আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
তোমরা বিশ্বকাপের খেলা দেখছ নিশ্চয়ই। ভারতের অংশগ্রহণ হল ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রধান আকর্ষণ। তবে, অংশগ্রহণই শুধু নয়, দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত এবারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অন্যতম দাবিদার। তাই ভারতীয়দের কাছে এই ক্রিকেট উৎসবের উন্মাদনাই আলাদা। এবারের ফরম্যাট অনুযায়ী প্রাথমিক পর্বে অংশগ্রহণকারী ১০টি দল একে অপরের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। তারপর সেরা চারটি দল লড়বে সেমি-ফাইনালে। ফেভারিটের তালিকায় না থাকলেও নামী দলগুলির পাশাপাশি যে দলটি ক্রিকেটপ্রেমীদের বাহবা কুড়োচ্ছে, তা হল আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে ১০ নম্বরে থাকা আফগানিস্তান। আফগানিস্তান যে কাপ জেতার দাবিদার বা নিদেনপক্ষে সেমি-ফাইনালে যাবে, এমন দুরাশা কেউই করছেন না, স্বয়ং আফগানরাও নন। বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জনই তাদের কাছে একটা বিরাট ব্যাপার। ইংল্যান্ডের বুকে ক্রিকেটের মহাযজ্ঞে অংশগ্রহণই তাদের কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচে যে লড়াই আফগানরা মেলে ধরতে পেরেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। যদি একটা বা দু’টো ম্যাচ জিতে তারা দেশে ফিরতে পারে, তাহলে তাদের কাছে সেটাই হবে বিশ্বজয় করার মতো ব্যাপার!
আফগানিস্তান কিন্তু এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছে। ২০১৫-র বিশ্বকাপে প্রত্যাশিতভাবেই তারা প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু, স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে এক উইকেটে জয় ছিনিয়ে নিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে এটাই তাদের প্রথম জয়। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে এসে সেক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্তির ঝুলিটি ছিল সম্পূর্ণই। এবারও কাগজে-কলমে ‘ডার্ক হর্স’ আফগানিস্তানকে নিয়ে ক্রিকেটের বৃত্তে আগ্রহের অন্ত নেই। আইপিএলের দৌলতে লেগস্পিনার রশিদ খান, অলরাউন্ডার মহম্মদ নবিদের তোমরা অনেকেই হয়তো চেনো। বিশ্বকাপ দলে এদের উপস্থিতির কারণে অনামী হলেও আফগানিস্তানের খেলা দেখার জন্য একটা বাড়তি আকর্ষণ অনুভব করা খুবই স্বাভাবিক।
আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসের দিকে তাকালে কিন্তু অবাক না হয়ে পারা যায় না। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হলেও এই দেশে প্রথম ক্রিকেট খেলার প্রমাণ রয়েছে আরও অনেক অনেক আগে। ইতিহাসের পাতা উল্টোলে দেখা যাবে, ১৮৩৯ সালে কাবুলে ব্রিটিশ সেনারা একটি ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ভারতে প্রথম ক্রিকেট ক্লাব স্থাপিত হয় ১৮৪৮ সালে, তদানীন্তন বম্বেতে (অধুনা মুম্বই)। পার্সিরা সেই ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ভারতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা, পরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং সংশ্লিষ্ট নানা কারণে দ্রুত এই খেলা বিস্তার লাভ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে কিন্তু সেই সুযোগ মেলেনি। তার উপর ছিল তালিবান শাসকের চোখ রাঙানি। তাই, সুদূর অতীতে বিক্ষিপ্ত ভাবে এই খেলার সামান্য চর্চা হলেও ক্রিকেট সে দেশে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। আসলে তালিবান জমানায় সব ধরনের খেলাধুলোর উপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। ক্রিকেটও এর ব্যতিক্রম ছিল না। শাস্তির ভয়ে সবাই সেই ফরমান মানতেই অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির বদল হয়। বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে আফগান প্রশাসন মত বদলে ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোগী হয়। জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়েই শেষপর্যন্ত পিছু হঠে তালিবান নেতৃত্ব। ক্রিকেটের প্রসার ও উন্নতির জন্য আফগান প্রশাসন শরণাপন্ন হয় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কাছে। তাদের সাহায্যে আফগানিস্তানে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়তে থাকে। এছাড়া, যুদ্ধের কারণে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে পাকিস্তানে চলে আসেন। পাকিস্তানে থাকার সময় তাঁরা ক্রিকেটকে রপ্ত করে নেন। আবার, আফগানিস্তানে থাকা পাক শান্তিরক্ষী বাহিনীর দৌলতেও সে দেশে ক্রিকেটের দ্রুত প্রসার ঘটে। এসব নানা কারণেই সে দেশের তরুণ প্রজন্ম এই খেলার প্রতি ক্রমে আকৃষ্ট হয়। নানা সমস্যার থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে ক্রিকেটে মেতে থাকার জন্য তারা এই খেলাকে আঁকড়ে ধরে।
খুব বেশিদিন আগে নয়, আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (আগে যার নাম ছিল আফগানিস্তান ক্রিকেট ফেডারেশন) তৈরি হয় ১৯৯৫ সালে। ২০০১ সালে তারা বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি (আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল)-র অ্যাফিলিয়েটেড সদস্য পদ পায়। তারা এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সদস্য হয় ২০০৩ সালে। ২০১৭-র ২২ জুন তারা আইসিসির পূর্ণ সদস্য পদ এবং সেই সঙ্গে টেস্ট খেলিয়ে দেশের স্বীকৃতি (একইসঙ্গে আয়ারল্যান্ডও) লাভ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে ক্রিকেট বোর্ড গঠন থেকে এই উত্থান যেন অনেকটা রূপকথার গল্পের মতোই। আর তাদের এই চলার পথে ভারতেরও বেশ কিছুটা অবদান রয়েছে।
আফগান ক্রিকেট কর্তাদের চিন্তাধারা কতটা আধুনিক এবং এই খেলায় উন্নতি করার জন্য তাঁরা কতটা সিরিয়াস, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ পাওয়া যাবে বোধহয় বিশ্বকাপে দলের সাপোর্ট স্টাফদের তালিকা দেখলেই। এক সময়ে দলের ব্যাটিং কোচের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রাক্তন অলরাউন্ডার ফিল সিমন্স বর্তমানে আফগানিস্তানের প্রধান কোচ। এছাড়া দলের বোলিং কোচ চার্ল ল্যাঙ্গভেল্ট (দক্ষিণ আফ্রিকা), ফিল্ডিং কোচ জন মুনি (আয়ারল্যান্ড), ফিটনেস ট্রেনার ও হেড ফিজিওথেরাপিস্টের দায়িত্বে রয়েছেন পাকিস্তানের আজিম মালিক। পাকিস্তানের ইনজামাম-উল-হক এবং ভারতের লালচাঁদ রাজপুতের পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ফিল সিমন্সকে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের দিকে লক্ষ্য রেখেই। ২০০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে হারিয়ে চমকে দেওয়া আয়ারল্যান্ড সিমন্সের কোচিংয়ে ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এবং ২০১৫ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবোয়েকে হারিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। তাছাড়া, আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেটকে প্রচুর সাফল্য এনে দিয়েছিলেন সিমন্স। তাই, তাঁর হাতেই জাতীয় দলের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব তুলে দেয় আফগান ক্রিকেট বোর্ড। ২০১৮-র জুনে বেঙ্গালুরুতে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টটি খেলে আফগানিস্তান। অনভিজ্ঞতার কারণে তারা ইনিংস ও ২৬২ রানে পরাজিত হয়। কিন্তু, পরের বছর মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে তারা জয় ছিনিয়ে নেয়। প্রসঙ্গত, ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের পর আফগানিস্তানই হল তৃতীয় দেশ, যারা দ্বিতীয় টেস্টেই জয় পেয়েছে।
২০১০ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ওমর জাখিওয়াল ঘোষণা করেছিলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সারা দেশে ১০টি স্টেডিয়াম এবং অন্তত ১৫টি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি গড়ার পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ ক্রিকেট সম্পর্কে কতটা চিন্তাশীল ও যত্নবান হলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা এই উদ্যোগই বোধহয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অনেকে মজাচ্ছলে বলেন, আফগানিস্তানে তালিবান তাণ্ডব ক্রিকেটের কাছে হার মেনেছে। আর বাস্তবিকই তাই। তা না হলে সে দেশে প্রায় ৩২০টি ক্রিকেট ক্লাব এবং ছ’টি টার্ফ উইকেট তৈরি হতে পারে কীভাবে? জালালাবাদে রয়েছে গাজি আমানুল্লা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। যার দর্শকাসন ১৪ হাজার। ১৪ হাজার আসনেরই আরও একটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম গড়ে উঠছে কান্দাহারে। কাবুল ও খোস্তে রয়েছে ছ’হাজার আসনের দু’টি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। মাজার শরিফ, কুন্দুজ, ময়দান শা’র এবং জালালাবাদে আরও চারটি স্টেডিয়ামের কাজ চলছে জোরকদমে। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির পাশাপাশি রয়েছে একাধিক ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তান পেয়েছে দেশের প্রথম ইন্ডোর ক্রিকেট অ্যাকাডেমি (কাবুলে)। সেখানে একসঙ্গে অন্তত আড়াইশো জনের অনুশীলনের সুবন্দোবস্ত রয়েছে। তাই, বলা যায় অধিনায়ক গুলবাদিন নায়িবের নেতৃত্বে আফগানিস্তান দলটি যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েই ইংল্যান্ডে খেলতে এসেছে। লড়াই গুলবাদিনদের রক্তে। কিন্তু, তাঁদের ঘাটতি শুধু অভিজ্ঞতায়। বড় দলের বিরুদ্ধে এবং চাপের মুখে ম্যাচ বের করার কৌশল ভালোমতো রপ্ত হয়ে গেলে অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তান যে তথাকথিত বড় দলের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারবে, সে সম্ভাবনাই প্রবল। তখন প্রতিযোগিতার মান আরও বাড়বে। ক্রিকেট বিশ্ব আরও ভালো লড়াই উপভোগ করতে পারবে। আপাতত অপেক্ষা সেই দিনটির জন্যই!
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে