যদি ঈশ্বরের জন্য কারও প্রাণ ব্যাকুল হয়েছে দেখা যায়, তখন বেশ বোঝা যায় যে এর ঈশ্বর লাভের আর দেরী নাই। এই ব্যাকুলতার পরই ঈশ্বরদর্শন। আর বিবেক বৈরাগ্য এনে যদি কেউ সর্ব্বত্যাগ করতে পারে, তাহলে সাক্ষাৎকার হবে। সে ব্যাকুলতা এলে উন্মাদের অবস্থা হয়—তা জ্ঞান পথেই থাক আর ভক্তি পথেই থাক। ব্যাকুল হয়ে মার কাছে আবদার কর। ব্যাকুল হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। ‘দাও পরিচয়, নয় গলায় ছুরি দিব’।
তাঁর কাছে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর যাতে শুভযোগ ঘটে, অনুকূল হাওয়া বয়। ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তিনি সব সুযোগ করে দেবেন।
বৃন্দাবন লীলার ভিতর তোরা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীমতীর মনের টানটাই শুধু দেখ্ না, ধর্ না—ঈশ্বরে মনের ঐরূপ টান না হলে তাঁকে পাওয়া যায় না। কামগন্ধহীন না হলে মহাভাবময়ী শ্রীরাধার ভাব বুঝা যায় না। দ্যাখ দেখি, গোপীরা স্বামী, পুত্র, কুল, শীল, মান, অপমান, লজ্জা, ঘৃণা, লোকভয়, সমাজভয়,—সব ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্য কতদূর উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল!—ঐরূপ করতে পারলে তবে ভগবান লাভ হয়। সচ্চিদানন্দ-ঘন শ্রীকৃষ্ণকে দেখলেই গোপীদের মনে কোটী কোটী রমণসুখের অধিক আনন্দ উপস্থিত হয়ে দেহবুদ্ধির লোপ হত। তুচ্ছ দেহের রমণ কি আর তখন তাদের মনে উদয় হতে পারে রে? যখন কালী বাড়ীতে সন্ধ্যার আরতির কাঁসর ঘণ্টা বেজে উঠতো, তখন আমি গঙ্গার ধারে গিয়ে মাকে কেঁদে কেঁদে চীৎকার করে বলতুম, ‘মা, দিন ত গেল, কই, এখনও তোমার দেখা পেলুম না।’ আবার কখন বলতাম, “ওহে দীননাথ জগন্নাথ, আমি ত জগৎ ছাড়া নই নাথ! আমি জ্ঞানহীন, সাধনহীন, ভক্তিহীন আমি কিছুই জানি না, দয়া করে দেখা দিতে হবে।” রোজ রোজ তাঁকে ডাকা অভ্যাস করলে ব্যাকুলতা আসে। একদিনে হয় না। রাতদিন কেবল কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকলে ব্যাকুলতা কেমন করে আসবে?
ঠিক ঠিক ত্যাগী সাধু অর্থ, মান, যশ কিছুই চায় না। সাধু সর্ব্বদা ঈশ্বর চিন্তা করেন, ঈশ্বরের কথা বই কথা কোন না। সাধুর মন ঈশ্বরে বার আনা,—আর কাজে চার আনা। সাধুর ঈশ্বরের কথাতেই বেশী হুঁস। সাপের ন্যাজমাড়ালে আর রক্ষা নাই।—ন্যাজে যেন তার বেশী লাগে।
যারা ঠিক ঠিক ত্যাগী তারাই গেরুয়া পরবে। যাদের বার ভিতর এক হয়ে গেছে, আসক্তির লেশমাত্র নাই, তারাই গেরুয়ার যোগ্যপাত্র। যার মনে আসক্তি রয়েছে, মাঝে মাঝে পতনও হচ্ছে অথচ বাহিরে গেরুয়া, সে বড় ভয়ঙ্কর। তার চেয়ে সাদা কাপড় ভাল।
সাধু তিন রকমের দেখা যায়। উত্তম, মধ্যম, অধম। যারা উত্তম সাধু তারা খাবার চেষ্টা করে না। তাদের অজগর বৃত্তি, বসে খাওয়া পাবে। অজগর নড়ে না। ঈশ্বরও তাদের কোনও অভাব রাখেন না। তাঁকে পেতে যা যা দরকার সব জোগাড় করে দেন। যারা মধ্যম তারা ‘নমো নারায়ণ’ বলে দাঁড়ায়। আর যারা অধম, যেমন দণ্ডী ফণ্ডী তারা না দিলে ঝগড়া করে। ঠিক ঠিক সাধু—ঠিক ঠিক ত্যাগী সোনার থালও চায় না, মানও চায় না।
কুমারকৃষ্ণ নন্দী সংকলিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও শাস্ত্রপ্রমাণ’ থেকে