মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়তে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি। পড়তে পড়তে গা-ছমছমে কোনও অ্যাডভেঞ্চারে মনে মনে হারিয়ে যেতে আমরা কে না চাই বলো? কখনও হিচকক, কখনও জুলেভার্নে, কিংবা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল আবার কখনও বা সত্যজিৎ রায় এগিয়ে আসেন তাঁদের গল্পর সম্ভার নিয়ে আমাদের সেই কল্পবিজ্ঞানের জগতে পৌঁছে দিতে! প্রফেসর শঙ্কুর দৌলতে আমরা কখনও তাই মনে মনে চাক্ষুষ করি টেনিস বলের দ্বিগুণ সাইজের গ্রহ ‘টেরাটম’কে! কখনও আবার পৌঁছে যাই কোচাবাম্বার গুহায় গুহাবাসী পঞ্চাশ হাজার বছরের বনমানুষজাতীয় প্রাণীকে দেখতে! আবার কখনও কোনান ডয়েলের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এ গিয়ে প্রত্যক্ষ করি ভয়ঙ্কর সব প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের!
না, মনে মনে নয়, এই সব কিছু এবং সেই সঙ্গে আরও অনেক অনেক অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা আর মজার ব্যাপারস্যাপার যদি নিজের চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে কেমন হয়? বেশ শূন্য দুলতে দুলতে আমরা পৌঁছে যাই সেই মজার দেশে। সে দেশের নাম ‘সায়েন্স সিটি’।
রোপওয়ে চড়ে চমৎকার কেয়ারি করা গার্ডেনের সামনে নামা মাত্রই চমকে উঠবে প্রথমেই। আরে! ওগুলি কী? একটা মূর্তি! আর একটা মাছ! কিন্তু মূর্তিটা ও মাছটার কানে আর মুখে কান পাতলে যে শোনা যাচ্ছে ফিসফাস কথা! এও কি সম্ভব নাকি! ‘হুইসপারিং স্ট্যাচু’ আর মাছকে ছাড়িয়ে এগতেই চোখে পড়বে একটা খাঁচা আর তার বাইরে একটা পাখি। কিন্তু এ কী! সামনের হাতলটা ঘোরাতেই যে পাখিটা খাঁচার ভেতর ঢুকে গেল! তাও আবার একেবারে তোমার চোখের সামনেই! একি কোনও জাদু নাকি! দোলনা দেখেই ছুট্টে গিয়ে যেই বসে পড়বে তাতে, ওমনি দেখবে একই সঙ্গে তোমার পাশের দোলনাটাও নিজে নিজেই দুলছে! মানে তোমার ভাই, বোন বা বন্ধু যদি সঙ্গে থাকে, তাহলে একই সঙ্গে দুজনে মনের সুখে দোল খেতে পারবে এই ‘সিমপ্যাথেটিক সুইং’-এর মারফত। গার্ডেনে ঘুরতে ঘুরতে মিউজিক শুনতে ইচ্ছে হলে ‘সুরেলানল’-এ টোকা দিলেই বাজবে নানারকম সুরের জলতরঙ্গ। আদ্যিকালের যে পিন হোল ক্যামেরা’র কথা পড়েছ তোমার ফিজিকস বইতে, সেই ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দেখবে তোমার নিজেরই উল্টো ছবি! আরে ওগুলো কী? নানান আয়তনের ‘পুলি’। ওগুলো বইয়ের পাতা থেকে এখানে এল কী করে! টেনে দেখ ‘পুলি লিফট লোড’-এর দড়ি ধরে শক্তি পরীক্ষা করো নিজের! এমনি আরও অনেক মজার খেলা ছড়িয়ে আছে সায়েন্স সিটির বাগানে— ‘নিপকভ চাকা’ ‘লিফট ইয়োরসেলফ’ ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’, ‘হু উইনস দ্য রেস’। শীতের রোদ গায়ে মেখে ঘুরতে ঘুরতে মজা পেতে পেতে চটপট শিখেও ফেলতে পারবে অনেক কিছু যা হয়তো পড়ার বইতে পড়তে তোমার একটুও ভালো লাগে না!
আরও একটা ট্রেন না? না, না, লাইনের ওপর দিয়ে তো চলছে না। চলছে বাসের মতো গিয়ারের সাহায্যে। কিন্তু দেখতে অবিকল টয়ট্রেনের মতোই। ইচ্ছে হলে ওতে চড়ে পুরো ‘সায়েন্স সিটি’ ঘুরে আসতে পার।
বাইরেটা তো দেখা হল। এবার চলো ভেতরে আরও কী কী বিস্ময় সাজানো আছে তোমার জন্য দেখতে হবে তো!
একটা কাচের ঘর ঠিক যেন ভুলভুলাইয়া! ওর ভেতরে ঘুরে ঘুরে বেরবার পথ খুঁজতে গিয়েই বিপত্তি! দুম করে ধাক্কা খাবে কাঁচের দেওয়ালে! আরে ওটা যে দেওয়াল তা তো তুমি বুঝতেই পারনি। তাইতেই তো এমন বিপত্তি। ওটা তো তুমি পথ ভেবেছিলে। তাহলে কী হবে। আরে এটাই তো এই মিরর ইমেজ-এর মজা। কোনও রকমে বেরতেই সামনে একটা অনন্তকূপ। নীচে তাকালে তল খুঁজে পাবে না। কিন্তু ওটা কি সত্যিই অনন্ত? নাকি তোমার চোখের ভুল। ওই তো সামনে একটা সাইকেল চড়তে হবে কিন্তু সাবধানে। কারণ এই ইউনি সাইকেল-এ নেই কোনও হ্যান্ডেল, সবটাই ব্যালান্সের খেলা। আরে ও দুটো কী? দুটো মুখোমুখি মানুষের মুখ যেন কথা বলছে একে অন্যের সঙ্গে। না না চোখের ভুল— ও দুটো তো কলসি বনবন করে ঘোরালেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে মানুষের মুখ— এমনি এই হুইসপারিং কলসি’র খেলা।
হাত দিয়ে পিয়ানো বাজায় এ তো সবারই জানা— কিন্তু পা দিয়ে! সে আবার কী? ওয়াক অন পিয়ানোতে তুমি শুধু হাঁটবে আর নানা রকম সুর বাজবে পিয়ানোতে! তোমাদের মধ্যে যারা ছবি আঁকতে ভালোবাসো তাদের জন্যও রয়েছে আশ্চর্য এক লিকুইড পেন্টিং-এর মজা। সুইচ টিপলেই তেল ভাসবে আর তৈরি হবে নানা ডিজাইন। এক্কেবারে চোখের সামনে। একরাশ নানান সাইজের পিন রাখা বোর্ড— ‘পিন স্ক্রিন’ তলায় হাত দিলেই দেখবে তোমার হাত দুটোই পিনের হয়ে গিয়েছে অথচ তোমার একটুও ব্যথা লাগছে না। সাবধান, সামনেই সুড়ঙ্গ। ‘ভার্টিজ’ যার নাম ভেতরে ঢুকলেই মাথা ঘুরতে পারে।
‘নিউম্যাটিক মেইল’ খেলায় সুইচ টিপে একটা বলকে শুধু পাইপের ভেতর বলটা প্রবেশ করাতে হবে তোমায়। বলটা তারপর নিজেই চলে যাবে পাইপ ধরে ধরে বহু দূরে। তোমরা নিশ্চয়ই অনেকে স্টেজে ম্যাজিশিয়ানকে কোনও জিনিসকে শূন্যে ভাসানোর খেলা দেখে হতভম্ব হয়েছ? আরে! তুমি নিজেই একটা হাতল ঘুরিয়ে একটা বলকে চোখের সামনে শূন্যে ভাসিয়ে দিতে পারবে। তার জন্য তোমায় ম্যাজিশিয়ান হতে হবে না। এমনকী ইচ্ছে করলেই সেই বলকে বাস্কেটেও ফেলতে পারবে এই ‘ফ্লোটিং দ্য বল’ খেলার মধ্য দিয়ে। তেমনি ‘বায়ু কামান’-এ ধাক্কা মারলে উল্টো দিকের দেওয়ালের ঝুলমুলি কাঁপাতে পারবে অনায়াসেই।
স্পিনিং ইরেজ খেলায় চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একসময় দেখবে ভেতরে রাখা কয়েন ভ্যানিস হয়ে যাবে ঠিক সোনারকেল্লার ড. হাজরার মতো। ওকি। ওটা কী। একটা ফল ভর্তি থালা আর তার মধ্যে একটা মানুষের মুণ্ডু। চোখ কচলে ভালো করে তাকালেও তো কই মিলিয়ে যাবে না তো। তার মানে সত্যিই মুণ্ডুটা প্লেটের ওপর। কিন্তু মানুষটার বাকি শরীরটা কোথায়? দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তো। ‘হেড অন দ্য প্ল্যাটার’ দেখতে দেখতে তোমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাবেই। না এখানেই শেষ নয়— আরও অনেক কিছুই এখনও বাকি আছে তো।
একদম চোখের সামনে সূর্য, চাঁদ, মঙ্গল গ্রহ দেখবে? কিংবা পৃথিবী? আকাশেও নানা দেশের এরোপ্লেনের কেমন যানজট হয় ঠিক আমাদের পৃথিবীর রাস্তার মতো দেখতে চাও? তবে চলে এসো ‘ডায়নামোশান হল-এর ভেতর— এস ও এস মানে ‘সায়েন্স অন এ স্ফেয়ার’ দেখতে। নাসা ও আমেরিকার নেওয়া ডেটা দিয়ে বুঝিয়ে দেবে সৌরজগৎ-এর নানান বৈচিত্র্যের কথা। আর এই শো দেখতে দেখতেই কখন যে তোমার জিওগ্রাফি পড়া হয়ে যাবে তা তুমি টেরই পাবে না। শুধু জিওগ্রাফি বুঝলেই তো হবে না ইতিহাসও তো জানতে হবে। ৩৬০ ডিগ্রির সিলিন্ড্রিকাল স্ক্রিনে ছ’হাজার বছরের পুরনো মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস দেখতে হবে— চোখের সামনে থাকবে তাদের মডেল, তারা কেমন করে জীবন কাটাত, খেত, শিকার করত, সব। হিস্ট্রি বইয়ের পাতায় সিন্ধু সভ্যতার কথা পড়েছ তো? সে সব কিছু চোখের সামনে দেখতে পাবার মজাই আলাদা কী বল? পাবে, সব কিছুই পাবে, তাদের জীবনযাত্রা সুন্দর মডেলের মাধ্যমে সচক্ষে দেখে মাথায় গেঁথে নিতে পারবে। ব্যস, পড়া হয়ে যাবে ইতিহাসও।
আরে! ওগুলো কী? প্রজাপতি না? হ্যাঁ তাই তো। ‘বাটারফ্লাই এনক্লেভ’-এ চাষ হচ্ছে মৌমাছির। গাছের পাতার ফাঁকে তারা জন্ম নিচ্ছে তারপর উড়ে উড়ে ফুলে ফুলে মধু খাচ্ছে। এই সুন্দর প্রজাপতিদের দেখতে দেখতে মনটা খুশিতে ওদের মতোই যে রঙিন হয়ে উঠবে তা হলফ করে বলতে পারি।
না, এবার চাই গা-ছমছম করা অ্যাডভেঞ্চার। কি ঠিক বলেছি তো? তাহলে চলো যাই ‘ডার্ক রাইড’-এ চড়তে। একটা আলো আঁধারি সুড়ঙ্গ। তুমি চড়ে আছ একটা ‘ইলেকট্রিক কার’-এ। শুনতে পাচ্ছ বিজাতীয় চিৎকার। এদিকওদিক তাকাতে তাকাতেই তোমার মুখের সামনে আসছে দুটো জ্বলন্ত চোখ— আর ইয়া বড় বড় দাঁত। সে দাঁতওয়ালা মুখটা খুলছে, বন্ধ হচ্ছে— তোমার দিকে তার গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে, হঠাৎ গাছের ফাঁকে দেখতে পাবে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার হুঁঙ্কার ছাড়ছে। নানা প্রজাতির ডায়নোসর মামোথ, প্রাগৈতিহাসিক যুগের নানা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জন্তুজানোয়ারের রাজত্ব এটা। গাড়ি করে যেতে যেতে তাদের দেখতে পাবে তুমি, কিন্তু ভয় পেও না যেন।
এবার বুকের রক্ত হিম করা অ্যাডভেঞ্চারে যেতে চাও? তাহলে চলো ‘অসট্রোনয়েড’ দেখে আসি। এজন্য যেতে হবে ‘স্পেস থিয়েটার’-এ। তুমি পৌঁছে যাবে মহাকাশে। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের স্পেস স্টেশন দেখতে। মহাকাশে গ্রহ, নক্ষত্র, তারা —সবকিছুর মধ্যে মহাশূন্যে ভাসতে ভাসতে একটু একটু ভয় করতেই পারে। কিন্তু সে ভয়কে জয় করলেই কিন্তু দেখবে দারুণ উপভোগ্য পুরো ব্যাপারটাই।
ঠিক এমন ভাবে দেখে আসতে পার ‘গালাপেগোস চলে যেতে পার পৃথিবীর শুরুর সময়। প্রাচীনতম কচ্ছপ আর অন্যান্য জীবজন্তুদের দেখতে দেখতে কখন যেন চলে যাবে সেই কালে। মাথার ওপর কখনও ভেঙে পড়বে কোনও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ডিম। কখনও তারা কেউ এগিয়ে আসবে তোমার দিকে। তবে ভয়টা একবার কাটিয়ে উঠতে পারলেই এক বিরল অভিজ্ঞতা যে হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
সায়েন্স সিটি ঘুরবে আর ‘টাইম মেশিন’-এ চড়বে না তা কখনও হয়। চলো একটা সাদা ধবধবে টাইম মেশিনে চড়ে বসি। কী রেডি তো? ‘দ্য ওয়াল অফ চায়না’য় ঘুরে আসি তাহলে? এক চীনা ভদ্রলোক নিয়ে যাবেন গাড়ি চালিয়ে— তিনি যখন চড়াই উতরাই ভাঙবেন, তুমিও কিন্তু ঝাঁকুনি খাবে। তারপর তিনি তোমাকে নিয়ে যাবেন কখনও চীনের প্রাচীরের সরু ধার দিয়ে, কখনও কালো সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে, কখনও উঁচু রাস্তা থেকে আছড়ে পড়বে তার গাড়ি। তুমি হয়তো চেঁচাবে। এদিক ওদিক বেসামাল হয়ে হেলে পড়বে তবে শক্ত করে ধরে থেকো সামনের রড, তাহলে আর কোনও ভয় নেই। টাইম মেশিন চড়ে ফিরে আসার পর দেখবে মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে। এমন সুযোগ ক’জন পায় সেটা ভাব একবার।
ফেরার পথে আবার রোপওয়ে। তবে ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। আলো ঝলমল সায়েন্স সিটিকে ওপর থেকে দেখার মজা নিতে নিতে নীচে দেখবে রঙিন ‘মিউজিক্যাল ফাউন্টেন’— গানও শুনতে পাবে।
কী? তর সইছে না তো? সারা বছর সকাল ন’টা থেকে রাত আটটা অবধি খোলা সায়েন্স সিটি বছরের সব ক’টা দিন, শুধুমাত্র দোলের দিনটা ছাড়া। তাহলে দিনটা চটপট ঠিক করে ফেল সায়েন্স সিটি তার হরেক মজার বিপুল সম্ভার নিয়ে অপেক্ষা করছে যে তোমার জন্য।