ঈশ্বরের উপর যখন ভালবাসা আসে তখন কেবল তাঁরই কথা কইতে ও শুনতে ইচ্ছা হয়। সংসারী লোকেরও নিজের ছেলের কথা বলতে বলতে লাল পড়ে। যদি কেউ ছেলের সুখ্যাতি করে তো বলবে, “ওরে তোর খুড়োর জন্যে পা ধোবার জল এনে দে।” ঈশ্বর ভক্ত তাঁর সঙ্গে যে ভাবে আলাপ করে, ও তাতে প্রাণে যে ভাব হয়, যার তার কাছে বলতে ইচ্ছা করে না। বলেও সুখ পায় না, আর বলতে গেলে প্রাণে সে ভাব থাকে না। কিন্তু সে আর একজন ভক্তের কাছে প্রাণ খুলে সব কথা বলে, বোলেও সুখ পায়, আর বলবার জন্য ব্যাকুল হয়। ঠিক ঠিক ভক্তি হলে সামান্য জিনিষ হতেও তার ঈশ্বরের উদ্দীপনা হয়ে ভাবে বিভোর হয়। শুনিসনি চৈতন্যদেব এক সময়ে মেড়্গাঁ দিয়ে যেতে যেতে শুনলেন, এই গ্রামের মাটীতে খোল তৈয়ারী হয়। অমনি ভাবে বিহ্বল হলেন,—কেন না হরিনাম কীর্ত্তনের সময় খোল বাজে। মেঘ দেখলে ময়ূরের উদ্দীপন হয়। তখন আনন্দে পেখম্ ধরে নৃত্য করে।
এত জপ করতে হবে, এত ধ্যান করতে হবে, এত যাগ যজ্ঞ হোম করবে, এত উপাচারে পূজা করতে হবে, পূজার সময় এই এই মন্ত্র পাঠ করবে, এত উপবাস করতে হবে, তীর্থে যেতে হবে, এতগুলি বলিদান দিতে হবে—এ সব বৈধী ভক্তি এ সব অনেক করতে করতে ক্রমে রাগ ভক্তি আসে।
শাস্ত্রে অনেক কর্ম্ম করতে বলেছে তাই করছি; এইরূপ ভক্তিকে ‘বৈধী-ভক্তি’ বলে। আর ঈশ্বরে ভালবাসা থেকে, অনুরাগ থেকে যে ভক্তি হয় তাকে বলে ‘রাগ-ভক্তি’। যেমন প্রহ্লাদের। সে ভক্তি এলে আর বৈধীকর্ম্মের প্রয়োজন হয় না। প্রথমে একবার পাপ পাপ করতে হয়, কিসে পাপ থেকে মুক্তি হয়, কিন্তু তাঁর কৃপায় যদি একবার ভালবাসা কি রাগভক্তি আসে, তাহলে পাপপূণ্য সব ভুল হয়ে যায়। তখন আইনের সঙ্গে, শাস্ত্রের সঙ্গে তফাৎ হয়ে যায়। অনুতাপ কি প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, এ সব ভাবনা আর থাকে না। বাঁকা নদী দিয়ে গন্তব্য স্থানে যেতে অনেকক্ষণ সময় লাগে ও অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু যদি বন্যে হয় তাহলে সোজাপথে অল্প সময়ের মধ্যে যাওয়া যায়। যারা নিত্যসিদ্ধ, অথবা যাদের পূর্ব্বজন্মে অনেক কাজ করা আছে, তাদের রাগ ভক্তি। যেমন কোন পোড়ো বাড়ীতে বন জঙ্গল সাফ করতে করতে এক জায়গায় মাটি ঢাকা ফোয়ারা পাওয়া গেল, আর যাই সেই মাটিগুলি সরিয়ে দিয়েছে অমনি ফর্ ফর্ করে জল বেরুতে লাগল। যাদের রাগ-ভক্তি তারা এমন কথা বলে না, ‘আর ভাই কত হবিষ্য করলুম, কতবার বাড়ীতে পূজা আনলুম, কিন্তু কি হলো।’ খানদানী চাষা যদি বার বৎসর অনাবৃষ্টি হয়, তবুও চাষ দিতে ছাড়ে না। ভক্তি অমনি করলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। প্রেমাভক্তি না হলে ঈশ্বর লাভ হয় না। প্রেম, অনুরাগ না হলে ভগবান লাভ হয় না। গোপীদের প্রেমাভক্তি। অহংতা আর মমতা এই দুটী জিনিষ প্রেমা-ভক্তিতে থাকে। অহংতা কি না, আমি যদি কৃষ্ণের সেবা না করি তবে তাঁর অসুখ হবে। এতে ঈশ্বর বোধ থাকে না। আর মমতা কি না, ‘আমার’ ‘আমার’ করা। শ্রীকৃষ্ণের পায়ে পাছে কাঁটা ফোটে সেইজন্য গোপীদের সূক্ষ্ম শরীর তাঁর চরণ তলে থাকতো, গোপীদের এত মমতা।
কুমারকৃষ্ণ নন্দী সংকলিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও শাস্ত্রপ্রমাণ’ থেকে