মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
এ এক আশ্চর্য মহাদেশ। প্রায় গোটাটাই পুরু বরফের চাদরে মোড়া। যেদিকে চোখ যায় কেবলই বরফ। ঠান্ডায় জমে গিয়েছে মাটি, জল, পাহাড়। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ কোন জায়গাটার কথা বলছি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ বন্ধুরা। এবারের হযবরল-এর পাতায় আমরা বরফের মহাদেশ আন্টার্কটিকা সফরেই বেরিয়ে পড়তে চলেছি।
আন্টার্কটিকার ভূগোল
কোথাও অভিযানে যাওয়ার আগে বন্ধুরা সেই জায়গার ভূগোলটা না জানলে মুশকিল হয়। তাই প্রথমেই পৃথিবীর এই অদ্ভুত অংশের ভূগোলটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুতে আন্টার্কটিকার অবস্থান। এক লক্ষ ৪২ হাজার কিমি আয়তনের আন্টার্কটিকা পৃথিবীর পঞ্চম সর্ববৃহৎ মহাদেশ। তবে এই বিশাল জায়গার প্রায় পুরোটাই (প্রায় ৯৮ শতাংশ) বরফে মোড়া।
এই মহাদেশের দু’টি ভাগ— উত্তর এবং দক্ষিণ আন্টার্কটিকা। উত্তর আন্টার্কটিকা তুলনায় একটু বেশি বড়। মহাদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এই উত্তর আন্টার্কটিকার অন্তর্গত। আয়তনের দিক থেকে উত্তর আন্টার্কটিকা অস্ট্রেলিয়ার মতো। এই অংশের বরফ প্রায় ২ কিলোমিটার পুরু। অন্যদিকে দক্ষিণ আন্টার্কটিকা জমে থাকা বরফের দ্বীপ নিয়ে গঠিত। উত্তর এবং দক্ষিণ আন্টার্কটিকাকে ভাগ করে বরফে ঢাকা ট্রানসনটার্কটিক পর্বতমালা। দক্ষিণ সাগর এই মহাদেশকে ঘিরে রেখেছে।
আন্টার্কটিকার বেশিরভাগটা জুড়েই রয়েছে হিমবাহ, হিমশৈল, বরফে ঢাকা পাহাড়। বরফের চরিত্র প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। কোথাও বরফ গলছে তো কোথাও ফাটল দেখা দিচ্ছে। কোথাও আবার বরফের চাঁই ভেঙে পড়ছে তো কোথাও জল জমে বরফ হচ্ছে। তবে কিছু অংশের বরফ অগুনতি সময় ধরে এখনও অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে।
আবহাওয়া
এই মহাদেশ হল পৃথিবীর চির শীতল স্থান! তাপমাত্রার বিচারে বিশ্বের সবথেকে শীতলতম স্থান হল আন্টার্কটিকা। তবে মহাদেশের উপকূলবর্তী স্থানগুলির তুলনায় মহাদেশের মধ্যভাগে তাপমাত্রা আরও কম। এই মহাদেশের তাপমাত্রা সবসময়ই জমিয়ে দেওয়ার মতো। তবে শীতের দিনগুলিতে তাপমাত্রা শূন্যের চেয়ে অনেকটাই নেমে যায়। এই দিনগুলিতে এখানকার অনেক জায়গার তাপমাত্রা -৭৫ ডিগ্রিতেও পৌঁছে যায়। আর জানো বন্ধুরা, পৃথিবীর শীতলতম তাপমাত্রার রেকর্ডও রয়েছে এই আন্টার্কটিকার মুকুটে। আন্টার্কটিকায় অবস্থিত রাশিয়ার ভোস্টক স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৩ সালের ২১ জুলাই সেখানকার তাপমাত্রা পৌঁছেছিল -৮৯.২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এটাই পৃথিবীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড!
এবার তোমাদের একটা অদ্ভুত তথ্য দিই। আন্টার্কটিকায় মূলত দু’টি ঋতু— গ্রীষ্ম এবং শীত। গ্রীষ্মের সময় পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু সূর্যের দিকে ঝুঁকে থাকে বলে এখানে গোটা গ্রীষ্মকালে আকাশে সূর্যের দেখা মেলে। পাওয়া যায় সূর্যের আলো। আবার শীতকালে পৃথিবীর এই অংশ থাকে সূর্যের বিপরীতে। তখন এখানে আলোর দেখা মেলে না বললেই চলে। অর্থাৎ বাকি বিশ্বের মতো দিন ও রাতের খেলা এখানে মোটের উপর অনুপস্থিত।
প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগৎ
আন্টার্কটিকা সম্পূর্ণরূপে একটি বরফের মরু প্রদেশ। এখানকার আবহাওয়া, জলবায়ু কোনওভাবেই উদ্ভিদ জগতের বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল নয়। তাই এখানে পা রাখলে বড় বড় গাছের দেখা মেলে না। তবে কি গোটা মহাদেশ জুড়ে গাছ নেই? আছে। সমুদ্র উপকূলের পার্শ্ববর্তী জায়গায় কিছু গাছ দেখা যায়। মূলত মস, লিভারওর্টস, লিচেনস বা ছত্রাক জাতীয় গাছ। এখানে মোট দু’ ধরনের গাছে ফুল ফোটে— আন্টার্কটিক হেয়ার গ্রাস এবং আন্টার্কটিক পার্লওর্ট। তবে আন্টার্কটিকার সমুদ্রে জীববৈচিত্র্যের কোনও অভাব নেই। পৃথিবীর এই অংশে নিরাপদে বাসা বাঁধে পেঙ্গুইন। তাদের হাঁটাচলা, খুনসুটি, সাঁতার দেওয়া সবই দেখার মতো। সমুদ্রে দেখা মেলে বিশালাকার নীল তিমির। একবার চাক্ষুষ করলে গায়ের রোম জেগে উঠতে বাধ্য। এছাড়াও অবাধে ঘোরাফেরা করে বিশেষ ধরনের তিমি মাছ কিলার হোয়েল বা ওরপাস। সমুদ্র তীরেই দেখা মিলবে আন্টার্কটিক ফার শিলের। পাশাপাশি এখানকার সমুদ্রে নানা ধরনের মাছ এবং জীবের বাস রয়েছে।
এখানে কারা থাকে?
এমন হিম শীতল আবহাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিকূল। তাই আন্টার্কটিকা মহাদেশে কোনও আদিম নিবাসী নেই। তবে বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন বহু মানুষ আন্টার্কটিকায় যাচ্ছেন। এঁরা মূলত বিজ্ঞানী এবং পর্যটক। গোটা বছরই আন্টার্কটিকায় গবেষণা চলে। গবেষণার জন্য পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশগুলি সেখানে রিসার্চ স্টেশন তৈরি করেছে। গরমকালে পৃথিবীর এই নির্মম অংশে প্রায় ১০ হাজার গবেষক কাজ করে থাকেন। তবে শীত আসলেই আবহাওয়া বেঁচে থাকার জন্য ভীষণ কঠিন হয়ে ওঠে। তাই তখন গবেষকের সংখ্যাও অনেকটাই কমে যায়। তথ্য বলছে, শীতকালে আন্টার্কটিকায় গবেষকের সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ১ হাজারের আশপাশে।
ইদানীং মানুষের মধ্যে আন্টার্কটিকা নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। তাই বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার ভ্রমণপিপাসু এখানে আসছেন। মূলত গ্রীষ্মকালেই পর্যটকদের আন্টার্কটিকা ভ্রমণের ছাড়পত্র পাওয়া যায়।
তবে এখন থেকেই আন্টার্কটিকা যাব যাব বলে বায়না ধরো না। আন্টার্কটিকায় যেতে গেলে আগে থেকে প্রস্তুত হতে হবে। অবশ্য পর্যটক হিসেবে গেলে তেমন কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু গবেষক হয়ে আন্টার্কটিকায় থাকতে গেলে প্রস্তুত হতেই হবে। কারণ এখানকার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকাটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। সাধারণত আন্টার্কটিকায় গবেষকরা রিসার্চ স্টেশনেই থাকেন। এখানে থাকা আর হোটেলে থাকা প্রায় সমান। তবে খুব খুশি হয়ো না। হোটেলের মতো এখানে কোনও কর্মী তোমার কাজ করে দেবে না। তোমার সব কাজ তোমায় নিজেকেই করতে হবে। এই রিসার্চ স্টেশনগুলিতে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপকরণ থাকে। অনেকসময় গবেষণার কাজে রিসার্চ স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাইরে থাকতে হতেও পারে। সেই ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা তাঁবুতেও দিন কাটিয়ে থাকেন। এমন সময় খাদ্য এবং বেঁচে থাকার অন্যান্য উপকরণ নিয়ে টেন্টে যেতে হয়। তাই এখানে গবেষক হিসেবে আসার আগে বেশকিছু শারীরিক এবং মানসিক শক্তির পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই পরীক্ষায় নির্বাচিত হলে শুরু হয় ট্রেনিং। সেই কঠিন প্রস্তুতিপর্ব পেরিয়েই পাড়ি জমানো যায় চির শীতের দেশে।
গবেষণা
গবেষণা আর আন্টার্কটিকা প্রায় সমর্থক। এখানে উপস্থিত বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে নিরন্তন বিজ্ঞান অন্বেষণে ব্যস্ত।
এখানকার বাস্তুতন্ত্রের উপর সকলের নজর রয়েছে। তাই পৃথিবীর প্রথম সারির দেশগুলি এখানকার বাস্তুতন্ত্র, জীব ও প্রাণীজগতের নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত। আন্টার্কটিকার বায়ু আর কলকাতার বায়ু এক নয়। আন্টার্কটিকায় এখনও বায়ু দূষণ পৌঁছায়নি বললেই চলে। তাই এখানকার বায়ু স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছ বায়ুর মধ্য দিয়ে টেলিস্কোপের মাধ্যমে খুব ভালো করে মহাকাশের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করা যায়। তাই মহাকাশ গবেষণার অঙ্গ হিসেবে বহু দেশ আন্টার্কটিকার শুষ্ক ভূমিকে বেছে নিয়েছে। এছাড়া উল্কার উপর গবেষণা করার জন্যও এই জায়গাটি অসম্ভব ভালো।
আন্টার্কটিকার বরফ, মাটি ইত্যাদি পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা প্রাচীনকালের আবহাওয়া সম্বন্ধে বিভিন্ন গবেষণা করে থাকেন।
যেহেতু পৃথিবীর এই অংশে মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীর উপস্থিতি সবথেকে কম, ফলে এখানকার বিভিন্ন অংশ বছরের পর বছর একইরকম অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। তাই বিশ্বের আদিম পরিস্থিতি সম্বন্ধে ধারণা করতেও গবেষকরা এই জায়গায় ছুটে আসেন।
আন্টার্কটিকা বা দক্ষিণ মেরুর আবহাওয়া বাকি বিশ্বের আবহাওয়ায় কতটা প্রভাব ফেলছে, এটাও গবেষণার বিষয়। আবার বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির দাপটে এখানকার তাপমাত্রার পরিবর্তন, বরফ গলে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়েও জোর গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা বুঝতে চাইছেন, এই অংশের বরফ গললে সমুদ্রের জল কতটা বাড়তে পারে, এই সমস্যা এড়ানো যায় কি না ইত্যাদি গুরুতর প্রশ্ন। তাই বুঝতেই পারছ বন্ধুরা, এই গবেষণা থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ কতটা বদলে যেতে পারে।
আন্টার্কটিকায় ভারত
আন্টার্কটিকা গবেষণায় পিছিয়ে নেই ভারতও। ন্যাশনাল সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড ওসিয়ান রিসার্চের অধীনে চলে ইন্ডিয়ান আন্টার্কটিক প্রোগ্রাম। ১৯৮১ সালে আমাদের দেশ প্রথমবারের জন্য এই মহাদেশে পাড়ি জমায়। আন্টার্কটিকায় ভারতের প্রথম গবেষণা কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে ১৯৮৩ সালে। রিসার্চ বেসটির নাম রাখা হয় দক্ষিণ গঙ্গোত্রী। এরপর ১৯৮৯ সালে তৈরি হয় দ্বিতীয় গবেষণা কেন্দ্র মৈত্রী। আন্টার্কটিকায় দেশের সর্বশেষ গবেষণা কেন্দ্রটি তৈরি হয় ২০১৫ সালে। এই রিসার্চ স্টেশনটির নাম ভারতী। এই রিসার্চ সেন্টারগুলিতে চলছে নিরন্তর গবেষণা। তাই এখানে গবেষক হিসেবে পৌঁছাতে চাইলে পড়াশোনায় কোনও খামতি রেখ না কিন্তু!