মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
পাড়াময় ঘুরতে ঘুরতে রুবেন, দিঘি, অর্চি, নভোনীল, সুবর্ণা, সার্থক, শামীমাদের রাজি করিয়ে ফেললাম। দুপুর বারোটায় এক অফুরান আনন্দ নিয়ে বইমেলা মুখো হলাম ডাঙাডিগলা থেকে। যেতে যেতে বাদাম, কখনও জয়নগরের মোয়া আবার কখনও বা চুইংগাম। কারও মুখেরই বিরাম দিল না। নভোনীল গান ধরল মজা করে, ‘যাবোই, আমরা যাবোই। এখন বইমেলাতে যাবই আমরা যাবই, আমরা যাবই।’ রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গান একটু অদলবদল করে আমরা সবাই কণ্ঠ দিলাম। কখন যে করুণাময়ীর কাছে কলকাতা বইমেলায় চলে এলাম বুঝতেও পারিনি। শহর দেখতে দেখতে ডাঙাডিগলা থেকে বড়সড় একটা সুমো গাড়ি চেপে ছোটকাকুর সঙ্গে চলে এসেছি। এয়ারপোর্ট হয়ে আসতে হয়েছে বলে কত এরোপ্লেন দেখলাম নামছে আর উঠছে।
মেলার মধ্যে ঢুকে কত যে বই কিনলাম তার অন্ত নেই। ছোটকাকু বললেন, ‘শুধু কিনলেই হবে? পড়তে হবে তো!’ আমাদের সমস্ত প্রিয় লেখকদের সঙ্গে মেলায় দেখা হয়ে গেল। তাঁদের চাক্ষুষও করা হল, বইয়ের সঙ্গেও দেখা হল। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, প্রচেত গুপ্ত, রাজেশ বসু, জয়ন্ত দে, দীপান্বিতা রায়, তপনকুমার দাস, সুনির্মল চক্রবর্তী, রতনতনু ঘাটী, অমরেন্দ্র চক্রবর্তী শুধু তাই নয়, সত্যজিৎ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শামসুর রহমানের সঙ্গেও দেখা হল তাঁদের বইয়ের মধ্যে দিয়ে।
নভোনীল বলল, ‘জানো ছোটকাকু, ইদানীং পড়ার মতো তেমন লেখা-জোকা আর পাচ্ছি না আমরা।’ বাবিন বলল, ‘ঠিক বলেছিস। হয় সেইসব বইপত্র তাদের মেধা হারিয়েছে নতুবা আমরাই একদল পাঠক-পাঠিকা আজকাল একেবারে বোকা-হাঁদা হয়ে পড়েছি। তবুও বইমেলা অনেক নতুন বইও আমাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়। তবে পুরনো লেখকদের বই আবার নতুন করে প্রকাশিত হওয়ায় সেগুলো আমরা যেমন পড়ছি আমাদের অভিভাবকেরাও পড়ছেন।’—ঠিকই তো। আমি কিনেছি বলরাম বসাক আর কার্তিক ঘোষের বই। আমার মাও খুব পছন্দ করেন। শামীমা বলল।
ঘুরতে ঘুরতে বিশ্বভারতী, প্রতিক্ষণ, পত্রভারতী, পুনশ্চ, দে’জ, আনন্দ, দেব সাহিত্য কুটীর, শিশু সাহিত্য সংসদ, মিত্র ও ঘোষ, গাংচিল, ছোটদের কচিপাতা থেকে যার যেমন খুশি পছন্দমতো কেনা কাটা করে ‘ফুড পার্কে’ গিয়ে লুচি আলুরদম আর আইসক্রিম খেলাম।
তারপর আবার চক্কর। সারা মাঠ জুড়ে বইয়ের স্টলগুলো একেবারে জমজমাট। আমরা সবাই সহমত হলাম যে আমাদেরই বয়সি যারা দশম একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ছি আর দেদার বই কিনছি, প্রায় সবাই এসেছি দূরদূরান্ত মফস্সল থেকে। তাদের চোখ-মুখ আর কথাবার্তা শুনেই মালুম হল। শহরে আমাদের বয়সি পাঠক খুব কম। কেন এমন কে জানে! আমার মনে হয় তাদের হয়তো ছোটকাকু নেই। আমাদের কিন্তু প্রত্যেক বন্ধুর একটা করে ছোটকাকু দরকার। যিনি পিকনিকে নিয়ে যাবেন, বইমেলায় নিয়ে আসবেন। এমনকী সিনেমা এবং সার্কাসও দেখাবেন। কখনও কানমোলা দিয়ে বলবেন, ‘ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ ছেড়ে তোরা একটু বইমুখী হয়ে ওঠ।’
ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ ছোটকাকু অ্যাই শিবনাথ বলে একজনকে ডাকলেন। ভদ্রলোক ছোটকাকুরই বয়সি। সঙ্গে স্ত্রী-কন্যা।
—আরে রণিত! তুই? এত সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে?
—প্রত্যেক বছরই তো নিয়ে আসি এদের। কিছুদিন পরে যখন কেউ কেউ দলছুট হবে, আবার অন্য কেউ চলে আসবে এই গ্রুপে।
—আছিস ভালো। চালিয়ে গেলি বেশ!
—আরে সামান্য এক স্কুল মাস্টারের এতগুলো ভাইপো-ভাইঝি থাকলেই যথেষ্ট। আর কী চাই?
—রিনিকে তো তুই চিনিস। এই আমার কন্যা ইমন। বহু বছর পরে বইমেলায় এলাম। ইমন বরোদায় ‘হিস্ট্রি অফ আর্ট’ নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হয়েছে এ বছর।
—কেমন লাগছে তোমার ইমন?
—খুব ভালো। একটা বড় তালিকা নিয়ে এসেছি। ঘুর ঘুরে বই কিনব।
—বেশ! বেশ! তুমি খুব পড় নিশ্চয়ই।
—সময় পেলেই। বেশির ভাগই বাংলা বই। ছড়া, কবিতা, গল্প কী নয় কাকু!
আমাদের দিকে তাকিয়ে ছোটকাকু বললেন, ‘তোদের শিবনাথকাকু ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। ডাক্তার, আমরা স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। ওদের বাড়িটাই একটা লাইব্রেরি ছিল।’
শিবনাথকাকু আমাদের আর এক দফা আইসক্রিম খাওয়ালেন। তারপর বললেন চলো আমার সঙ্গে। আমাদের দলের সবচেয়ে ছোট্ট সদস্য ক্লাস সেভেনের দিঘিকে কিনে দিলেন রং-বেরঙের কত না মজার বই সুকুমার রায় অবনীন্দ্রনাথের পাশাপাশি হিমাদ্রিকিশোর, হাননান আহসান, তিলোত্তমা মজুমদার এবং দীপ মুখোপাধ্যায়ের বই। আর আমাদের কাউকে দিলেন গোগোল, টেনিদা, ঘনাদা, ফেলুদা, শঙ্কু, অর্জুন, কর্নেল আর ঋজুদার পাশাপাশি প্রত্যেককে একটা করে আবোল তাবোল।
আমরা বুঝলাম ছোটকাকুর পাশাপাশি শিবনাথকাকুদেরও আজ বড় প্রয়োজন।