়ে একসময় কপর্দকশূন্য হয়ে পড়লেন ডাক্তার নীলরতন। ৫১ বছর ধরে নীলরতন সরকারের সবসময় পাশে থাকা নির্মলা দেবী চলে গেলেন ১৯৩৯ সালে। ডাক্তারবাবু ক্লান্ত, একা। ১৯৪৩ সালের ১৮ মে প্রয়াত হলেন বাঙালি ধন্বন্তরি। শুধু জেগে থাকল তাঁর প্রিয়তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি। 
শিয়ালদহ মেডিক্যাল স্কুল। ১৮৮৪ সালে নামকরণ হয় ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল। দশ বছর পর আবার নাম পাল্টে হয় ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজ। স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালে প্রাক্তনীর নামানুসারে রাখা হল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। আমাদের চিরপরিচিত ‘এনআরএস’।
 

30th     October,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা