সন্তানের কর্ম সাফল্যে মানসিক প্রফুল্লতা ও সাংসারিক সুখ বৃদ্ধি। আয়ের ক্ষেত্রটি শুভ। সামাজিক কর্মে সাফল্য ... বিশদ
সে কথায় পরে আসছি। তার আগে ফানুস নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। খুব প্রচলিত যে আকারের ফানুস দেখা যায়, সেটার গড়ন অনেকটা লম্বাটে লাউয়ের মতো। পাতলা কাগজ কেটে নানা আকারের ফানুস তৈরি করা যায়। ফানুসের মূল আকার যাই হোক তার নীচের দিকে ঠিক জায়গা বুঝে ফাঁক রাখা হয়। সেই ফাঁকে কায়দা করে বেঁধে দেওয়া হয় কেরোসিন ভেজানো বল বা ‘নুটি’। সেই বলে আগুন ধরিয়ে দিলেই ফানুসের ভেতরটা গরম হাওয়ায় ভরে যায়। তারপর ‘হট এয়ার বেলুন’-এর নীতি মেনে ফানুস উঠে যায় আকাশে।
তবে ফানুসের এই স্বাধীন চলন অনেকটা পরের দিকের উদ্ভাবন। আগে ফানুসের সঙ্গে একটি সুতো বেঁধে তার নিয়ন্ত্রণ মানুষ নিজের হাতে রাখত। তবে তখন তার প্রচলিত নাম ছিল ‘রৌশন পুতলা’ বা আলোকোজ্জ্বল পুতুল। এমন নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফানুসের উৎস ও বিবর্তনের গল্প।
মেটিয়াবুরুজে ছোটা লখনউ স্থাপিত হওয়ার পরেই ফানুস ওড়ানোর শখ জাঁকিয়ে বসে শহরে। আবদুল হালিম লিখেছেন যে, এই ‘রইসি’ শখের উৎপত্তি দিল্লিতে। তিনি আন্দাজ করেছেন যে, এর উৎস হয়তো কার্তিক মাসে হিন্দুদের আকাশপ্রদীপ জ্বালার প্রাচীন প্রথার সঙ্গে যুক্ত। রাতের বেলা গোলাকার ফানুসের ভেতরে বেঁধে দেওয়া তেলে চোবানো কাপড়ের গোলা জ্বেলে দিলেই সেগুলি উড়ত আকাশে। আর শক্ত সুতো বেঁধে সেগুলি ওড়ানোর ফলে, ইচ্ছেমতো নামিয়ে নেওয়া যেত। একসময় প্রচলিত আকারের বাইরে খানিকটা বৈচিত্র্য নিয়ে আসার লক্ষ্যে কেউ কেউ কাগজের মানুষ-পুতুল বানিয়ে ওড়াতে লাগলেন। অন্ধকার রাতের আকাশে উড়তে থাকা উজ্জ্বল পুতুলকে তারা বলতেন ‘রৌশন-পুতলা’।
আজকাল দেওয়ালির আগে-পরে বাজারে যে সব চাইনিজ ‘স্কাই ল্যান্টার্ন’ পাওয়া যায়, তার সঙ্গে মিল আছে হালিম বর্ণিত ফানুস ও রৌশন পুতলার। দু’টিই ওড়ানো হয় বা হতো রাতের বেলা। তাই নির্মাণে বৈচিত্র্যে থাকত না। কিন্তু কলকাতার ফানুস ওড়ানো হয় দিনের আলো থাকতে। আর সেই জন্যই নানা রং ও বিচিত্র আকারের ফানুস তৈরি করা হয়। এই নির্মাণের মধ্যে সৃষ্টিশীল মানুষ রেখে যেতে পারেন শৈল্পিক ছোঁয়া।
উনিশ শতকের স্বর্ণযুগ পার করেও কলকাতায় মানুষ শখ-শৌখিনতার পেছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করার মতো মানসিকতা রাখতেন। আশাপূর্ণা দেবীর বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের প্রথম বছরের ছাত্র। পেশায় ছিলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। তার নানা রকমের শখের মধ্যে ছিল কালীপুজোর আগে বাজি ও ফানুস বানানো। বাড়ির গিন্নি সহ গোটা পরিবার ফানুস বানানোয় মেতে উঠতেন। ফানুস তৈরির নানা কাজে সকলে হাত লাগালেও ফানুসের নীচে যে নুটিতে আগুন ধরানো হয়, সেটি তৈরি ও জায়গা মতো স্থাপন করার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নিজের হাতেই করতেন হরেন্দ্রনাথ। আশাপূর্ণা দেবী নিজের স্মৃতিকথায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ের কলকাতার এই নিটোল পারিবারিক ছবি এঁকে গিয়েছেন। এমন পারিবারিক ইতিহাস হয়তো বহু বাড়িতেই খোঁজ করলে পাওয়া যাবে।
আসলে সময়টাই এমন ছিল। তখনও বাজার থেকে নগদের বিনিময়ে কেনার থেকে নিজের হাতে গড়া জিনিসের বেশি মূল্য দিত মানুষ। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কালীপুজোর প্রচলন না থাকলেও রীতিমতো বাজি আর ফানুস বানানো হতো। ফানুস তৈরির ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে দেখা যেত অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। তিনি ঘড়ি, হাতি, মানুষ, জেপলিন (এক ধরনের উড়োজাহাজ) ইত্যাদি নানা আকারের ফানুস বানাতেন।
জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়ি ছেড়ে অবনীন্দ্রনাথ সপরিবারে বরানগর গুপ্তনিবাসে উঠে আসার পরও বাড়ির দক্ষিণের বাগানের মাঝের শান বাঁধানো উঠোন থেকে প্রতি বছর ফানুস ওড়ানোর রীতি বজায় রেখেছিলেন মোহনলাল। ঘড়ি ফানুস তৈরি করলে তার কাঁটা দেখাত ঠিক চারটে। বাড়ির পুরনো ম্যাকাবি ঘড়িতে চারটে বাজার সংকেত কানে এলেই মোহনলাল গ্যাসে ঠাসা ফানুসটা দু’হাতে আসতে আসতে আকাশের দিকে তুলে নিয়ে টুক করে ছেড়ে দিতেন। ঘড়ি ফানুস এত নিখুঁত আর নিটোল হতো যে তর তর করে আকাশে উঠে যেত এবং উত্তরের বাতাসে ভর করে সামনের রেললাইন পেরিয়ে দক্ষিণেশ্বরের দিকে হারিয়ে যেত
দৃষ্টি সীমানার বাইরে। মোহনলালের পর বাড়ির ছোটদের আনন্দ দেওয়ার
জন্য ফানুস তৈরির সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের পৌত্র সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর স্মৃতিকথায় খুব যত্ন করে লিখে গিয়েছেন ঠাকুরবাড়ির ফানুস চর্চার কথা।
অতি বিরল হলেও পারিবারিক ঐতিহ্য হিসাবে ফানুস বানানোর উত্তরাধিকার যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে উত্তর কলকাতার একটি প্রাচীন পরিবার। বিডন স্ট্রিটের ভোলানাথ ধামের কথা তাদের দুর্গাপুজোর সূত্রে অনেকেই জানেন। ১৯১৫ সালের স্ট্রিট ডিরেকটারির নতুন সংস্করণের তথ্য অনুযায়ী এই বাড়িটির আদি মালিক ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের বাবা ভূপতিনাথ বিশ্বাস। আর্থিক কারণে ভূপতিবাবু বাড়িটি বিক্রি করে দেন সে সময়ের সফল কাগজ ব্যবসায়ী ভোলানাথ দত্তকে। এই বাড়ি থেকে ফানুস ওড়ানো শুরু হয় ১৯২৫ সালে। তারপর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এতগুলো বছর ধরে এই শহরে কালীপুজোর বিকেলগুলো রঙিন করার দায়িত্ব পালন করে এসেছেন ভোলানাথ ধামের দত্ত পরিবার। সেই হিসাবে এবছর তারা পালন করছেন তাঁদের এই পারিবারিক উৎসবের শতবর্ষ। এখন ফানুস তৈরির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন অজয় দত্ত। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর শেষেই তিনি ফানুস তৈরির কাজ শুরু করেন। সঙ্গে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। বাইরে থেকে কয়েকজন শিক্ষানবিশও যোগ দেন। প্রচলিত আকার ছাড়াও গোল, চৌকো, পুতুল সহ নানা আকারের ফানুস তৈরি হয়।
প্রতি বছর কালীপুজোর দুপুর থেকেই উৎসাহীরা ভিড় করতে থাকেন ভোলানাথ ধামের উঠোনে। এবছরও তার অন্যথা হবে না। বরং শতবর্ষ বলে একটু বেশিই হবে মানুষের আনাগোনা। আর একের পর এক ফানুস উড়তে থাকবে আকাশে। মানিকতলা বাজারের সদ্য সংস্কার করা ঘড়ি গম্বুজের উপর দিয়ে ভাসতে থাকা ফানুসের ছবি নতুন প্রজন্মের কাছে হবে ঐতিহ্যের এক
উজ্জ্বল উদ্ধার।