আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
রঞ্জিত মল্লিক, না না অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক নন এবং কস্মিনকালে একখানা সিনেমা দেখেছেন কিনাও সন্দেহ। শুনেছি সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতেন না বলে সেই দুঃখে কাকিমার অকালমৃত্যু ঘটল। তবে এবার আসি শারীরিক বর্ণনায় যা একেবারে পরিষ্কার করে অভিনেতা এবং টেকোর তফাৎ বুঝিয়ে দেবে। বেঁটেখাটো, শ্যামবর্ণ, হরলিকসের শিশির কাচের মতো মান্ধাতার আমলের এক চশমা, এই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ফতুয়া আর লুঙ্গি ছাড়া কখনওই কিছু পরেন না। বাজার-হাট লক্ষ্মীদিই করে। তবে আকর্ষণের বিষয়বস্তু হল ওনার ওই মসৃণ, মোলায়েম, চকচকে টাকটা। দেখলেই হাতগুলো নিশপিশ করতে থাকে, মনে হয় একটু তবলা বাজিয়ে দিই। ‘ধা ধিন ধিন ধা, ধা ধিন ধিন ধা।’ অতএব ওনার বাবা, মায়ের দেওয়া বেমানান নামটা বদলে দিয়ে উনি পাড়ায় ‘টেকো মল্লিক’ বলেই খ্যাত। টেকোকে নিয়েই আমাদের যত দুশ্চিন্তা। মোটা টাকা পেনশন পান, মেয়ে জামাই বিদেশ থেকে মোটা টাকার হাতখরচ পাঠায়। তা এতে এত কার্পণ্য করার কী আছে বাপু? ব্যাঙ্কের লোককেও ভরসা করেন না তাই সব পয়সা বুঝি গদির তলায় রেখে শোন। আমরা তো চেয়েছিলাম ওই মুদ্রা রহিতকরণের সময় কেন যে ওকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল না কে জানে? চাঁদা চাইতে গেলেই গণ্ডাখানেক কথা শুনিয়ে দেন। পাড়ায় নাকি চাঁদা তুলে ফুর্তি করা হয়, সবাই নাকি স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। যত সব বাজে অজুহাত। কথায় আর কাজে কোনও মিল নেই— পাড়ায় যে কোনও অনুষ্ঠানে এক পয়সা চাঁদা না দিয়ে দিব্যি প্রত্যেকবার এসে পাত পেড়ে খেয়ে যান। সেইদিনগুলো আবার ওর বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। তবে এবার ক্লাবের ইউথ সিদ্ধান্ত নিয়েছে টেকোর থেকে চাঁদা আদায় করেই ছাড়বে— তা সম্ভবপর হলে তা হবে এক ঐতিহাসিক জয়। গোটা প্ল্যানটাই চূড়ান্ত বিপজ্জনক, রতনদা জানেন না। সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত, কিছু গোলমাল হলে এলোপাথাড়ি দৌড় লাগাতে হবে।
তখন বাজে রাত এগারোটা। বারটা ছিল শনিবার। তিনজনে মিলে দল পাকিয়েছি। বৈশাখ মাসের ভীষণ গরমে কাশ্মীরি শালটা গায়ে, মাথায় জড়িয়ে নিয়ে সে একেবারে হাঁসফাঁস অবস্থা। বাকি দু’জনেরও খানিক একই অবস্থা। সৌরভের মাঙ্কি টুপিটা ঘামে ভিজে ছপছপ করছে আর রিনি বড় বড় শ্বাস ফেলছে। তবে এছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সামান্যতম এই ছদ্মবেশটুকু না নিলে গোড়াতেই গলদ, হাজতবাস কেউ রুখতে পারত না। এ কি আর ছোটখাট চুরি-চামারি, চাঁদা চাইতে গিয়ে একেবারে ডাকাতি! অত্যন্ত সন্তর্পণে মই বেয়ে একতলার কার্নিসে উঠে বারান্দায় ঝপাং করে এক লাফ। বাবা! একমুঠো পলেস্তারা খসে পড়ল। কপাল ভালো কার্নিসটা ধসে পড়েনি। বাড়িটা তো মেনটেনও করে না। মুখ দিয়ে গালাগালি বর্ষণ হবার আগে নিজেকে সামলে নিয়ে একটা ভয়ানক নাসিকা ধ্বনির আওয়াজ অনুসরণ করে পৌঁছে গেলাম টেকোর শোওয়ার ঘরে। ব্যাস! মিশন রাবণ বধ মানে ওই মিশন টেকো বধ। রিনি আর সৌরভ অস্ত্রধারী বীর সৈনিক আর আমার হাতে সেই লাল খাতাটা। এটাই তো টেকোর প্রাণভোমরা। এটার সন্ধান দিয়েছে আমাদের RAW এজেন্ট লক্ষ্মীদি। খাতাখানা যৌবনকাল থেকে আড়াল করে রেখেছে। টেকো খাটের মাঝখানে চাদর আর মশারির মধ্যে জড়িয়ে বসে উসখুস করছে। সৌরভের হাতে ওর ভাই লাট্টুর খেলনা পিস্তল, রিনির হাতে বাটার নাইফ। টেনশনে মানুষের মাথা কাজ করে না। তা না হলে টেকো খেলনা পিস্তল আর বাটার নাইফের ভয়ে খাট থেকে নেমে আসতে পারছে না। ‘আমরা সব জানি। এই খাতায় আপনি কবিতা লেখেন। সুতরাং যদি না চান যে অবগুন্ঠনে থাকা এই রোমান্টিক কবির সামাজিক আবির্ভাব ঘটুক তাহলে ভালোয় ভালোয় হাজার দুয়েক (পাশ থেকে সৌরভ দাঁত কিড়মিড় করে, ঘুসি দেখিয়ে বলল ‘পাঁচেক’) বেশ বেশ তাহলে হাজার পাঁচেক টাকা ছাড়ুন।’ কাজটা যে এত সহজ হবে ভাবতে পারিনি। সুড়সুড় করে খাট থেকে নেমে আলমারি খুলে একখানা সাদা খামে ভরে পাঁচ হাজার এক টাকা চলে এল আমাদের হাতে। সৌরভটা হঠাৎ কেবলার মতো চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হুররে! টেকো মল্লিক জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ!’ তখন আর কে দাঁড়ায়। ভাঙা কার্নিস দিয়ে ঝপাং করে এক লাফ দিয়ে নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেলাম।
আমরা উল্লসিত! সম্রাট বাবরও যে পানিপথের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে এত খুশি হননি তা হলফ করে বলতে পারি। বাবা! একেবারে প্রাণ হাতে নিয়ে চম্পট দিয়েছিলাম। সিনেমায় নায়িকার খলনায়ক বাবার মতো গলা করে যা একখানা হুমকি দিয়েছিলাম আর বোধহয় টেকো জীবনেও চাঁদা দিতে না করবে না। ‘কবি প্রণাম’ হল বিশাল জাঁকজমক করে। সবাই ভীষণ খুশি, এমনকী টেকোও। যতই হোক এই মধুময় সমাপ্তির নেপথ্যে আমাদের টেকো মল্লিকই! থানা, পুলিস হয়নি। নির্ঘাত বুঝতেই পেরেছিলেন এই অপকর্মটা কারা ঘটিয়েছে। তবে পাড়ায় একটা ডাকাতির ঘটনা চাউর হয়েছে, যদিও বা কেউ বিশেষ মাথা ঘামায়নি। তবে আমরা কিন্তু ভালো ডাকাত— যা টাকা বেশি হয়েছে সবটা জমিয়ে রাখা হয়েছে, কোনও অকারণ খরচ আমরা করিনি। কিন্তু মাথা মোটা রতনদা মাঝেমধ্যেই ঘুরে ফিরে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা চাঁদা যা উঠেছিল তাতে টাকা তো কম পড়ার কথা ছিল। অতগুলো টাকা বেশি হল কী করে?’
অলংকরণ : সুব্রত মাজী