অন্যের স্বভাব ও কর্ম্ম প্রশংসা বা নিন্দা করিবে না। এই সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি ও পুরুষের সহিত ওতঃপ্রোতভাবে এক—ইহাই চিন্তা করিবে। পরের স্বভাব ও কর্ম্ম যে প্রশংসা বা নিন্দা করে, সে সেই অসত্যের প্রতি আসক্তির ফলে শীঘ্রই স্বার্থভ্রষ্ট হইয়া থাকে, অর্থাৎ সমস্তই “ভগবদাত্মক” এই জ্ঞান হইতে বিচ্যুত হইয়া থাকে। রাজস অহঙ্ককারের কার্য্যে ইন্দ্রিয়বর্গ নিদ্রায় অভিভূত হইলে দেহস্থ জীব যেমন স্বপ্নরূপা মায়া প্রাপ্ত হইয়া থাকে এবং তুচ্ছ স্বপ্নভোগের পর চেতনাবিহীন হইয়া সুষুপ্তিরূপ মৃত্যু প্রাপ্ত হইয়া থাকে, সেইরূপ যে জীব নিজের ইষ্টানিষ্টের প্রাপ্তিকে দেব-মনুষ্যাদি কৃত বলিয়া দর্শন করে, সেই জীব জন্মগ্রহণ করিয়া দুঃখমিশ্রিত তুচ্ছ ভোগ প্রাপ্ত হইয়া পরে মৃত্যু প্রাপ্ত হইয়া থাকে, অর্থাৎ জন্ম-মরণ প্রবাহরূপ সংসারে পরিভ্রমণ করিতে থাকে।
পরমাত্মা ভিন্ন পরাধীন ও অনিত্য অপর সকলের মঙ্গল কি? অমঙ্গলই বা কি? কতটুকুই বা মঙ্গল, কতটুকুই বা অমঙ্গল? পরমাত্মা ভিন্ন পরাধীন ও অনিত্য অপর সকলকে যে মঙ্গলামঙ্গলের কারণ বাক্যের দ্বারা বলা হয় এবং মনের দ্বারা চিন্তা করা হয়, তাহা অজ্ঞান-কল্পিত, যথার্থ নহে। এ জগতে কাহারও সহিত দীর্ঘকাল বাস করা সম্ভব হয় না। নিজের শরীরের দ্বারাই যখন সম্ভব হয় না, তখন আর পৃথক্ জনের কথা কি বলিব? মৃত বা নষ্ট ব্যক্তির জন্য যদি কেহ শোক করে, তবে সে দুঃখের দ্বারা দুঃখই লাভ করিয়া থাকে এবং দুই প্রকার অনর্থ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। অতএব মনকে দৃঢ়রূপে নিগ্রহ করিতে মনই সমর্থ।
বাসনা কখন বাসনাভোগের দ্বারা তিরোহিত হয় না, বরঞ্চ অগ্নি যেমন ঘৃতাহুতিতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইয়া থাকে, তেমনি বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। পৃথিবীতে ধান্য, যব, সুবর্ণ, পশু ও স্ত্রী যাহা আছে, তাহাদের মধ্যে একটির দ্বারাও বাসনার পর্য্যাপ্ততা হয় না। অতএব বুদ্ধিমান ব্যক্তি ইহা বুঝিয়া ঐ সমস্ত বিষয়ে মোহ প্রাপ্ত হইবেন না। যখন মানব কর্ম্মের দ্বারা, মনের দ্বারা ও বাক্যের সমস্ত ভূতগণের প্রতি পাপভাব স্থাপন করে না, তখনই তাহার ব্রহ্মপ্রাপ্তি হইয়া থাকে। যখন ঐ মানব সেইসমস্ত প্রাণী হইতে ভয় পায় না বা ঐ মানব হইতে কেহ ভয় পায় না, এবং যখন তাহার কোন কিছু ভোগ করিবার ইচ্ছা হয় না বা কোন কিছুর প্রতি ঐ মানব বিদ্বেষও করে না, তখনই তাহার ব্রহ্মপ্রাপ্তি হইয়া থাকে।
দুষ্টবুদ্ধি ব্যক্তিগণ যাহা পরিত্যাগ করিতে পারে না, যাহা বৃদ্ধ হইলেও বৃদ্ধ হয় না এবং যাহা প্রাণান্তিক (অর্থাৎ প্রাণ না গেলে আর যায় না) রোগ বলিয়া কথিত হয়, সেই তৃষ্ণাকে ত্যাগ করিলে সুখ হইয়া থাকে। বৃদ্ধ হইলে তাহার কেশ বৃদ্ধ অর্থাৎ পক্ব হইয়া যায়, বৃদ্ধ হইলে দন্তগুলি বৃদ্ধ অর্থাৎ নড়িয়া যায় ও পড়িয়া যায়, কিন্তু ধনের আশা ও জীবনের আশা বৃদ্ধ হইলেও বৃদ্ধ হয় না। এ জগতে যাহা কামসুখ এবং দিব্য ও মহৎ সুখ বলিয়া অভিহিত হয়, তৃষ্ণাক্ষয়রূপ সুখের তাহারা ষোড়শাংশের যোগ্যতাও ধারণ করতে পারে না। বিষ্ণুমায়ায় মুগ্ধচিত্ত ব্যক্তিগণ তাঁহাকে জানিয়াও জানে না। নিদ্রিত অর্থাৎ মায়ামুগ্ধ জীবগণ জাগরিত হউক, তাহারা কেন মোহ-নিদ্রায় অভিভূত হইয়া আছে? সেই প্রভু ভগবানের মায়া অতীব বলবতী এবং মায়াবীদিগকেও মুগ্ধ করে।
স্বামী শংকরানন্দ সংকলিত ‘রত্নমালা’ থেকে