আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
তবে আমাদের পৃথিবীতে ভর বদলায় নিশ্চিতভাবে। বিজ্ঞানীরা সেটা জানেন। সবচেয়ে বিপদের কথা হল, ভর মাপার বাটখারাটাই বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তোমাদের কি কখনও সন্দেহ হয়েছে, দোকান-বাজার থেকে যে সমস্ত জিনিস কিনছি আমরা, তার সবারই ওজন কিঞ্চিৎ কম? বাজার থেকে অত দরাদরি করে যে এক কেজির ইলিশ মাছটা কিনলাম, তা যে আদপে এক কিলোর চাইতে কম হলে সে বড় দুঃখের কথা হবে। বিজ্ঞানীরা কিন্তু তেমনটাই বলছেন।
‘মেট্রোলজি’ হল পরিমাপের বিজ্ঞান। গত বছরের নভেম্বরে ফ্রান্সের ভার্সাইতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় বিজ্ঞানীদের। ভর ও পরিমাপ নিয়ে। সেখানেই ঠিক হয় যে, ২০১৯-এর ২০ মে, অর্থাৎ বিশ্ব পরিমাপ দিবস থেকেই কার্যকর হবে কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞা। যা এতদিনের চলতি সংজ্ঞার চাইতে অনেক বেশি সঠিক। আসলে আজকের দুনিয়ায় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন সমস্ত ধরনের পরিমাপগুলিকেই হতে হবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রকমের ‘সঠিক’। এবং অবশ্যই ‘অপরিবর্তনীয়’। আর এখানেই ছিল ভর নিয়ে খানিক সমস্যা।
সঠিক? তার মানে আগের সংজ্ঞাটায় কী গলদ ছিল? আচ্ছা, কী ছিল সেই সংজ্ঞাটা? ১৮৮৯ থেকেই ৯০ শতাংশ প্লাটিনাম আর ১০ শতাংশ ইরিডিয়ামের সংকর ধাতুর তৈরি ‘ল্য গ্রঁদ কে’ নামের চোঙ আকৃতির এক ধাতব খন্ডের ভরকে ধরা হয়ে এসেছে এক কিলোগ্রাম। পদার্থবিদ্যার বইতে এমন সংজ্ঞাই পড়েছি আমরা সকলে। ১৩০ বছর ধরে। একে বলা হয় 'ইন্টারন্যাশনাল প্রোটোটাইপ অব কিলোগ্রাম' (আইপিকে)। এবং এটাই ছিল একমাত্র মূল একক যা নির্ভর করে ছিল কোনও বস্তুর উপরে। প্যারিসের উপকণ্ঠে সেন্ট ক্লাউডে যা রাখা আছে দু’টি কাচের জারের ভিতরে।
এই আইপিকে-র ‘কপি’ বা ‘রেপ্লিকা’ রয়েছে পৃথিবীর নানা জায়গায়। সেগুলিকে কখনও সখনও ফ্রান্সে পাঠানো হয় মূলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য। আর সেখানেই গন্ডগোল। দেখা যাচ্ছে যে এই ‘কপি’-গুলির ভর মূল আইপিকে-র থেকে বদলে যাচ্ছে। এক কিলোগ্রামের ধাতব খণ্ডটির ভর গত ১৩০ বছরে কমে গিয়েছে ৫০ মাইক্রোগ্রামের মতো। এটা অবশ্য পরিষ্কার নয় যে, কপি-গুলি ভর হারাচ্ছে, নাকি মূল আইপিকে-ই বাড়াচ্ছে তার ভর। কিন্তু যেটাই হোক না কেন, বিষয়টা অনভিপ্রেত এবং বেশ গোলমেলে। ভরের পার্থক্যটা যতই মাইক্রোগ্রামে হোক না কেন।
আসলে ‘ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম অব ইউনিটস’ (এসআই)-এর সাতটি মূল এককের মধ্যে চারটিই পদার্থবিদ্যার কোনও ধ্রুবকের উপর নির্ভরশীল ছিল না। এগুলি হল বিদ্যুতের একক ‘অ্যাম্পিয়ার’, তাপমাত্রার একক ‘কেলভিন’, পদার্থের পরিমাণের একক ‘মোল’, আর ভরের একক ‘কিলোগ্রাম’। বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন সমস্ত একক-কেই পদার্থবিদ্যার কোনও না কোনও ধ্রুবকের সাহায্যে সংজ্ঞায়িত করা যায় কিনা। কারণ ধ্রুবকগুলি অপরিবর্তনীয়, বদলাবে না ভবিষ্যতেও। এমনকী এদের পাওয়া সম্ভব যে কোনও সময়, যে কোনও জায়গা থেকেই।
যেমন আজকের দিনে ‘মিটার’-কে আর আগেকার মতো সংজ্ঞায়িত করা হয় না। এখনকার সংজ্ঞা অনুসারে শূন্যে আলো এক সেকেন্ডে যতটা যায় তার ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ ভাগের এক ভাগ হল এক ‘মিটার’। আবার সময়ের একক ‘সেকেন্ড’ হল যে সময়ে একটা সিজিয়াম পরমাণু ৯,১৯২,৬৩১,৭৭০ বার দোল খায়।
তাই চাই একটি উপযুক্ত ধ্রুবক যার এককের মধ্যে থাকবে কিলোগ্রাম। খুঁজে-পেতে পাওয়া গেল তা। বিজ্ঞানীরা ঠিক করেছেন যে, কিলোগ্রামকে সংজ্ঞায়িত করা হবে প্লাঙ্ক ধ্রুবকের সাহায্যে, বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্কের নামে যে ধ্রুবক। যা জড়িয়ে রয়েছে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ মাপার তত্ত্বের সঙ্গে। প্লাঙ্ক ধ্রুবকের একক হল ‘কিলোগ্রাম বর্গমিটার প্রতি সেকেন্ড’। এর মধ্যে রয়েছে ‘কিলোগ্রাম’। এখান থেকে মিটার এবং সেকেন্ড-কে তাড়াতে পারলেই যেটা পড়ে থাকবে তা হল বিশুদ্ধ কিলোগ্রাম। আর সেজন্যে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে মিটার এবং সেকেন্ডের সংজ্ঞা।
ফোটন কণার মাধ্যমে কিলোগ্রামকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ কেটের্লে দেখিয়েছেন যে, সিজিয়াম পরমাণুর একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ১৮৭৫৫২১৪-এর পরে ৩৩টা শূন্য দিলে যা হয়, ততগুলো ফোটনের ভর এক কিলোগ্রাম।
কিন্তু প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের মান এতই ক্ষুদ্র যে তা ঠিকঠাক বের করা সহজ নয়। অসম্ভব কঠিন তার নির্ভুলতা বজায় রাখা। এখানেই ব্যবহার করা হচ্ছে বিজ্ঞানী ব্রায়ান কিবলের স্কেল, যাতে এই প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবকের পরিমাপে ভুল হবে ০.০০০০০১ শতাংশেরও কম। কেটের্লে যেমন বলেছেন, ‘ফোটন, পরমাণু, তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপার প্রতিটা নতুন পদ্ধতি যতই নিখুঁত হবে, ভরের মাপও হবে ততটাই নিখুঁত। মানুষের তৈরি কোনও বস্তু এতটা নিখুঁত পরিমাপ করতে পারবে না।’
যাই হোক, কিলোগ্রাম তো বদলে গেল। আমাদের বাজার-দোকানে কিন্তু কোনও তফাৎ চোখে পড়েনি এখনও। এই বদলে যাওয়া কিলোগ্রাম অবশ্যই প্রভাব ফেলবে না আমাদের দৈনন্দিন দোকান বাজারের কেনাকাটায়। আমাদের দৈনন্দিন বাজার করার ক্ষেত্রে দাঁড়িপাল্লার একদিকে বাটখারার পরিবর্তে ফোটন গুনে গুনে রেখে অন্যদিকে কাতলা মাছের ওজন হবে, এটা কখনওই হবে না বাস্তবে। কিন্তু এই বদলটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপ-বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক কাজ-কর্মে। যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে ওষুধ শিল্প, ন্যানো টেকনোলজি ও ধাতুর সংমিশ্রণে। কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞার সাহায্যে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হবে অ্যাম্পিয়ার, কেলভিন বা মোলের মতো এককগুলিও। সত্যি বলতে কী, বিজ্ঞানের দুনিয়ায় এটা যেন একটা যুগের অবসান। সেই সঙ্গে সূত্রপাত এক নতুন ‘নিখুঁত’ যুগের। আর হ্যাঁ, এবার থেকে ছাত্রদেরও পড়ার বইতে পড়তে হবে কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞা।
আচ্ছা, কী হবে সেই আইপিকে-র, ১৩০ বছর ধরে যা ছিল অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এক মাপদণ্ড? তাকে কি পাঠিয়ে দেওয়া হবে কোনও জাদুঘরে? না, সেই ধাতুখণ্ডটির লেগাসিকে সম্মান জানিয়ে তাকে রেখে দেওয়া হবে তার আগের জায়গাতেই, আবহাওয়া-নিরোধক ভল্টের মধ্যে। সেটাই যেন হয়ে যাবে এক জাদুঘর। তবে বিজ্ঞানীর অনুসন্ধিৎসা তো অসীম। তাই ভবিষ্যতে নতুন মানদন্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হতে থাকবে এই ধাতব-খণ্ডের ভর। তা কতটা কমে সময়ের সঙ্গে।
পদার্থবিদ্যার একক ঠিক করার এই পর্যায় আমাদের দেখাল যে ধ্রুবকের সাহায্যে একক নির্দেশ করতে না পারলে রয়েছে গন্ডগোলের সম্ভাবনা। আমাদের সমাজ-জীবনে, তার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও যতটা সম্ভব এই অপরিবর্তনীয় বিষয়গুলিকে খুঁজে বের করে, তাকে ভিত্তি করেই বোধহয় এগনো উচিত। নইলে জীবনের অনেক হিসেবেই গরমিল হয়ে যাবার পুরো সম্ভাবনা।
অতনু বিশ্বাস
লেখক: ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে