যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
এমনকী মুঘল দরবারের অনুগত মওলানা পির মহম্মদ শিরওয়ানিকে সরিয়ে দিয়ে বৈরাম নিজের পছন্দসই হাজি মহম্মদ খান শিস্তানিকে নিয়ে এলেন। ক্রমেই নিজের অনুগত একটি গোষ্ঠী সাজাচ্ছেন তিনি। কয়েক বছর আগেই একটি কাজ করেছেন। আকবরের অভিষেকের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বৈরাম খান দাবি করেছিলেন, সেলিমা সুলতানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে হবে। সেলিমা সুলতান অন্তত ৪০ বছরের ছোট বৈরামের থেকে। ১৫ বছর বয়সি আকবর তাঁর খান বাবার এই ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলতেই পারেননি। তবে তাঁর যে তেমন সায় ছিল এমনটা নয়। বৈরাম বলেছিলেন, ‘তোমার বাবা সম্রাট হুমায়ুন আমাকে বলেছিলেন সেলিমার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন।’ অর্থাৎ বাবার প্রতিশ্রুতি যেন আকবর পালন করে। সেলিমাকে বিবাহ করেন বৈরাম। সেলিমা কে ছিলেন? বাবরের নাতনি। সুতরাং বৈরাম খানের ওই অঙ্কটি নেহাত একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল এক অন্য সমীকরণও— জামাই হয়ে কৌশলে মুঘল বংশের অংশীদার হওয়া। যদিও সেই সেলিমা সুলতান বেগমের কোনও সন্তান হল না।
আকবর এই তিন বছরে অনেকটা পরিণত মনস্ক হয়েছেন। একদিকে খান বাবা। আর অন্যদিকে মেহাম আঙ্গা। আকবরের ধাত্রী মা। আকবরের জীবনকে এই দু’জন চালিত করছেন সর্বক্ষণ। প্রিয় মাহুতদের মৃত্যুর কারণে আকবর অসম্ভব ক্ষুব্ধ। এটাই সুযোগ। মেহাম আঙ্গা উপলব্ধি করলেন আকবরের সেই ক্ষোভ। ১৫৬০। মার্চ। আকবরকে মেহাম আঙ্গা এবার স্বাধীন ও স্বাবলম্বী হতে বললেন। অর্থাৎ বৈরামের অভিভাবকত্বের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মেহাম আঙ্গার সঙ্গে পরামর্শ করে আগ্রা ছেড়ে আকবর দিল্লি চললেন। ঘোষিতভাবে উদ্দেশ্য, মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া। হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানু তখন দিল্লিতে। ক্রমেই দিল্লি ও আগ্রায় জল্পনা শুরু হল, বৈরামের গুরুত্ব কমছে। অনেকেই খুশি। অনেকে আবার বিষণ্ণ। বৈরামকে আকবর বুঝিয়ে দিলেন যে, এবার তাঁর অবসরের সময় হয়েছে। তিনি বরং
মক্কা যান। বৈরাম তর্ক করলেন না। বিরোধিতাও নয়। সপরিবারে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু মক্কা নয়। গেলেন পাঞ্জাব। আকবর হঠাৎ জানতে পারলেন তিনি সম্ভবত চক্রান্ত করছেন। আকবরকে সিংহাসনচ্যুত করার। সম্রাট তৎক্ষণাৎ সেনা পাঠালেন এবং নিজেও অগ্রসর হবেন স্থির করলেন। বৈরাম অবশ্যই কিছু একটা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অচিরে বুঝলেন তাঁর পক্ষে মুঘল বাদশার শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তাই আত্মসমর্পণের বার্তা দিলেন। দরবারে হাজির করানোর পর আকবর তাঁর খান বাবাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দু’জনের চোখে জল। বৈরামকে নিজের তখতের পাশেই বসালেন। বৈরাম জানালেন, তিনি থাকতে আসেননি। মক্কায় চলে যাবেন। আকবর ৫০ হাজার টাকা নজরানা দিয়ে বিদায় জানালেন তাঁকে।
মক্কা যাওয়া হল না। গুজরাতে সহস্রলিঙ্গ হ্রদের পাশে বৈরামকে এক যুবক হত্যা করল। কে সেই যুবক? মাছিয়াওয়াড়ার যুদ্ধে বৈরাম এক আফগান যোদ্ধাকে হত্যা করেছিলেন। ওই যুবক হল সেই যোদ্ধার পুত্র। পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিল সে।
বৈরাম খান নেই! আকবর এই খবর শুনেই নির্দেশ দিলেন তাঁর গোটা পরিবারকে যেন আগ্রায় নিয়ে আসা হয়। তাঁরা এখন থেকে তাঁর দায়িত্ব। খান বাবার পরিবারকে তিনি ভেসে যেতে দেবেন না। বৈরাম খানের পূর্বতন এক পত্নীর পুত্র রহিম। সেলিমা সুলতান বেগমের সন্তান হয়নি। ওই রহিমই সেলিমার নিজের পুত্রের মতো। আগ্রায় সপরিবারে পৌঁছনোর পর বৈরাম খানের বেগম সেলিমাকে বিবাহ করলেন আকবর। সুতরাং রহিম হলেন তাঁর কাছেও পুত্রসম।
রহিমের জন্ম কবে হয়েছিল? ১৫৫৬ সালে। যে বছর আকবরর সিংহাসনে বসেন। অর্থাৎ রহিম আকবরের থেকে ১৪ বছরের ছোট। বেশ কিছু বছর পর বৈরাম খানের পুত্র রহিমকে আকবর করলেন তাঁর সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনাপ্রধান। উপাধি দেওয়া হল মির্জা। মির্জা আবদুর রহিম খান।
আবদুর রহিম খানের সবথেকে বড় কৃতিত্ব কী? যুদ্ধে জয়? সেটি তাঁর সাফল্যের একটি অংশ। তার থেকেও বেশি হল, বৈরাম খানের এই পুত্র আকবরের সেনাপ্রধান ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভাধর কবি। মুঘল সাম্রাজ্যে বহু কবি এসেছেন। কবীর থেকে সন্ত তুলসীদাস— আবদুর রহিম খানের লেখার সঙ্গে এই স্তরের দোঁহা ও কাব্যকারদের তুলনা করা হয়। মহারানা প্রতাপের
বিরুদ্ধে আকবরের বাহিনীর একটি যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন রহিম। তাঁকে আকবর করেছিলেন আজমিরের আমির।
রহিম নিজের পরিবারকে শেরপুরায় রেখে মহারানা প্রতাপের বিরুদ্ধে রওনা হলেন যুদ্ধে। কিন্তু তিনি যখন এগচ্ছেন, তখন রানা প্রতাপের পুত্র অমর সিং শেরপুরায় ঢুকে পড়েন। আর আবদুর রহিমের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের বন্দি করে নিয়ে আসেন মেবারে। ঢোলান উপত্যকায় মুঘল সেনার অপেক্ষায় থাকা রানা প্রতাপের কাছে এই সংবাদ গেলে তিনি পুত্রকে অত্যন্ত তিরস্কার করলেন। বললেন, রাজপুত ঘরানায় এই ব্যবহার? নারী-শিশুদের যুদ্ধে বন্দি করা? এখনই আবদুর রহিমের পরিবারকে সসম্মানে ফেরত দিয়ে এসো। এরকম অমার্জনীয় অপরাধ আর করবে না। কৃতজ্ঞ আবদুর রহিম খান অভিভূত হয়ে ধন্যবাদ বার্তা পাঠান রানা প্রতাপকে। আবদুর রহিম যত বড় যোদ্ধা, তার থেকেও বড় কবি। আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম আবদুর রহিম খানের প্রিয়তম চরিত্রের নাম শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর দোঁহায় মিশে থেকেছে হরিনাম। আবদুর রহিম খানের অন্যতম নামই ছিল ভক্ত রহিম দাস। কতটা উচ্চমানের সাহিত্য চর্চা করতেন আবদুর রহিম খান? তিনি ‘বাবরনামা’র অনুবাদ করেছেন ফারসিতে। আবার জ্যোতিষবিদ্যার দু’টি গ্রন্থ লিখেছেন ও অনুবাদ করেছেন সংস্কৃত ভাষায়। তাঁর সবথেকে বড় কৃতিত্ব হল, ‘ব্রজভাষা’কে জনপ্রিয় করা। আজও ভক্ত রহিম দাসের ব্রজভাষার দোঁহা উত্তর ভারতে জনপ্রিয়! শাহজাহান নয়। নিজের স্ত্রীর জন্য সমাধি নির্মাণ করে গিয়েছেন সর্বপ্রথম আবদুর রহিম খান।
আবার সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। দিল্লির প্রাণকেন্দ্র নিজামউদ্দিন দরগার পূর্বে অবস্থিত ‘হুমায়ুন টুম্ব’। যা বিশ্বখ্যাত। কিন্তু বিশাল, উজ্জ্বল ও পর্যটকের ভিড়ে আচ্ছন্ন হুমায়ুন টুম্বের অনতিদূরে একাকী, নির্জন ওই যে, ছত্রীধারী লাল পাথরের সমাধিস্থলে শুয়ে আছেন আবদুর রহিম খান!