মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
দাদা তোর পায়ে পড়ি রে, মেলা থেকে ‘বই’ এনে দে’— হ্যাঁ আমাদের ছোটবেলায় ‘বই’-এর প্রতি টান বা ভালোবাসা এতটাই ছিল যে চড়কের মেলা, রথের মেলা, রাসের মেলা বাড়ি থেকে যেখানেই নিয়ে যাক না কেন, ইচ্ছেটা কিন্তু থেকেই যেত এই কলকাতা বইমেলায় যাওয়ার। আর সেখানে কোনও কারণে কোনও বার না যেতে পারলে আমাদের মন খারাপের কোনও সীমা পরিসীমা থাকত না। কিন্তু এখন তো তোমরা আমাদের মতো নও। এখন তোমরা ওই যাকে বলে ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়ে। তোমাদের ভেতর কি আর ছাপা বই-এর প্রতি তেমন টান আছে? মনে মনে এমন একটা আশঙ্কা, আর সেইসঙ্গে কিছুটা সংশয় আর সন্দেহ নিয়ে যেই ২৯ জানুয়ারি এবারের চুয়াল্লিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার উঠোনে পা দিয়েছি— ওমনি দেখি সামনে একঝাঁক ছেলেমেয়ের দল! আরে! তারা যে সব্বাই দেখি বাড়ির লোকের হাত ধরে ভিড় করেছে বিভিন্ন বই-এর স্টলের সামনে! তাহলে তো এখনকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভেতরেও বই পড়ার আগ্রহ সমানই আছে, একটুও কমেনি!
‘নিশ্চয়ই আছে। আরে! আছে বলেই তো আমাদের বইয়ের তালিকায় ছোটদের পছন্দের নানারকম বই আছে— ভূত, গোয়েন্দা, কার্টুন, হাসি, রূপকথা, অ্যাডভেঞ্চার ছোটদের প্রায় সব কিছুই। তাছাড়া ছোটদের বিশেষভাবে বই-এর প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য আছে আমাদের স্পেশাল কিছু বই’— বললেন লালমাটি প্রকাশ-এর কর্ণধার নিমাই গরাই। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি এক ছোট্ট মেয়ে, হাতে তার একটা লাল মখমলের বাক্স। ‘ওমা তুমি জানো না? এটা তো ‘পদী পিসির বর্মী বাক্স’! সে চোখ পাকিয়ে গর্বিতভাবে বলল আমায়। সত্যিই তো! এতো দেখি লীলা মজুমদারের কালজয়ী ছোটদের উপন্যাস! তাকে এমন সুন্দর মোড়কে হাজির করেছে ‘লালমাটি প্রকাশন’। নাম জানতে চাইলে মেয়েটি জানাল তার নাম আরুষী মিত্র, পড়ে ক্লাস টুতে।
ওমা! দেখো দেখো বোতলের ভেতর বই? কচি গলার বিস্ময় প্রকাশ শুনে তাকিয়ে দেখি, আরে হ্যাঁ— তাই তো! এগিয়ে গেলাম প্রশ্নকারিণীর দিকে। ক্লাস ফোরের তৃষা সেন ততক্ষণে ‘বোতল’টি থুড়ি ‘বই’টি সংগ্রহ করে ফেলেছে। নিমাই গরাই জানালেন, দাদাঠাকুরের অরিজিনাল ‘বোতল পুরাণ’-এর আদলেই তাঁরা এই বইটিকে নবরূপে এনেছেন। ‘ও বাবা, দেখো কত্ত বড় একটা ইলিশ মাছ!’ মাছের পেটের ভেতর আছে বই— নানারকম ইলিশের পদের রেসিপি। ক্লাস ফাইভের ঋক ঘোষ ততক্ষণে বায়না ধরেছে বইটি কেনার। তার বাবাও হাসিমুখে মেটালেন ছেলের আবদার। জানালেন, ছেলে ইলিশ মাছের খুব ভক্ত। সুতরাং এ বই কিছুতেই ঋক হাতছাড়া করবে না। আসলে তোমাদের মতো ছোটদের আকর্ষণ করছে এই ধরনের নতুন গেটআপের বই!
নতুন ‘গেটআপ’ অবশ্য সমস্ত মেলাপ্রাঙ্গণ জুড়েই! এবারের থিম রাশিয়া। আছে তাদের বিশাল প্যাভেলিয়ান। এছাড়া অংশগ্রহণ করেছে দেশ বিদেশের বহু পাবলিশার। জাপান, আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, পেরু, অস্ট্রেলিয়া, এগারোটি লাতিন আমেরিকান দেশ। সেই সঙ্গে আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকেও এসেছেন বই প্রকাশকরা—দিল্লি, হরিয়ানা, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, গুজরাত, অরুণাচল প্রদেশ, কেরল, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা।
সাংস্কৃতিক মঞ্চে শুরু হয়েছে বাংলার বাউল সঙ্গীত। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল দেখি দিব্যি তালে বাউলদের অনুকরণ করে নাচও জুড়ে দিয়েছে। আরে! একি! সামনে যে একটা পাহাড়! আর সে পাহাড়ের পাথরের খাঁজেখাঁজে আছেন আমাদের মনীষীরা— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগৎ সিং ও আরও অনেকে। না, ওটা পাহাড় না— আসলে ওটা একটি বইয়ের স্টল!
‘চ আগে ফুডকোর্টে গিয়ে খেয়ে নিবি, ক্ষিদে পায়নি তোর? কখন থেকে ঘুরছিস?’ মা হাত ধরে টানলেন একটি ছোট্ট ছেলের। ছেলেটি কিন্তু তার মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘না, খিদে পায়নি— প্লিজ মা! আগে চলো না ডায়নোসরের বই কিনি— আর ছোট ভীম— আর ডোরেমন— আর মার্ভেল অ্যাভেনজার্স’— আর ভূতের গল্পের বই—।’
নাঃ! যে ছেলের বইয়ের ক্ষিদে এত তার কি আর খাবার খাওয়ার কথা মনে থাকতে পারে? নাম জিজ্ঞেস করতে সে জবাব দিল তার নাম রোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, পড়ে ক্লাস থ্রিতে। বই পড়তে খুব ভালো লাগে বুঝি? আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রোহন বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল— জানাল তার কী কী বই আছে। সেই সঙ্গে এটাও জানাল যে রাতে ঘুমোবার সময় আজ তার মাথার কাছে থাকবে এই সব নতুন নতুন বই! নতুন বইয়ের গন্ধ তাহলে এ যুগের ডিজিটাল কিশোর-কিশোরীদেরও রাতের ঘুমে আবেশ এনে দেয়!
‘সেন্টুর কাটুন’-এর স্টলে আবার শুধুই কার্টুন বইয়ের সম্ভার। ছোটদের রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, মা সারদা, নেতাজি সুভাষ বোস থেকে শুরু করে হর্ষবর্ধন গোবর্ধন, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ডাকাত কানা বিশে, রঘু ডাকাত, আবার ভূতের গা ছমছম গল্প। লক্ষ করলাম বেশ কয়েকজন কচিকাঁচা বেশ আগ্রহের সঙ্গে নিজেরাই উল্টেপাল্টে দেখছে সেসব বই। কর্ণধার শান্তা শিকদার জানালেন তাঁর প্রতিক্রিয়া— ‘আমাদের এখানে ছোটরা কিন্তু বেশ ভালোবাসে কার্টুনের বই। ছবিতে গল্পের আকর্ষণ ওদের কাছে খুব। তাই আমরা শিশু সাহিত্যিকদের জনপ্রিয় গল্প ছবির মাধ্যমে আনি, বাচ্চাদের সাহিত্য সম্বন্ধে আগ্রহী করে তোলার জন্য। যাদের বাড়িতে বই পড়ার চর্চা আছে তারাই বইয়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। আমরা ইংরাজি কার্টুনের বইও রাখি যাতে ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরাও পড়ার আগ্রহ পায়।’
সামনেই ‘দেব সাহিত্য কুটির’-এর স্টল। সেখানে দেখলাম মা বাবারা ছেলেমেয়েদের কিনে দিতে ব্যস্ত ‘শুকতারার একশো এক ভূতের গল্প’ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ড, পুরনো পূজাবার্ষিকী ‘মণিদীপা’, ‘ইন্দ্রধনু’, ‘তপোবন’-এর নতুন সংস্করণ। হয়তো এর ভেতর দিয়েই আরেকবার নিজেদের শৈশবের দিনগুলোয় ফিরে যাওয়ার নস্টালজিয়া উপভোগও করে নিচ্ছেন ওঁরা।
সন্দেশ, শিশু সাহিত্য সংসদ, পত্রভারতী, সূর্য্য পাবলিশার্স— সব জায়গাতেই দেখলাম প্রায় একই ছবি, বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ছোটদের ভিড়ও! ক্লাস থ্রির সংহিতা ভট্টাচার্য বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে খোঁজ করছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ কবিতাটার। তার আবৃত্তির ক্লাসে লাগবে যে! সূর্য্য পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘ছোটদের আবৃত্তির শ্রেষ্ঠ ছড়া ও কবিতা’ বইটির ভেতর কবিতাটি খুঁজে পেয়ে তার খুশি আর ধরে না! ‘সূর্য্য পাবলিশার্স’-এর তরফ থেকে শুভ গরাই জানালেন, ‘প্রতিবছর কিন্তু ছোটদের সমান উৎসাহ আমরা লক্ষ করি এই বইমেলাকে ঘিরে। তাই আমি মানতে রাজি নই যে এখনকার ছেলেমেয়েরা বই ভালোবাসে না।’
স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসেছিলেন টিচাররা। তাঁরা যেমন শিক্ষামূলক বই নিলেন, তেমন আবার স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে নাটক করানোর উদ্দেশ্যে সুকুমার রায়ের ‘ভালো রে ভালো’, শৈলেন ঘোষের ‘ছোটদের নাটক সমগ্র’, বিমল ঘোষের (মৌমাছি) ‘শিশু রবি’ এবং ‘বিলে’র মতো একাধিক বই সংগ্রহ করলেন। দেখলাম, ছাত্রছাত্রীরা উৎসাহে রীতিমতো ছটফট করছে। ক্লাস সেভেনের আকাশ চট্টোপাধ্যায় তো প্রশ্ন করেই বসল, ‘স্যার, কবে থেকে রিহার্সাল শুরু হবে?’
গত বছর বিধাননগর সেন্ট্রাল পার্কের এই বইমেলায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এসেছিলেন। এবারে হয়তো সেই সংখ্যাটা অতিক্রম করে যাবে বলেই মনে হল সেদিনের ভিড় দেখে! চলছে ‘লিটারারি ফেস্টিভ্যাল’ও। তাতে বইমেলার প্রতিটি দিনই যোগ দিচ্ছেন বিশিষ্ট লেখক, কবি, নাট্য ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র নির্দেশক, ক্রীড়াবিদ, ইতিহাসবিদরা।
পাওয়া যাচ্ছে ছোটখাট নানারকম হস্তশিল্পের টুকিটাকি জিনিসপত্রও। আছে ফুডকোর্ট। সেখানে পিঠেপুলি খাওয়ার জন্য বেশ হুড়োহুড়ি দেখলাম ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে।
মেলা চলবে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা বারোটা থেকে রাত আটটা অবধি। বইমেলায় ঢুকতে গেলে কোনও টিকিট কাটতে হবে না।
সব মিলিয়ে বইমেলা জমজমাট। তোমরা যারা এখনও যাওনি তারা কিন্তু শিগগির ঘুরে এসো। কলকাতা বইমেলা তার হরেকরকম বইয়ের ঝুলি সাজিয়ে অপেক্ষা করছে যে তোমাদের জন্য! বই ভালোবাসো, বই চেনো, বই কেনো— দেখবে সারা পৃথিবী তোমার হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা দিয়েছে!
ছবি: সুফল ভট্টাচার্য