যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
পুরু হেরেছিলেন আলেকজান্ডারের কাছে। সেই পরাজয় ছিল গৌরবের। কারণ, সে ছিল, এক শৌর্যবানের কাছে আরেক শৌর্যশালীর পরাজয়। কিন্তু এ তো নেপোলিয়নকে হারতে হল এক তালপাতার সেপাইয়ের কাছে। অতুলবাবু অর্থ দফতরের একজন সামান্য কেরানি। প্রতুলবাবু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন দাপুটে অফিসার। সেদিক দিয়ে প্রতুলবাবুর কাছে মানে মর্যাদায়, অর্থবলে, বৈভবে হেরেই আছেন অতুলবাবু। প্রতুলবাবু বলেন, ‘আরে ধুর ছাড় তো, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের পদ ধুয়ে কি জল খাব নাকি? তুই হলে গে আমার সেই প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু। এক শহরে এক পাড়ায় থাকি। ছেলেবেলা থেকে একসঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি। লিসন অতুল, ইউ আর ভেরি গুড ফ্রেন্ড অফ মাইন সিন্স আওয়ার চাইল্ড হুড। নামেও কেমন মিল দেখ অতুল আর প্রতুল। অফিসার আছি অফিসে, পাড়ায় ওসব ডগমা নিয়ে চলি না আমি।’ প্রতুলবাবু পড়াশোনায় ছিলেন এক নম্বর। আর অতুলবাবু মিডিওকার। সব মিলিয়ে অতুলবাবুর একটা হীনম্মন্যতা তো ছিলই। তিনি তাই প্রতুলবাবুর সামনে একটু মেন্দা মেড়ে থাকেন।
সেই বন্ধু অতুলবাবুকে নিয়ে আচমকাই একটা খেলা শুরু করলেন প্রতুলবাবু। অতুলবাবু একদিন প্রতুলবাবুর বাড়িতে এসে মিনতি করে গেলেন। বললেন, ‘দেখ প্রতুল, তোর কাছে আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি। রাস্তাঘাটে লোকজনের সামনে ওসব ঠাট্টা, ইয়ার্কি করিস না। আমাদের দু’জনেরই তো বয়স হচ্ছে। লোকে ভাবে সত্যি সত্যিই আমি বুঝি...আমারও তো একটা মান সম্মান আছে, তুই বল? তুই সেদিন আমার গিন্নির সামনেই অত লোকের মাঝখানে এক সপ্তাহের মধ্যে পাওনা শোধ করার হুমকি দিলি। লোক কি এসব ঠাট্টা বুঝবে? আমার গিন্নি তো রেগে ফায়ার হয়ে আছে। সে বলছে, তুমি প্রতুলদার কাছ থেকে আবার কবে ধার করলে? কত টাকা ধার করেছ? যাও আমার গয়না বেচে টাকা দিয়ে এসো এক্ষুনি।’
‘তাই নাকি? তোর বউ তাহলে ব্যাপারটা সত্যি ভেবে নিয়েছে?’
‘শুধু সত্যিই ভাবেনি। তোকে চামার বলেছে।’
‘হাউ ফানি! নেক্সট? আর কী বলেছে?’
‘বলেছে তুই পয়সার পিশাচ। টাকার জন্য বন্ধুকে যে রাস্তায় ওভাবে অপমান করতে পারে সে আবার কীসের ছাতার বন্ধু।’
‘তাই নাকি? এসব বলেছে বুঝি? ইন্টারেস্টিং! তাহলে তো খেলা জমে গেছে অতুল। জীবনটা বড্ড একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। বুঝলি, এই খেলাটা আমি চালিয়েই যাব বুঝলি।’
‘তার মানে, তুই কি আবার লোকজনের সামনে ওভাবে টাকা চাইবি নাকি? আমারও তো একটা প্রেস্টিজ আছে।’
‘আরে তুই তোর প্রেস্টিজটা দেখছিস, আমার নিখুঁত অ্যাক্টিংটা দেখলি না? লোকে বিশ্বাস করছে, তার মানে আমার মধ্যে যে সুপ্ত অভিনয় প্রতিভা এ তো তারই স্বীকৃতি। তুই সেটা ভেবে আমাকে পুরস্কার দে!’
অতুলবাবু আজ সেই পুরস্কারই দিয়েছেন প্রতুলবাবুকে।
অলকেশ একদিন ফোন করে প্রতুলবাবুকে বললেন, ‘অতুল তো তোর ওপর প্রচণ্ড চটে আছে রে। একদিন না কোনও কাণ্ড করে বসে। আর তাছাড়া ইয়াং এজে যা করেছিস মানিয়ে গেছে। তখন তো ওকে কম জ্বালাসনি। এখন এই আধবুড়ো বয়সে কি এসব শোভা পায়?’ প্রতুলবাবু হো হো করে হেসেছেন। বলেছেন, ‘আধবুড়ো তোরা। আই ডোন্ট বিলিভ ইন এজ। আই বিলিভ ইন এনার্জি। আ’ম স্টিল ইয়াং অ্যান্ড আ’হ্যাভ এনাফ এনার্জি। মোস্ট অব অল আই টেক গ্রেট প্লেজার টু ডু দ্যাট। অতুলের ওই রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখটা দেখার নেশা আমি ছাড়তে পারব না।’
গেল হপ্তায় শিয়ালদা থেকে ট্রেনে ফিরছিলেন প্রতুলবাবু। একা একা বোকার মতো বসে থাকা অসহ্য লাগছিল। এভাবে বোকার মতো বোবা হয়ে বসে থাকাটাও যেন এক শাস্তি। ভাবতে ভাবতেই বিধাননগর রোড থেকে ওই কম্পার্টমেন্টেই উঠলেন অতুলবাবু। আহা! এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। জল না চাইতেই মিছরির পানা। দুধ, ঘি, ছানা, কাবুলের চানা সব একসঙ্গে সাজিয়ে দিল কেউ। এ যেন ভূতের রাজা যৌতুক পাঠাল কৌতুক করার জন্য। চলন্ত ট্রেনের ঘটাংঘট শব্দ— তাই একটু গলা চড়িয়েই ডাকলেন প্রতুলবাবু। ‘আরে অতুল! তুই কোত্থেকে?’
প্রতুলবাবুকে দেখে মিইয়ে গেলেন অতুলবাবু। প্রতুলবাবু বললেন, ‘আয় আয় বোস এখানে।’ গুছিয়ে বসলেন অতুলবাবু। প্রতুলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘সল্টলেকে তোর বোনের বাড়ি এসছিলি?’ ট্রেনের বিচ্ছিরি আওয়াজে কথাটা ঠিক মতো কানে গেল না অতুলবাবুর। তিনি বললেন, ‘অ্যাঁ?’
প্রতুলবাবু এবার একটু জোরে গলা তুলেই জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু অতুলবাবু উত্তর দেওয়ার ওই অবসরে প্রতুলবাবুর মগজে কিলবিল করে উঠল দুষ্টু বুদ্ধি। সারা শরীরে পিলপিল করে সাড়া দিতে লাগল মজা। ব্যস, অতুলবাবুর দফারফা করে ছেড়ে দিলেন প্রতুলবাবু। সব কথাই তিনি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। কম্পার্টমেন্টের সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছে। সবাই বুঝতে পারছে, লোকটা কানে খাটো। অতুলবাবু মিনমিন করে ক’বারই প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু কে কার কথা শোনে? প্রতুলবাবু চিৎকার করেই যত কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন হল যে, শেষপর্যন্ত দুর্গানগর স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে পড়তে হল অতুলবাবুকে।
তারপর মাস দুয়েক প্রতুলবাবুকে এড়িয়ে চললেন অতুলবাবু। কিন্তু, মাছের বাজারে আবার প্রতুলবাবুর ফাঁদে পড়ে গেলেন অতুলবাবু। রোববারের বাজার। প্রচুর ইলিশ উঠেছে। দামেও পুষিয়ে যাচ্ছে। সেই ইলিশ কেনার মুখে প্রতুলবাবু শিকার ধরার মতো করে গিয়ে ধরলেন অতুলবাবুকে। গলাটাকে বেশ খানিক চড়িয়েই তিনি বললেন, ‘এই যে অতুল, লোকের টাকা বাকি রেখে ইলিশ খাচ্ছিস, লজ্জা করে না? বাড়ি গিয়ে তো দেখা পাওয়া যায় না। যখনই যাই তোর বউ বলে বাড়ি নেই। বন্ধু ভেবে অতগুলো টাকা দিলাম। একমাস সময় নিলি। এখন প্রায় বছর ঘুরতে চলল। বন্ধুর সঙ্গে চিটিংবাজি? আর এক সপ্তাহ সময় দিলাম। তারপর আমিও দেখে নেব টাকা কী করে আদায় করতে হয়।’ অতুলবাবুকে ট্যা ফুঁ করার সুযোগ না দিয়ে প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে কর্পূরের মতো সটকে গেলেন প্রতুলবাবু। অতুলবাবু যেন সত্যিই পাওনাদারের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছেন, তেমনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভরা বাজারের কয়েকজন লোক অতুলবাবুর অপমানে নত, ম্লান মুখের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ভেতরে ভেতরে রাগে থর থর করে কাঁপছিলেন তিনি। দুপুরে গিন্নির তরিবত করে রান্না পদ্মার ইলিশ ভাপা গলা দিয়ে নামতে চাইছিল না। তাঁর মন বলছে, ইলিশ চাই না। চাই প্রতিশোধ।
প্রতি রোববার তরিবতের রান্না খেয়ে ঘণ্টা দুয়েক ভাত-ঘুম দিয়ে নেন তিনি। কিন্তু আজ বিছানায় শরীর গড়িয়ে দিয়েও শুধু ঘন ঘন পাশ বদল করছেন। মগজের ভিতরে শুধু একটাই শব্দ করাত চালাচ্ছে, প্রতিশোধ। হ্যাঁ, হ্যাঁ প্রতিশোধ নিতে হবে তাঁকে। ভাবতে ভাবতেই তাঁর সামনে দরজা খুলে গেল। তুখোড় একটা প্ল্যান খেলে গেল তাঁর মগজে। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন তিনি। মধ্যমগ্রামে ফোন করে ঘুঁটি সাজিয়েই রাখলেন। এখন প্রতুলবাবু মধ্যমগ্রামে যেতে রাজি হলেই কেল্লাফতে হয়ে যাবে।
দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল এসে দরজায় টোকা দিয়েছে। প্রতুলবাবুর মোবাইল ফোনের কালার স্ক্রিন কাঁপিয়ে ফুটে উঠল অতুল কলিং। প্রতুলবাবু ভাবলেন, সেই একই গাওনা বুঝি— ‘বাজারে অত লোকের সামনে তুই আমাকে ডুবিয়ে দিলি।’ তাই না ধরি না ধরি করেও ফোন তুলে নিলেন কানে। কিন্তু, অবাক হলেন প্রতুলবাবু। অতুলবাবু সন্ধেবেলা মধ্যমগ্রামে শুভ্রর বাড়ি আড্ডা দিতে যাওয়ার প্ল্যান দিলেন। বললেন, ‘প্রতুল, শোন, শুভ্র ফোন করেছিল। ওর বাড়িতে যেতে বলছে। বলছে, প্রতুলকে নিয়ে আয় না। কতদিন দেখা হয় না। গরমাগরম চপ আর চায়ের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা হবে। প্রতুলকে নিয়ে চলে আয়। যাবি তুই?’ প্রতুলবাবু এক পায়ে খাড়া। কত বছর হল মধ্যমগ্রামে যাওয়া হয়নি। শুভ্রর সঙ্গে দেখা হয়নি। ছুটির দিন সন্ধেটা ভালোই কাটবে ভেবে এককথায় রাজি হয়ে গেলেন তিনি। মনে মনে ভেবে নিলেন শুভ্রর মেয়ে-বউয়ের সামনেও একচোট হবে। অতুলকে নিয়ে একটা জব্বর তাৎক্ষণিক নাটকের সিন ক্রিয়েট করা যাবে। ভালোই জমবে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামার ঝোঁকে অতুলবাবু আর প্রতুলবাবু বাসে চেপে বসলেন। বাসে ওঠা আর নামা। মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্ব। সেকথা ভেবেও রাজি হয়েছেন প্রতুলবাবু। কারণ, জার্নির ধকল কিছু নেই।
আলোয় ঝলমল সোদপুর রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রতুলবাবু বললেন, ‘বহুবছর পরে এদিকটায় এলাম। সব একদম পাল্টে গেছে রে অতুল। বসুনগর দু’নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতে হবে, তাই না? একসময় এদিকে কত আড্ডা দিয়েছি। এখন তো একটাও চেনা মুখ দেখছি না রে।’ অতুলবাবু বললেন, ‘প্রতুল, তোর মনে আছে? এখানে বাবুনদের একটা ওষুধের দোকান ছিল, আমরা এলে বাবুনের বাবা আমাদের চিউইংগাম দিতেন?’
‘হ্যাঁ, খুব মনে আছে।’
রাস্তার ডানদিকে সুরমা মেডিক্যাল হলকে দেখিয়ে অতুলবাবু বললেন, ‘এই হল বাবুনদের সেই ফার্মেসিটা। কিন্তু ওরা বেচে দিয়েছে। এখন সব নতুন মুখ। তবে সবাই আমার চেনা। ভাই টুবলুটা তো ওষুধের লাইনে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ। তাই ভাইকে প্যালা দিতে ছুটির দিনে এসে আমাকে ঢুঁ মারতে হয়। ভালো কথা, আজ তো রোববার। তুই দু’মিনিট দাঁড়াবি? আমি ডক্টর দে-কে একটু মুখটা দেখিয়ে আসি। ভাইকে উনি ভালোই সাপোর্ট দিচ্ছেন। একটু পিআর করে আসি। তুই জাস্ট দু’মিনিট দাঁড়া। বলতে বলতে মেডিক্যাল হলে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে গেলেন অতুলবাবু। প্রতুলবাবুকে একটা ফাঁকা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, তুই জাস্ট দু’মিনিট বোস। আমি দু’মিনিটে আসছি। প্রতুলবাবু শুভ্রর বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ভাবলেন, মিনিট দুয়েকের ব্যাপার তো। পায়ে পায়ে গিয়ে বসে পড়লেন চেয়ারটায়। কিন্তু কোথায় দু’মিনিট? প্রায় দশ-পনেরো মিনিট গড়িয়ে গেল। প্রতুলবাবু অধৈর্য হয়ে পড়েন। ভেতরে পাখা ঘুরছে। তবুও একটা গুমোট ভাব রয়েছে। মেডিক্যাল হল থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁকে বেরতে দেখেই কাউন্টার থেকে দু’জন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এসে দেহরক্ষীর মতো ঘিরে ধরল। তিনি কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে পা বাড়াতে গেলেন। অমনি প্রতুলবাবুর দু’হাত দু’জনে চেপে ধরল। ওদের মধ্যে একজন বলল, ‘উহু, যাবেন না। এক পা-ও নড়বেন না এখান থেকে। চলুন ভেতরে গিয়ে বসবেন চলুন।’ প্রতুলবাবু বললেন, ‘ব্যাপার কী?’ একজন বলল, ‘মাত্র একজন পেশেন্ট ভেতরে। উনি বেরলেই ডাক্তারবাবু আপনাকে দেখে দেবেন। চলুন ভেতরে গিয়ে বসবেন চলুন।’ প্রতুলবাবু বলেন, ‘আরে না না, আমি পেশেন্ট নই। বন্ধুর সঙ্গে এসেছি।’ ওরা বলল, ‘জানি তো। বন্ধুর সঙ্গেই তো এসেছেন। আপনার বন্ধু তো ভেতরে। ডাক্তারবাবুকে আপনার কেস হিস্ট্রি দিচ্ছেন। আপনি চলুন, আসুন ভেতরে।’ দু’জনে প্রতুলবাবুকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে। তখনই ডাক্তারের চেম্বারের সুইং ডোরে ঝোলানো বোর্ডে নজর আটকে যায় প্রতুলবাবুর। তাতে লেখা ডাঃ এস কে দে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।