প্রচ্ছদ নিবন্ধ

বিদায় এলিজাবেথ
শাসন-হীন এক শাসকের গল্প

রূপাঞ্জনা দত্ত: বিষণ্ণ বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছিল শেষপর্যন্ত। জলে ধোয়া পরিষ্কার আকাশ। জোড়া রামধনুর দেখা পেতে বেশিক্ষণ লাগেনি। মনে হচ্ছিল ও দুটো বোধহয় বাকিংহাম প্যালেসেরই তোরণ। প্রাসাদের ব্যারিকেডের বাইরে তখন থিকথিক করছে ভিড়। চিৎকার, জাতীয় সঙ্গীত ... সব কিছু জমজমাট। শুধু তিনি নেই। সেই হাসিখুশি ছোট্ট মানুষটি। কথাটা মনে পড়ামাত্র কানজুড়ে নেমে আসে এক আশ্চর্য নীরবতা! চোখ বুজলেই সেই হাসির ঝিলিক।
নামেই তিনি ছিলেন ব্রিটেন সম্রাজ্ঞী। অথচ শাসনের বিন্দুমাত্র টের পেত না কাকপক্ষী। বরং জমকালো আদব কায়দার ফাঁকে রানি ছিলেন ছোট্ট শিশুটির মতো। প্যাডিংটন ভালুক আর মার্মালেড তাঁর বড় প্রিয়, সেকথা আর বিশ্বের অজানা নয়। এর বাইরেও কতশত মজার ঘটনা ছড়িয়ে প্রিয়জন, রাজ কর্মচারী, প্রতিবেশী, এমনকী অচেনা ব্যক্তিদের স্মৃতিতে। একবার সঙ্গীতজ্ঞ স্যার রবার্ট মেয়ারের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মুকুট না পরেই চলে এসেছিলেন রানি। সচরাচর তিনি এরকম করতেন না। ফলে অনুষ্ঠানে হাজির ৮৬ বছরের বৃদ্ধা ডায়ানা তাঁকে চিনতে পারেননি। এলিজাবেথের কাছে এসে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার মুখটি বড়ই মায়াবী। আমার খুব চেনা চেনাও ঠেকছে। আপনার পরিচয়টা দেবেন কি?’ শুনে হেসে ফেলেন রানি। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু চিরপরিচিত হাসি দেখেই বৃদ্ধা স্মৃতিশক্তি ফিরে পান। একইরকম ঘটনা ঘটেছিল স্কটল্যান্ডের এক পিকনিকে। মার্কিন পর্যটকরা এলিজাবেথকেই শুধিয়েছিলেন রানির কথা। জবাবে হাসতে হাসতেই রয়্যাল প্রোটেকশন অফিসারকে দেখিয়ে দেন এলিজাবেথ। বলেছিলেন, ‘আমি কোনওদিন রানিকে দেখিনি। এই ডিকি ওঁর সঙ্গে রোজ দেখা করেন।’ শুধু রসবোধ নয়, এক শিশুসুলভ চপলতা লুকিয়ে ছিল তাঁর মধ্যে।
ভারতকে দীর্ঘকাল পদানত করে রেখেছিল তাঁর পূর্বসূরিরা। সেই ইতিহাস নিয়ে খানিক অস্বস্তি ছিল এলিজাবেথের। তাই কাছে টেনে নিয়েছিলেন ব্রিটিশ ভূখণ্ডে ভাগ্যান্বেষণে আসা ভারতীয় অভিবাসীদের। বাকিংহাম ও উইনসর ক্যাসলের প্রাচীর উপচে পড়া ফুল ও শোকবার্তার ফাঁকেই সেসব কথা মনে পড়ছিল লর্ড জিতেশ গাডিয়া, লর্ড করণ বিলিমোরিয়া, লর্ড ডোলর পোপাটদের।
ক্রিসমাসেও দীপাবলির স্মৃতিতে ডুব
সবাই একটা বিষয়ে একমত, রানি ছিলেন সংখ্যালঘুদের পরমাত্মীয়। হিন্দু, শিখ, জৈন, পার্সি প্রত্যেকের উৎসবের প্রতি ছিল তাঁর টান। এই তো সেদিনের কথা, করোনাকালে লকডাউনের মধ্যে ক্রিসমাসের বার্তা দিয়েছিলেন রানি। তাতেও উজ্জ্বলভাবে ধরা ছিল দীপাবলি উদ্‌যাপনের স্মৃতি। লিখেছিলেন, ‘গত মাসে আতসবাজির আলোয় আলোকিত ছিল উইনসরের আকাশ। হিন্দু, শিখ ও জৈনরা দীপাবলি পালন করেছিলেন। এ এক আলোর উৎসব, যা সামাজিক দূরত্বের দিনেও আশা ও সৌভ্রাতৃত্বের আনন্দঘন মুহূর্ত রচনা করে।’ রানির এহেন একান্ত অনুভূতির অন্যতম সাক্ষী ছিলেন শ্রুতিধর্ম দাস। ভক্তিবেদান্ত ম্যানর মন্দিরের প্রয়াত সভাপতি নিজেই জানিয়ে গিয়েছেন সেই অভিজ্ঞতা। ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন রাজ পরিবারের। বাকিংহাম প্যালেসে সেবার একেবারে মুখোমুখি রানি। এর আগেও তাঁদের দেখা হয়েছিল। সেটা ২০১৫ সালে কৃষ্ণ অবন্তী স্কুলে। রানিকে সেকথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘মনে আছে সেবার আমাকে মহাপ্রভু চৈতন্য দেবের একটি ওয়াল হ্যাঙ্গিং উপহার দিয়েছিলেন আপনারা। সেটি আজও প্রাসাদের একটি ঘরের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে। ওটা দেখলেই আপনাদের কথা মনে পড়ে যায়।’
ভারতীয়দের প্রতি রানির মমত্ববোধ ও আত্মিক যোগাযোগের সাক্ষী লর্ড জিতেশ গাডিয়াও। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি সেকথা অনুভব করেছেন। চার্লসের রাজত্বেও তা বজায় থাকবে বলে আশাবাদী ব্রিটিশ এশিয়ান ট্রাস্টের চেয়ারম্যান।
প্রতিবেশীর চোখে
লন্ডনে রানির কার্যত প্রতিবেশী ছিলেন বিজয় গোয়েল। ইন্দো-ইউরোপিয়ান বিজনেস ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের বাড়ির কাছ দিয়ে হামেশাই যাতায়াত করতেন ঩দ্বিতীয় এলিজাবেথ। বেশিরভাগ সময় কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় গাড়ির মধ্যে বসা রানির দেখাও পেতেন তিনি। সামনাসামনি দেখা অবশ্য অনেক পরে। এলিজাবেথের সঙ্গে সেদিন তাঁর স্বামী, ডিউক অব এডিনবরা ফিলিপও উপস্থিত হন। স্ত্রী পুনমকে নিয়ে আলাপ করতে গিয়েছিলেন বিজয়। মুগ্ধতার রেশ আজও কাটেনি। ‘ওঁর ব্যক্তিত্ব, বিনয়, সারল্য দেখে মুখ থেকে কথা সরছিল না। নীরবে হাত বাড়িয়েছিলাম করমর্দনের জন্য। উনি আমার ব্যাপারে প্রশ্ন করছিলেন। পেশা, পরিজন...। সেসব কানেই ঢুকছিল না। পরে সংবিৎ ফিরতে রানিকে আমার ল’ ফার্ম, বিনিয়োগের প্রচার ইত্যাদির কথা জানাই। একদম শেষে বলি, আমি কিন্তু আপনার প্রতিবেশী। মিষ্টি হেসে প্রত্যুত্তরে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। এ যেন এক পরম পাওয়া। ডিউক অব এডিনবরাও ছিলেন রসিক। মজা করেই জানতে চেয়েছিলেন, বিজনেস ফোরামের সদস্যপদ কীভাবে পাব? ভাবা যায়!’ রানির হাসিতে একটা ম্যাজিক ছিল, মনে করেন চিগওয়েলের কাউন্সিলর প্রণব ভানোতও। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়াটাও রূপকথার চেয়ে কম নয়। বলছিলেন, ‘আমি পুরো জমে গিয়েছিলাম। মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইছিল। কিন্তু উনি সব যেন কাটিয়ে দিলেন নিমেষে। এত সহজ রানির সঙ্গে কথা বলা... কোনওদিন ভাবিনি। হাসির সঙ্গে ওঁর চোখে একটা খুশির ঝিলিক খেলে যেত। যে দেখেছে, সে-ই জানে ওই দৃশ্য জীবনে ভোলার নয়।’
বিয়ের জুতো
লর্ড করণ বিলিমোরিয়া রানিকে প্রথম দেখেন ছবিতে। বাবা ক্যাপ্টেন বিলিমোরিয়া ছিলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সিনিয়র এডিসি। ১৯৬১ সালে ভারত সফরের সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল রানি এলিজাবেথ ও ডিউক অব এডিনবরা ফিলিপের। সেই ছবিই ছিল লর্ড করণের ভারতের বাড়িতে। পরবর্তীকালে ছবির সেই দু’জন মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মুখোমুখি আলাপও হয়। সেই দিনগুলির স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল বিলিমোরিয়ার মনে। দম্পতির যে রসায়ন তাঁর চোখে ধরা পড়েছে, তা অদ্ভুত রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন। একবার হ্যারোর জোরোস্ট্রিয়ান (জরাথ্রুস্টবাদী) সেন্টারে এসেছিলেন রানি ও ফিলিপ। সঙ্গী হন লর্ড বিলিমোরিয়াও। প্রার্থনাকক্ষ থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি বসে জুতো পায়ে গলাচ্ছিলেন তিনি ও প্রিন্স ফিলিপ। সবাই চুপচাপ ছিল। আচমকাই ফিলিপ বলে ওঠেন, ‘জানো, সেই বিয়ে থেকে এই জুতোজোড়া আমার সঙ্গী?’ দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত লর্ড। তিনি জানতেন একথার কোনও জবাব হয় না। রানির দেহ এখন শায়িত রয়েছে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে। আগামী কাল সকাল ১১টায় শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান। তার আগে, আজ রাত আটটায় এক মিনিটের নীরবতা পালন করবে গোটা ইংল্যান্ড। তাঁদের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকবেন এক সম্রাজ্ঞী, যিনি কখনও কাউকে শাসন করার কথা ভাবেননি। 
22Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা