আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
—কেন?
—অনেকক্ষণ তো এসেছি—
—তা হোক, বোসো না, কেউ তো বাড়ি নেই—
বেশি কথা বা শব্দ, আলো এখন ভালো লাগছে না। বিদিশাকে বলতেই, ও টিউব লাইট নিভিয়ে জিরো পাওয়ারের নীল আলো জ্বালিয়ে দিল। জানলার পর্দা হাওয়ায় উড়ছে। বাইরের রাস্তায় গাড়ির শব্দ। বিদিশা আমার দিকে চেয়ে আছে। কিছুই বলছে না। এগিয়ে ওর একটা হাত ধরতে ইচ্ছে করছে। ধরব কি? কিন্তু হাত বাড়াতেই ও চট করে সরে গেল। মুখে অদ্ভুত শব্দ করল। কী যে করি! এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। জানলাটা দিলে হয়, কিন্তু ও তো জানলা ধরেই দাঁড়িয়ে। আজ বিকেলেই তো ফোন করেছিলাম। ওর দাদা-বউদি বাড়ি নেই শুনে বলেছিলাম,— দেখলে তো ঠিক সময়েই ফোন করেছি—
—কেন?
—জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।
—যাঃ, ওরা যদি এসে পড়ে?
—এলই বা, আমি কি চোর না ডাকাত?
—তা নয়, তবে এ বাড়িতে কেউ তো তোমাকে চেনে না।
—চেনে না, আজ চিনবে। আর তাছাড়া—
—কী, তাছাড়া?
—বাড়িতে তুমি একা, এমন সুযোগ ছাড়া যায় না—
—অসভ্য!
কথাটা হঠাৎ মনে পড়তেই, ওর দিকে চেয়ে হাসলাম। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে, বিদিশা কী যেন বলল। ঠিক বোঝা গেল না। হাওয়ায় দেওয়ালে ক্যালেন্ডারের পাতা নড়ে উঠতেই, এগিয়ে ওর একটা হাত ধরলাম। ঘরের দরজাটা কেঁপে উঠল। পাশের বাড়িতে কে যেন শব্দ করে হাসছে। জানলার বাইরে ঘোলাটে জ্যোৎস্না। ধোঁয়া কিংবা কুয়াশা।
আমার সামনে এখন যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে তার নাম বিদিশা। ওকে আমার ভালোলাগে। অনেক চেষ্টা করেও কথাটা ওকে গুছিয়ে বলতে পারিনি। হয়তো সেও কিছু বলতে চায়, পারে না। অথচ দু’জনেই জানি, ব্যাপারটা কী। মাথার ঠিক উপরেই ফ্যান ঘুরলেও, কেমন যেন গুমোট। রুমাল বের করে মুখ মুছলাম। হাত তিনেক দূরে সোফায় গা এলিয়ে বিদিশা বসে। বিনুনি সামনে চলে এসেছে। খুচরো চুল হাওয়ায় উড়ছে। কী করি এখন? একটু ইতস্তত করে সোফায় গিয়ে বসতেই, ওর হাতের বালা আর আমার হাতের ঘড়িটা ঠুকে গেল। হাতের মধ্যে হাত। দূরে কোথাও ঘড়িতে ঘণ্টার শব্দ। রাত আটটা। শব্দটা মিলিয়ে যেতেই, নীচে রাস্তায় একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল।
বিদিশা জানলার দিকে গেল। নীচের দিকে একটু ঝুঁকে বলল, ওরা আসছে। উঠে দাঁড়ালাম— তাহলে চলি আমি?
—দাদা-বউদির সঙ্গে দেখা করবে না?
—আজ থাক।
মুচকি হাসে বিদিশা— ভীতু কোথাকার!
জুতো পরতে পরতে বললাম— আর একদিন আসা যাবে।
—কিন্তু মশাই, সিঁড়িতে তো দেখা হয়ে যাবে।
—আমাকে তো চেনে না।
বিদিশা আর কিছু বলল না। জানলার দিকে গেল। আমি ততক্ষণে ঘরের বাইরে।
ফ্ল্যাটের সিঁড়ির কয়েক ধাপ নামতেই, বিদিশার দাদা-বউদিকে দেখা গেল। যদিও ওরা আমাকে চেনেন না, কিন্তু ওঁদের সামনে দিয়েই তো নামতে হবে। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু কীভাবে? অগত্যা তিনতলার সিঁড়ি ধরলাম। তিনতলায় দু’দিকেই ফ্ল্যাট। দুটোই বন্ধ। এরপর বোধহয় ছাদের সিঁড়ি। কারণ বাড়িটা তো তিনতলা। ছাদে যাব? কেউ কিছু বলবে না তো? নিঃশব্দে ছাদে উঠলাম। আবছা অন্ধকার। কেউ নেই। আবছা আলোয় ফুলের টব, ভাঙা চেয়ার কিংবা কাগজের টুকরোও চোখে পড়ছে না। কখনও এমন ছিমছাম পরিষ্কার ছাদ দেখিনি। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। একটু দাঁড়ালে হয়। কিন্তু অচেনা একটা বাড়ির ছাদে কতক্ষণ থাকা যায়। এখন সঙ্গে যদি বিদিশা থাকত। কিছু একটা ছুতো করে তো চলে আসতে পারে। কিন্তু আমি এখানে ও জানবে কী করে? কয়েক পা এগিয়ে একটু ঝুঁকে নীচের দিকে চাইলাম। বাড়িটার সামনেই একটা দেবদারু গাছ। নীচেটা সিমেন্ট বাঁধানো। কে যেন বসে পা দোলাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে একটা লরি চলে গেল। পিছনে হঠাৎ খসখস শব্দ। ফিরে চাইলাম। সাদা বিড়াল একটা। বিড়ালটা আমাকে পাত্তাও দিল না। হেলেদুলে ছাদের অন্যদিকে চলে গেল। না, এভাবে আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সিঁড়ির দিকেই পা বাড়ালাম। নীচে নেমে আবার বিদিশার দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দরজা বন্ধ। বেল টিপব? ও নিশ্চয় অবাক হবে। ওর দাদা-বউদি তো কিছুই জানে না। ভাববেন, এই এলাম। অবশ্য ওঁদের সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে। প্রথম আলাপে আমার সম্পর্কে ওদের কী প্রতিক্রিয়া হয়, দেখাই যাক না। হাত বাড়িয়ে কলিং বেল টিপলাম। কোনও সাড়া নেই। আবার টিপলাম। এবার দরজা খোলার শব্দ। সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।
‘কাকে চাই?’ বিদিশার দাদা বোধহয়।
‘বিদিশা আছে?’
‘আপনি?’ ভদ্রলোক আপাদমস্তক আমাকে দেখছেন।
‘আমি বিদিশার বন্ধু।’ কী করে যে কথাটা বলে ফেললাম, জানি না। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি শুধুই বন্ধুত্বের?
ভদ্রলোক দরজাটা পুরোপুরি খুলে দিলেন।— আসুন, ভেতরে আসুন। জুতো না খুলেই ভিতরে ঢুকে সোফায় বসলাম। একটু আগে তো এখানেই বসেছিলাম। ফ্যান চালিয়ে ভদ্রলোক বোধহয় বিদিশাকেই ডাকতে গেলেন।
একাই বসে রইলাম। দেওয়ালের ক্যালেন্ডার হাওয়ায় দুলছে। জানলার পর্দা উড়ছে। ঠিক আগের মতোই। বিদিশার বউদি এলেন। হাসি হাসি মুখ।— আমি কিন্তু ভাই সব জানি— বিদিশা বলেছে। —প্রায় আঁতকে উঠলাম। একটু আগে যে এখানে ছিলাম, বিদিশা কি বলে দিয়েছে? আচ্ছা মেয়ে, যাই হোক। অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে বউদি একটু মুচকি হেসে বললেন— বসুন আপনি, বিদিশাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
চুপচাপ বসে রইলাম। টিভিটা বন্ধ। ফ্যানের হাওয়ায় একটু যেন শীত শীত করছে। কতক্ষণ বসে থাকব? পায়ের শব্দে মুখ তুলে চাইলাম। বিদিশা সামনেই দাঁড়িয়ে। একটু যেন গম্ভীর। কী ব্যাপার, তুমি হঠাৎ?
—হঠাৎ মানে?
পাশেই সোফায় বসতে বসতে বিদিশা বলল— বলা-কওয়া নেই, এভাবে এলে যে বড়? ওঁরা কী ভাবছেন বল তো?
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। বিদিশার চোখের দিকে চেয়ে বললাম— আমাকে দেখে অবাক হচ্ছো কেন? একটু আগে তো এখানেই ছিলাম— অবাক হয় বিদিশা— বল কী? আমি তো এইমাত্র এলাম— ওঁরাও তো ছিলেন না। উঠে গিয়ে পাশের ঘরে উঁকি দেয় বিদিশা।
ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে— তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই ফ্ল্যাটের চাবি আছে তোমার কাছে?
এবার বিরক্ত হলাম। বলে কী মেয়েটা? এতক্ষণ এখানে ছিলাম। ঘরের টিবি-সোফা-জানলার পর্দা, ক্যালেন্ডার— এরা সবাই সাক্ষী। ও বলছে, আমি নাকি এই প্রথম এলাম। মজা করছে? চলে গিয়ে আবার ঘুরে আসায় অসন্তুষ্ট হয়েছে? মেয়েরা সত্যিই রহস্যময়ী। বললাম— বিরক্ত করায় ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা-টমা কী বলছ! বোসো, সারাদিন পর ফিরলাম তো, একটু হাত-মুখ ধুয়ে আসি। বলতে বলতে বিদিশা চলে গেল। কিছু বলার সুযোগই হল না। এরকম হল কেন? আমি তো আমার মতোই আছি। এই তো দুটো হাত, পা, চোখে চশমা, পরনে ট্রাউজার, গায়ে জামা। জামার নীচে গেঞ্জি। গেঞ্জির নীচে আমার বুক। বুকের মধ্যে শব্দ। ঘরের সবকিছুই আগের মতো আছে। গোলমালটা কোথায়? তবে কি সত্যিই আসিনি? এতক্ষণ তবে ছিলাম কোথায়? রুমালে চশমার কাচ পরিষ্কার করলাম। দরজার আবার শব্দ। কে এল? আমার কি দরজা খোলা উচিত? বিদিশার দাদা-বউদি কিংবা বিদিশা তো আসছে না। ওরা তো ঘরেই আছে। তাহলে?
আবার শব্দ। এবার পর পর দু’বার। অগত্যা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই হল। আর খুলতেই—
—এ কি! তুমি কোত্থেকে? অবাক হয়ে বিদিশার দিকে চাইলাম। -তুমি-তুমি তো ঘরেই ছিলে, বাইরে গেলে কখন?
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বিদিশা বলল, —কী যা-তা বলছ! আমি তো এই এলাম। —হাতের ব্যাগটা টেবিলে রাখল বিদিশা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল— এভাবে না বলেকয়ে, হুট করে চলে আসার মানে কী? দাদা-বউদির সঙ্গে দেখা হয়েছে?
কী বলি? এমন ধাঁধায় পড়ব জানলে, কে আসত? বিদিশাকে ভালোলাগা বা ভালোবাসা আমার মাথায় থাক। এখান থেকে এখন বেরতে পারলে হয়! বললাম, কী ভেবেছ বল তো?
—কেন? খোঁপা খুলতে খুলতে সোফায় গা এলিয়ে দেয় বিদিশা।
—কত আর জাদু দেখাবে? তুমি কি ভানুমতী? হাসল বিদিশা। যেন কিছুই হয়নি— বোসো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
ভীষণ রাগ হচ্ছে। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। দরজার দিকে এগতে এগতে বললাম— চলি তাহলে? প্রায় লাফিয়ে উঠে বিদিশা পথ আগলে দাঁড়াল— এই, কী হচ্ছে?
—পথ ছাড়। যতটা সম্ভব গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার চোখের দিকে চেয়ে বিদিশা বলল— এলেই যদি চলে যাচ্ছ কেন? দরজা খুলতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম। ও আমার দিকেই চেয়ে। কেন জানি না মনে হল, যদি আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকি তো, আরও একজন বিদিশা এসে হাজির হবে। তখন হয়তো...
দরজা খুলে বাইরে গেলাম। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিতে দিতে শেষবারের মতো পিছন ফিরতেই, দেখি বিদিশা দাঁড়িয়ে। কেমন অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল