বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
 

জয় হে…

কাল, সোমবার জাতীয় ক্রীড়া দিবস। ‘হকির জাদুকর’ ধ্যান চাঁদের জন্মদিন উপলক্ষে পালিত হয় ন্যাশনাল স্পোর্টস ডে। ক্রিকেট, ফুটবলের চরম উন্মাদনার মধ্যেও অন্যান্য ক্রীড়া ক্ষেত্রে দেশের মাথা উঁচু করেছেন বহু খেলোয়াড়। তেমনই কয়েকজনের কৃতিত্বকে ফিরে দেখলেন অভিজিৎ সরকার।

সিংহহৃদয়
লিয়েন্ডার পেজ

পুত্রের নাম ‘লিয়েন্ডার’ রাখলেন কী ভেবে? সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রাক্তন হকি ওলিম্পিয়ান ডাঃ ভেস পেজের উত্তর, ‘লিয়েন্ডার নামের অর্থ সিংহহৃদয়। ছোটবেলা থেকে ওর বুকের খাঁচা বড়। অকুতোভয়। লড়াই-পরিশ্রমকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠেছে। আমি ওর স্বপ্নকে স্রেফ উস্কে দিয়েছি।’ সত্যিই তো, না হলে এই উচ্চতায় ওঠা যায়! একের পর এক বাধা অতিক্রম করে লিয়েন্ডার তো পেশাদারি সার্কিটে টিকে থেকেছে রাজার মতো। 
১৯৯৬ আটলান্টা ওলিম্পিকসে ব্রোঞ্জ জয়। আন্দ্রে আগাসি পর্যন্ত অবাক হয়েছিলেন  মাইকেল মধুসূদন দত্তের বংশধরকে দেখে! আটলান্টায় দেশের ধ্বজা উড়িয়ে লিয়েন্ডার ক্রমপ্রবহমান।  টানা সাতটি ওলিম্পিকসে অংশ নেওয়ার কীর্তি ভূ-ভারতে আর কারও নেই। ঝুলিতে রয়েছে ডাবলস ও মিক্সড ডাবলস মিলিয়ে ১৮টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব।  ডেভিস কাপে ঈর্ষণীয় রেকর্ড।  মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, মার্টিনা হিঙ্গিসের মতো একদা বিশ্বের একনম্বর মহিলা সিঙ্গলস প্লেয়ার লি-স্তুতি করেন এখনও। দু’জনের সঙ্গেই জুটিতে একাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যাম মিক্সড ডাবলস খেতাব। জুনিয়র উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন। বিশ্ব জুনিয়র টেনিসে একনম্বর স্থান তাঁর দখলে ছিল দীর্ঘদিন। জোরালো সার্ভিস, অবিশ্বাস্য নেট প্লে, অ্যাক্রোবেটিক ফিটনেস, প্রতিটি উইনিং শটের জন্য ট্রেডমার্ক চেস্ট বাম্প মনে করলেই লিয়েন্ডার পেজের মুখটা ভেসে ওঠে।  জীবনে একাধিক ব্যাডপ্যাচ কাটিয়ে বারবার গর্জে উঠেছেন লিয়েন্ডার।  কিন্তু ২০০৩ সালটা ভুলতে চাইবেন ডাঃ ভেস পেজের পুত্র। উইম্বলডন মিক্সড ডাবলসে খেলতে খেলতে কোর্টে পড়ে যান পেজ। কী অনুভূতি ছিল তখন? লি বলছেন, ‘চোখ-মুখ জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। সংজ্ঞা হারাই।’ ধরা পড়ে মস্তিস্কে সিস্ট। আমেরিকার হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর লিয়েন্ডার উক্তি ছিল, ‘পুনর্জীবন পেলাম।’  বৈবাহিক জীবন তাঁকে বারবার বিব্রত করেছে। কিন্তু তাঁর ফোকাস নষ্ট করতে পারেনি। দেশের হয়ে বারবার জ্বলে উঠেছেন। কলকাতার লা মার্টিনিয়ার স্কুলে লিয়েন্ডারের বেড়ে ওঠা। চোস্ত ইংরাজি তাঁর ব্যক্তিত্বকে ধারালো করেছে। লি’কে নিয়ে হয়েছে ডকুমেন্টারি সিরিজ। তাঁর জীবন কাহিনি ফুটে উঠেছে অ্যানিমেশন সিরিজ ‘ছোটা ভীম’-এ। 

আগ্রাসী মানসিকতা
পি ভি সিন্ধু

মুঠোফোনের ওপার থেকে ভেসে উঠল সেই আওয়াজ। ‘এক্সেলেন্ট অ্যাচিভমেন্ট। আই উইল মিট ইউ সুন।’ কয়েক সেকেন্ডের স্তব্ধতা! পি ভি সিন্ধু শিহরিত। স্বপ্নের নায়ক শচীন তেন্ডুলকরের ফোন। রীতিমতো কাঁপছেন ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাডমিন্টন তারকা। সময়টা ২০১৬ রিও ওলিম্পিকসের রুপো জয়ের পর। ভারতের ক্রিকেট আইকন কেন দেখা করতে চান? তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী পরে সিন্ধুকে বলেছিলেন, ‘শচীনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি একটা বিএমডব্লু গাড়ি উপহার দিতে চান।’ কয়েকদিন পর শচীনের হাত থেকে গাড়ির চাবি পেয়ে শিহরিত সিন্ধু। কোনও সন্দেহ নেই, স্বাধীনতার পরবর্তী যুগে ভারতের সেরা ক্রীড়াবিদের তালিকায় সিন্ধুর নাম থাকবেই। কুস্তিগীর সুশীল কুমারের মতো গোপীচাঁদের এই ছাত্রীর ঝুলিতেও রয়েছে দু’টি ওলিম্পিক পদক। রিও’র পর ২০২০ টোকিও ওলিম্পিকসে ব্রোঞ্জ। সুশীল হয়তো আর ম্যাটে ফিরবেন না। সিন্ধুর সামনে ২০২৪ প্যারিস ওলিম্পিকসে সোনা জয়ের সুযোগ রয়েছে। পুরোপুরি খেলাধুলোর পরিবেশে বেড়ে ওঠা সিন্ধুর। বাবা রামান্না ও মা বিজয়া প্রাক্তন জাতীয় ভলিবলার। । হতে পারতেন ভলিবলার। হয়ে গেলেন ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার। বাবা রামান্না বলছেন, ‘ছোটবেলায় ওর সঙ্গে ভলিবল খেলতাম। ওর জাম্পিং স্ম্যাশের কাছে  মাঝেমধ্যে আমিও বোকাও বনে যেতাম। ওই ছোট বয়সে স্ম্যাশে কী সাংঘাতিক শক্তি! সঙ্গে দুরন্ত টাইমিং প্লেসমেন্ট। ভলিবল খেলার ওই গুণ ওর ব্যাডমিন্টন কেরিয়ারে কাজে লেগেছে।’ সত্যিই তো, সিন্ধুর ওভারহেড ও বডি স্ম্যাশ বিশ্বের তাবড় প্লেয়াররা সামলাতে হিমশিম খান। উচ্চতার সঙ্গে স্পটজাম্পের নিখুঁত ব্লেন্ডিং। ছোটবেলা থেকে সিন্ধুর মধ্যে সেই আগুনে মেজাজ দেখেছেন তাঁর মেন্টর গোপীচাঁদ। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন বলছিলেন, ‘আগ্রাসী মেজাজ সিন্ধুকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপান, চীনের খেলোয়াড়রা টেকনিকে মাত করে। সিন্ধুর স্ট্রাইড, পাওয়ার, র‌্যাকেট পাঞ্চ, ঈশ্বরপ্রদত্ত স্ম্যাশ ওদের মধ্যে নেই।’ ছোটবেলা থেকে প্রখর মনঃসংযোগ এবং বই পড়ার অভ্যাস সিন্ধুর অফ ও অন দ্য কোর্ট ভারসাম্য তৈরি করেছে। আর ভালোবাসেন নিত্য-নতুন খাবার তৈরি করতে। পোষ্য কুকুরটি সিন্ধুর প্রিয় বন্ধু।

পাথর থেকে জ্যাভেলিন
নীরজ চোপড়া

সম্প্রতি এক ইনভেস্টর সংস্থার বিজ্ঞাপন শ্যুট করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নীরজ চোপড়া। একাধারে তিনি ব্যাটসম্যান, আবার গোলরক্ষকের ভূমিকায়। ভারতের এক ফ্যাশন ম্যাগাজিনের কভার পেজের ছবিতে নীরজ চোপড়া। টোকিও ওলিম্পিকসে সোনা জয়ের পর ভারতের জ্যাভেলিন থ্রোয়ার এক নম্বর এনডোর্সমেন্ট ব্র্যান্ড। 
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গত কয়েক বছর ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের মধ্যে বিজ্ঞাপন জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল বিরাট কোহলি। আর টোকিওতে সোনা জেতার সেই চিত্র পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছেন নীরজ। এমন ফ্ল্যামবয়েন্ট ইমেজের স্পোর্টসম্যান ভারত এর আগে পায়নি। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। পেশিবহুল চেহারা। পেস বোলারের মতো সুঠাম শরীর। বিশ্বের যে কোনও রানিং ট্র্যাকে নীরজ যখন জ্যাভেলিন নিয়ে দৌড়ন, বিভিন্ন পোজের ছবিতে ভরে যায় সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়াল। এটাই ম্যাজিক নীরজের।
বিশ্ব অ্যাথলেটিকস এখনও রীতিমতো গবেষণা করছে, ভারতের মতো দেশ থেকে এমন বিশ্বমানের থ্রোয়ার কীভাবে তৈরি হয়! জ্যাভেলিন নামক বস্তুটি কী, নীরজের থেকেই জেনেছে ভারতবাসী। আধুনিক বর্শার মোহে মজে উঠেছে তরুণ ক্রীড়া প্রজন্ম। হরিয়ানার পানিপথ ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবেই। এরপর নীরজের আলোয় আলোকিত সেই ভূমি। কোনও সন্দেহ নেই, স্বাধীনোত্তর যুগে নীরজ ভারতীয় ক্রীড়ার সর্বশ্রেষ্ঠ  বীরপুরুষ।
কীভাবে তৈরি হলেন নীরজ? তাঁর বাবা সতীশকুমার চোপড়া বলেন, ‘ছোটবেলায় অ্যাথলেটিকসের প্রতি কোনও আগ্রহ ছিল না নীরজের। জ্যাভেলিন তো দূরঅস্ত। পানিপথের শিবাজি স্টেডিয়ামে সিনিয়র অ্যাথলিটদের দেখে নীরজ ধীরে ধীরে অনুপ্রাণিত হয়।’ তবে ছোটবেলা থেকেই নীরজের একটা গুণ বর্তমান। খুব ভালো নিশানা। লক্ষ্যভেদ করতে ওস্তাদ। পাথর ছুড়ে গাছে থাকা ফল পাড়ায় ছিল অব্যর্থ নিশানা। সেটা দেখেই নীরজের গ্রামের কাছাকাছি থাকা সিনিয়র জ্যাভেলিন থ্রোয়ার জয়বীর চৌধুরী অনুজকে অনুপ্রাণিত করেন।  
২০১২ সালে অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় মিটে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম নজর কাড়েন নীরজ চোপড়া। তারপর ধীরে ধীরে উত্থান। বাকিটা তো ইতিহাস। নায়েব সুবেদারের চাকরি পেয়েছেন নীরজ। হিন্দি ছাড়া কোনও ভাষাই বলতে পারেন না। কৃষক পরিবারে মানুষ হওয়ার জন্য ভাষার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তাঁর মধ্যে। এব্যাপারে কিছুটা দুঃখ রয়েছে নীরজের। সেই আক্ষেপ সাফল্য দিয়েই ঢাকতে প্রত্যয়ী তিনি। আপাতত তাঁর লক্ষ্য দু’টি। ৯০ মিটার দূরত্বে জ্যাভেলিন ছোঁড়া। ২০২৪ প্যারিস ওলিম্পিকসে সোনা জয়।

...বাট প্লে স্পোর্টস
অভিনব বিন্দ্রা

খেলাধুলো ছিল তাঁর একেবারে না-পসন্দ। সেই অভিনব বিন্দ্রাই হলেন ওলিম্পিকসের ইতিহাসে ভারতের প্রথম সোনা জয়ী ক্রীড়াবিদ। ২০০৮ সালের বেজিং ওলিম্পিকসের শ্যুটিং রেঞ্জে ভারতের পতাকা উড়িয়েছেন অভিনব। আগামী প্রজন্মকে সাহস জুগিয়েছেন। বিশ্ব ক্রীড়া মঞ্চে ব্যক্তিগত বিভাগেও সোনা জেতা সম্ভব তা প্রমাণও করেছেন। দেরাদুনের এই শ্যুটারের জীবন কাহিনিতে বায়োপিক তৈরি হওয়ার যাবতীয় মশলা মজুত। 
বেজিং ওলিম্পিকসে সোনা জয়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বারবার থমকে যান অভিনব। তাঁর বিস্ময়ের ঘোর কিছুতেই কাটতে চায় না। কীভাবে এটা সম্ভব হল? তাঁর কথায়, ‘জীবনের প্রথম ১১টা বছর খেলাধুলো আমায় কোনওভাবেই আকর্ষণ করেনি। স্কুলে পড়ার সময় কোনওদিন খেলা দেখিনি। অংশ নেওয়া তো দূরঅস্ত। তবে, আমার এই মানসিকতা দেখে অভিভাবকরা হতোদ্যম হয়ে পড়েননি।  বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সময় বাবার চিঠি পেতাম নিয়মিত। তাতে একটা কমন বাক্য লেখা থাকত, নেভার মাইন্ড ইফ ইউ ডোন্ট স্টাডি বাট প্লে স্পোর্টস।’ 
ভারতীয় শ্যুটিং সার্কিটে বলা হয়, বিন্দ্রার দৃষ্টি শকুনের থেকেও প্রখর। প্রথাগত অনুশীলনের বাইরেও চলত মনঃসংযোগ ধরে রাখার অভ্যাস। চোখের পাতা স্থির রাখার কঠোর প্র্যাকটিস। শ্যুটিং সরঞ্জামের যত্নকে এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিন্দ্রা। জীবনের প্রথম ব্যবহৃত রাইফেল তাঁর কাছে এখনও সযত্নে রক্ষিত রয়েছে। পেশাদার জীবনের শুরু থেকেই ক্রীড়াবিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সার্কিটে সঙ্গে রাখতেন মনোবিদকে। মনস্তত্ত্ব ও ম্যানেজমেন্টে নিয়ে তাঁর অগাধ পড়াশোনা। সবেরই যোগফল ওলিম্পিক গেমসে সোনা। অথচ শ্যুটিং কখনওই তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল না। প্রথমে গলফ, তারপর টেনিস প্লেয়ার হতে চেয়েছিলেন। দু’টিতেই ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা তাঁকে সফল শ্যুটার তৈরি করেছে। 
বেজিং ওলিম্পিকসে সোনা জয়ের মূলমন্ত্র কী? অভিনবের বেদবাক্য ওয়ান লাইনার, ‘উইনিং টু মি ইজ নট ইমপর্টেন্ট বাট আই হেট লুজ।’
ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিদের ক্লাস নেওয়ার জন্য দেশব্যাপী বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে ডাক পড়ে অভিনব বিন্দ্রার। সেখানে জীবনের অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেন ভারতের সোনার ছেলে।  শ্যুটিং মহলে অভিনব বিন্দ্রার একটা গুণ নিয়ে প্রায়ই চর্চা হয়। শ্যুটার না হলে দক্ষ ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ হতে পারতেন তিনি। মারাত্মক দূরদর্শিতা।  ২০০৯ সালেই বলেছিলেন, ‘কমনওয়েলথ গেমসই ভারতের আন্তর্জাতিক মঞ্চে তৈরি হওয়ার আদর্শ মঞ্চ। এশিয়ান গেমস, ওলিম্পিকস ও বিশ্ব অ্যাথলেটিকস মিটের পারফরম্যান্স অনেকটাই নির্ভর করে কমনওয়েলথ গেমসের পদক জয়ের পর।’ ভারত সরকারের অন্যতম ক্রী‌ড়া পরামর্শদাতা অভিনব বিন্দ্রা। তাঁর তৈরি করে দেওয়া স্পোর্টস ডেভেলপমেন্টের ব্লু-প্রিন্ট অনুসরণ করছে ক্রীড়মন্ত্রক। 

মা-ই নেপথ্য শক্তি
কর্ণম মালেশ্বরী

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০০।  সিডনি ওলিম্পিকসের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে কর্ণম মালেশ্বরী। গলায় ব্রোঞ্জ পদক। চোখ বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। আনন্দাশ্রু? নাকি বঞ্চনার বিরুদ্ধে আবেগের স্রোত? ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এ প্রথম ভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে দেশকে পদক উপহার। সেদিনের কথা ভাবলেই ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ভারোত্তোলক আবেগমথিত। সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবসের ৭৫ বছর পূর্তিতে এক সাক্ষাৎকারে কর্ণম বলেছেন, ‘পদক জয়ের দিন আমার সামনে কোনও ভারতীয় সাংবাদিক ছিলেন না। তাঁরা অন্য ইভেন্ট কভার করতে ব্যস্ত। আসলে কেউই ভাবতে পারেননি, আমি পদক জিততে পারি। কারণ তার আগের চারটি ওলিম্পিকসে ভারতের সংগ্রহে ছিল মাত্র একটি পদক। আসলে কর্ণম মালেশ্বরী পদক জিতেছে, সেটা বড় কথা নয়। সেদিন বিশ্বমঞ্চে সমগ্র ভারতীয় নারী শক্তির ধ্বজা উড়িয়ে সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছি।’ রাশিয়ান কোচই মালেশ্বরীকে ওলিম্পিক পদক জয়ের স্বপ্ন দেখান। তাঁর পরামর্শেই ৬৩ থেকে ৬৯ কেজি ক্যাটাগরিতে উন্নীত হন অন্ধ্রপ্রদেশের এই ভারোত্তোলক। সিডনিতে স্ন্যাচে ১১০ কেজি, ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১৩৭.৫ কেজি ওজন লিফট করেন মালেশ্বরী। সিডনি ওলিম্পিকসে ভারতের প্রাপ্তি একমাত্র মালেশ্বরীর ব্রোঞ্জই। সিডনি ওলিম্পিকসে মঞ্চে নামার আগেই মালেশ্বরীর আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। কারণ তখন তাঁর ১১টি সোনাসহ ২৯টি আন্তর্জাতিক পদক জেতা হয়ে গিয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশের ভুসাভানিপেটা। এক ছোট্ট গ্রাম। সেই জায়গা বিশ্ব ক্রীড়া মানচিত্রে আলাদা করে নিয়েছে কর্ণম মালেশ্বরীর জন্মভূমি হিসেবেই। বাবা মনোহর আরপিএফের কনস্টেবল ছিলেন। মা শ্যামলাই ‘পিলার অব স্ট্রেংথ’ মালেশ্বরীর। গ্রামের প্রতিবেশীরা বলতেন, ‘মেয়ে মানুষ আবার ওয়েটলিফটার হয় নাকি! এ তো চরম অপসংস্কৃতি!’ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মালেশ্বরীর মা। পণ করেছিলেন মেয়েকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেনই। কর্ণম বলছেন, ‘আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মা-ও কঠিন সংগ্রাম করেছেন। শুরুতে হোটেলের দামি খাবার খাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। মা আমার সঙ্গে যেতেন গ্যাস স্টোভ, রান্নার সামগ্রী  নিয়ে। যাতে মেয়েকে রান্না করে দেওয়া যায়। কিছুটা খরচ বাঁচে।’১৯ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন মালেশ্বরী।

আলো থেকে অন্ধকার
সুশীল কুমার

দিল্লির ছত্রশাল স্টেডিয়াম থেকে তিহার জেল। ভারতের সর্বকালের সেরা কুস্তিগির সুশীল কুমারের এটাই জীবন পরিধি। বিস্ফোরক উত্থান, তারপর একের পর এক সাফল্য, ভারতীয় কুস্তিকে আন্তর্জাতিক স্তরে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া, সর্বশেষে দুঃখজনক পরিসমাপ্তি। 
দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্বর এমন পরিণতি ঘটবে কেউ ভাবতে পারেননি। কে বলবে, সুশীল কুমারের ঝুলিতে জোড়া ওলিম্পিক পদক রয়েছে। ব্যাডমিন্টন তারকা পি ভি সিন্ধু ছাড়া এমন সাফল্য তৃতীয় কোনও ক্রীড়াবিদের নেই। দু’বছর আগে ছত্রশাল স্টেডিয়ামের বাইরে  প্রাক্তন জুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন সাগর রানা হত্যাকাণ্ডে এই বিশ্বখ্যাত কুস্তিগিরের জায়গা হয় তিহার জেলের কুঠুরিতে। একধাক্কায় সুশীলের বর্ণময় জীবনে নেমে আসে যবনিকা। তিহার জেলে তিনি এখন কয়েদিদের ফিটনেস কোচ। টোকিও ওলিম্পিকস ও সম্প্রতি হয়ে যাওয়া কমনওয়েলথ গেমসের কুস্তির প্রতিটি ইভেন্ট টেলিভিশনে দেখেছেন তিনি। বজরং পুনিয়াদের পদক জয়ে উল্লসিত হয়েছেন। তিহার জেলের মুখপাত্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কুস্তির মূলস্রোতে ফিরতে উদগ্রীব সুশীল। কিন্তু বয়সটা ৩৯। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’ ২০০৮ সালে বেজিং ওলিম্পিকসের বাছাই পর্বে সুশীল জেতেন সোনা। মূলপর্বের ৬৬ কেজি ফ্রিস্টাইল ক্যাটাগরিতে তাঁর ঝুলিতে আসে ব্রোঞ্জ। ঝড়ের গতিতে ধরাশায়ী করেন প্রতিপক্ষকে। ১৯৫২ ওলিম্পিকসে ভারতীয় কুস্তিতে প্রথম পদক জয়ের স্বাদ এনে দিয়েছিলেন কে ডি যাদব। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি সুশীল কুমার। ২০১২ লন্ডন ওলিম্পিকসে রুপো জিতে ইতিহাস গড়েন সতপাল সিংয়ের ছাত্র। ২০১০ মস্কোতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, কমনওয়েলথ গেমসে সোনালি দৌড়ের হ্যাটট্রিক, কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে পাঁচবার সোনা জয়, এশিয়ান কুস্তিতে একবার সোনার পদক স্পর্শ করা— সুশীলের ঈর্ষণীয় রেকর্ড বোধহয় অক্ষতই থেকে যাবে। চার বছর বয়সে কুস্তির আখড়ায় দশ বছর বয়সি প্রতিপক্ষকে বারবার কুপোকাত করেছেন। পাকিস্তানের কুস্তিগির কামার আব্বাস বলছেন, ‘ম্যাটে ওর চোখ জ্বলত শিকারকে ঘায়েল করার স্পৃহায়। ১০০ শতাংশ নিখুঁত টেকনিক। প্যাঁচ একেবারে ময়াল সাপের মতো।’ এখন সুশীলকেই চোখ রাঙাচ্ছে তাঁর জেল জীবন।

28th     August,   2022
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা